ইমাম জাফর সাদিক (আ:) এর নূরানী জীবন ও কর্ম
লেখক- মুহাম্মদ নাসেরউদ্দিন আব্বাসী
বিলায়েতের সূর্য প্রভা, শ্বাশ্বত আত্মার বার্তাবাহক, আউলিয়াকূল শিরোমণি, মিল্লাতের ষষ্ঠ শাহী ইমাম, ইসলামের অনন্য নক্ষত্র, নবুয়তের জ্ঞানভান্ডারের উত্তাধিকার, হজরত রাসূলুল্লাহ সা.-এর আদর্শের ধারক বাহক ইমাম জাফর আস -সাদিক (আ:)।
জন্ম: ৭০২ সালের ২৩ এপ্রিল (৮৩ হিজরির ১৭ রবিউল আউয়াল) সৌদি আরবের মদিনা নগরীতে জন্মগ্ৰহণ করেন।কুনিয়াত-আবদুল্লাহ,উপাধি-আস -সাদিক, আল-তাহির।
পিতা-মাতা: পিতা ইমাম মুহাম্মদ আল-বাকের রাহ.। মাতা ফারওয়া বিনতে কাসেম রাহ.।
শিক্ষা: পিতা এবং পিতামহের নিকট থেকে ইসলামের সকল শিক্ষা অর্জন করেন।ধর্মের নিবিড় গূঢ় রহস্য সম্বন্ধে সম্পূর্ণ তিনি জ্ঞাত ছিলেন। তিনি বলতেন,”আমার কথা আমার পিতা ইমাম বাকের -এর কথা, তাঁর কথা আমার দাদা ইমাম জয়নুল আবেদিন -এর কথা, আমার দাদার কথা ইমাম হোসাইন (আ:) -এর কথা, ইমাম হোসাইন (আ:)-এর কথা হজরত আলী (আ:)-এর কথা,আর মাওলার কথা হজরত রাসূলুল্লাহ সা.-এর কথা, এবং রাসূল সা.-এর কথা মানেই মহান আল্লাহর কথা।”
তিনি আরো বলতেন, “আমাদের কথা রাসূলুল্লাহ সা.-এর আহলে-বায়েত -এর কাছে রয়েছে অতীত, ভবিয্যতের জ্ঞান,আর অন্তরে সঞ্চারিত খোদায়ী জ্ঞান তথা ইলহাম”।
তাঁর সময়কালে মুসলিম জাহানে ধর্মীয় জ্ঞানে সবচেয়ে প্রাজ্ঞ ছিলেন তিনি। ধর্ম, কুরআন, হাদিস, ফিকাহ, আকাইদ, মানতিক, -সহ আধ্যাত্মিকবাদের সকল শাখায় ছিল তাঁর পূর্ণ দখল। তিনি অনেক বিখ্যাত পন্ডিতকে ধর্ম জ্ঞান শিখিয়েছেন। তিনি ছিলেন দিগন্ত প্রসারী চিন্তাশক্তি, দূরদর্শীসম্পন্ন সীমাহীন জ্ঞানের অধিকারী।

শাসক শ্রেণী: তিনি উমাইয়া ও আব্বাসীয়া উভয় শাসক গোষ্ঠীর শাসনকাল দেখেছেন। উমাইয়া শাসকগণ-(১) হিশাম ইবনে আবদুল মালেক (১০৫-১২৫ হি.), (২) ওয়ালিদ ইবনে ইয়াজিদ বিন আবদুল মালেক (১২৫-১২৬ হি.), (৩) ইয়াজিদ ইবনে ওয়ালিদ (১২৬ হি.), (৪) ইবরাহিম ইবনে ওয়ালিদ বিন আবদুল মালেক (১২৫হি.), (৫) মারওয়ান ইবনে মুহাম্মদ (১২৬-১৩২হি.)।
আব্বাসীয়া শাসকগণ: (১) আবদুল্লাহ ইবনে মুহাম্মদ ওরফে সাফফাহ (১৩২-১৩৭ হি.), (২) আবু জাফর ওরফে মনসুর দাওয়ানেকী (১৩৭-১৫৮ হি.)।
