হেদায়তের আলোকবর্তিকা খাজা ইউনুছ আলী এনায়েতপুরী রহ.
সূফিবাদী লেখক ও গবেষক — কায়ছার উদ্দীন আল-মালেকী
ভারতীয় উপমহাদেশে ইসলাম প্রচার ও কুসংস্কারাচ্ছন্ন সমাজ সংস্করণে কিংবদন্তিতুল্য আধ্যাত্মিক রাহবার খাজা ইউনুছ আলী এনায়েতপুরী (রহ.)’র অবদান, অনুপ্রেরণা ও ত্যাগ অনস্বীকার্য। মানবের কলুষিত অন্তর পরিশুদ্ধ করে খাঁটি মানুষ তৈরির এক মহাবিদ্যালয় ছিলো তাঁর আস্তানা। যাঁর আধ্যাত্মিকতার প্রভাবে লক্ষ লক্ষ মানুষের মুর্দা দীল জিন্দা হয়েছে, মানুষ খুঁজে পেয়েছে সিরাতুল মুস্তাকিম। তাঁর নেসবতের অনুসারীদের সিংহভাগ বাংলা—ভারতের হলেও বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছেন কয়েক কোটি ভক্ত—আশেক। সর্বমহলে তিনি ‘খাজাবাবা এনায়েতপুরী’ নামে সমাদৃত। এই মহান আউলিয়া উত্তরবঙ্গের সিরাজগঞ্জ জেলার এনায়েতপুর গ্রামে চিরনিদ্রায় শায়িত আছেন।
আমি চট্টগ্রামের লোক, উত্তরবঙ্গের দিকে আমাদের যাতায়াত নেই বললেই চলে। কিন্তু বিশেষ এক আকর্ষণে অতিসম্প্রতি আমার এনায়েতপুর পাক দরবার শরীফ ও হযরত খাজা ইউনুছ আলী এনায়েতপুরী (রহ.)’র মাজার জিয়ারতের সৌভাগ্য হয়। হক্বপন্থী যেসব তরীক্বতের জংশন রয়েছে, তন্মধ্যে এ দরবার শরীফ অন্যতম। তাঁর মাজার শরীফ থেকে এখনো ফয়েজ জারি হয়। আমি তাঁর তরিকার বা দরবারে সাথে সম্পৃক্ত নই, তথাপি তাঁর সম্পর্কে যতটুকু জানার সুযোগ হয়েছে এবং দ্বীন ও তরিকা প্রচার, সমাজ ও সভ্যতার উন্নয়নে তাঁর প্রচেষ্টা সম্পর্কে যা উপলদ্ধি করেছি— তা ভাষা ও প্রকাশের সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও কিছুটা তুলে ধরার চেষ্টা করলাম।
জন্ম ও শিক্ষা—
হযরত খাজা ইউনুছ আলী এনায়েতপুরী (রহ.)’র জন্ম ১৮৮৬ সালে, শনিবার সুবহে সাদিকের সময়। পিতার দিক দিয়ে ফাতেমী বংশের এবং মায়ের দিক দিয়ে ইসলামের প্রথম খলিফা হজরত আবু বকর ছিদ্দিক (রাদ্বি.)’র বংশের সাথে সম্পৃক্ত। পাঁচ বছর বয়সেই পিতৃবিয়োগ হওয়ায় মহীয়সী ও বিদূষী মাতার তত্ত্বাবধানে অপ্রাতিষ্ঠাতিকভাবে পৈতৃক পাঠাগারে সংরক্ষিত কুরআন—হাদিস—ফেকাহ ও অন্যান্য কিতাবাদি অধ্যায়নসহ আরবী ও ফারসি ভাষার বিশেষ জ্ঞান লাভ করেন। তাঁর আম্মাজান তাহমিনা বেগম পারিবারিকভাবে তফসির—হাদিস—ফেকাহ এমনকি আরবী ও ফারসি ভাষার জ্ঞান অর্জন করেছিলেন।
আয়-রোজগার—
পিতার অবর্তমানে ছোটখাটো কাজ করে সংসারের প্রয়োজন মেটাতে মাকে সাহায্য করতেন। তাঁর আম্মাজান টুপি সেলাই, সবজি বাগান ও এলাকার শিক্ষার্থীদের নিজগৃহে পাঠদান করে সংসার চালাতেন।
