হোমপেজ জীবনী ও পরিচিতি স্রষ্টার প্রেমে রাবেয়া বসরী

স্রষ্টার প্রেমে রাবেয়া বসরী

201
Advertisement:
IPL 2024: ফ্রিতেই IPL Live Cricket খেলা দেখুন Full HD তে

স্রষ্টার প্রেমে রাবেয়া বসরী

“কোনো শাস্তির ভয় কিংবা লোভ না থাকলেও আল্লাহর এবাদত করা মানুষের একমাত্র উদ্দেশ্য” হযরত রাবেয়া বসরী (রাঃ) আল্লাহ তায়ালার এবাদতকে ভালোভাবে উপলদ্ধি করেছেন, নিজ আত্মপলব্ধি থেকে। স্রষ্ঠা মানুষকে পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন একমাত্র তিনার এবাদতের জন্য। দোযখের ভয়ে কিংবা বেহেশত পাওয়ার আশায় নয় বরং মানুষকে সৃষ্টিকর্তা তাহার সান্নিধ্য লাভের জন্য এবাদত করার নির্দেশ দিয়েছেন। তাপসী রাবেয়া বসরী (রাঃ) সর্বদা স্রষ্ঠাকে ভালোবেসেছেন তাঁর সন্তুষ্টি লাভের জন্য।

নিজের প্রেমিকরূপে রাবেয়া বসরী আল্লাহ তায়ালাকে ভালোবেসেছেন। তাঁর ধ্যান, চিন্তা, জ্ঞান ও চেতনায় ছিল শুধুই আল্লাহ তায়ালাকে একান্ত নিজের করে পাওয়ার সাধনা। শিশুকাল হতে তিনি অধিকাংশ সময়ই স্রষ্টার প্রার্থনায় ধ্যানে ডুবে থাকতেন। পার্থিব জীবনের নানান রকমের দুঃখ-কষ্টে থেকেও তিনি আল্লাহকে ভুলে যাননি বরং সর্বদা তিনি নিজের একমাত্র সম্বল হিসেবে চিনেছেন।

রাবেয়া বসরী বলতেন, “যেদিন থেকে খোদাকে জেনেছি ও চিনেছি সেইদিন থেকেই লোকের মুখাপেক্ষী হওয়াকে আমার জীবন থেকে ত্যাগ করেছি “। সর্বদা প্রার্থনায় স্রষ্টাকে হাজির রেখে তাঁহার মাঝে ডুবে যেতেন রাবেয়া বসরী। এবং মোনাজাতে তিনি বলতেন, “হে মাবুদ! এই পৃথিবীতে আমার জন্য তুমি যা নির্দিষ্ট করেছো তা তোমার শত্রুকে দান করো। আর পরকালে আমার জন্য যা নির্ধারিত রেখেছ, তা তোমার মিত্রকে দান করো। আমার জন্য শুধু তুমিই থেকো”।

তাপসী রাবেয়া সর্বসময়, সর্ববস্থায় আল্লাহর ইচ্ছার ওপর পুরোপুরি নির্ভর করতেন। রাবেয়া বসরী আল্লাহর এমনই এক আশেক ও প্রেমিক যিনি কিনা তার প্রিয়াকে (আল্লাহকে) দেখেই তাঁর দেয়া আঘাতের কথা ভুলে যেতেন। তাই তো তিনি স্রষ্ঠাকে পাওয়ার আশায় শত বিপদে অটল, স্থির এবং ক্লেশ যাতনায়ও অনড় থেকেছেন। স্রষ্টার প্রতি দৃঢ় প্রেম, ভক্তি ও আনুগত্য বজায় রেখে আল্লাহর প্রার্থনা করে গেছেন।

IPL 2024: ফ্রিতেই IPL Live Cricket খেলা দেখুন Full HD তে

শিশুকাল থেকেই তাপসী রাবেয়া পড়শী ও আত্মীয়দের রুজি হালাল না হারাম বুঝতে না পারলে তাদের দেয়া খাবার গ্রহণ করতেন না। আল্লাহর প্রেম তাকে ক্ষুধার কষ্টও ভুলিয়ে দিতো। এমনকি মনিবের ঘরে দিন-রাত দাসীর কাজ করে যখনই তিনি মুক্তি পেতেন তখনই তিনি নিজের ঘরে মাওলার আরাধনায় ডুবে থাকতেন। কিন্তু এই খোদাপ্রেমিকের প্রার্থনায় কখনও কোনো নিয়মকানুন ছিলনা। রাবেয়া চাইতেন জীবনের প্রতিটি মুহূর্তে প্রভুর প্রেমের সঞ্জীবনী সুধা পান করতে আর সে কারণে সার্বক্ষণিকভাবে প্রভুর এবাদতে কাটিয়ে দিতেন।

