সূফী ফতেহ আলী ওয়াইসী (রহঃ) এর জীবনী
কুতুবুল ইরশাদ, রসুলনোমা পীর, সূফী সৈয়দ ফতেহ আলী ওয়াইসী (রহঃ) (১৮২৫-১৮৮৬ খ্রি.)
উনবিংশ শতাব্দীর মহান যুগসংস্কারক, বিশ্ববরেণ্য আউলিয়া, যুবদাতুল আরিফিন, কুতুবুল ইরশাদ, রসুলনোমা, ইসলামী দার্শনিক,ফারসি কবি,যুগশ্রেষ্ঠ মহাপুরুষ, দেশপ্রেমিক হজরত সুফি সৈয়দ ফতেহ আলী ওয়সী রাহ.।
জন্ম- ১৮২৫ সাল,১২৩২ বঙ্গাব্দ, হিজরী ১৩৪২ সনে বাংলাদেশের চট্রগ্ৰাম জেলার সাতকানিয়া উপজেলার আমিরাবাদ ইউনিয়নের লোহাপাড়া থানার, ডাকঘর পদুয়ার মল্লিক সোবহান হাজি পাড়ায় সৈয়দ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন।
পূর্বপুরুষ- সৌদি আরবের মক্কা শরীফ ছিল ওয়সী পীর কেবলার পূর্বপুরুষদের পৈতৃক নিবাস। ইসলামের চতুর্থ খলিফা হজরত আলী ইবনে আবু তালিব রা. -এর বংশধারা সংযুক্ত। উল্লেখ্য, সৌদির হারামাইন শরীফে যে মুসাফিরখানা বিদ্যমান,তা ওয়সী হজরতের বংশধরদের উদ্ধর্তম পুরুষদের প্রদেয় সম্পত্তির ওপর নির্মিত হয়েছে। সেই হেতু তৎসময়ের সৌদি সরকার তাঁদের একটি মান্যতাপত্র হস্তান্তর করেছিলেন। তাঁদের বংশের কেউ আরবে অবস্থানরত হলে তাঁদের সমুদয় আতিথেয়তার সম্যক বন্দোবস্ত উক্ত হাম্মাম শরীফের এই মুসাফিরখানা কর্তৃপক্ষ করবে।
প্রকাশ থাকে যে, পিতৃকূল বড়ো পীর সৈয়দ আব্দুল কাদির জিলানী রাহ.-এর সঙ্গে বংশ পরম্পরা প্রবাহিত। মাতৃকূল হজরত ফাতেমা রা. এবং খাজা মুঈনুদ্দীন চিশতী রাহ.-সঙ্গে যুক্ত হয়েছে। সৌদি আরব থেকে প্রস্থানের সময় তাঁদের সমস্ত সম্পত্তি সৌদি সরকারকে ওয়াকফ করে এসেছিলেন, যা পরবর্তীতে ওয়সী হজরতের আওলাদের সমীপে উক্ত দলিলের কপি সংরক্ষিত আছে। পরবর্তীতে সৌদি থেকে তাঁর বংশধরেরা ইরাক,ইরান, আফগানিস্তান হয়ে হিন্দুস্তানের দিল্লিতে গৃহ নির্মাণ করেন। অতঃপর ওয়সী হজরতের পিতামহ সৈয়দ হাকিম আলী দিল্লি ত্যাগ করে গৌড় ও সোনারগাঁও হয়ে বর্তমান বাংলাদেশের চট্রগ্ৰাম আসেন। মল্লিক সোবহান হাজি পাড়ায় বসতি স্থাপন করেন। উল্লেখ্য, মল্লিক সোবহানে হজরত মাওলানা মুহাম্মদ শামসুদ্দিন সাহেব প্রতিষ্ঠিত সুফি ফতেহ আলী ওয়সী গার্লস মাদ্রাসা,হস্টেল, মসজিদ হজরতের স্মৃতি বহন করে চলেছে।
পিতা মাতা- ওয়সী হজরতের পিতা সৈয়দ ওয়ারেস আলী প্রথমে সৈয়দ হারিস আলীর নিকটে বাইআত হন। কাদেরিয়া, চিশতিয়া, নকশবন্দিয়া ও মুজাদ্দেদীয়া তরিকায় শিক্ষা হাসিল করেন। অতঃপর হজরত সৈয়দ আহমদ শহীদ রায়বেরেলী রাহ.-এর নিকট মুরিদ হন।চার তরিকার শিক্ষা হাসিল করে খিলাফতে ভূষিত হন।একজন কবি, সাহিত্যিক, কবিগুরু ছিলেন। তাঁর কাব্য সাধনা,”আশকী”.। তিনি ১৮০১ সালে ফোর্ট উইলিয়ামের কলেজের ফার্সির অধ্যাপক ছিলেন।হাওড়া জেলার ধসা মাদ্রাসা কমিটির পরিচালক ছিলেন।
