লতিফায়ে কালব-এর শ্রেষ্ঠত্ব ও ব্যাপকতা।
মানবদেহে আল্লাহ প্রদত্ত্ব জ্ঞানকেন্দ্র ‘লতিফায়ে কালব-এর শ্রেষ্ঠত্ব ও ব্যাপকতা সম্পর্কে বিশ্বওলী খাজাবাবা হযরত ফরিদপুরী (কুঃছেঃআঃ) ছাহেব যা বলেনঃ-
নবী রাসূল ও ওলীয়ে কামেলগণ আল্লাহপ্রদত্ত যে জ্ঞান মাধ্যমের সাহায্যে জ্ঞান আহরণ করেন, তাহার নাম লতিফায়ে কালব। ইহাই জ্ঞানার্জনের শ্রেষ্ঠতম মাধ্যম। ইহা নূরময় জগতের উপাদান। মানবদেহে ইহা আল্লাহপাকের এক বিশেষ দান। কালবী জ্ঞানের মাধ্যমে নিজেকে চেনা যায়, নিজ সত্ত্বার নিগুঢ় তত্ত্ব সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন করা যায়, যে জ্ঞান খোদাতালাশীকে খোদাতায়ালার একান্ত সান্নিধ্যে পৌঁছাইয়া দেয়।
হযরত রাসূলে করীম (সাঃ) উম্মী উপাধীতে ভূষিত ছিলেন। তিনি নিরক্ষর ছিলেন। তিনি কোন স্কুল, কলেজ, ইউনিভার্সিটিতে পড়েন নাই। অথচ তিনিই মানব সমাজকে কিতাব ও হেকমত শিক্ষা দিলেন, জ্ঞানের আলোতে সমগ্র জগতকে আলোকিত করিলেন। তিনি নিজেই বলিলেন, ‘‘আমি জ্ঞানের শহর আর আলী সেই শহরের দরজা।” ইহা কোন্ জ্ঞান? ইহাই কালবের মাধ্যমে অর্জিত জ্ঞান। এই জ্ঞানের মাধ্যমেই আত্মপরিচয় বা মান আরাফা নাফসাহু’র দরজায় উপনীত হওয়া যায়; এই জ্ঞানের মাধ্যমেই খোদাতত্ত্বজ্ঞান বা ‘‘ফাকাদ আরাফা রাব্বাহু”র পর্যায়ে উন্নীত হওয়া যায়।
জগতে যত প্রকারের জ্ঞান আছে যথা বিজ্ঞান, দর্শন, গতিবিদ্যা, সমাজবিদ্যা, রাষ্ট্রবিদ্যা, শিল্পকলা ইত্যাদি সমুদয়ই লতিফা কালবের জ্ঞানের নিকট এতই ক্ষুদ্র যে সাহারা মরুভূমির তুলনায় একটা বালুকণার সমানও নয়। এই জ্ঞানই সম্মানিত নবী ও রাসূলগণ শিক্ষা দিয়াছেন। এই জ্ঞানের আলোতেই তাহারা জগতের অজ্ঞতা, বর্বরতা, নির্লজ্জতা, পাপ ও পংকিলতার অন্ধকার বিদূরীত করিয়া তথায় শান্তি ও মানবতা প্রতিষ্ঠা করিয়াছেন। এই কালবী জ্ঞানের মাধ্যমে ওলীয়ে কামেল সকল জগতের বুকে সত্যের পতাকা উড্ডীন রাখিয়াছেন।
এই জ্ঞানের সাহায্যে হযরত মুজাদ্দেদ আলফেছানী (রাঃ) ছাহেব সম্রাট আকবরের পাঁচ মিশালী ধর্ম দীনে-এলাহীর বিরুদ্ধে বিপ্লব সাধন করিয়া মৃত্যুপ্রায় ইসলামকে পুনরুজ্জীবিত করিলেন। যুগে যুগে ওলীয়ে কামেল সকল এই জ্ঞানই প্রচার করিয়া আসিতেছেন। পরিচ্ছন্ন কালবে খোদাতায়ালার নূর প্রতিফলিত হয়। সেই নূরের আলোতে কালবী নেত্রে আল্লাহপাকের সমুদয় সৃষ্টি জগত তথা আসমান ও জমীনের সমুদয় রাজ্য অবলোকন করা যায়। শুধু অবলোকন