
স্বপ্ন ও কাশফ এবং এর মধ্যে পার্থক্য (সূফিতত্ব)
কাশফ আরবী শব্দ, যার অর্থ উন্মুক্ত হওয়া, প্রকাশ হওয়া, পরিদর্শন করা, অন্তর্দৃষ্টি উন্মোচন ইত্যাদি।
কাশফ ২ প্রকার। যথা –
১/ কাশফে আয়ানী অর্থাৎ প্রত্যক্ষদর্শন
২/ কাশফে বেজদানী বা পরোক্ষ দর্শন বা অনুভব।
এই দুই রকম কাশফের মধ্যে পার্থক্য এতটুকু যে, কাশফে আয়ানী অর্জিত হলে সাধক স্পষ্ট সব কিছু দেখতে পায়, আর কাশফে বেজদানীর বেলায় সে স্পষ্ট দেখতে পায়না বটে, কিন্তু অবস্হার পরিবর্তন নির্ভুলভাবে অনুভব করতে সক্ষম হয়। যেমন – বায়ু দেখা না গেলেও উহা অনুভব করা যায়। অন্ধ ব্যক্তি যেমন স্পর্শ দ্বারা বাতাস ও পানির পার্থক্য নিরুপন করে।
পবিত্র কুরআনে আল্লাহ বলেন,
“কাফেরদের বলা হবে তুমি এ দিবস সমন্ধে উদাসীন ছিলে এখন আমি তোমার থেকে আবরণ সরিয়ে ফেলেছি, অতএব আজ তোমার দৃষ্টি শক্তি অতি তীক্ষ্ণ।” (সূরা ক্বাফ, আয়াত নং ২২)।
কুরআনের উক্ত আয়াত দ্বারা মৃত্যুর দ্বার প্রান্তে উপনীত ব্যক্তির কাশফ পাওয়াকে বুঝানো হয়েছে। যার ফলে জীবনের অন্তিম মুহূর্তে মানুষের অস্বাভাবিক আচরণ প্রকাশ পায়।
তাসাউফের জ্ঞান দ্বারা সাধনা করলে বিষয়টি এরুপ দাঁড়ায় যে, কাশফ বলতে পরিশুদ্ধ জীবআত্নার অলৌকি দর্শন ক্ষমতাকে বুঝায়। পরিশুদ্ধি লাভের পর জীবআত্না যখন পরমাত্মার কাছে আত্মসমর্পণ করে, তখন রহস্যময় পরমাত্মা এবং সৃষ্টি জগতের নানা বিচিত্র তথ্য জীবাত্মার কাছে প্রকাশ পেতে থাকে। অর্থাৎ সাধকের অন্তর্দৃষ্টি খুলে যায়। সূক্ষ্ম জগতের বিষয়সমূহ এই অন্তর্চক্ষুর মাধ্যমে স্হূল জগতের মত বাস্তব দৃশ্যমান হয়। জীবাত্মার এরুপ দর্শন ক্ষমতা মূলতঃ পরমাত্মার সাথে যোগাযোগের মাধ্যমে অর্জিত হয়।
স্বপ্ন ও কাশফের মধ্যে পার্থক্যঃ
মানুষ যখন ঘুমিয়ে পড়ে, তখন তার বাহ্যিক পঞ্চ ইন্দ্রিয় নিস্তেজ হয়ে যায়। এ সময় মানুষের আত্মা আলমে মেছালে বিচরণ করে যে দৃশ্য (ঘুমন্ত অবস্থায়) দেখতে পায় উহাকে স্বপ্ন বলে। অপরদিকে গভীর সাধনার মাধ্যমে সাধকগণ যখন ষড়রিপু নির্জীব ও নিস্তেজ করে দেন, তখন তিনি অন্তর্চক্ষু দ্বারা জাগ্রত অবস্থায় যা দেখেন তাকে কাশফ বলে।
স্বপ্ন ও কাশফের মধ্যে প্রধানত দুটি পার্থক্য রয়েছে।
প্রথমতঃ জাগ্রত অবস্থায় স্বপ্ন দেখা যায় না। কিন্তু কাশফের দর্শন জাগ্রত ও তন্দ্রাচ্ছন্ন এই উভয় অবস্থাতেই লাভ হওয়া সম্ভব।