নবীপ্রেমিক: ইমামের সামনে হজরত রাসূলুল্লাহ সা.-এর নাম উচ্চারিত হলে তাঁর চেহারার রঙ পাল্টে যেত।হজ্জের মরসুমে ইহরাম বাধার পর ইমাম আল্লাহর ভয়ে এতটা ভীত -সন্ত্রস্ত হয়ে পড়তেন যে, লাব্বাইক আল্লাহুমা লাব্বাইক শীর্ষক আলবিয়া উচ্চারণকে ঔদ্বাত্য বলে মনে করতেন।
শাহী ইমাম: তিনি মুসলিম জাহানের ষষ্ঠ শাহী ইমাম। তাঁর সময়কাল ৭৩৩-৭৬৫ খ্রি.। উমাইয়া এবং আব্বাসীয়া শাসকগণ তাঁর ভয়ে কম্পিত থাকতেন।
গ্ৰন্থাবলী: তাফসির আল ইমাম আস সাদিক, তাওহিদ আল মুফাদ্দাল,মিসবাহ আল শরিয়া,মিফতাহ আল হাকিকাহ, তাকসিম আল বোয়া প্রভৃতি।
কুরআন ও ইমাম সম্পর্কে অভিমত: মানুষের জন্য প্রয়োজনীয় সব কিছুই রয়েছে পবিত্র কুরআনে। আল্লাহ এমনটি করেছেন এই কারণে যাতে কেউ বলতে না পারে যে অমুক জরুরি বিষয়টি কুরআনে থাকলে ভালো হতো। এই মহান ইমামের মতে, দুইজন মানুষের মধ্যে মতভেদ হতে পারে এমন সব বিষয়ের সমাধানও রয়েছে এই কুরআনে, কিন্তু মানুষের বুদ্ধি সেখান পর্যন্ত পৌঁছায় না। (উসুলে কাফি,১ম খন্ড)
জনৈক ব্যক্তি ইমাম জাফর সাদিক (আ:)-কে প্রশ্ন করেন যে, সূরা নিসার ৫৯ নম্বর আয়াতে আল্লাহ, রাসূল এবং উলিল আমরে -এর আনুগত্যের যে কথা বলা হয়েছে,এর অর্থ কী? উত্তরে ইমাম সাহেব বলেছেন, “এখানে উলিল আমর বলতে আল্লাহ আমাদের তথা আহলে বায়েতকে বুঝিয়েছেন এবং কিয়ামত পর্যন্ত আমাদের আনুগত্য করার নির্দেশ দিয়েছেন”.। তাফসির অনুযায়ী, সূরা নিসার ৫৯ নম্বর আয়াতে উলুল আমর বলতে আলী এবং হাসান ও হোসাইন কে বোঝানো হয়েছে।
পত্নী: ফাতেমা বিনতে হোসাইন, হামিদা আল বারবারিয়া।
সন্তান: পুত্র-মুসা আল কাজিম,ইসমাইল ইবনে জাফর, আবদুল্লাহ আল আফতা ইসহাক,আল আব্বাস। কন্যা- ফাতেমা,উম্মে ফারওয়া,আসমা।

শাহাদতের পটভূমি: ইমাম জাফর সাদিক (আ:) তাঁর জীবদ্দশায় বনী উমাইয়া এবং বনী আব্বাসীয়ার সাত খলিফার অত্যাচারকে সহ্য করেন। শায়খ সাদুক আবু বাসির থেকে বর্ণনা করেছেন যে, তিনি বলেন, আমি ইমামের স্ত্রী হামিদার কাছে তাঁকে সান্ত্বনা প্রদানের জন্য উপস্থিত হই। তিনি আমাকে বলেন, হে আবু মুহাম্মদ! যদি তুমি ইমাম -কে ওফাতকালীন সময়ে দেখতে তাহলে তুমি বুঝতে যে তাঁর কিরূপ অবস্থা হয়েছিল।
একবার তিনি চোখ মেলে বলেন, “আমার সকল আত্মীয় স্বজনকে আমার কাছে আসতে বলো”। সুতরাং আমি তাঁর সকল আত্মীয় স্বজনকে একত্রিত করি। অতঃপর তিনি সকলের দিকে একবার দৃষ্টি ফিরিয়ে বলেন, “যারা নামাজকে গুরুত্ব সহকারে আদায় করবে না, আমি তাঁদেরকে সাফাআত করবো না”।