নয়, আল্লাহর সমস্ত সৃষ্টি জগতের অর্থাৎ ১৮,০০০ আলমের প্রকাশ্য ও অন্তর্নিহিত জ্ঞান অর্জন করা যায়। যে জ্ঞানের তুলনায় বিজ্ঞানের আবিস্কৃত মহাবিশ্বে ১০০ কোটি গ্যালাক্সির জ্ঞান একেবারেই সামান্য; যাহা উল্লেখেরও দাবী রাখে না। পরিচ্ছন্ন কালবের অধিকারী ওলীয়ে কামেলগণ ১৮ হাজার আলম সম্বলিত সমগ্র সৃষ্টি জগতকে নখদর্পণে দেখিতে সক্ষম।
হযরত রাসূলে করীম (সাঃ) বর্ণনা করিয়াছেন, “সমস্ত বিশ্ব জগতকে আমার সম্মুখে পেশ করা হইয়াছে, তখন আমি উহার পূর্ব প্রান্ত হইতে পশ্চিম প্রান্ত পর্যন্ত সমস্তই প্রত্যক্ষ করিয়াছি।“
হযরত বায়েজীদ বোস্তামী (রঃ) ছাহেব বলেন, ‘‘আমি সমগ্র সৃষ্ট জগতকে দুই অংগুলীর মাঝে দেখিয়া থাকি।”
হযরত ইব্রাহিম (আঃ) সম্পর্কে আল্লাহপাক বলেন, “এইরূপে আমি ইব্রাহিমকে আসমান ও জমীনের সমস্ত রাজ্য দেখাইয়াছি।” (‘‘সূরা আন্আম”)
লতিফা কালবের মূল আরশ, মূলের মূল তাজাল্লীয়াতে আফয়াল। সমগ্র সৃষ্টি জগত; রূহানী বা হুকুমের জগত, নূরের জগত, সিফাতে এজাফিয়ার বিশাল জগত সম্পর্কে জ্ঞান লতিফা কালবের মাধ্যমে অর্জন করা যায়। বেলায়েতে ছোগরার শেষ প্রান্তে তাজাল্লীয়াতে আফ্য়ালের নূরে কালব ফানা প্রাপ্ত হয়।
পরিচ্ছন্ন কালব একাধারে রিসেপ্টর, রেডিও, টেলিভিশন, টেলিফোন ও টেলিস্কোপের কাজ করেঃ
মহান খোদাতায়ালার জাত পাক হইতে যাহা কিছু কামেলের কালবে নিক্ষেপ করা হয়, তাহা সমস্তই কালব ধারণ করিয়া রিসেপ্টরের কাজ করে।
শত শত, হাজার হাজার মাইল দূর হইতে খবর পাঠ করা হয়, রেডিওর সুইজ অন্ করিয়া তাহা তৎক্ষণাৎ আমরা শুনিতে পারি। ঠিক তেমনি জাতপাক হইতে যত খবর বা এলহাম প্রেরণ করা হয়, কামেলের পরিচ্ছন্ন কালব তাহা তৎক্ষণাৎ ধারণ করিয়া কামেলেরই জ্ঞাত ভাষায় তদীয় সম্মুখে উপস্থিত করিয়া রেডিওর মত কাজ করিতেছে।
টেলিভিশনে একই সাথে খবর শোনা ও ছবিও দেখা যায়। পরিচ্ছন্ন লতিফা কালব টেলিভিশনের পর্দার মত কাজ করে। ১৮ হাজার আলম বা সৃষ্টি জগতের সব কিছুই কালবের পর্দায় দেখা যায়। এবার টেলিস্কোপের কথা বলি। বিজ্ঞান মহাকাশ সম্পর্কে যে ধারণা জগতবাসীদের প্রদান করিল, সেই জ্ঞান অর্জনে বিজ্ঞানীকে সহায়তা দান করিল বিজ্ঞানীদেরই আশ্চর্য আবিস্কার টেলিস্কোপ। বিজ্ঞানীরা এই টেলিস্কোপের সাহায্যে মহাবিশ্বের গ্যালাক্সি সমূহের সৌন্দর্য অবলোকন করিয়া আনন্দে আত্মহারা হইয়া অশ্রু বিসর্জন করে। কামেলের কালব অত্যন্ত শক্তিশালী এক