ব্যবসা—
এগারো বছর বয়স থেকেই নানান প্রতিকূলতার মধ্য দিয়ে হালাল রুজির জন্য রাসূলুল্লাহ (দ.)’র সুন্নাতের অনুসরণে রংপুর, দিনাজপুর, ময়মনসিংহ, রাজশাহী, কুষ্টিয়া, নদীয় ও মালদাহসহ নানান জায়গায় ব্যবসায়িক সফর করেন।
সৈয়দ ওয়াজেদ আলী রহ’র সান্নিধ্য লাভ—
হঠাৎ একরাতে তাঁর পরহেগার আম্মাজান স্বপ্নে দেখলেন, ‘দক্ষিণ আকশে এক উজ্জ্বল আলো উদিত হচ্ছে।” হাদিস শরীফে ‘রুয়ায়ে সালেহা’ কে সত্য বলে সত্যায়িত করেছেন। তাঁর কিছুদিন পরই আম্মাজান জানতে পারলেন, শাহজাদপুর উপজেলায় হজরত আল্লামা শাহ্সূফি সৈয়দ ওয়াজেদ আলী মেহেদীবাগী (রহ.) আগমন করেছেন। বলে রাখা প্রয়োজন যে, শাহসূফি সৈয়দ ওয়াজেদ আলী রহ. ছিলেন একজন উঁচুমানের শরীয়তের আলেম ও তরীক্বতের উচ্চমানের ধারক—বাহক। সংবাদটি শোনা মাত্রই তিনি পুত্র ইউনুছ আলীকে উক্ত আউলিয়ার সান্নিধ্যে প্রেরণ করেন। তখন তাঁর বয়স ছিলো ১৭/১৮ বছর। অতি আদবের সহিত সৈয়দ ওয়াজেদ আলী মেহেদীবাগী (রহ.)’র সাথে সাক্ষাত শেষ করেন এবং তাঁর হাতে মুরিদ হয়ে তরীক্বত গ্রহণ করেন। তথায় সৈয়দ সাহেবের সোহবতে সাতদিন অতিবাহিত করেন। সাতদিন পরে সৈয়দ ওয়াজেদ আলী মেহেদীবাগী (রহ.)’র অনুমতিক্রমে নিজগৃহে ফিরে যান। এরপর থেকেই তাঁর অন্তরে মুর্শিদে করিমের মুহাব্বতের ফয়েজ অতিমাত্রা হারে বৃদ্ধি পেয়েছিলো। এ মুহাব্বতের মাঝে হারিয়ে যাওয়াকে তরীক্বতের ভাষায় ফানাফিশ শায়খ বলা হয়। এ স্তরের তরীক্বতপন্থীগণ আপন পীরের খাছলত আয়ত্ত করতে শুরু করে। এ প্রসঙ্গে খাজা বাবা এনায়েতপুরী রহ. খুবই সুন্দর বলেছিলেন, ‘‘পীরের খাছলত ধরো তবেই ত্রাণ ও মুক্তি।’’
তরীক্বতের মাক্বাম ও খেলাফত লাভ—
কোন এক শুভক্ষণে সৈয়দ সাহেবের স্বাক্ষতের উদ্দেশ্যে মায়ের অনুমতিক্রমে কলকতায় সফর করেন। এই সফরের মাধ্যমেই তিনি ইলমে মারেফতের পথচলা শুরু করেন। তাঁর উত্তম চারিত্রিক বৈশিষ্ট ও শিষ্টাচারের কারণে অল্পদিনের মধ্যেই সৈয়দ সাহেব হুজুরের সুনজরে আসেন। আপন পীরের নেক নজর ও কঠিন রিয়াজত—সাধনার মাধ্যমে শরীয়ত ও তরীক্বতের নিযার্স জ্ঞান লাভ পূর্বক ক্বলবে ফয়েজ জারি হয়ে লতিফাসমূহে সুলতানুল আজকার জারি হয়ে যায়। এভাবে দায়রা—ই এমকানের স্তর আলমে নাছুত (বস্তুজগৎ) ও আলমে আরোয়ার (রুহের জগৎ) যাবতীয় মাকাম অতিক্রম করে ফানাফিশ শায়খের মাকামে উপনীত হন। এ দায়রা থেকে আত্মিক জগতের রহস্যময় ও মহাবিস্ময়কর জ্ঞানের পথচলা শুরু হয়। এরপর তিনি দায়রায়ে জেলালের মঞ্জিল সম্পন্ন করেন। দায়রায়ে জেলালের মাধ্যমে বান্দা আল্লাহর