স্বীয় পীরের সঙ্গে ১৮২৯ সালের জুন মাসে সফরে বের হন।১৮৩১ সালের ৬ মে ঐতিহাসিক বালাকোট যুদ্ধে পীর সৈয়দ আহমদ, ইসমাইল দেহলভী, তিনি সৈয়দ ওয়ারেস আলী শহীদ হন। একজন আরবি,ফার্সি,উর্দু ভাষায় সুপন্ডিত ছিলেন।
ওয়সী হজরতের মাতা ছিলেন,চট্রগ্ৰামের সায়েদা বেগম আরবি, ফার্সি ,বাংলা ভাষায় পারদর্শী ছিলেন। কুরআনে হাফেজা ও ক্বারি ছিলেন। তাঁর বংশধারা হজরত ফাতেমা বিনতে রাসূলুল্লাহ সা.-এর সঙ্গে মিলিত হয়েছে।
শিক্ষা- সেই সময় অধিক সংখ্যক শিক্ষার্থী পাঠশালা,গুরুমহাশয়ের টোলে, মাদ্রাসায় পড়াশোনা করতেন। তিনি শৈশবে অতিশয় মেধাবী,অত্যন্ত বুদ্ধিমান,আল্লাহপ্রেমিক ছিলেন।১৮২৪ সালে পিতা প্রেরিত হাজি মুহাম্মদ মহসিন -এর সঙ্গে মাতা, শিশুপুত্র কলকাতায় আসেন।১৮৩০ সাল পর্যন্ত তিনি পিতার কাছে কুরআন শরীফ, আরবি, ফার্সি, উর্দু ভাষা শিক্ষা করেন। তাঁর স্মৃতিশক্তি প্রখর ছিল।সাত বছর বয়সে কুরআনে হাফেজ হন। শৈশব থেকেই তাঁর হস্তাক্ষর সুন্দর ছিল। কন্ঠস্বর ছিন অতি মধুর। তাঁর কুরআন তিলাওয়াত শুনে সকলেই মহিত হয়ে যেতেন।
হাওড়া জেলার ধসার পারিবারিক পানাউল্লাহ মাদ্রাসায় কিছুদিন পিতার নিকট শিক্ষা হাসিল করেন। এহেন সময় কুরআন, হাদীস, তাফসীর,ফিকাহ,উসুল,মানতেক,হিকমত কিতাব পাঠ করে গম্ভীর জ্ঞান অর্জন করেন। ছাত্র জীবনে ফার্সি কবিতা সমকালীন পত্রিকায় মুদ্রিত হতে থাকে।পরে হুগলি মাদ্রাসায় পড়াশোনা করে অসাধারণ কৃতিত্বের সঙ্গে পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। ধর্মীয় পাশাপাশি হেকমী চিকিৎসা শিক্ষা হাসিল করেন। ছাত্রজীবনে মুর্শিদাবাদের পুনাশির এমদাদুল হোসেন সাহেবের অনুরোধে তাঁর গৃহশিক্ষকের অংশকালীন চাকরি করেছেন।
চাকরি– পিতার প্রতিষ্ঠিত সাতকানিয়া মাদ্রাসায় কিছুদিন শিক্ষকতা করেন। অতঃপর কলকাতার তালতলায় গৃহশিক্ষতার কাজ করেন। কলকাতার একাধিক ধর্মীয় সভার তাঁর জ্ঞানগর্ভ ভাষণ বিদগ্ধ ব্যক্তিদের আকর্ষিত হয়। কলকাতা আলিয়া মাদ্রাসায় অংশকালীন তিনি অধ্যাপক ছিলেন। কলকাতার দমদমের গোরা বাজারে একটি গবেষণা কেন্দ্রে চাকরি করেছেন, সহকর্মী ছিলেন ফুরফুরা শরীফের বেলপাড়ার মাওঃ রাশেদ সিদ্দিকী। কলকাতার শ্রদ্ধানন্দ পার্কের অপরদিকে মাঠকোঠায় ভাড়া বাড়িতে থাকতেন, বর্তমানে এখানে একটি হোটেলে তৈরি হয়েছে। চাকরির অবসরে রাত্রিতে কুরআন পাঠ,নফল নামাজ,দরুদ পাঠ, ওজিফা ও মুরাকাবা মুশাহিদায় মশগুল থাকতেন।
