আধ্যাতিক গল্প: ‘সী-মোরগ’
লেখক পরিচিতি:
শেখ ফরিদ উদ্দিন আত্তার নিশাপুরি (র:) বিশ্বের খ্যাতিমান আধ্যাতিক কবি ও সাধকগণের একজন। তিনি ইরানের খোরাসান প্রদেশের নিশাপুর শহরে ১১৪৫ খ্রীস্টাব্দে জন্মগ্রহণ এবং ১২২১ খ্রীস্টাব্দে মৃত্যুবরণ করেন। নিশাপুরেই কবির সমাধি রয়েছে। মাওলানা জালালুদ্দিন রুমি (র:) কিশোর বয়সে বয়োবৃদ্ধ শেখ আত্তারের সাক্ষাৎ ও দোয়া লাভ করেন। রুমি (র:) আত্তার সম্পর্কে লিখেছেন, “আত্তার করেছেন সফর প্রেমের সপ্তনগর, আমরা এখনও ঘুরছি কানা গলির ভেতর”।
শেখ ফরিদ উদ্দিন আত্তার (র:) তার জগদ্বিখ্যাত গদ্য গ্রন্থ ‘তাযকিরাতুল আউলিয়ার’ জন্য বিশেষভাবে পরিচিত। তার রচিত কাব্যসমূহ আধ্যাতিক মনিষীবৃন্দ, গবেষক ও সাধকদের মনকে সমৃদ্ধ করেছে ও বিভিন্ন ভাষায় অনুবাদ হয়েছে। গবেষকদের মতে তার রচিত গ্রন্থ সংখ্যা ১১৪ টি।
আজকের আলোচনার বিষয় শেখ আত্তারের ‘মানতেকুত্তায়ির’ কাব্য সংক্ষেপ। ‘মানতেকুত্তায়ির’ বা পাখিদের ভাষা, যুক্তি ও প্রজ্ঞাগ্রন্থের নামকরণ করা হয়েছে আল কুরআনে বর্ণিত হযরত সুলাইমান আঃ এর কাহিনীতে ব্যবহৃত পরিভাষা তথা মানতেকুত্তায়ির থেকে যেখানে হুদহুদ নামের এক জ্ঞানী ও প্রজ্ঞাবান পাখির সাথে হযরত সুলাইমান আঃ এর আলোচনা বর্ণিত হয়েছে। এই কাব্যগ্রন্থ এক বিস্ময়কর আধ্যাতিক পথনির্দেশনার গ্রন্থ তা পাখিদের ভাষা ও আচরণে বলা হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে লাখো পাখির সমাবেশ মানুষেরই সমাবেশ।
মানুষের স্বভাব-চরিত্র ও আচার ব্যবহার পাখিদের জবানে ও আচরণে তুলে ধরা হয়েছে। প্রায় আটচল্লিশ হাজার শব্দের এ গ্রন্থে রয়েছে মানবমনের হাজার হাজার পর্দার কাহিনী এবং তা বিদীর্ণ করে মাশুকে মুতলাক আল্লাহ তায়ালার দিদারে গমনের পথ পরিক্রমার অন্যান্য এক দিকনির্দেশনা। এর ইংরেজি অনুবাদ হয়েছে কনফারেন্স অব দ্যা বার্ডস, পার্লামেন্ট অফ দ্যা বার্ডস, এসেম্বলি অফ দ্যা বার্ডস প্রভৃতি পরিভাষায়।
গল্প
গ্রন্থের শুরুতে আল্লাহর প্রশংসা, হামদ্ নাত, দোয়া দরুদের পর মূল কাহিনীতে বলা হয়েছে:
চন্দ্রবিহীন এক মধ্যরাতে চীন দেশে সী-মোরগ তার রূপের বাহার মেলে ধরল। সী-মোরগের পাখা থেকে একটি পালক ছুটে পড়ল জমিনে। পালকের রূপের আলোতে চমক লাগলো দেশ-বিদেশ ও সারা জাহানে।এত রূপ দেখে দেশের পাখিরা জমা হলো বিশাল ময়দানে।সবার এক কথা,পৃথিবীর সব দেশেই রাজা বাদশাহ রয়েছে।