টেলিস্কোপ। যাহার সাহায্যে আছমানসমূহে রক্ষিত সৌন্দর্য, নূরময় জগতের মনোমুগ্ধকর অপরূপ রূপ দর্শন করিয়া ছালেক সবকিছু বিস্মৃত হয়; এমনকি নিজেকেও পর্যন্ত ভুলিয়া যায়। দুনিয়ার প্রতি তাহার আর বিন্দুমাত্র আকর্ষণ থাকে না। সে দ্রুত খোদাতায়ালার জাতপাকের দিকে ধাবমান হয়, জাতপাকের সান্নিধ্য-আকাংখা ছালেককে অস্থির করিয়া তোলে।
পরিচ্ছন্ন কালবের মাধ্যমে যে কি ব্যাপক জ্ঞান অর্জন করা যায় সে সম্পর্কে একটি দৃষ্টান্ত তুলিয়া ধরিতেছেঃ
হযরত আবুল হাসান আলী খেরকানী (রঃ) ছাহেব আমাদের এই ছেলছেলার ৭ম পুরুষ ছিলেন। তিনি হযরত বায়েজিদ বোস্তামী (রঃ) ছাহেবের প্রধান খলিফা। সমকালীন সময়ে সমস্ত ওলী-আল্লাহদের ছর্দার ছিলেন। অথচ তিনি ছিলেন অক্ষরজ্ঞানশূন্য। যাহাই হোক, লক্ষ লক্ষ লোক তাহার সমীপে বা খেদমতে খোদাপ্রাপ্তিতত্ত্বজ্ঞান লাভের উদ্দেশ্যে উপনীত হইতেন। একদা এক যুবক আসিয়া তাহার নিকট বাগদাদে যাইয়া হাদীসশাস্ত্র অধ্যয়নের অনুমতি প্রার্থনা করিল।
হযরত খেরকানী (রঃ) ছাহেব যুবককে বাগদাদে না যাইয়া বরং খেরকানেরই কোন আলেমের নিকট হইতে হাদীস শাস্ত্রের জ্ঞান আহরণ করিতে পরামর্শ দিলেন। কিন্তু এই পরামর্শ তাহার ভাল লাগিল না। যুবকটি বলিল, ‘‘হুজুর! খেরকানে তেমন কোন ভাল মোহাদ্দেস নাই, কিন্তু বাগদাদে বহু বিখ্যাত ও নামকরা মোহাদ্দেস আছে।” ইহা শুনিয়া হযরত খেরকানী (রঃ) ছাহেব চেহারায় বিরক্তিভাব আনিয়া বলিলেন, ‘‘আমি তো একজন মুর্খ ও নিরক্ষর লোক। কিন্তু আল্লাহতায়ালা আমাকে সমস্ত দফতরের জ্ঞান দান করিয়াছেন।” যুবকটি জিজ্ঞাসা করিল, ‘‘হুজুর, হাদীস শাস্ত্রের জ্ঞান আপনি কাহার নিকট হইতে অর্জন করিয়াছেন?” হযরত খেরকানী (রঃ) ছাহেব বলিলেন, ‘‘রাসূলে পাক (সাঃ) হইতে।” কিন্তু এই কথা যুবকের বিশ্বাস হইল না।
যুবক বাড়ী চলিয়া গেল। রাত্রিতে যুবক স্বপ্নে দেখিল যে রাসূলে করীম (সাঃ) তাহাকে বলিতেছেন, ‘‘হে যুবক! তুমি আবুল হাসান খেরকানীর কথা বিশ্বাস কর নাই কেন? সে ঠিকই বলিয়াছে। সমুদয় হাদীস আমি নিজে তাহাকে শিক্ষা দিয়াছি।” পরবর্তী দিন যুবকটি দ্রুত হযরত খেরকানী (রঃ) ছাহেবের খেদমতে হাজির হইয়া তাঁহার নিকট হইতে হাদীস শিখিবার জন্য আকুতি জানাইল। হযরত খেরকানী (রঃ) ছাহেব যুবকটিকে হাদীস শিখাইতেন। কোন কোন সময় তিনি কোন কোন হাদীস সম্পর্কে বলিতেন, ‘‘ইহা হুজুরে আকরাম (সাঃ) এর হাদীস নয়। যুবকটি জিজ্ঞাসা করিত, ‘‘হুজুর আপনি