কোরানিক দর্শন আলোকে সালাত সম্পর্কিত প্রবন্ধ:
সালাত: আপন আপন রবের সহিত স্মরণের মারফত সংযোগ স্থাপন প্রচেষ্টাকে সালাত বলা হয়। কোরানিক দর্শনে সালাতের মূল্য অসীম। সালাতের উপর দাঁড়াতে না পারিলে, কোরান এবং কেতাবের রহস্য মাথার জ্ঞান দ্বরা বুঝবার কোনো উপায় নাই। জ্ঞান সাধনা দ্বারা অর্জিত হয়। সাধনা ব্যতীত আত্মিক জ্ঞান অর্জন করিবার কোনো বিশেষ পন্থা নাই। যাহার জীবনের উপর সালাত ক্রিয়ার আঘাত আসে নাই। তাহার মানব জীবন কন্টকময়। সালাত বিহীন ব্যক্তিকে কাফের, মুর্শিক ও মুর্তাদ বলিয়াও কোরান তকমা দিয়েছে। একমাত্র সালাতি তথা মুসল্লিই পারিবে শিরক হইতে মুক্তি নিতে। সালাতে শিরক নাই, আর শেরেকে সালাতের অবস্থান নাই। ঈমান এবং কুফরের মধ্যে প্রভেদ নির্ণয় করিয়া থাকে সালাত। সালাত প্রক্রিয়া না আসিলে ঈমান পরিপূর্ণতা পায় না তথা বা-ঈমান অর্জিত হয় না।
ঈমানের পূর্ণতাদানের অমর্ঘ অস্ত্র হিসাবে সালাত কার্য করিয়া থাকে। তাই কোরানিক দর্শন জানান দিচ্ছে “ওয়াবুদু রাব্বুকা হাত্তা ইয়াতিকাল ইয়াকীন” (১৫ঃ৯৯)। অর্থাৎ “ইয়াকীন তথা ঈমান অর্জিত হওয়া পর্যন্ত তোমার রবের(প্রভু)ইবাদত কর।” ইবাদত করতে হবে দর্শনের ঈমান অর্জনের পূর্বমূহুর্ত পর্যন্ত। যাহার জীবনে দর্শনের ঈমান অর্জিত হইয়াছে তিনি বা -ঈমান তথা মুমিন। এই মুমিনের সহিত আল্লাহ রব তথা জাতরূপে অবস্থান করিয়া থাকে। মুমিন তাহার সালাতকে হেফাজত করিয়া থাকে। মুমিন তাহার সালাতের উপর দন্ডায়মান। মুমিন তার নিজের প্রতি সন্তুষ্ট এবং রবও তাহার প্রতি সন্তুষ্ট। মুমিন জন্নাতি। মুমিন প্রশান্তচিত্তের অধীকারি এবং মুমিন সফলকাম।
সালাত কুফর এবং শিরিকের ভিত্তি কাপিয়ে তুলে। সালাতের সমপর্ক সবরের সহিত। সবরের মাধ্যমেই সালাতের সমক্য পরিচয় পাওয়া যাইবে। আত্মজ্ঞান সবরের উপর নির্ভরশীল। জ্ঞান সালাতিকে বিনম্র করিয়া তুলে। অসার তথা ফায়েশা ক্রিয়াকলাপ হইতে বিরত রাখে। সালাতিকে জাকাতদানে সক্রিয় করিয়া তুলে। অপরের অধিকার সমপর্কে সচেতন করিয়া তুলে। এবং নিজ কর্তব্য সমপর্কে যত্নবান করিয়া তুলে। সালাতবিহীন জীবন আপন কামনা বাসনার উপর প্রতিষ্ঠিত জীবন। (কোরান)।
সালাত বিহীন জীবন আপন খেয়াল খুশির উপর প্রতিষ্টিত জীবন। কামনা -বাসনা খেয়াল- খুশি উপর প্রতিষ্ঠিত জীবন। কামনা -বাসনা, খেয়াল -খুশি এইগুলি শির্কের জীবন্ত প্রতিমূর্তি। সালাতহীন ব্যক্তি তাগুত তথা মূর্তিপূজারী। সালাতবিহীন ব্যক্তিসত্তা খান্নাসের ক্রীতদাস। সালাত ব্যতীত আল্লাহর দ্বীনে প্রবেশ করিবার অন্য কোনো উপায় নাই। ইসলামের আগমন হইয়াছে দাসপ্রথার মূলোৎপাটন করিবার নিমিত্তে। যাহাতে মানুষ খান্নাস তথা আপন খেয়াল খুশির দাসত্ব না করে। ইসলামে প্রবেশ করতে হইলে আপন আপন রবের দাসত্ব করিতে হইবে।