চাকরির রত অবস্থায় হজরত খিজির আ.-এর সঙ্গে স্বপ্নে দর্শন হয়। অতঃপর ১৮৫৬ সালে ওয়সী হজরত কলকাতা হাইকোর্টের অধীন কলকাতা নগর দায়রা আদালতে রেজিষ্ট্রেশন বিভাগে প্রধান রেজিষ্টার পদে চাকরিতে যোগ দেন। এই সময় এই পার্ক সার্কাসের কড়েয়া রোডের বেগবাগান রো-এর কুঠিতে থাকতেন। কিছুদিন পর লখনউ-এর নির্বাসিত নবাব ওয়াজেদ আলী মেটিয়াব্রুজে আগমন করলেন। ১৮৫৭ সালের সিপাহীদের নিদারুণ অত্যাচারের প্রতিবাদে রেজিষ্টারের চাকরিতে ইস্তফা দেন। ১৮৬৭ সালে নবাব ওয়াজেদ আলী শাহ -এর অনুরোধে তাঁর ব্যক্তিগত সচিব পদ অলংকৃত করেন।
১৮৬৮ সালে তিনি পলিটিক্যাল পেনশন অফিসের সুপার পদে চাকরিতে যোগ দেন। এহেন সময় ওয়ালিউল্লাহ লেনে বিবি সালেটের মসজিদ সংলগ্ন কুঠিতে অবস্থান করতেন। এই কুঠিতে আমার প্রপিতামহ গোলাম সালমানী আব্বাসী ফুরফুরাবী রাহ.-এর যাতায়াত ছিল। ওয়সী হজরত কলকাতা ধর্মতলার টিপু সুলতান মসজিদের ওয়াকফনামা তাঁর পবিত্র হস্তে সংকলিত ফার্সি ভাষায় লিখেছিলেন, যা আজও লখনউতে মসজিদের মুতাওয়াল্লির নিকটে সংরক্ষিত আছে। চাকরি জীবনে অধিকাংশ অর্থ তিনি অসহায়,দরিদ্র মানুষদের অকাতরে দান করতেন।
বিবাহ- মুর্শিদাবাদের পুনাশি গ্ৰামের ইমদাদুল হোসেন সাহেবের দুই সন্তানের ওয়সী হজরত গৃহশিক্ষক ছিলেন। তাঁর পিতৃব্য পুনাশির জমিদার খোন্দকার নেজাবত হোসেনের একান্ত অনুরোধে তাঁর নিকট আত্মীয়ের কন্যা মুসাম্মাৎ ফাতেমা খাতুনের সঙ্গে ওয়সী হজরতের বিবাহ সুসম্পন্ন হয়। তিনি পুনাশিতে গৃহ নির্মাণ করার জন্য একটি জমি ক্রয় করলেন। উক্ত জমিতে একতলা বাড়ি নির্মাণ করা হয়।
পত্নীর প্রেরণায় তিনি একটি পুকুর,বাগান, কৃষিজমি ক্রয় করেন।প্রায় নয় বিঘা কৃষিজাত জমিতে বনঔষধীর বাগান (ভুবন বাগান) প্রতিষ্ঠা করেন। পত্নী ফাতেমা খাতুন অত্যন্ত নম্র ভদ্র রমনী ছিলেন। তিনি খুব সাধারণ জীবনযাপন করতেন। তিনি কখনো স্বর্ণালঙ্কার পরিধান করতেন না। বছরের বেশি সময় রোজাব্রত পালন করতেন। প্রতিবেশীদের সর্বদা সাহায্য সহযোগিতা করতেন। কিছুদিন কলকাতায় তালতলার ওয়েলেসলী স্কোয়ারে শাহ ওয়ালিউল্লাহ লেনে বিবি সালেটের মসজিদ সংলগ্ন আবাসে বসবাস করতেন। ১৮৯৮ সাল,১৩০৮ বঙ্গাব্দের ৫ মাঘ তনয়া জোহুরা খাতুনের শ্বশুর বাড়িতে শনিবার রাত ১০ টায় ইন্তেকাল করেন।