আল্লাহর প্রতি রাবেয়ার এরূপ প্রেম সুধা তাঁর সকল দুঃখকে ভুলিয়ে দিতো। তাই তো মনিবের নিষ্ঠুর অত্যাচারেও রাবেয়ার কণ্ঠধ্বনিত হয়েছে- “হে দয়াময় প্রভু! আপানার অসহায় দাসীর ওপর কেন আপনি এতো অসন্তুষ্ট হয়ে আছেন? আপনার একটু জিকির করবো, স্তুতি গাইবো, তার জন্য বেশি সময় পাই না। হয়তো এসব তোমার এই দাসীর কোনো অন্যায়ের ফল, না অন্য কিছু? যদি অন্যায় কিছু করে থাকি, তাহার শাস্তি আরো যদি দিতে হয় দিও। কিন্তু আমার আর্জি তুমি আমার ওপর রাজি ও খুশি থেকো।”

দুনিয়াবী চাহিদার চেয়ে তাপসী রাবেয়া বসরীর কাছে দয়াময় প্রভুর দিদার লাভ করাই ছিল মূল উদ্দেশ্য। প্রার্থনার মাধ্যমে যেন আত্ম অহংকার ও দাম্ভিকতা প্রকাশ না পায় সেদিকে তিনি সর্বদা সতর্ক থাকতেন। কেনোনা তিনি বিশ্বাস করতেন, লোক দেখানো প্রার্থনা মানুষের হৃদয়ের মধ্যে এমন দুঃখের ঝড় তোলে যা আর কখনো দূর হতে চায় না।

রাবেয়া বসরী (রাঃ) আরো বলতেন, “মানুষ কেনো দেহ ও মন নিয়ে ভাবনায় এতো অস্থির হয়! ‘আমিত্ব’ নিয়ে দুশ্চিন্তা করার জন্য আল্লাহ তার বান্দাকে সৃষ্টি করেননি। বান্দাকে সৃষ্টি করা হয়েছে কেবল আল্লাহর এবাদতের জন্য। বান্দার ভালো ও মন্দ দেখার জন্য তো স্বয়ং স্রষ্ঠাই রয়েছেন।”

তিনি আরো বলতেন, “প্রভুকে আমরা কেন দূরে ভাবি! তিনি তো সর্বদা আমাদের মধ্যেই আছেন”। একদিন তাপসী রাবেয়া বসরীর দরবারে বসে সূফীসাধক সালেহ মুগরি (রঃ) বারবার করে বলছিলেন, “যে লোক বারবার আল্লাহর দরবারে ধরনা দিয়ে দরজা খোলার চেষ্টা করে তার জন্য অবশ্যই সেই দরজা খুলে দেয়া হয়।”

কথাটি শুনে রাবেয়া বসরী বলেছিলেন- “আপনি বারবার একই কথা বলছেন! দরজা বন্ধ, কবে দেখলেন? যে তা খোলার কথা উঠছে? বান্দার প্রতি আল্লাহর কৃপাদৃষ্টি কোনোদিনই বন্ধ থাকে না।”

রাবেয়া নিজেকে পুরোপুরি উপেক্ষা করে খোদাপ্রেমে নিমগ্ন থাকতেন। একবার প্রভুর স্মরণে থাকা অবস্থায় তাঁর চোখ দিয়ে অনবরত পানি পড়ছিল। তিনি যখন স্বাভাবিক হলেন তখন উপস্থিত অন্যদের কাছে চোখ দিয়ে কেন পানি পড়ছে তার কারণ জিজ্ঞেস করলে উপস্থিত সকলে বললেন, “আপনি যখন এক খেয়ালে ছিলেন তখন হয়তো আপনার চোখে কিছু ঢুকেছে, আপনি টের পাননি!” রাবেয়া তখন বলেছিলেন- “স্রষ্টার ধ্যান খেয়ালের মধ্যে এদিক-সেদিক খেয়াল করার মতো সময় কোথায়? আমার এবাদত প্রভুর দরবারে কবুল হবে কিনা সেই ভয়ে দিশেহারা হয়ে আমি ব্যাকুল হয়ে থাকি”।

কালক্রমে তাপসী রাবেয়া বসরী তাঁর সময়ের অন্যান্য ওলিদের চেয়েও শ্রেষ্ঠ “আল-আবেদিন বা ইবাদতকারী” ও “আল-বাকায়িন বা ক্রন্দনকারী” হিসেবে আখ্যা পেয়েছেন। রাবেয়া তাঁর প্রেমময় প্রভুর সঙ্গে দিদার লাভের জন্য এতোটাই ব্যাকুল হয়ে থাকতেন যে, তিনি স্রষ্টার ইবাদতে মশগুল হওয়ার আগে উপস্থিত সকলকে বলতেন- “যদি ইবাদতের মধ্যে আমার প্রাণ বের হয়ে যায় তাহলে তোমরা আমাকে কিছুক্ষণের জন্য নাড়াচাড়া করো না। আমি যেন সূ-স্থিরভাবে মওলার সঙ্গে আলাপ করতে পারি।”