কিন্তু আমাদের দেশে বাদশাহ নেই।এ কারণে সবখানে অরাজকতা,অন্যায়, অবিচার, দুর্নীতি, সন্ত্রাস, অশান্তি, যুদ্ধ, হত্যাকাণ্ড, বৈষম্য, হিংসা, বিদ্বেষ ইত্যাদি চলছে। আমাদের প্রয়োজন একজন ন্যায়বিচারক দরদি বাদশাহ। কিন্তু কোথায় পাবো তাকে? কে নিয়ে আসবে এমন একজন প্রজ্ঞাবান প্রজাবৎসল বাদশাহ। পাখিদের এমনসব কথাবার্তা ও কোলাহলে উপস্থিত হলো হুদহুদ। হুদহুদ অত্যন্ত জ্ঞানী, বুদ্ধিমান, প্রজ্ঞাবান ও কষ্ট সহিষ্ণু পাখি। সব পাখিই তার গুনাবলিতে মুগ্ধ। সবাই মিলে তাকে ধরলো এবং তাদের দাবির কথা জানালো। হুদহুদ পাখিদের কথা মনোযোগ দিয়ে শুনলো এবং তাদের মনের কথা বুঝে নিলো। সমবেত পাখিরা তাকেই নেতা ও মুখপাত্র হিসেবে মনোনীত করল।
কেননা, হুদহুদ হযরত সুলাইমান আঃ এলো ঘনিষ্ঠ ও বিশ্বস্ত পাখি। সবার কথা ও দাবি শোনার পর হুদহুদ বলল: “আমাদের জন্য একজন যোগ্যতম বাদশাহ বা সম্রাট হওয়ার যোগ্যতা রয়েছে শুধুমাত্র সী-মোরগের”। ফারসি সাহিত্যে সী-মোরগ বলা হয় ইনসানে কামেল ও পীরে কামেলকে যিনি আল্লাহ পাকেরই খাঁটি প্রতিনিধি। হুদহুদ পাখিদের বলল: “সী-মোরগের সন্ধান ও সাক্ষাৎ পাওয়া এত সহজ নয়। সী-মোরগের আবাসে যেতে হলে অত্যন্ত কঠিন ও সংগ্রামময় অভিযান জরুরি।
সী-মোরগ থাকে “কুহে কাফে” কুহে কাফে যেতে হলে আমাদের এদেশ ও এ বেশ ছাড়তে হবে। আমাদের নফসানি লেবাস ও রেশ থাকা অবস্থায় ‘কুহে কাফে’ যাওয়া সম্ভব নয়। আর সেখানে যেতে না পারলে ‘সী-মোরগের’দিদার লাভও অসম্ভব।” এ অভিযান ও অভিযাত্রা নিয়ে পাখিদের মাঝে শুরু হলো নানা তর্ক-বিতর্ক ও বাদানুবাদ। প্রত্যেকেই যার যার স্বার্থ, যুক্তি ও অবস্থানের আলোকে নিজেকে এ অভিযান থেকে দূরে রাখার চেষ্টা চালালো। বুলবুল, ময়ূর, চড়ুই, কবুতর, ঘুঘু, দোয়েল, হাস, কাক, শকুন, বাজ, ঈগল প্রভৃতি হাজার হাজার নামের পাখি সাত মরু-বিয়াবান পাড়ি দেয়ার নাম শুনেই ছিটকে পড়তে ও সটকে পড়তে যুক্তি দেখাতে লাগল। হুদহুদ সবাইকে তার প্রজ্ঞা দিয়ে বুঝানোর আপ্রাণ চেষ্টা চালালো। বলল: আমাদের মুক্তির একমাত্র পথই এ সংগ্রামী অভিযানে জীবনপণ করে নামা।