অনন্য মাধুর্য- ওয়সী হজরত অপরূপ আরোগ্যজনক উজ্জ্বল নূরের আলোয় উদ্ভাসিত। গাত্রবর্ণ ছিল উজ্জল শ্যামবর্ণ,সুঠাম দেহ,মধ্যভাগে ভ্রুযুগল জোড়া ছিল। বক্ষ ও উভয় স্কন্দ ছিল বিস্তৃত। চক্ষু ছিল সংযত ও নাসিকা মনোহর, ঘন দাড়ি। চিবুক ছিল ঘন ভারমুক্ত শ্মশ্রু আবৃত। দাঁত ছিল মোতি -সুসজ্জিত, কঠিন সুন্দর ও দীপ্তিময়।সারা মস্তকে কেশে আবৃত।
সমগ্ৰ জীবনে কঠিন ব্যাধি স্পর্শ করতে পারেনি। শীতের রাতে পাতলা কুর্তা পরিধান করতেন। সর্বদা ফকির ও দরবেশের ন্যায় জীবন যাপন করতেন। অত্যন্ত দানশীল ছিলেন। সর্বদা আতর ও খুশবু ব্যবহার করতেন। ছোট বড় সকলকেই আগে সালাম দিতেন। পীড়িতদের সাক্ষাৎ ও সান্ত্বনা দিতেন। মৃত্যু সংবাদ জ্ঞাত হলে তাঁর মাগফিরাতের জন্য দোয়া করতেন। ঈদ উৎসবে শিরওয়ানী, পাঁচ কলি গোল টুপি, নাগরা জুতা অপরিহার্য ছিল।
রবিবার ও ছুটির দিনের বেতন নিতেন না। তিনি শ্বশুর ও নানা শ্বশুরের জমিদারির মালিক হন। দরিদ্র ও অসহায় মুরিদদের সাহায্য করতেন।মৃত ব্যক্তির সালাতে জানাজায় শরিক হতেন। সুন্নাতের জলন্ত প্রতীক ছিলেন। সর্বদা অশ্রু বিসর্জনে আল্লাহর স্মরণ করতেন।ধীরে ধীরে স্পষ্ট ভাষায় কথা বলতেন।একশত মোটা দানার তসবিহ ব্যবহার করতেন।গৃহের ও পাড়ার কুকুর ও বিড়ালকে আহার করাতেন। শিশুদের স্বহস্তে মিঠাই দিতেন।দান খায়রাতে সাম্প্রদায়িক ভেদাভেদ করতেন না।
অনাথ শিশুদের বিদ্যা শিক্ষার ব্যবস্থা করতেন।সকল সময় মিসওয়াক ব্যবহার করতেন।শিয্য ও খলিফাদের থেকে নগদ অর্থ গ্ৰহণ করতেন না। খাদ্য সামগ্রী গ্ৰহণ করে দরিদ্রদের মাঝে বিতরণ করে দিতেন। তিনি শরীয়তের কঠোর পাবন্দ ছিলেন। তিনি পশু পাখিদের খাদ্য সামগ্রী বিতরণ করতেন। দুনিয়া তাঁকে গ্ৰাস করতে পারেনি।পান প্রিয় ছিল। বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে দাওয়াত কবুল করতেন।
খিতাব-
(১) তিনি হজরত রাসূলুল্লাহ সা., আহলে বায়েত, খাজা খিজির আ.-থেকে তরিকতের রুহানী নিসবত হাসিল করে,”ওয়সী” নামে শোভিত হন। তিনি রুহানীভাবে সকলের দীক্ষা হাসিল করে “নিসবতে জামিয়া” -র অধিকারী হন।
(২) হজরত আহমদ আলী সুরেশ্বরী বলেন, ওয়সী হজরত হজরত ওয়ারেস করনী রাহ.-হতে রুহানী দীক্ষা ও শক্তি অর্জন করে ওয়সীয়া তরিকার ফয়েজ, নিসবত ও খিলাফত প্রাপ্ত হন। (নূরে হক গঞ্জেনুর)
(৩) হজরত রাসূলুল্লাহ সা.-এর স্নেহদৃষ্টি অর্জন করে ওয়সী হজরত নিদ্রায় ও জাগরণে সর্বদা তাঁর জিয়ারত ও নৈকট্য লাভ করতেন বলে তাঁকে “রাসূলনোমা” নামে শোভিত হন।