সমস্ত গুপ্তরহস্য ও সিফাতের জ্ঞান অর্জন করে থাকেন। এ দায়রাতে রয়েছে— বেলায়াতে ছোগরা, বেলায়াতে কোবরা, বেলায়াতে আউলিয়া, দায়রায়ে মহব্বত, দায়রায়ে মাইয়াত, আল্লাহর কুওত (আল্লাহর শক্তি), আল্লাহর ছামাদিয়াত (ছামাদ অর্থ— আল্লাহ অমুখাপেক্ষী, অবিনশ্বর, চিরন্তন, স্বয়ংসম্পূর্ণ, সূত্র— সূরা আর রাহমান ২৯, সূরা আল—ইখলাস ১—২)।
এভাবে তিনি মাকামে মুসাবী, মাকামে ইব্রাহীম, মাকামে ঈসাবী, দায়রায়ে বেলায়তে মুহাম্মদী, দায়রায়ে হাকিকতে কুরআন, দায়রায়ে হাকিকতে সালাত, দায়রায়ে হাকিকতে সাওমসহ প্রভৃতি মাকামসমূহ হাসিল করেন। এভাবে তিনি সুদীর্ঘ এগার বছর সৈয়দ ওয়াজেদ আলী মেহেদীবাগী (রহ.)’র দয়ার পরবশে নিসবতে মুজাদ্দেদীয়ার চব্বিশ দায়রা, নিসবতে চিশতিয়া, নিসবতে মাদারিয়া, নিসবতে সোহরাওয়াদীর্য়া, নিসবতে কাবরূইয়া, নিসবতে মোসাফিয়া, নিসবতে রাসূল করিম (দ.)’র আল আজহাব ও আজওয়াজে মোতাহেরাত রপ্ত করে হজরত মুহাম্মদ (দ.)’র খাছুল খাছ মাকামের উরূজ, ফানা, বাকা ও নিসবতে জামেয়ার সমস্ত ছুলুক হাসিল করেন এবং ছায়েরে ইলাল্লাহ (তওবা, মোহাছেবা, মোয়াতেবা, মোয়ামেলাত, ইস্তেকামাত), ছায়েরে মা’আল্লাহ (ময়েল, উলফৎ, উন্স, মহব্বত, ইশক), ছায়েরে ফিল্লাহ (আলমে নাছূত, আলমে মালাকুত, আলমে জবরুত, আলমে লাহুত, আলমে ছে․উদ/হাহুদ) এবং আবেদিয়াতের মাকামসমূহ হাসিল করে সৈয়দ ওয়াজেদ আলী মেহেদীবাগী (রহ.)’র খেলাফতপ্রাপ্ত হয়ে আধ্যাত্মিক জগতের সুউচ্চ আসনে সমাসীন হন। তিনি ২৭ বছর বয়সে ১৯১৩ সালে খেলাফতপ্রাপ্ত হন। তবে তিনি নকশেবন্দীয়া—মুজাদ্দেদীয়া তরিকা বেশি চচার্ করতেন।
নক্সবন্দিয়া ও মোজাদ্দেদিয়া তরীক্বার শাজরা—
খাজা মুহাম্মদ ইউনুছ আলী রহ, শাহ্সূফি সৈয়দ ওয়াজেদ আলী রহ., শাহ্সূফি সৈয়দ ফতেহ আলী ওয়ায়েসী রহ., শাহ্সূফি মাওলানা নূর মুহাম্মদ নিজামপুরী রহ., শাহ্সূফি সৈয়দ আহমদ শহীদ বেরলভী রহ., মাওলানা আবদুল আজীজ মুহাদ্দেস দেহলভী রহ., মাওলানা শাহ্ ওয়ালীউল্লাহ মুহাদ্দেস দেহলভী রহ.,মাওলানা শাহ্ আবদুর রহীম মুহাদ্দেস দেহলভী রহ., মাওলানা আবদুল্লাহ আকবরাবাদী রহ., শেখ সৈয়দ আদম বিন নূরী রহ., শায়খ আহাম্মদ সেরহিন্দী মোজাদ্দেদ—এ আলফেসানী ফারুকী রহ. হয়ে সিলসিলাটি সরাসসরি হজরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম পর্যন্ত পৌঁছেছে। আলহামদুল্লিাহ।
খাজা বাবা ইউসুস আলী রহ. সম্পর্কে আপন সৈয়দ সাহেব রহ’র ভবিষৎ বাণী—
