হোমপেজ ইলমে মারেফত হকিকতে রোজা ও ইফতার

হকিকতে রোজা ও ইফতার

863

হকিকতে রোজা ও ইফতার

রোজা কথাটি যদিও বাংলায় চালু, কিন্তু ইহা ফারসি ভাষা হতে এসেছে। উর্দুতেও রোজাই বলা হয়। কিন্তু আরবিতে ইহাকে সিয়াম বলে। যে ব্যক্তি সিয়াম পালন করে তাকে বলে সায়েম। এখন প্রশ্নটি হলো, সিয়াম বলতে কী বোঝায়? সিয়াম অর্থ হলো, প্রত্যাখ্যান, বর্জন, ত্যাগ, বিরত থাকা। ইংরেজিতে রিজেকশন বলা যেতে পারে। সুতরাং যে ব্যক্তি এই প্রত্যাখ্যান, বর্জন, ত্যাগ এবং বিরত থাকার প্রচেষ্টায় লিপ্ত তাকে সায়েম বলে তথা রোজাদার বলে। এখন কথাটি হলো যে, সায়েম তথা রোজাদার কোন বিষয়টি হতে বিরত থাকবে? এবং কী তাকে প্রত্যাখ্যান করতে হবে? প্রত্যাখ্যান করার অথবা বর্জন করার একমাত্র বিষয়টি হল আমিত্ব।

আমিত্ব বলতে কী বোঝায়? যে ‘আমি’-টি নির্ভেজাল নয়, বরং ভেজাল আছে সেই ভেজাল ‘আমি’-টিকে বলা হয় আমিত্ব। ‘আমি’-টি কখন ভেজালে পরিণত হয়? যখন ‘আমি’-র সঙ্গে খান্নাসরূপী শয়তানটি বহাল তবিয়তে বাস করে এক ‘আমি’-কে দুই ‘আমি’-তে পরিণত করে। এক ‘আমি’-র মাঝে দুই ‘আমি’ থাকাটাকেই ভেজাল বলে। এই দুই ‘আমি’-র ভেজাল হতে পরিত্রাণ পাবার জন্য, মুক্তিলাভ করার আশায় যে ‘আমি’-টি নকল ‘আমি’-টিকে বর্জন করার প্রচেষ্টায় লিপ্ত তাকেই রোজাদার বলা হয়। আরবিতে তাকে বলা হয় সায়েম। ইহাই রোজার তথা সিয়ামের মূল উদ্দেশ্য। মূল উদ্দেশ্যটিকে সামনে রেখে যে ব্যবস্থাপত্রটি দেওয়া হয় সেই ব্যবস্থাপত্রটিতে নানা প্রকার আদেশ উপদেশ থাকে। কারণ যে কোনো মূল বিষয়টিকে প্রয়োগ করতে গেলে ব্যবস্থাপত্রে অনেক রকম আদেশ উপদেশ থাকতে বাধ্য।

মনে রাখতে হবে যে, ব্যবস্থাপত্রের আদেশ নিষেধগুলোর পেছনে যে মূল উদ্দেশ্যটি আছে উহা যেন ভুলে না যাই। মূল উদ্দেশ্যটি ভুলে গেলেই অথবা গুরুত্ব না দিলেই বিষয়টি কেবলমাত্র আনুষ্ঠানিকতার বলয়ে আবদ্ধ হয়ে পড়ে এবং অনুষ্ঠানগুলোকেই মূল বিষয় মনে করে মতভেদের উদ্ভব হয়। এই মতভেদ জন্ম দেয় নানা প্রকার ফেরকাবাজির। তখন সমাজ জীবন এবং জীবন পরিচালনার দর্শনগুলো ফেরকাবাজিতে ডুবে যায় এবং বাকবিতণ্ডা ও ঝগড়াঝাঁটি করে মূল বিষয়টি হতে অনিচ্ছায় বহু দূরে সরে পড়ি।

অধম লিখক যেমন বললাম যে, নফসের ভেতর খান্নাসরূপী শয়তানটিকে তাড়িয়ে দেবার সাধনার নামটি হল সিয়াম, কিন্তু অন্য গবেষণা হয়তো একথাটি এভাবে না বলে অন্যভাবে বলবে। বলবে দুনিয়া ত্যাগ করতে হবে। বলবে তাগুত ত্যাগ করতে হবে। এখন প্রশ্ন হলো, দুনিয়া বলতে কী বুঝায়? দুনিয়া বলতে কিন্তু এই পৃথিবী নামক গ্রহটিকে পরিত্যাগ করার কথাটি মোটেই বলা হয় নি। কারণ দুনিয়া বলতে আপন নফসের স্বেচ্ছাচারটিকে বোঝানো হয়েছে।

