
ধর্ম কাকে বলে এবং ধর্মের মর্মার্থ
“ধর্ম” শব্দটি সংস্কৃত প্রকৃতি প্রত্যয়জাত শব্দ। সংস্কৃত “ধৃ”ধাতু হতে ধর্ম শব্দের উৎপত্তি। √ধৃ+মন= ধর্ম। “ধৃ” শব্দের অর্থ হল ধারণ করা, লব্ধ করা তথা অর্জন করা। আর “মন” হল প্রত্যয়। অতএব ধর্ম শব্দের অর্থ দাড়াল- “মন যাহা ধারণ করে রয়েছ”, অথবা মানুষকে যাহা ধারণ করিয়া রয়েছেন।
ধর্ম কাকে বলে?
কোনো বিশেষ চিন্তাধারা এবং দর্শনকে ধারণ করাইকে বলে ধর্ম। (a) আমাদের অন্তরনিহির্ত দেবত্বের বিকাশই ধর্ম। (b) মানুষের মধ্যে জম্মগতভাবে যে ঈশ্বরীয় ভাবটি বিদ্যমান তার বিকাশের নাম ধর্ম। (c) ধর্ম হল জীবাত্মার সহিত পরমাত্মার চিরন্তন সম্বন্ধ।
প্রকৃত ধর্ম:
আলোচনা না, মর্তবাদ নয়, তত্ত্ব নয়, সামপ্রদায়িকতা নয়, মসজিদ, মন্দির ও গীর্জা তৈরীর মধ্যে কোনো ধর্ম নেই। পূজা অর্চনাতে, ইবাদত বন্দেগীতেও ধর্ম সীমাবদ্ধ নয়। পুথির পাতায় বা বানী বা বক্তিতায় অথবা কোনো অনুষ্ঠানেও ধর্ম খুঁজে পাওয়া যাবে না। ধর্ম অনুভূতির বিষয়। ফিল করার বিষয়, স্বাদ তথা উপভোগ করার বিষয়। (আমাদের) আপন রবকে (প্রভুকে) উপলব্ধি করতে হবে, তাকে অনুভব করতে হবে, আপনার মাঝে দর্শন করতে হবে, তার সঙ্গে কথা বলতে হবে, সেটাই ধর্ম।
অতীন্দ্রিয় অনুভব, সত্য ও উপলব্ধি হলো ধর্মের অপরিহার্য অঙ্গ। সবগুলো একত্রিত করলে এইভাবেও ধর্মের সংজ্ঞা দেয়া যায়, ধর্ম হল জীবনের এক দিগদর্শন যা আমাদের প্রকৃত স্বরূপের প্রত্যক্ষ উপলব্ধি করানোর মাধ্যমে আমাদের মানুষী সীমাবদ্ধতা অতিক্রম করতে সাহায্য করে এবং আমাদের অস্তিত্বকে আরও অর্থবহ সত্য ও (স্বরূপের সঙ্গে) অধিকতর যুক্ত করে তোলে।
“সর্বশাস্ত্রে এই ধর্ম অহংকারহীন।
হিংসা নাই যে ধর্মে তারে বলি দীন।।
মহেসেনী নিবেদিলা মহাদেব তরে।
আদেশিবে মহারাজ,ধর্ম বলে কারে।।
মহাদেব সম্বোদিয়া, পার্বতীরে কয়।
হেন কথা শুনে মম মনে সুখ হয়।।
হেন কেহ জিজ্ঞেসে না ধর্ম ব্যবহার।
জিজ্ঞাসিছে ধর্ম দীন ধর্মের আচার।।
ধর্মধামে ধর্মা ধর্ম, ধর্ম সমুদয়।
সে ঘরেতে ধর্ম নৈলে, তার ধর্ম নয়।।
যে ঘরে প্রভুর যাত, ঐ ধর্মপুর।
লয় হওয়া প্রভুসনে, সে ধর্ম মধুর।।
লয় হওয়া প্রভুসনে, ফানা কামালাত।
এই ধর্ম এই দীন এই আখেরাত।।
মূল যার মূল পদ মূলে মূলাধার।
যার ধর্মে সেই ধর্মী হইবে উদ্ধার।। (d)
“চরিত্র সাধনার মূল, সুচরিত্র গঠন হইলে ফুটে ফুল-
তখন পায় সে, অকূলের কূল।।
বিকারেতে সর্বস্ব হারায়, পূর্ণসংযমি না হইলে-
নিষবিকারে, পায় সকল।।
ইশকের আগুনে পুরে, যে জন পরশ হইলে-
উদ্ধমর্তি শান্তমতি, তার তুলনা নাই ভ্রমন্ডলে।।