একমাত্র সালাতই পারিবে দাসপ্রথা নির্মল করিতে। সালাত ব্যতীত ব্যক্তিসত্তার উপর ইসলাম কায়েম অসম্ভব। সালাতই পারে মুসল্লির পূর্বজম্মের কর্মফল তকদীর বদলাতে। সালাতই পারে মুসল্লিকে কবরের আযাব হইতে মুক্তি দিতে। সালাতই পারিবে নরকের ধ্রুমবিহীন অগ্নি হইতে মুসুল্লিকে মুক্তি দিতে। সালাতই পারিবে খন্ড কাল হইতে অখন্ড মহাকালে সাধক বা মুসল্লিকে অধিষ্ঠিত করিতে। যাহার জীবনের উপর সালাত নাই তাহার মানবজীবনের কোনো মূল্য নাই। তাহার কর্ম কলুর বলদের ন্যায়। সালাত যাহার জীবনের উপর রহিয়াছে তাহার মানবজীবন সার্থক, সফলকাম ও স্থিতিশীল।
কোরানিক দর্শনে ৮২ বার সালাত উল্লিখিত রহিয়াছে। মেজাজি কোরানের সুরাসমূহকে মাক্কিও মাদানী দুইভাগে বিভক্ত করা হইয়াছে। সালাতের ৮২ টি আয়াতের মধ্যে ৩৯ টি আয়াত মাক্কি সুরার অন্তর্ভুক্ত। আর অবশিষ্ট ৪৩টি আয়াত মাদানী সুরার অন্তর্ভুক্ত। মহানবী সা: নবুওয়াত প্রকাশ করিয়াছেন ৪০বছর বয়সে, জাবালুল নুর পরবত হেরার গুহায় ৬১০ খ্রি:। মহানবী সা: মক্কা ত্যাগ করিয়া মদিনায় হিজরত করেন ৬২২ খ্রিঃ। মহানবী সালাতের আনুষ্ঠানিক বিধান বা মডেল চালু করেন ২৭ শে রজব মেরাজ পরবর্তী সময়ে। মহানবী মেরাজ করেন ৬২০ সালে। প্রচলিত যে ওয়াক্তিয়া সালাত চালু রহিয়াছে তা মহানবীর মেরাজ পরবর্তী সময় থেকে। তাহার পূর্বে কোনো ওয়াক্তি সালাত ছিল না। কোরান মহানবী প্রকাশ করেন ২৩ বছরের মধ্যে। ১২ বৎসর মক্কায় এবং ১১ বৎসর মদিনায় মহানবী কোরান প্রকাশ করিয়াছেন।
ইসলামের ইতিহাসের নিকট আমাদের প্রশ্ন? আমরা ইসলামের ইতিহাসের কাছ থেকে জানতে চাই যে, আনুষ্ঠানিক বা শরিয়াতি সালাতের বিধানের পূর্বে মহানবী মক্কায় থাকাকালীন সময়ে কিভাবে সালাত প্রক্রিয়া শিক্ষা দিতেন এবং সাহাবীগণ কিভাবে সালাতের কার্যকম পালন করিতেন? কোরানিক দর্শন আলোকে আমরা জানিতে পারি যে, পূর্ববর্তী নবী ও রসুলগণের উম্মতের উপরও সালাত ক্রিয়া ফরজে আইন ছিল। পূর্ববর্তী নবী ও রাসুলগণ তাদের উম্মতদের কিভাবে সালাত প্রক্রিয়া শিক্ষা দিয়েছেন তা পর্যবেক্ষণ বিষয়? কেননা পূর্ববর্তী নবী ও রসুলগণের অনুসারীদের আল্লাহ যে কেতাব দান করিয়াছেন তাহাতেও আপন আপন রবের পরিচয় পাওয়া পূর্নাঙ্গ।
জীবন দর্শন ছিল, কোরানপাক জানান দিচ্ছে- “আল্লাহ যাহা নবীর জন্য বিধিসম্মত করিয়াছেন তাহা করিতে তাহার জন্য কোনো বাধা নাই। পূর্বে যেসব নবী অতীত হইয়া গিয়াছে তাহাদের ক্ষেত্রেও ইহাই (কেতাব) ছিল আল্লাহর বিধান। (৩৩ঃ৩৮)”