আব্বাসীয়া খলিফা মনসুর দাওয়ানেকী ইমাম জাফর সাদিক (আ:)-কে হত্যা করার জন্য মদিনা থেকে ইরাকে পাঁচ বার জোরপূর্বক তলব করে, কিন্তু বিভিন্ন কারণে আর তাঁকে হত্যা করতে পারেনি। অবশেষে খলিফা মনসুর দাওয়ানেকী মদিনার গর্ভণরকে নির্দেশ দান করে যে, সে যেন ইমামকে বিষ প্রয়োগ করে হত্যা করে, আর সেই হেতু গভর্ণর ইমাম জাফর সাদিক (আ:)-কে বিষাক্ত আঙুর খাওয়ায়, যার কারণে তিনি শাহাদতবরণ করেন। সময়টি ছিল- ৭৬৫ সালের ১৪ ডিসেম্বর (১৪৮ হিজরির ২৫ শাওয়াল )।
মাজার: মাসউদি বলেন যে, তাঁর শাহাদতের পর তাকে তাঁর পূর্বপুরুষদের কবরের পাশে জান্নাতুল বাকীতে দাফন করা হয়।

ইমাম জাফর সাদিক (আ:) এর ১০টি বাণী:
(১) একজন মুসলমানের জন্য এটা কখনও উচিত নয় যে, সে কোনো নাফারমান তথা খোদাদ্রোহী, নির্বোধ ও মিথ্যাবাদীর সঙ্গে বন্ধুত্ব করবে। (কিতাবুল ঈমান ওয়াল কুফর, চতুর্থ খন্ড)
(২) ক্রোধ পরিহার কর, কেননা এটা তোমার জন্য তিরস্কার নিয়ে আনবে।
(৩) সত্যকথা বলার প্রতি সুদৃঢ় ভাবে অনুগত থেকো, আর ন্যায়পরায়ণ ও পাপী, উভয়ের কাছে তাঁদের আমানত পৌঁছে দেবে। কেননা, ওরাই হচ্ছে রিজিকের চাবি। (সাফিনাতুল বিহার, ১ম খন্ড)
(৪) দয়া ও নম্র ব্যবহার জমিনকে অধিক ফলনশীল করে এবং মানুষের আয়ু বৃদ্ধি করে। (ওয়াসাইলুশশীয়া, ২য় খন্ড)
(৫) মুনাফিকের তিনটি চিহ্ন থাকে,তাঁর অন্তরে যা থাকে মুখে তাঁর বিপরীত বলে।তার অন্তরে তাঁর আচরণের বিরোধী, চেহারা তার অভ্যন্তরীণ বিশ্বাসের বিরোধী। (বিহারুল আনোয়ার, ১৫৩ খন্ড)
(৬) হীনতা নিচতা অবলম্বনের পরিণতি ব্যতীত একটা লোকও বিপদগামী হয় না। (উসুল আলক্বাদী)
(৭) পাঁচ শ্রেণীর লোকের সাথে সম্পর্ক রাখবে না,-মিথ্যাবাদী,কৃপণ,দয়াহীন ব্যক্তি,কাপুরুষ,ফাসিক।
(৮) বংশ দিয়ে কোনো কিছু হয় না।আমল বা সাধনা দরকার।আমলেই মানুষের মুক্তি আনে।
(৯) মানুষের মুখের একটা দিক হল, তাঁর অমায়িক ব্যবহার।
(১০) ক্রোধ জ্ঞানী লোকের আত্মার পরিপূর্ণ ধ্বংসকারী। যে তার ক্রোধকে দমন করতে অক্ষম, সে তার মনকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। (উসুল আলক্বাফী)
- কৃতজ্ঞতা স্বীকার -মুজাদ্দিদে আলফেসানী হয়ে সালমানিয়া সিলসিলা।
- লেখক -মুহাম্মদ নাসেরউদ্দিন আব্বাসী
- প্রপৌত্র পীর গোলাম সালমানী আব্বাসী ফুরফুরাবী (আ:)