দ্বিতীয়ঃ স্বপ্নের বিষয় স্বপ্ন দ্রষ্টার ইচ্ছাধীন নয়, অর্থাৎ ইচ্ছা করলেই যে কোন বিষয়ের স্বপ্ন দেখা যায় না। পক্ষান্তরে কাশফের মাধ্যমে ইচ্ছামত সাধক তাঁর কাঙ্খিত বস্তুর দর্শন লাভ করতে সক্ষম।
কাশফের দ্বার উন্মোচিত হলে সাধক সৃষ্টি জগতের সমস্ত ভেদ ও রহস্য সম্পর্কে অবগত হতে পারেন। আমাদের এখানে আশেকে রাসূলদের মধ্যে অনেকেই আছেন যারা কাশফের মাধ্যমে মানুষের আত্মার বিভিন্ন সুরত দেখে থাকেন। বাহ্যিক চেহারা ও লেবাসে সকলেই মানুষ বটে, কিন্তু আত্মার সুরতে এরা মানুষ মানুষ নন বরং অনেকেই নিম্নশ্রেণীর জীবজন্তু।
মানুষের মধ্যে ২টি আত্মা। যথা – জীবাত্মা ও পরমাত্মা। হিংস্র জন্তুর আত্মা, পশুর আত্মা ও শয়তানের আত্মা – এই ৩টি মিলে হয় জীবাত্মা। অপরদিকে মানবাত্মা ও ফেরেশতার আত্মা – এই দুটি মিলে হয় পরমাত্মা। হিংস্র জন্তুর স্বভাব হলো – একটি অপরটিকে সহ্য করতে পারে না। যাদের চরিত্রে হিংসা ও লোভ বেশী আত্মার সুরতে তারা কেউ বাঘ, কেউ কুকুর ও কেউ বিড়াল ইত্যাদি।
পশুর স্বভাব খাওয়া, ঘুমানো, মনিবের চিন্তা সে কখনো করে না এবং আপন পর কিছুই বোঝে না। যাদের চরিত্রে এই স্বভাব আছে, আত্মার সুরতে তারা কেউ গরু, কেউ মহিষ ইত্যাদি। শয়তানের স্বভাব হলো গর্ব, অহংকার ও ঝগড়া-বিবাদ সৃষ্টি করা। যাদের চরিত্রে এই স্বভাব রয়েছে আত্মার সুরতে তারা কেউ শিয়াল, কেউ বানর ইত্যাদি। অসংযমী কামরিপুর প্রভাবে যারা ব্যভিচারে লিপ্ত হয়ে থাকে, আত্মার সুরতে তারা শুকুর।
তাই যে আত্মার সুরতে মানুষ নয় সে যতই ইবাদত বন্দেগী করুক না কেন তার মুক্তি নেই। পবিত্র কুরআনে তাই আল্লাহ বলেন, “তোমরা পুতঃপবিত্র আত্মা নিয়ে আমার কাছে এসো।” পবিত্র কুরআনের বর্ণনায় জীবাত্মাকে নফস বলা হয়েছে।
সাধকগণ পরিশুদ্ধি লাভের সাধনায় নফসের ৪টি অবস্থা প্রাপ্ত হন। যথা –
১/ নফসে আম্বারা বা অসংযমি নফস
২/ নফসে লাওয়ামা বা অনুশোচনাকারী ও তিরস্কারকারী নফস
৩/ নফসে মুতমায়িন্না বা শান্তিপূর্ণ নফস
৪/ মূলহেমা বা এলহামপ্রাপ্ত নফস।
পবিত্র কুরআনে আল্লাহ বলেন,
“মানুষের মন অবশ্যই মন্দ কর্ম প্রবণ, কিন্তু যার প্রতি আমার প্রতিপালক দয়া করেন সে এর অন্তর্ভুক্ত নয়। আমার প্রতিপালক ক্ষমাশীল ও পরম দয়ালু।” (সূরা ইউসুফ, আয়াত নং ৫৩)।