রাবেয়া বসরী প্রতি রাতে মোনাজাত করে বলতেন, “হে প্রভু! সারা জগৎ নিদ্রায় কাতর। কিন্তু তোমার রাবেয়া এখনও তোমার দরজায় জেগে আছে। তোমার উপস্থিতি আমার নিদ্রা দূর করেছে। হে প্রভু! আমি শপথ করছি, আমি নিদ্রা দিনেও চাই না, রাতেও চাই না। যতদিন তোমার দিদার থেকে বঞ্চিত হয়ে থাকবো, চোখে নিদ্রা যতই আসুক না কেন নিদ্রার কোলে আমি আশ্রয় নেবো না।”

যদি কখনো অনিচ্ছায় তার দুই চোখের পাতায় ঘুম নেমে আসতো অমনি ভয়ে ঝাকুনি দিয়ে কেঁপে উঠে নিজেকে শাসন করতেন, “হে রাবেয়া! এতো ঘুম কেন তোমার! দীর্ঘ নিদ্রার কথা ভুলে গেছো? শিগগিরই তো তুমি তা লাভ করবে। এমন নিদ্রার কোলে নিজেকে সঁপে দিবে যে, মহাপ্রলয়ের আগে সে তোমাকে ছাড়বে না।”

এভাবে প্রার্থনায় সারারাত কাটিয়ে পূর্ব আকাশের দিকে যখন আলোর রেখা ফুটে উঠতো সেদিকে তাকিয়ে তাপসী রাবেয়া বসরী বলতেন, “ওহে দয়াময় প্রভু! যদি এই লাল দৃপ্তময় উজ্জ্বল সূর্যের মতো আমি সু-সংবাদ পেতাম যে, তুমি আমার প্রার্থনা কবুল করেছো তবেই তো আমার জীবন ধন্য হতো। আমার প্রার্থনা শুনে রাখো, যতোদিন তুমি এই অধম দাসীকে ঐ সু-সংবাদ না দিবে ততদিন আমি তোমার দরজায় এভাবেই পড়ে থাকবো।”

সারারাত প্রার্থনা শেষে ভোর থেকে আবারো নিমগ্ন হতেন প্রভুতে। রাবেয়ার এই প্রার্থনা চলতো সন্ধ্যা পর্যন্ত। খোদাকে পাওয়ার আশায় কঠর সাধনায় তিনি নিজেকে এমনভাবে সপে দিয়েছিলেন যে, নিজের আহার-নিদ্রার কথাও ভুলে যেতেন।

রাবেয়া বসরী যেদিন রাতে ইবাদতে কোনো বাধা-বিপত্তি ছাড়াই পূর্ণ মনোযোগ প্রভুর নিকটে নিজেকে সমর্পণ করতেন, সেদিন কৃতজ্ঞতা প্রকাশের জন্য সিজদারত হয়ে তিনি বলতেন, “‘হে দয়াময় প্রভু! আমাকে সারারাত তোমারই মহিমার গুন-গান করার তৌফিক দান করেছো। সম্বলহীন এই অধম কি দিয়ে তোমার এই ঋণ শোধ করবো।

রাবেয়া বসরী আরো বলেছেন- “কোনো গুনাহগার আল্লহর নিকট তওবা করলে তাকে তওবার তৌফিক তিনি দান করেন। আল্লাহতায়ালা কাউকে তওবা করার ক্ষমতা না দিলে কেউ কখনোই তওবা করতে সক্ষম হয় না। শুধু মৌখিক ক্ষমা প্রার্থনা করা হলো মিথ্যাবাদীর কাজ। আর তওবা অনুতাপ নিয়ে একান্ত নিজে করাই যথেষ্ট, অন্যের সাহায্যে তওবার প্রয়োজন নেই।”

একবার রাবেয়াকে প্রশ্ন করা হয়েছিল, তিনি শয়তানকে ঘৃণা করেন কিনা? তিনি উত্তরে বলেছিলেন, “আমার অন্তর ভরে আছে মাওলার প্রেমে। সেখানে অন্য কারো জন্য ভালোবাসা বা ঘৃণা প্রকাশ করার জায়গাই নেই।”