কোরানিক দর্শন আলোকে জানিতে পারলাম পূর্ববর্তী সকল নবী এবং রাসুগনের উম্মতের উপর সালাত ফরজ ছিল। এবং মহানবীর উম্মতের বেলাতেও ব্যআমরাতীক্রম নাই। এবং মহানবীর পরবর্তী রসুলগণের অনুসারীদের উপরও সালাত একইভাবে ফরজ। (মহামবী শেষনবী, কোরানে খাতামুন রসুল নাই) আল্লাহর কেতাব একটিই এবং আল্লাহর বিধান সুনির্ধারিত। কিন্তু সালাতের প্রায়োগিক বিধান ভিন্ন ভিন্ন। কারণ কোরান মূল নীতি ও দর্শন প্রকাশ করিয়া থাকে। প্রয়োগপদ্ধির ধারার ক্রমপরিবর্তনশীল। যুগের আবর্তনের দেশ কাল পরিবেশভেদে সালাতের আনুষ্ঠানিক ধারার পরিবর্তন হয়। কিন্তু দর্শনের পরিবর্তন নাই। অবশ্যই মহানবীর উওর রসুলগণও যুগের চাহিদা অনুযায়ী সালাতের আনুষ্ঠানিক মডেল প্রদান কিয়াছেন এবং করিবেন।
ইহা চলমান প্রক্রিয়া। তবে ইহা সত্য যে, প্রত্যেক রসুলগণ যুগের চাহিদা অনুযয়ী সালাতের প্রতিবিধান প্রদান করিবেন। ইহাই চীরন্তন প্রক্রিয়া। তাই কোরানিক দর্শন জানান দিচ্ছে যে- “এই কোরান মানব জাতীর জন্য সুস্পষ্ট দলিল এবং নিশ্চিত বিশ্বাসী সমপ্রদায়ের জন্য পথনির্দেশ ও রহমত।”(৪৫:২০)। “আকাশে ও পৃথিবীতে এমন কোনো গোপন রহস্য নাই, যা সুস্পষ্ট কিতাবে নাই” (সুরা নমল ৭৫) “এবং সকল বিষয় (তাহা)আমরা (বহুবচন) সংরক্ষণ করিয়া রাখিয়াছি ইমামের মধ্যে (যিনি) প্রকাশ্য। (৩৬ঃ১২).
কোরানিক দর্শনের আলোকে সালাতের প্রভেদ:
- কায়েমি সালাত।
- দায়েমি সালাত।
- হেফাজতে সালাত।
- মধ্যবর্তী সালাত।
- দ্বান্বিক সালাত।
- যিকরে সালাত।
- দাসি সালাত।
এই সালাতের প্রকারভেদ কোরানিক দর্শনে পেলাম।
- এযাজি সালাত
- মেজাজি সালাত (ওয়াক্তিয়া সালাত)
- হাকিকি সালাত (উপরে বর্নিত ৭ প্রকার সালাত)
- কায়েমি সালাত > আকিমুস সালাত (সালাত প্রতিষ্ঠিত করা)
- দায়েমি সালাত > দায়েমুন সালাত (সার্বক্ষণিক সালাত)
- হেফাজতে সালাত >হা ফিজু সালাত (সালাত সংরক্ষণ করা)
- মধ্যবর্তী সালাত > সালাতুত উসতা(যৌবনের সালাত)
- দ্বান্দ্বিক সালাত > (না গোপনে না প্রকাশ্যে সালাত)
- উদাসি সালাত > অমনোযোগী সালাত।
- যিকির সালাত (স্মরণ সালাত)
- এযাজি সালাত (তাহাজ্জুত বা সাধন প্রচেষ্টা)
- মেজাজি সালাত (আনুষ্ঠানিক বা মাহজাবগত এফ রাসালাত)
- হাকিকি সালাত (কোরানিক দর্শনে বর্নিত সালাত)
তাছাড়া রয়েছে সালাতুদ করোনা। অতএব এ প্রবন্ধে কোরানিক দর্শন আলোকে সালাতের স্বরূপটি কেমন তা দেখাতে চেয়েছি। কেউ যেন মনে না করেন যে, অধম লিখক পাঁচ ওয়াক্ত সালাত বিরোধী। সালাত সর্বজনীন প্রক্রিয়া। সালাত ঈমানের পরিচয়। আনুষ্ঠানিকার মধ্যে সত্য নাই। যদিও সত্য থাকিয়া থাকে তাহলে অনু পরিমান সত্যে উপস্থিত রহিয়াছে। আর সত্যের মধ্যে অনুষ্ঠান নাই। মূর্ত না থাকিলে বিমূর্ত বুঝা যায় না।
সালাতের সম্পর্ক দেহ ও মনের সহিত। সালাতের অবস্থান মানসত্তার অন্তরলোকে। নিরপেক্ষতা, ধৈর্যশীলতা, ইতিবাচক মূল্যবোধ যার আচারনের ভূষণ তিনিই সালাতের উপযুক্ত। সুতরাং জানার উপর মানা নির্ভরশীল। জানলেই মানা যায়, না জানিলে মানব কেমন করে। যাহারা জ্ঞানগবেষনার পথে দেয়াল দার করায় তারা আর যাহোক সভ্য নয়, জংলী মানুষ ,সমাজের দুষ্টক্ষত।
– আর এফ রাসেল আহমেদ
– ১৩/০৩/২০২১