হোমপেজ ইলমে মারেফত হে সাকী (পর্ব-০২)

হে সাকী (পর্ব-০২)

ছবি: সুফি দ্বীন মোহাম্মদ চিশতি নিজামী

হে সাকী (পর্ব-০২)

৬.
হে সাকী!
সুখ যা এক দোয়াসা ঘেরা বস্তু। যার পিছনে দৌড়াতে দৌড়াতে মানুষের জীবন সায়াহ্নের অবসান ঘটে। যা এই মায়ার নগরী থেকে চিরমুক্তি দিয়ে নিয়ে যায় মাওলার নিকট। সুখ সে তো কল্পনার এক মরীচিকার নাম। যা আদৌ কেউ কখনো পেয়েছে বলে আমার মনে জাগে না। কারণ সুখ নামক এই অধরাকে ধরতে গিয়ে মানুষ তার অমূল্য জীবনটাই শেষ করে ফেলে। যে জীবনে মাওলাকে চেনা/জানার কথা, সে অমূল্য জীবনকে আমরা সুখের পিছনে দৌরাত্ব করে রাখি। কিন্তু মানুষ আমরা ভ‚লে যাই যে, যা ক্ষাণিক সময়ের জন্য একটু প্রণোদোনা দান করে সুখ তা নয়। সুখ তাকে বলে যার কাঙ্খিত বস্তু তথা মাওলাকে তাঁর অপরূপে নিজের করে পাওয়ার নামই সুখ।

৭.
হে সাকী!
শুধুমাত্র দুগ্ধ দেখে যেমন বুঝা ভারী দুস্কর বিষয় যে, ইহার পশ্চাত্বে মাখন ছানা লোকিয়ে রয়েছে। তেমনি প্রথমে মুর্শিদকে সাধারণ মানুষ রূপে দেখে বুঝে ওঠা ভারী দুস্কর বিষয় মনে হবে যে মুর্শিদ রূপে পরম বন্ধু সয়ম্ভু সয়ং খোদা-ই তাঁহার মাঝে লোকিয়ে রয়েছেন। কিন্তু উহা দর্শন করিতে হইলে সেই চোখ ও দৃষ্টি তৈয়ার করে নিতে হইবে। নচেৎ আনারী লোক তথা আম জনতা উহা দেখিতে পাইবে না। তাহা দেখিতে হইলে আপন আপন মুর্শিদে ফানা তথা বিলিন হও তবেই যদি দর্শণাতীত হয় মুর্শিদের সেই গঞ্জরূপ।

৮.
হে সাকী!
গুরুর লিঙ্গ শিষ্যের যোনি, বীর্য নিলে হয় মহাজ্ঞানী।
গুরু মুখের নিঃসৃত বাণী তথা গুরু জি¦ব্বাই হচ্ছে লিঙ্গ আর শিষ্য কর্ণে শুনে ধারণ করা/সংরক্ষণ করা তথা শিষ্য কর্ণই হল যোণী। যে উহা যথার্থ ধারণ ও পোষণ করিতে পারে সে হয় জ্ঞানী তথা তখন তার মধ্যে এক জ্ঞান সন্তানের জন্ম হয়। আর জ্ঞান মানুষকে সর্বদায় আলোকিত করে কল্যাণের দিকে ধাবিত করে তথা বীর্য হচ্ছে আলো তথা জ্ঞান।

৯.
হে সাকী!
মানুষের মনের মধ্যে প্রবেশ তথা প্রেম প্রতিষ্ঠা করিতে হইলে যেমন একটি মানবদেহের প্রয়োজন পড়ে, তেমনি ধর্মের নিগূঢ়ে পৌছাইতে হলে ধর্মের বাহ্যিক আনুষ্ঠানিক ক্রীয়ার দরজা দিয়াই প্রবেশ করিতে হয় আর খোদার সহিত মিলিত হতে হলে একজন নায়েবে রাসূলের প্রয়োজন হয়। কিন্তু শরিয়তের কর্মটি তথা আনুষ্ঠানিকতার মধ্য দিয়া যখন মারেফাতের নিগুঢ়ে পৌছাইবে। ঠিক তখন-ই আমার মত বন্ধুর সরাবখানায় এসে মস্তানদের পাগল করা অপূর্ব নৃত্য দেখিতে পাইবে, দেখবে মাওলার ধ্যানে তাঁহারা কতটা উলঙ্গ হয়ে নৃত্য করছে। মামুন প্রতিটি ক্ষণে ঐ সরাবখানায় গিয়ে মস্তানদের পায়ের ধূলোয় গড়াগড়ি খায় আর মাহাবুবের চরণে চুমোতে থাকে।