“হে প্রশান্ত আত্মা, তুমি তোমার প্রতিপালকের নিকট ফিরে এসো এমনভাবে যে তুমি তার প্রতি সন্তুষ্ট এবং তিনি তোমার প্রতি সন্তুষ্ট।” (সূরা আল ফজর, আয়াত নং ২৭ ও ২৮)।
“আমি শপথ করছি সে আত্মার, যে নিজ কর্মের জন্য নিজেকে ধিক্কার দেয়।” (সূরা আল কিয়ামাহ, আয়াত নং ২)।
আমরা জানি যে, মানুষের মধ্যে জীবাত্মা ও পরমাত্মা বিদ্যমান রয়েছে। আল্লাহর পথে সাধনা করে যিনি তার জীবাত্মা তথা জীব চরিত্রের পরিবর্তন সাধন করতে সক্ষম হয়েছেন, তিনি প্রকৃত মানুষ। আর যে তার জীবাত্মার তথা জীব চরিত্রের পরিবর্তন ঘটাতে পারেননি, সে প্রকৃত মানুষ নয়।
পবিত্র কুরআনে আল্লাহ বলেন,
“আমি তো বহু জ্বীন ও মানবকে জাহান্নামের জন্য সৃষ্টি করেছি, তাদের হৃদয় আছে কিন্তু তা দ্বারা তারা উপলব্ধি করে না, তাদের চক্ষু আছে তা দ্বারা দেখেনা এবং কান আছে তা দ্বারা তারা শোনে না, উহারা পশুর ন্যায়, বরং উহার চেয়েও অধিক নিকৃষ্ট, তারাই উদাসীন।” (সূরা আল আরাফ, আয়াত নং ১৭৯)।
পবিত্র কুরআনে উপরে বর্ণিত আয়াতে চোখ, কান দ্বারা এই বাহ্যিক চোখ ও কানকে বুঝানো হয়নি। কারণ চোখ ও কান দিয়ে সকল প্রাণী যেমন দেখে ও শুনে থাকে তদ্রুপ মানুষও চোখ ও কান দিয়ে যথাক্রমে দেখেন এবং শোনেন। তথাপি তাদের অন্ধ ও বধির বলার অর্থ হচ্ছে -তাদের আত্মার চোখ ও আত্মার কান বন্ধ থাকা। এই অবস্থায় কোন কাশফ বা অন্তর চক্ষুওয়ালা ব্যক্তি এরুপ ব্যক্তিকে দেখলে বিভিন্ন ধরনের জীবের সুরতে দেখতে পেয়ে থাকেন।
উল্লেখ্য যে, যাদের কাশফ বা অন্তর চক্ষু খুলে যায়, আল্লাহর প্রেমাবেগে তারা অনেক সময় স্বাভাবিক অবস্থায় থাকে না। এমতাবস্থায় কখনো কখনো তারা মানুষের প্রতি এমন দুর্ব্যবহারও করে থাকে যার কারণে মানুষ খুঁজে পায় না। তখন শরীয়তের সকল বিধি বিধান তাদের উপর কার্যকরী থাকে না।
বস্তুতঃ যে মানুষের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য যেরুপ, তার আত্মার সুরতও সেরুপ হয়ে থাকে। অর্থাৎ মানুষের আত্মার সুরতই বাহ্যিক আচরণের মাধ্যমে প্রকাশিত হয়। এমতাবস্থায় অন্তর চক্ষু দ্বারা মানুষের ঐ আত্মার সুরতই পরিলক্ষিত হয়। সুতরাং আত্মাকে পুতঃপবিত্র করে মানুষের পর্যায়ে পৌঁছাতে হলে কোন মহামানব বা অলী-আল্লার সান্নিধ্যে যাওয়া একান্ত প্রয়োজন।
সূত্র: আল্লাহ কোন পথে।
নিবেদক: অধম পাপী মোজাম্মেল পাগলা।