লালন দর্শনে কারা শরিয়ত পালন করে?
“কুতর্ক আর কুস্বভাবী
তারে ভেদ বলেনাই নবি।
ভেদের ঘরে দিয়ে চাবি
শরা মতে বুঝিয়েছে।।”
(সাইজি লালন ফকির)
ব্যাখ্যাঃ ভেদ দুই প্রকার যথা: একটি সিনার ভেদ তথা আত্মার ভেদ তথা পরমের ভেদ, অপরটি সফিনার ভেদ তথা বস্তুভেদ তথা ফিকা ও কালাম শাস্ত্র।
ভেদ তথা সির তথা রহস্য জ্ঞান- বিজ্ঞানের ধারক ও বাহক সুফিরা, তথা নবী, রসুল ও অলিরা। এই সিনার ভেদকে কোরানিক দর্শনে “মিনহাজ” তথা এলমে লদুনি তথা এলমে মারফত বলা হয়। নবী অলীদের গুপ্তভেদের স্বরূপই হলো সিনার ভেদ। “কুতর্ক আর কুস্বভাবী যারা, তাদের ভেদ বলেন নাই নবী।” কোরানিক দর্শন জানান দিচ্ছে সুরা হুমাজার প্রথম আয়াতে “দুর্ভোগ তথা যন্ত্রনা তথা নানত তথা আযাব তাদের জন্য যারা অপরে দুর্নাম ও বদনাম করে বেড়ায়।” যাদের স্বভাব ও চরিত্র পবিত্র নয়, তারাই মূলত কুতর্কী কুস্বভাবী।
তারা অন্যের অনিষ্ট করা, অপরের গায়ে পড়ে তর্ক করা ও ক্ষতির চিন্তা মাথায় নিয়ে ঘুরে বেড়ায়। যাদের স্বভাব চরিত্র পবিত্র নয় তারা মুহাম্মদ সাঃ মোকামে মাহমুদার ভেদ উপলব্ধি করতে পারবে না। তারা মুহাম্মদি সুন্দর্য হতে বঞ্চিত। তাদেরকে নবী সিনার বিজ্ঞান দেন নাই।
যেমন:: মহানবী সাঃ মাওলা আলীকে সুরা ইখলাসের মারফত শিখিয়ে দিলেন, আর আরব বেদুইন সাহাবাকে নবী তিনবার সুরা ইখলাস পড়লে এক খতম কোরান পড়ার সাওয়াব পাবে বলে দিলেন। যে যতটুকু নেওয়ার উপযুক্ত তাদের মাত্রা বুঝে নবী অলীগণ জ্ঞান বিতরণ করেন। নবী অলীগণ জগতের রহমতস্বরূপ। “ভেদের ঘরে দিয়ে চাবি, শরা মতে বুঝিয়েছে”।
যাদেরকে নবী অলীগণ সিনার ভেদ তথা রহস্যের বিজ্ঞান তথা এলমে মারফত থেকে বঞ্চিত করেছেন তাদেরকে নবী শরিয়ত দিয়েছেন। যারা কাষ্ঠধর্ম তথা সৈনিক ধর্মের অনুসারী তারা ভেদের জ্ঞান থেকে বঞ্চিত, মূলত তাদের কলব মৃত, তারা অন্ধ, বধির ও বোবা। আমরা কোরানের দুই নং সুরা বাকারায় দেখতে পাই- “আল্লাহ তাদের অন্তকরণ এবং তাদের কানসমূহ বন্ধ করে দিয়েছেন, আর তাদের চোখসমূহ পর্দায় ঢেকে দিয়েছেন। আর তাদের জন্য রয়েছে কঠোর শাস্তি।” (২ঃ০৭)। “তারা বধির, মূক ও অন্ধ। সুতরাং তারা ফিরে আসবে না।” (২ঃ১৮)।
যাদেরকে আল্লাহ তাঁর নবী অলিগণ আত্মার বিজ্ঞান থেকে বঞ্চিত করেছেন তাদেরকে নবী অলিগণ শরিয়ত তথা কাষ্ঠধর্ম অনুসরণ করতে দিয়েছেন। যারা মারফতের জ্ঞান থেকে বঞ্চিত কোরানিক দর্শন তাদের অন্ধ, বধির, বোবা ও মৃত বলে অভিহিত করেছেন। আর নবী অলীগণ যাদের কলব তথা হৃদয়কে উন্মুক্ত করেছেন তাদেরকে কোরানিক দর্শন জীবন্ত তথা রহমত প্রাপ্ত তথা হেদায়েত প্রাপ্ত বলে আভিহিত করেছেন।
আমরা কোরানের সুরা যুমারের বাইশ নং আয়াতে দেখতে পাই- “আল্লাহ যার বক্ষ ইসলামের জন্যে উম্মুক্ত করে দিয়েছেন, অতঃপর সে তার পালনকর্তার পক্ষ থেকে আগত আলোর মাঝে রয়েছে। (সে কি তার সমান, যে এরূপ নয়) যাদের অন্তর আল্লাহ স্মরণের ব্যাপারে কঠোর, তাদের জন্যে দূর্ভোগ। তারা সুস্পষ্ঠ গোমরাহীতে রয়েছে।” (৩৯:২২ নং আয়াত)।
সুতরাং বলা যায় যারা শরা তথা শরিয়ত তথা কাষ্ঠধর্মের অনুসরণ ও অনুকরণ করে কোরানিক দর্শন তাদের নবীর ভেদ বিজ্ঞান থেকে বঞ্চিত করেছেন। তাদের জন্যই আপসোস যারা চোখ দিয়ে দেখে অথচ অন্ধ, কান দিয়ে শুনে অথচ বধির, যাদের হৃদয় আছে কিন্তু উপলব্ধি নেই। তারাই মূলত মানব সমাজে ফেতনা ও ফ্যাসাদকারী। তারাই শান্তি শৃঙ্খলা বিনষ্টকারী। তারাই অমঙ্গলের ধারক বাহক। আর তাদের জন্য ওই দূর্ভোগ। অর্থাৎ আপন স্বভাবই জানান দিচ্ছে আমি কি জান্নাতে আছি তথা রহমতে আছি নাকি জাহান্নামে তথা গজবে আছি।
সুতরাং আপন স্বভাবই বলে দেয় আমার চরিত্র। সুপথ আর কুপথের আয়নাই হলো ব্যক্তির চরিত্র। সাইজি লালন ফকিরের পদ্যের কালামগুলো কোরানিক দর্শনের অন্তর্নিহিত সুগভীর ভাব প্রকাশ করে চলছে।
নিবেদক: আর এফ রাসেল আহমেদ