১০.
হে সাকী!
যে বৃক্ষটি ভেতর থেকে মরে যায় তার উপড়ী জ¦ল সেবনে কি স্বার্থকতা পায়? যে বৃক্ষ তার আদ্যশক্তির অভাবে কান্ড-শাখা-প্রশাখা নিস্তেজ হয়ে পাতা হলুদ বর্ণ ধারণ করে তার গোড়ায় মাটি দিলেই কি আর অন্য গাছ দিয়ে বেঁধে দিলেই বা আর কত ক্ষণ তার মূল তথা আপন অস্তিত্ব নিয়ে দাড়িয়ে থাকতে পারে? যে ফুল অঙ্কুরেই ঝরে পড়ে সে ফুলের সুভাস কি কেউ পায় তথা তার অপ্রকাশিত সুভাসে কী আদৌও কোন প্রেমিক ব্যকুল হয়। এমন ফুলের তো কোন মূল্যই থাকে না, যা মানুষের পদ তলে পড়ে পিষ্ঠ হয়ে যায়। তা কি কোন মহৎ এঁর পূঁজায় ব্যবহৃত হয়? হয় না।

১১.
হে সাকী!
তোমার পরিবেষ্ঠিত সরাবপানে তাকিয়ে আমার প্রেম টগবগিয়ে উথলিয়ে পেয়ালার দু’টি ধারায় প্রবাহিত হচ্ছে। যে প্রেম অসীম, যার কোনো সীমা রেখা নেই। নেই কোন শব্দ সংজ্ঞা। যা দ্বারা অনন্ত-অসীম প্রেমকে লিখনীর ভাষা-বাক্যে প্রকাশ করা যাইবে। তবে প্রেমের কিছুটা ভোবা উদাহরণ দেওয়া যাইতে পারে। প্রেমটি এরূপ যেমন লাইলির গলির কুকুরটিকে মজনু একদিন তাঁর নিজ এলাকায় পেয়ে ঐ কুকুরটির পায়ে পড়ে চুমোতে থাকে আর বলে এ তো আমার লাইলির-ই সুভাস। হযরত আমির খসরু যেমন তাঁর মাহাবুবে এঁলাহী নিজাম উদ্দীনের পায়ের খরম হতে মাহাবুবে এঁলাহী নিজাম উদ্দীনের প্রেমের ঘ্রাণ পেয়ে কাওয়ালকে তাঁর পুরো রাজ্য দিয়ে দেওয়ার অভিব্যক্তি প্রকাশ করে বলে, এ কাওয়াল তোমার নিকট হইতে আমার মাহাবুবের শরীরের ঘ্রাণ ছড়াচ্ছে। পরে তাঁর মাহাবুবের খরম বুকে ধরে পাগলের ন্যায় চুমোতে থাকে। মহানবীর প্রেমে যেমন ওয়ায়েস কুরণী নিজের সকল দন্ত পাথর দিয়ে থেতলিয়ে ফেলে দেয়, প্রেমটা হচ্ছে ঠিক ঐ রকম।

১২.
হে সাকী!
পার্থিব জগতের মানুষদের মাঝে কি আজব নিয়ম দেখো। দরিদ্র শ্রেণীর যত মানুষ আছে তারা আরোও দারিদ্রের দিকে ধাবিত হচ্ছে আর ধনি যত আছে তারা আরো ধনবান প্রাপ্ত হয়ে বিপুল ধনি হইতেছে। কিন্তু সাকী, তাদের উভয়ের দিকে দৃষ্টিপাত করলে দেখা যায় যে খোদার নিকট পৌছানোর পথে একটি-ই ধাবিত অন্যটি সে পথ হইতে বিমুখ। খোদার নিকট পৌছানোর রাস্তা ২টি, একটি দরিদ্রতা অন্যটি প্রেম। কিন্তু অনেক সময় দরিদ্রতার পেশানলে দরিদ্র পথ হইতে অকেফহাল হয়ে পড়ে। তবে জেনে রাখো সাকী, খোদার অন্বেষণ করতে হলে দারিদ্রের পথ ও বেশ-ই বন্ধুর তালাশ করতে হয়। পার্থিব ধনীর ধনের গোলায় ধন-সম্পদ মওজুদ থাকে, খোদা নয়।

লেখা- সৈয়দ মামুন চিশতী

» হে সাকী (সব পর্ব)