(৪) জোহরা খাতুন হতে বর্ণিত, পিতা যখন হুজরা থেকে প্রকাশ হতেন,তখন কখনো কখনো ভাবে আচ্ছন্ন অবস্থায় হজরত রাসূলুল্লাহ সা., কখনো বড় পীর রূপে পরিবর্তিত অবস্থায় থাকতেন। এই সব দর্শনে কন্যা তাঁকে জানতে চাইলে তিনি মুহূর্তে আপন আকৃতিতে ফিরে যেতেন।
(৫) তিনি বড়পীর,খাজা সাহেব, বাহাউদ্দিন নকশবন্দী, মুজাদ্দিদে আলফেসানী রাহ.-এর নিকট থেকে তাদের ব্যক্তিগত স্নেহ ও পবিত্র নিসবত প্রাপ্ত হন।
(৬) একদিন ওয়সী হজরতকে ইমাম আবু হানীফা রাহ. খানকায়ে রুহানীভাবে হাজির হয়ে ইসলামী শরীয়তের সুগভীর জ্ঞান ও ফায়েজ প্রদান করেন।
(৭) মারিফাতের উচ্চ মার্গে উন্নীত হয়ে আল্লাহর অনুগ্রহে ওয়সী হজরত “কুতুবুল ইরশাদ” নামের উচ্চ মার্গে আসীন হয়েছেন।
(৮) হজরত আবুবকর হতে বর্ণিত, জনৈক মুরিদ পীর কেবলার ফানাফির রাসুল অবস্থা অবলোকন করতে আগ্রহী। এই পর্যায়ে পীর তাঁর “ফানাফির রাসুল” হবার দৃষ্টান্ত দেখাতে সক্ষম হন। সেই হেতু আমার প্রপিতামহ গোলাম সালমানী আব্বাসী ফুরফুরাবী রাহ. বলেন,” হাওয়ায় উড়ে যাওয়া,পানির উপর দিয়ে হেঁটে যাওয়া এবং নাসুতী,মালাকুতী,জাবারুতী বা লাহুতী সায়র করা ফকিরীর মূল বিষয় নয়। প্রকৃতপক্ষে নিজেকে চিনতে পারলে ফকির হওয়া যায়। আর যে ব্যক্তি এই ধোঁকায় পড়েছে,সে খোদা থেকে দূরে রয়েছে। (মিরআতুস সলুক)
নসিহত-
- (১) হজরত রাসূলুল্লাহ সা.-এর মহব্বতে বিহ্বল হয়ে আল্লাহর সান্নিধ্য লাভ করা।
- (২) যারা হজরত রাসূল সাঃ -এর দিদার আকাঙ্ক্ষা করে, তাঁরা যেন জীবনের আরাম,ভোগ বিলাস হারাম করে।
- (৩) যে জাতি শেষ নবী সা.-এর সুন্নাত ত্যাগ করেছে,সে জাতি শয়তানের পদাঙ্ক অনুসরণ করে।
- (৪) মনের মুকুরে হজরত রাসূল সাঃ -এর প্রেমের বাগান প্রতিষ্ঠা করতে হবে। এতেই সিরাতে মুস্তাকিম।
- (৫) দুনিয়াতে যদি সবার আগে কাউকে আপন রূপে পেতে আকাঙ্ক্ষা হয়,তবে হজরত রাসূল সাঃ-কে পেতে হবে।
- (৬) ব্যক্তি স্বার্থ ও আমিত্বের প্রতিমার বেদি চূর্ণ করে দাঁড়াতে পারলে এই জগতের সব শক্তি তোমার কদমে লুটিয়ে পড়বে।
- (৭) হজরত মুহাম্মদ সাঃ সারা বিশ্বের চূড়ান্ত নবী। তিনি সাম্যের নবী,সাদা কালোর নবী।
- (৮) সর্বদা আল্লাহর রহমতের উপর নির্ভর করবে।
- (৯) যারা সুন্নাতে রাসূল সাঃ -হতে বিমুখ, তাঁরা হজরত রাসূল সাঃ -এর শাফায়াত হতে মাহরূম।
- (১০) নবী প্রেম পাগল ব্যাধির কোন্ প্রতিকার নেই।