খাজা ইউনুছ আলীর মাকাম সম্পর্কে সৈয়দ ওয়াজেদ আলী মেহেদীবাগী (রহ.) বলেছিলেন: (১) আল্লাহ তা’লা তাঁকে ইমামতির সনদ দিয়ে দুনিয়াতে পাঠিয়েছেন (২) ইউনুছ তরিকতের গউস (৩) ইউনুছের দ্বারা হেদায়াতের নূর এতোদূর প্রসারিত হবে যে, সারাবিশ্ববে লক্ষ লক্ষ লোক হেদায়াতের নূর লাভ পূর্বক মুক্তি লাভ করবে’’। আল্লাহর এ মহান ‘গউস’ নানান প্রতিকূলতা ও নানান ঘাত—প্রতিঘাতের মধ্যদিয়ে আল্লাহর দ্বীন ও রাসুলুল্লাহর সত্য তরিকা প্রচার করেছেন। খলিফাতুল মুসলেমিন হজরত উসমান রাদ্বি. বলেছিলেন, “যত দুরবস্থায় পতিত হওনা কেনো, আদর্শের ক্ষেত্রে পরাজয় বরণ করোনা।”
মুসলিম উম্মাহ’র বিজয়ের জন্য দোয়া—
মুসলমানদের দুরবস্থা দূর করার জন্য সবসময় আল্লাহর দরবারে দোয়া করতেন। কাফিরদের উপর মুসলমান বিজয় দান করার জন্য দিনের পর দিন আল্লাহর দরবারে কান্নাজড়িত কন্ঠে আর্তনাত করতেন। প্রকৃত পক্ষে— আল্লাহর প্রকৃত কুতুবদের চোখের পানি আল্লাহর দরবারে এতই দামী যে; তাঁদের চোখের পানি গড়িয়ে পড়ার সাথেসাথেই জমীন আল্লাহর দরবারে আর্তনাত করতে থাকেন। তাঁদের দোয়া আল্লাহর দরবারে অফেরৎযোগ্য।
ইসলাম ও তরীক্বত প্রচারে অবদান—
তিনি ১৯১৪—১৯৩৯ সাল পর্যন্ত বাংলা ও আসামের বিভিন্ন অঞ্চলে ইসলাম প্রচার ও তরিকতের কাজে সফর করেছিলেন। তন্মধ্যে— ময়মনসিংহ, আসাম (বঙ্গাইগাঁও, উদালগড়ি), জামালপুর জেলার (খোপাবাড়ী, শীতলকূশার্, মাছিমপুর, তিতপল্লা, ঢেঙ্গারগড়, রায়েরচর, মামাভাগিনা, সাতকোড়া, রাঙ্গামাটিয়া, সুবর্ণেরচর, জঙ্গলদী, কুমড়ারচর, বঘাবাইদ, মেলান্দহ, খাসিমারা, পুইটারচর, টুপকারচর, গোপীনপুর), রাজশাহী জেলার (খুগজীপুর, গুরুদাসপুর, শ্রীপুর)। একটি কথা না বললেই নয়। সবোর্চ্চ ত্যাগ স্বীকার করে পূর্ববঙ্গে যে ক’জন ব্যক্তি ইসলাম প্রচার ও প্রসারে অবদান রেখেছেন তন্মধ্যে খাজাবাবা এনায়েতপুরী (রহ:) অন্যতম। তাঁকে প্রাণে মেরে ফেলার জন্য বহুবার নানান ষড়যন্ত্রের ফাঁদ ও চেষ্টা করা হয়েছিলো। তিনি সবসময় আল্লাহর হেফাজতে সুরক্ষিত ছিলেন। আল্লাহ তা’লা পবিত্র কুরআনে এরশাদ করেছেন, ‘‘আল্লাহ সবোর্ত্তম হেফাজতকারী ও সাহায্যকারী।’’ বর্তমান সময়ে ভন্ড নামধারী পীররা তাদের নিরাপত্তার জন্য সিকিউরিটি ফোর্স তথা রক্ষীবাহিনী সাথে রাখেন। যা কুরআন—হাদিসের সাথে সম্পূর্ণ সাংঘর্ষিক। এনায়েতপুর পাক দরবার শরীফে আসা—যাওয়ার পথে আল্লাহর দুশমনরা তাঁর মুরিদানদের নানানভাবে অপদস্থ করতো। এমনকি তাঁদের সাথে থাকা টাকা—পয়সা এবং মূল্যবান জিনিসিপত্র কেড়ে নিয়ে ঠাট্ট—বিদ্রুপসহ নানানভাবে অপমানিত করতো। মুসলিম লীগে যোগদান না করার কারণে তাঁকে বহুবার নিযার্তনের স্বীকার হতে হয়েছে। এ সংবাদটি মাওলানা ভাসানী পর্যন্ত পৌছলে তিনি দুঃখপ্রকাশ করে বলেছিলেন, “রাজনীতি শিখতে হলে এসো আমার কাছে আর ধর্ম শিখতে হলে যাও এনায়েতপুরে।”
