হোমপেজ ইলমে মারেফত তাসাউফের দৃষ্টিতে সেহেরি ও ইফতার

তাসাউফের দৃষ্টিতে সেহেরি ও ইফতার

713

তাসাউফের দৃষ্টিতে সেহেরি ও ইফতার

সিয়াম সাধনার মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে আত্মপরিচয় অর্জন করা, অথবা আত্মদর্শন লাভ করা, অথবা আপন রবদর্শন অথবা দীদারে এলাহি দর্শন । যে সাধক দীদারে এলাহির দর্শন লাভ করেছেন তিনিই সায়েম। সায়েম পর্যায়ে পৌছাতে একজন সাধককে কতগুলো মার্গ অতিক্রম করে হয় প্রথমে সেহেরি করতে হয়, সেহেরির পর ইফতার করতে হয়, ইফতারের পর কদর হয়, কদরের পর ঈদ হয়, ঈদ হলে একজন সাধক সায়েমে রূপান্তর হয়। অর্থাৎ আত্মজ্ঞানে বৃদ্ধ হন তথা পূর্ণসংযমী হন, দ্বীনপূর্তা লাভ করলো। আল কেতাবের পরিচয় হলো।

সেহেরি

সেহেরি শব্দের অর্থ হলো আত্মবল, আত্মশক্তি অর্জন করা।

আত্মবল, আত্মশক্তি অর্জন কেন করব?

  উত্তর:  ইফতার করার জন্য প্রত্যেকটি মানুষের নফসের মধ্যে প্রবৃত্তি নামক মায়ামূর্তি রয়েছে, আপন নফসের মধ্যে যে ষড়রিপু তথা মায়ামূর্তি রয়েছে তা ভেঙে ফেলার মনোবল তথা আত্মবল তথা আত্মশক্তি নামক মুক্তির জ্ঞান লাভ করাই হলো সেহেরি। শেষ রাতে পেট ভরে খাওয়া নয়, অর্থাৎ এই মুহূর্তে আমি চৈতন্যের সঙ্গ পেলাম। আমার মধ্যে যে কামনা-বাসনা-রসনা নামক প্রবৃত্তির মূর্তিগুলে রয়েছে, যেগুলো আমাকে যে বিভ্রান্তির বেড়াজালে ঘুরপাক খাচ্ছে তার বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়ার সক্ষমতার নামই হলো সেহেরি।

অর্থাৎ আপন ইচ্ছার বিরদ্ধে লাগাম দেওয়ার প্রচেষ্টার নাম হচ্ছে সেহেরি। এই সেহেরি জীবনে একবার করতে হয়, ফি বছর নয়, ফি বছর হয় অনুষ্ঠান পালন, এই অনুষ্ঠান পালন ধর্ম নয়, এবাদত বন্দেগি নয়, এই অনুষ্ঠান হচ্ছে একটি ধোঁকা, একটি ফাঁদ, একটি কন্টক , একটি জঞ্জাল। আপন নফস থেকে প্রবৃত্তি তাড়ানোর প্রায়াসকেই বলা হয় সেহেরি।

ইফতার

ইফতার আরবি শব্দ, এর বাংলা অর্থ হলো আত্মশুদ্ধি। একজন সাধক সেহেরি করে তথা আত্মবল অর্জন করে ইফতার করার জন্য। একজন সাধক কেন ইফতার করবে? একজন সাধক আত্মবলে বলিয়ান হয়ে আপন পবিত্র নফস থেকে খান্নাস নামক শয়তানের ধোকাঁ থেকে বের হওয়াকে ইফতার বলা হয়। অর্থাৎ একজন সাধক যখন আপন নফস থেকে কুপ্রবৃত্তিগুলো নিয়ন্ত্রণ করে ফেললো তখন তার ইফতার হয়ে গেল। যে সাধক আত্মবলে বলিয়ান হয়ে প্রবৃত্তির লাগাম টেনে ধরেছেন তখনই তার আত্মনিয়ন্ত্রণ হয়। হাকিকতে ইফতার করে রমজানে প্রবেশ করতে হয়। সাধকের অন্তরে যখন রমজান প্রবেশ করবে তখনই সাধক দেখতে পায়, শয়তান শৃঙ্খলিত হয়ে গেছে, তাগুত মিটে গেছে, দুনিয়া ফানা হয়ে গেছে, আসমানের দ্বার খোলে গেছে, রহমতের দ্বার খোলে গেছে, জান্নাতের দ্বার খোলে গেছে।

ইফতার মানে হলো মনে প্রানে পবিত্র হওয়া। পবিত্র না হলে কোনো সাধক ধ্যানগমগ্ন হতে পারে না, পবিত্রতাই শক্তি, আর ধ্যানেই মুক্তি। আর ধ্যান না হলে সমাধি হবে না, সাধকের কাশফের দরজা খুলবে না। সুতরাং ধ্যানে ঘরে প্রবেশ করতে হলে নফস থেকে খান্নাস নামক শয়তানকে তাড়িয়ে দিতে হবে। যেই মাত্র অন্তর থেকে সাধক খান্নাস তাড়িয়ে দিলো সেইমাত্র তার ইফতার হলো। তাই মহামবি (স.) তাঁর ভক্তদের বলেছেন ” তোমাদের মধ্যে সেই ব্যাক্তিই উত্তম সে তাড়াতাড়ি ইফতার করে।”

এই ইফতার আনুষ্ঠানিক গুধূলিলগ্নের খেজুর, আর মুড়িভর্তা খাওয়া নয়। এই ইফতার করতে হবে কদর প্রাপ্তির জন্য। এই ইফতার জীবনে একবার করতে হবে, আর ফি বছর হয় অনুষ্ঠান। আবার এই আনুষ্ঠানিকতার আধিক্য আধ্যাত্বজীবনে মৃত্যু ডেকে আনে, আনুষ্ঠানিকতার মধ্যে প্রভু থাকে না, প্রভু থাকে প্রেমের মধ্যে। আনুষ্ঠানিক জ্ঞান বুদ্ধি যত সুন্দরই হোক না কেন, তার মধ্যে অহংকার লুকিয়ে থাকে।

অহংমুক্ত জীবন তথা আমিত্বমুক্ত জীবন তথা নিষ্কাম কর্মযোগই মূলত ইফতারকৃত জীবন। এই ইফতার করলে একজন সাধক রমজানে প্রবেশ করে। হাকিকতে সাওম ভঙ্গ করা হারাম। আনুষ্ঠানিক রমজান মাসে উপবাস থেকে সাঝের বেলায় সাওম ভঙ্গ করতে হয়, আর হাকিকতে ইফতার করে রমজানে প্রবেশ করতে হয়, কারণ, সিয়াম সাধনা আল্লাহর মারফত দিয়ে শুরু, আর দীদারে এলাহির মাধ্যমে মুক্তি।

লেখা: আর.এফ রাসেল আহমেদ