আধ্যাত্মিক গুরু- হজরত সুফি নূর মুহাম্মদ নিজামপুরী রাহ. বালাকোট যুদ্ধ হতে ফিরে কলকাতার তালতলার বড় গির্জার পাশে মুন্সি গোলাম রহমানের মসজিদ সংলগ্ন হুজরাতে থাকতেন। বৃটিশ পুলিশের হয়রানির ফলে তিনি কলিন স্ট্রিটের অদূরে মিসরীগঞ্জের মাওঃ তৈয়ব সাহেবের মসজিদে সুফি সাহেব এবাদত বন্দেগীতে লিপ্ত থাকতেন। এই মসজিদে পীর নূর মুহাম্মদ নিজামপুরী হজরতের সমীপে সৈয়দ ফতেহ আলী ওয়সী বাইআত হন। দীর্ঘ সময় তাঁর খিদমতে আত্মনিবেদন করে বিলায়েত ও কামালিয়াত হাসিল করে খিলাফতে ভূষিত হন। তিনি কাদেরিয়া, চিশতিয়া, নকশবন্দিয়া -মুজাদ্দিদীয়া, আহমদীয়া তরিকায় বাইআত- এর এজাজত হাসিল করেন।
পীরভাই- গোলাম কাদির আব্বাসী, আনোয়াউল্লাহ ইসলামাবাদী,আকরম আলী নিজামপুরী, হামিদুল্লাহ খান ইসলামাবাদী, আহমদুল্লাহ চট্রগামী, হাফেজ মুহাম্মদ ইব্রাহিম, মুন্সি মেহেরুল্লাহ, হাজি আব্দুল্লাহ,ওসিউর আলী রাজশাহী,এনয়েত আলী, ইমাম উদ্দিন,সন্দীপ, মাওঃ আব্দুল্লাহ,ঢাকা রাহ.প্রমুখ।
সন্তান-সন্ততি- ওয়সী হজরতের দুই পুত্র ও দুই কন্যা ছিলেন।
(১) প্রথম পুত্র -সৈয়দ গোলাম মোস্তফা আলী রাহ. তাঁর দুই পুত্র -সৈয়দ মাসুদুর রহমান, সৈয়দ মুহাম্মদ জানে আলম।কন্যা- সৈয়েদা তামান্না খাতুন,সৈয়েদা ফাতেমা খাতুন।
(২) দ্বিতীয় পুত্র- সৈয়দ আব্দুল্লাহ আলী -সাত বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন।
(৩) প্রথম কন্যা- সৈয়েদা জোহুরা খাতুন।
তাঁর এক পুত্র- সৈয়দ এহসান আহমদ মাসুম।
তাঁর তিন পুত্র- সৈয়দ আব্দুল মাতিন জাহাঙ্গীর, সৈয়দ আবুল বাসার, সৈয়দ ফিরদৌস আহমেদ।
পাঁচ কন্যা- সৈয়েদা সালেহা বেগম, সৈয়েদা এলডিশ বেগম, সৈয়েদা হালিমা বেগম, সৈয়েদা নাসিমা বেগম, সৈয়েদা আংগুরা বেগম।
দুই কন্যা- প্রথম কন্যা সৈয়েদা সিদ্দিকা খাতুন। তাঁর পুত্র খোন্দকার গোলাম মাহবুব সিদ্দিকী। দুই কন্যা গোলেমান বানু, শাহিনা বানু।
দ্বিতীয় কন্যা- সৈয়েদা হাজেরা খাতুন। তাঁর এক পুত্র খোন্দকার বদরুদ্দোজা, চার কন্যা -বিবি আসিয়া খাতুন, বিবি জোবেদা খাতুন,বিবি আনোয়ারা খাতুন, বিবি আয়েশা খাতুন।
(৪) সৈয়েদা জোবেদা খাতুন- ওয়সী হজরতের দ্বিতীয় কন্যা মাত্র বারো বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন।
দিওয়ান -ই-ওয়সী- প্রথম বাঙালি ফার্সি কবি ওয়সী হজরতের জীবনের শ্রেষ্ঠ সংকলন। হজরত রাসূলুল্লাহ সা.-এর শানে ইশক ও মহব্বতের দৃষ্টান্ত স্বরুপ ১৭৯ টি গজল ও ২৩ টি কাসিদা লেখা ১৮৮২ সালে,১৩০০ হিজরিতে সমাপ্ত। ফার্সি ভাষায় গজল রচনায় হাফিজ,সাদি, ফিরদৌস-এর সমকক্ষ ছিলেন।