ইহা কেমন করিয়া জানিতে পারিলেন? তিনি বলিলেন, তুমি যতক্ষণ হাদীস পড়িতে থাক ততক্ষণ পর্যন্ত আমার কালবী দৃষ্টি থাকে হুজুরে আকরাম (সাঃ) এর ভ্রু-যুগলের প্রতি এবং আমরা যে সকল হাদীস লইয়া আলোচনা করি, রাসূলে করীম (সাঃ) তাহা সমুদয় মনোযোগ সহকারে শুনেন। কখনও কখনও তিনি ভ্রু-কুঞ্চিত করিয়া আমাকে জানাইয়া দেন যে, ইহা তাঁহার হাদীস নয়।”
এতক্ষণ কালবী জ্ঞান লইয়া আলোচনা করিতেছি। কিন্তু আল্লাহপাক ওলীয়ে কামেলসকলকে জ্ঞানের যে ব্যাপকতা দান করেন, তাহার নিকট লতিফা কালবের মাধ্যমে অর্জিত জ্ঞানও যৎসামান্য বলিয়া পরিগণিত হয়। লতিফা কালবের মত আরও তেত্রিশ কোটি লতিফা তাঁহাদেরকে দান করা হয়। প্রত্যেকটি লতিফার সাথে আল্লাহপাকের নূরের সংযোগ থাকে। ইহা ছাড়াও আল্লাহপাক ওলীয়ে কামেলকে ‘ওজুদ মাওহুব লাহ’ নামক এক বিশেষ নূরের দেহ বা শরীর প্রদান করেন, যাহার সাহায্যে কামেল সিফাতে হাকীকীর আটটি বিশাল বিশাল গ্রন্থ তথা হায়াত, এলেম, কুদরত, এরাদত, ছামাওয়াত, বাছারাত, কালাম ও তাকবীন অধ্যয়ন পূর্বক অর্থাৎ ছায়ের করিয়া তদীয় জ্ঞানের পরিধিকে বৃদ্ধি করেন। ‘ওজুদ মাওহুব লাহুর’ সাহায্যেই আসমা, সিফাত, শান, মহব্বত ও হকিকতের মুল্লকে বিচরণ করিয়া জ্ঞানের ক্ষেত্র বিস্তৃত করিয়া পরিশেষে খোদাতায়ালার জাতপাকের একান্ত সান্নিধ্য অর্জন করেন, রেজামন্দী লাভ করেন।
কলেমার প্রথম অংশ বা বেলায়েতের পরিপূর্ণতা তাহার হাছিল হয়। তৎপর কলেমার দ্বিতীয় অংশের তথা কামালাতে নবুয়তের জ্ঞান ও সম্পদ প্রদান পূর্বক আল্লাহ তাহাকে দুনিয়ার দিকে ঘুরাইয়া দুনিয়াবাসীদের হেদায়েতের দায়িত্ব প্রদান করেন। এমন ব্যক্তির চরিত্র হয় আল্লাহর চরিত্রের অনুরূপ। এমন ব্যক্তির সম্বন্ধেই আল্লাহ বলেন যে, ‘‘মানুষ আমার ভেদ, আমি মানুষের ভেদ।” এমন ব্যক্তিকে আল্লাহর নূরের তৈরী ফেরেশতারাও অতিশয় সম্মান প্রদর্শন করেন। এমন ব্যক্তিই আল্লাহতায়ালার জ্ঞানে জ্ঞানী হয়।
হযরত খেরকানী (রঃ) ছাহেব বলেন যে, তিন তিনটি জায়গায় ফেরেশতারা উল্লিখিত উত্তম চরিত্রের অধিকারী ব্যক্তিকে অত্যন্ত ভয়ও করিয়া থাকে। যথাঃ
- ১. কেরামুন কাতেবীন তাহাদের আমল নামা লিখিবার সময়।
- ২. মালাকুল মউত তাহাদের জান কবজ করিবার সময়।
- ৩. মুনকার নকীব কবরে সওয়াল করিবার সময়।
(তথ্যসূত্রঃ বিশ্বওলি শাহসূফী হযরত খাজাবাবা ফরিদপুরী (কুঃছেঃআঃ) ছাহেবের- নসিহত সকল খন্ড একত্রে, নসিহত নং-১১১)