তাপসী রাবেয়া বসরী আনুমানিক ৯৫ থেকে ৯৯ হিজরির মধ্যে কোনো এক সময় ইরাকের বসরা নগরীতে জন্মগ্রহণ করেন। এবং ১৮৫ হিজরির ৭১৭ খ্রিঃ তিনি জেরুজালেমে ওফাত লাভ করেন।

তাপসী রাবেয়া বসরী সূফী সাধকদের সংসর্গ ও উপদেশকে আল্লাহর সান্নিধ্য লাভের প্রধান ও একমাত্র সোপান মনে করতেন। এজন্যই রাবেয়া সূফী সাধনার পথে আল্লাহর আবেদ, ধর্মীয় ও জীবনের বিভিন্ন সূক্ষ্ম তত্ত্বে সূ-গভীর ভাবে হযরত হাসান বসরীর (রাঃ) এর সঙ্গে তাঁর আধ্যাত্মিক ও রুহানি সম্পর্ক ছিল। এছাড়াও রাবেয়া নিজের সম্পর্কে কোনো অসিয়ত বা কোনো লিখিত উপকরণ রেখে যাননি। তবে সূফী হযরত ফরিদ আল-দ্বীন আত্তার তাঁর জীবনী ও দর্শন নিয়ে প্রচলিত ঘটনাগুলো সংগ্রহ করে লিপিবদ্ধ করেছিলেন।

রাবেয়া বসরী শৈশবকাল  থেকেই দুঃখ-কষ্ট ও অভাবে থেকেই বড় হয়েছেন। জীবনে নানান ঘাত-প্রতিঘাতের সম্মুখীন হতে হয়েছে রাবেয়াকে। বাবা-মায়ের মৃত্যুর শোক, দুর্ভিক্ষ ও তিন বোনের অপহরণের ব্যথা পেয়েছেন। এমনকি অভাবের তাড়নায় একসময় রাবেয়া দাসী হিসেবে বিক্রিও হয়ে যান।

মনিবের ঘরে দাসী হয়ে নিষ্ঠুর অত্যাচার ও লাঞ্চনা সহ্য করতে হয় রাবেয়াকে। প্রতিটি বিপর্যস্ত অবস্থার মধ্যে অসহায় হয়ে রাবেয়া এক দয়াময় প্রভুর কাছেই শুধু আশ্রয় চেয়েছেন। ফলে তিনি পার্থিব যে কোনো ভোগ-বিলাস, চাওয়া-পাওয়া, আকাংখা, বিয়ে-সাদীকে অতি তুচ্ছ করতেন।

তৎকালীন বসরার গভর্নর থেকে শুরু করে অনেকেই পোশাক ও খাবারসহ নানা উপহার নিয়ে তাঁর দরবারে হাজির হতেন। তিনি এসব গ্রহণ না করে ফিরিয়ে দিয়ে বলতেন, “আমি তো আমার দয়াময় প্রভুর ধনে ধনবতী, আমার এসবের কোনো প্রয়োজন নেই। আমার পোশাকের প্রয়োজন হলে প্রেমময় প্রভুই আমাকে তা দান করবেন। আর আমি অন্যের দেয়া কোনো পোশাক পড়লে প্রভু তাতে নারাজ হবেন।”

রাবেয়ার আদর্শ ছিল, আল্লাহ মানুষকে সৃষ্টি করেছেন একমাত্র তাঁর ইবাদতের জন্য। একদিকে পার্থিব সুখ-শান্তি ভোগ এবং অপরদিকে আল্লাহর ইবাদত একসঙ্গে করা কখনই সম্ভব নয়। একটিকে ধরতে গেলে অপরটিকে বর্জন করতে হবে। তাই তাপসী রাবেয়া বসরী মানব জীবনের চরম লক্ষ্য ‘এবাদতকে’ই আঁকড়ে ধরেছিলেন। সার্থক এবাদতের মূল উৎস হচ্ছে স্রষ্টার প্রতি হৃদয়ের কৃতজ্ঞতা প্রকাশ, এ কথা তাপসী রাবেয়া বসরী সুস্পষ্টভাবে নিজ কর্মের মাধ্যমে দেখিয়েছেন।

সূফী সাধনার যে উচ্চ আসনে তাঁর অবস্থান, সেখান থেকে  তিনি বলতে পেরেছেন-

“ওগো প্রেমময়!
তোমার সঙ্গে আমার ভালোবাসা
এ তো শুধু ভালোবাসার জন্য ভালোবাসা,
যা শুধু তোমার তরেই নিবেদিত।
এই প্রেম সুধা তখনই পাই,
যখন তোমাকে প্রাণ ভরে দেখতে দাও,
তোমার আমার মধ্যকার পর্দাটি সরিয়ে দিয়ে।”

নিবেদক- নিশাত ওয়াহিদ

তাপসী রাবেয়া বসরী (রাঃ) এর ১৫টি বাণী।