বিদগ্ধ মুরিদ ও খলিফা- ওয়সী হজরতের জীবনের ৩৯ জন মুরিদ ও খলিফাদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ কয়েকজন-
(১) মাওঃ আব্দুল হক, সিজ গ্ৰাম, মুর্শিদাবাদ, (২) সুফি একরামুল হক, পুনাশি, মুর্শিদাবাদ, (৩) সুফি আবুবকর সিদ্দিকী, ফুরফুরা শরীফ, (৪) সুফি গোলাম সালমানী আব্বাসী, ফুরফুরা শরীফ, (৫)সৈয়দ ওয়াজেদ আলী, মেহদিবাগ, কলকাতা (৬) সৈয়েদা জোহরা খাতুন, শাহপুর, মুর্শিদাবাদ।
অন্তিম উপদেশ- ওয়সী হজরত অন্তিম সময়ে উপদেশ দিলেন। তাঁর ওফাতের পর তাঁর কন্যা সৈয়েদা জোহরা খাতুন -এর কাছ থেকে নিসবতে জামিয়ার ফায়েজ যেন তাঁরা হাসিল করেন। আমি আমার সর্বস্ব তাঁকে প্রদান করেছি।
অতঃপর সুফি আবুবকর সিদ্দিকী ও সুফি আহমদ আলী সুরেশ্বরী রাহ.-কে গভীর রাতে জিজ্ঞেস করেন, মাওঃ গোলাম সালমানী আব্বাসী কোথায়? কারণ, তাঁর সঙ্গে কিছু আলোচনা ছিল। তিনি তখন তথায় হাজির ছিলেন না।
প্রকাশ থাকে যে, ওয়সী হজরত তাঁর সিলসিলার কর্মধারা গোলাম সালমানী আব্বাসী -র হস্তে অর্পণ করার ইচ্ছা পোষণ করেছিলেন। জোহরা খাতুন -ও একই কথা বলেছেন। তাঁর নিকট নিসবতে জামিয়ার জন্য কেউ উপস্থিত হলে তিনি গোলাম সালমানী আব্বাসী ফুরফুরাবী রাহ এর কাছে পাঠাতেন।
ইন্তেকাল- হুগলি জেলার মোল্লাসিমলা হতে ট্রেনে কলকাতা অভিমুখে যাত্রা পথে হাওড়া রেলওয়ে স্টেশনে সুফি আবুবকর সিদ্দিকী রাহ এর কোলে মাথা রেখে ১৮৮৬ সালের ৬ ডিসেম্বর, ১৩০৪ হিজরির ৮ রবিউল আউয়াল, ১২৯৩ বঙ্গাব্দের ২০ অগ্ৰহায়ণ রবিবার বিকাল চার ঘটিকায় ইন্তেকাল করেন। (ইন্না লিল্লাহে ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)
হাওড়া রেল স্টেশন থেকে পুলিশ পিকেট করে কলকাতা তালতলায় বিবি সালেটের মসজিদে দেহ মুবারক আনা হয়।
গোসল– মসজিদ সংলগ্ন আবাসে গোসল কার্য সমাধা হয়ে গেল।
সালাতে জানাজা- ক্রমানয়ে তিন দিন সোমবার, মঙ্গলবার, বুধবার সালাতে জানাজা পালিত হয়। এককভাবে কেউ ইমামত করেননি।
দাফন- ১৮৮৬ সালের ৯ ডিসেম্বর বুধবার দিবাগত রাতে কলকাতার মানিকতলা লালবাগান মহল্লার ২৪/১, মুন্সিপাড়া লেনের দুই নম্বর দিল্লিওয়ালা কবরস্থানে ওয়সী হজরতকে কবরে দেহ শায়িত করা হয়।
শোকপ্রকাশ- ভারতের গভর্নর জেনারেল, বৃটিশ রাণী,বাংলার লেফটেন্যান্ট গভর্নর, কলকাতা হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি, দেওবন্দ মাদরাসার প্রিন্সিপাল, দেশের সমস্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রধান,সরকারি আধিকারি প্রমুখ শোক প্রকাশ করেছেন।