নইলে এই অরাজকতাপূর্ণ, অশান্তির ও ধ্বংসাত্মক পৃথিবীর কারাগার থেকে আমাদের মুক্তি নেই। আত্মত্যাগ ও সংগ্রামই একমাত্র উপায়। লোভ-লালসা, স্বার্থপরতা, হিংসা-বিদ্বেস, স্বাধীনতা ইত্যাদির সাত ভয়াবহ ময়দান পাড়ি দিতেই হবে। তবেই আমরা চিরন্তন শান্তিময় জীবন পাবো এবং সী-মোরগের পরশ লাভে ধন্য হবো। শেখ মুহাম্মদ ফরিদ উদ্দিন আত্তার তার চিত্তাকর্ষক ও আধ্যাত্মিক তাৎপর্যপূর্ণ গ্রন্থে উল্লেখ করেন-অবশেষে পাখিদের সমাবেশ থেকে হাজার হাজার পাখি রওনা হলো কুহে কাফের দিকে হুদহুদের নেতৃত্বে। ভয়াবহ সাত মরু পাড়ি দিতে গিয়ে হাজার হাজার পাখি মারা গেল, হারিয়ে গেল এবং নানা আকর্ষণ ও ফাঁদে আটকে পড়ল। শত শত মঞ্জিলে হুদহুদ সঙ্গী-সাথীদের উপদেশ ও পথনির্দেশ দিয়ে প্রাণ সঞ্চার করতে লাগলো।
সাহসী এই বীর পাখিরা দীর্ঘ কঠিনতম পথ পরিক্রমা শেষে যখন ‘কুহে কাফে’ পৌঁছালো তখন তাদের সংখ্যা দাঁড়ালো মাত্র তিরিশে। ফারসিতে তিরিশ কে বলা হয়’সী’। তিরিশ পাখি অর্থ্যাৎ সী মোরগ! সী মোরগ বা তিরিশ পাখি যখন কুহে কাফে মহান বাদশাহ সী মোরগের আবাসে পৌছল তখন তাদের অবস্থা কাহিল, প্রাণ যায় যায়। পথে পথে কত হাজার হাজার সাথী পাখি বিদায় নিয়েছে বা ধ্বংস হয়েছে। কত হৃদয়বিদারক এ কাহিনী। কিন্তু সবাই ঠিকানাবিহীন গহীন অন্ধকার যুলুমাতের দেশে ও দীনহীন বেশে ঘুরপাক খাচ্ছে। শেষ পর্যন্ত সী-মোরগ বা তিরিশ বীর বিক্রম পাখি অধীর চিত্তে অপেক্ষা করতে লাগল অন্তরের আরাধ্য সী-মোরগের দেখা পাওয়ার সৌভাগ্য অর্জনের জন্য।
সেখানে ছিল এক বিশাল অতি স্বচ্ছ হ্রদ। অপেক্ষমান সী-মোরগরা হ্রদের স্বচ্ছ জলের দিকে এগিয়ে গেল। একি! সী মোরগের সবার চেহারা হ্রদের পানিতে ফুটে উঠেছে। প্রত্যেকেই নিজের ছবিতে দেখলো মহামান্য ন্যায় বিচারক অতিশয় দরদি সী-মোরগের হুবহু চেহারা। তাঁরা তো বিস্ময়ে হতবাক! তখন প্রতিচ্ছবি থেকে চোখ ফিরিয়ে যার যার দেহের দিকে তাকিয়ে দেখে তারাই এখন সী- মোরগ! সী-মোরগের সন্ধানে, ধ্যানে, স্মরণে ও অভিযানে গিয়ে তারাই হয়ে গেছে সী-মোরগ।
কুহে কাফের সী-মোরগ। চিরশান্তির সী-মোরগ। একত্ব ও একাকারের তাওহিদী হৃদয়ের প্রশান্তি, দরদ ও ইশকে তারা মাতোয়ারা। তাদের চোখে-মুখে, কানে ও সর্বাঙ্গে এবং রূহে সর্বত্র বাজছে এক মধুর তান-আমি এক আহাদ, অদ্বিতীয় সামাদ, আমাকেই বানাও তোমার একক লক্ষ্য ও প্রেমময় প্রাসাদ, আমার উপস্থিতিই যথেষ্ট হোক তোমার মনে, আমিই তোমাদের মাওলা-মাবুদ বরণ করো অনিবার্য জেনে, দমে দমে জপো আমার নাম, বিভোর থাকো হু আর আল্লাহু স্মরণে।
গ্রন্থসূত্র:’মানতেকুত্তায়ির’, লেখক: শেখ ফরিদ উদ্দিন আত্তার (র:)।