নফসের এই স্বেচ্ছাচারটি কেমন করে আসতে পারে? যখন নফসের সঙ্গে খান্নাসরূপী শয়তানটিকে জড়িয়ে দেওয়া হয়। কেন খান্নাসরূপী শয়তানটিকে একটি পবিত্র নফসের সঙ্গে জড়িয়ে দেওয়া হয়? জড়িয়ে দেওয়া হয় এই জন্য যে, একটি নফস তথা একটি মানুষ কি আল্লাহকে চায়, না চায় না-এই আল্লাহকে চাওয়া আর না- চাওয়ার নামটিই হল পরীক্ষা। এই পরীক্ষাটির জন্যই মানুষকে বানানো হয়েছে। এই পরীক্ষাটি একমাত্র মানুষ ও জ্বিন ছাড়া আর কাউকেই দিতে হয় না। ফেরেস্তা যতই শক্তিশালী হোক না কেন, যতই হিয়া হুয়া করতে পারুক না কেন, কিন্তু ফেরেস্তাদের পরীক্ষা দিতে হয় না। কারণ হলো, ফেরেস্তাদেরকে আল্লাহ নফস এবং রূহ একটিও দেন নাই। নফস এবং রূহ দুটো একত্রে থাকলেই পরীক্ষাটি অবধারিত।

যাদের কেবলমাত্র নফস আছে, কিন্তু রূহ নাই, তাদেরকেও পরীক্ষা দিতে হয় না এবং পরীক্ষা দেবার বিধানটি রাখা হয় নি। কারণ যদি রূহ না থাকে এবং কেবলমাত্র নফসটিই থাকে তা হলে সেই জীবগুলোকে মানুষ এবং জ্বিন জাতির মধ্যে গণ্য করা যায় না এবং যাবে না। সেই জীবগুলো হয়ে যাবে তখন অনেক রকম জানোয়ার এবং অনেক রকম পাখি। মানুষ এবং জ্বিন ছাড়া কোনো পশু, কোনো পাখি, কোনো মাছ অথবা কোনো প্রাণীকেই রূহ দেওয়া হয় নি। কারণ রূহ আল্লাহর আদেশ। আল্লাহর আদেশ আল্লাহ হতে আলাদা নয়। সুতরাং ঢাকনা খুলে যদি বলতে হয় তো বলতে হয় যে, রূহ স্বয়ং আল্লাহ।

মানুষের মাঝে এবং জ্বিনের মাঝে রূহ আছে বলেই সেফাতি নুরের তৈরি রোবট ফেরেস্তাদেরকে আদমকে সেজদা দেবার আদেশটি দেওয়া হল। সেফাতি নুরের তৈরি আল্লাহর রোবট নামক ফেরেস্তাগুলোর সবাইকে আদমকে সেজদা দিতে বলা হলো এবং সবাই সেজদা করলো এবং সেজদা করতে বাধ্য হলো। কারণ, ফেরেস্তাদের নফসও নাই এবং রূহও নাই, তথা ভালো-মন্দ বিচার করার সীমিত (মৃত্যুর আগ পর্যন্তকে সীমিত বলা হয়) স্বাধীনতাটাই দেওয়া হয় নাই।

যেহেতু আজাজিল জ্বিন জাতি হতে আগত এবং আজাজিল মোটেই ফেরেস্তা নয়, যদিও আজাজিলকে ফেরেস্তাদের সরদার বানানো হয়েছিল এবং সরদার এ জন্যই আল্লাহ বানিয়েছেন যে আজাজিলের মধ্যে নফসও ছিল, রূহও ছিল। আজাজিল নফস এবং রূহের অধিকারী বলেই ফেরেস্তাদের সরদার বানিয়েছেন, নতুবা সরদার বানাবার প্রশ্নই উঠে না।

গ্রন্থ: কোরান ও হাদিসের দৃষ্টিতে রোজা ও ইফতার।
লেখক: ডা.বাবা জাহাঙ্গীর বা-ঈমান আল সুরেশ্বরী