মুর্শিদের সূক্ষ্ণ প্রেমে, যে জন ভবে মজিয়াছে-
সংযমে সর্বক্ষণ চলে, রতিরনে জয় হইয়াছে।।” (e)
মন কী ধারণ করলে সেটা ধর্ম হবে? এমন কী অর্জন করলে মানুষ ধর্মকে ধারণ করতে পারবে? কী এমন বিশেষ গুণ রয়েছে যাহা অর্জন করলে মানুষ ধারণকৃত তথা ধর্ম হয়ে যায়? ধারণ মানেই হল ধর্ম। এই ধরম শব্দে তিনটি বর্ন রয়েছে যথা: ধ,র,ও ম। “ধ”বর্ণ দিয়ে ধন বুঝায়। “র”বর্ণ দিয়ে রতি বুঝায়। “ম”বর্ণ দিয়ে মতি বুঝায়। তাহলে ধর্মের মধ্যে তিন বিষয় পেলাম যথা:- ধন, রতি ও মতি।
যে সত্তা এই ত্রিগুন ধারণ করেছেন তিনিই সাধারণ তথা ধর্ম। তার কাছে সকলেই সমান ও নিরাপদ। সাধকের তথা আমানুর দেহের মধ্যে যে যৌবন রয়েছে সেটাই সাধকের ধনস্বরূপ। তার অভ্যন্তরে যে বীর্যশক্তি রয়েছে সেটাই রতিস্বরূপ। যে সাধক রতিকে সংযত তথা হেফাজত তথা মন্থন করে মতির বিকাশ করেন তিনিই ধারণকৃত। লুলু ওয়া মারজান হল মতিস্বরূপ।
উত্তাল যৌবন সাগরে যখন সাধক ডুবুরী হয়ে ডুব দেয়, তখনই সাধকের রতিশক্তিই ষড়রিপু হয়ে, সাধককে আঘাত করে মতি উদগীরণ করতে তথা প্রবাল ও মানিক্য তুলতে। দুর্লভ পদার্থের অধিকারী না হলে ধারণকৃত তথা সাধারণ হওয়া যায় না। যিনি সবাইকে জানেন, বুঝেন এবং সকলের মধ্যে একজন হয়েও সকলের মধ্যে অন্যতম তিনিই সাধারণ।
[ধরম=ধর্ম] এই ধর্মের রেফটাই মানুষকে ভদ্রলোক বানিয়ে ফেলেছে। মানুষ রতিকে আড়াল তথা গোপন করে ধার্মিক নামের সং সেজেছে। রতি পবিত্র না হলে মতির উদয় হবে না। সরল মানুষ ব্যতীত সকল মানুষজীব রতিতে গতি হারিয়ে যাচ্ছে। প্রেমের পথ ত্যাগ করে কামীনীররূপে ঝাপ দিয়েছে। এই তথাকথিত সভ্যতার দর্শনটাই রতিতে গতি হারাচ্ছে। ধর্মজীবন ততা সাধারণ হতে হলে অবশ্যই রতিতে মতির উদয় করতে হবে। তবেই না ধনস্থায়ীত্ব লাভ করবে।
এই ধন হল অনন্তযৌবনের প্রতীক। মতি হল রূহের প্রতীক। রতি হল পবিত্র নফসের মধ্যে রিপুর প্রতীক সাধক যখন নফসের উপর রূহকে উদ্ভাসিত করবে, তখনই ধনের মালিক চীরসবুজ যৌবনরূপ প্রকাশ করবে। সুতরাং নিজেকে নিজের মধ্যে বিশেষভাবে যিনি দর্শন করেছেন তিনিই ধার্মিক। একজন পবিত্র মানবসত্তাই ধর্মের প্রাণ। এই প্রাণটাকে যিনি জীবন্ত করে তুলেছেন তিনিই ধর্মের মর্মার্থ উদঘাটন করেছেন। তিনিই ধর্মের ব্যাখ্যাদাতা, ধর্মের প্রচারক, শান্তির রক্ষাকবচ। তার সান্নিধ্যে গেলে কল্যাণ ও মঙ্গল অনুভব করা যায়।
সূত্র: (a)কালান্দার জাহাঙ্গীর, (b,c)স্বামী বিবেক আনন্দ, (d)মাওলানা শানশরীফ শাহ। (e)সাধক কবি শাহজাহান শাহ।
– আর এফ রাসেল আহমেদ