সিলসিলা জারী—
বর্তমান আসামের (মওগাঁও, দরং, কামরূপ, গোয়ালপাড়া), অরুণাচল ও মেঘালয় প্রদেশ, পশ্চিমবঙ্গের (মালদাহ, নদিয়া, মুর্শিদাবাদ), ভারতের পাঞ্জাব প্রদেশ ও পশ্চিম পাঞ্জাব এবং বাংলাদেশের ময়মনসিংহ, টাঙ্গাইল, জামালপুর, সিলেট, ঢাকা, চট্টগ্রাম, রংপুর, দিনাজপুর, বগুড়া, রাজশাহী, কুমিল্লা, বরিশাল, যশোর, খুলনাসহ ৬৪ জেলায় ও বিশে^র রন্দ্রে রন্দ্রে এই সিলসিলার দরবার—খানকাহ, অনুসারী এখনও জারি আছে। এই সিলসিলা সম্পূর্ণ শরীয়তের পাবন্দীর মাধ্যমে আল্লাহ ও তাঁর প্রিয় হাবীবের খুশি—রেজামন্দি হাসিলের লক্ষে তরিকতের অজিফা মতে কঠিন—কঠোর রিয়াজত সাধানার উপর প্রতিষ্ঠিত। তরিকতের নামে ভন্ডামীকে তিনি কখনও আশ্রয়—প্রশ্রয় দিতেন না। এ সিলসিলার কেউ শরীয়তকে অমান্য বা অবমূল্যায়ন করলে বুঝতে হবে সে খাজাবাবা এনায়েতপুরীর অনুসারী নয় বরঞ্চ সে শয়তানের অনুসারী। সে ভন্ড, মিথ্যুক, ধোঁকাবাজ ও ধর্মব্যবসায়ী। খাজা সাহেব তদ্বীয় বাণীতে ফরমান— ‘যে শরীয়তের বিরুদ্ধ চলে, সে আমার মুরিদ না’।
ইবাদাত—বান্দেগী ও তরীক্বতের ছবক প্রদান—
কুরআনের পবিত্র সূরা মুযযাম্মিলের নির্দেশ মোতাবেক এবং সুন্নতে নববীর অনুসরণে রাত জেগে ইবাদত বান্দেগী করতেন। এশারের নামাজের পর অজিফা শেষ করে কিছু সময় বিশ্রাম করে রাতের অর্ধাংশ মাঝেমাঝে সারারাত ইবাদত বান্দেগীতে রত থাকতেন। প্রতি সকালে নিয়মিত কুরআন তেলাওয়াত করতেন। ফজর, জোহর এবং মাগরিবের নামাজ শেষে ছালেক মুরিদানদের রূহানি অবস্থা পর্যালোচনা করে ছবক বাড়িয়ে দিতেন; প্রয়োজনবোধে ছবক আদায়ের তরতিবের রদবদল করে দিতেন। আল্লাহর পক্ষ হতে ইলহামকৃত অজিফাসমূহ নিয়মতিভাবে আদায় করতেন। মাসের প্রায়সময় নফল রোজা রাখতেন। তিনি উচ্চ পযার্য়ের তাক্বওয়াবান ও ঈমানদার ব্যক্তি ছিলেন। এদের প্রসঙ্গে আল্লাহ তা’লা বলেন, ‘‘নিশ্চয়! আল্লাহর ওলিগণ দুনিয়া ও আখেরাত নিয়ে চিন্তিতও নন, এমনকি পেরেশানও নন।” তিনি ছিলেন আল্লাহর প্রকৃত আশেক এবং রাসূল (দ.)’র সত্য তরিকা ও সুন্নতের ধারক—বাহক। শিশু বয়স থেকেই তিনি নিয়মিত নামাজ আদায় করতেন। কুরআন তেলাওয়াত, জিকির—আজকার, মুরাক্বাবা—মোশাহেদা, তাহাজ্জুদ, অজিফা, তসবিহ—তাহলীল, কুরআন ও হাদিসের আলোকে বয়ান ও নসীহতে সময় কাটাতেন। বেহুদা কোন কাজ বা কথা বলতেন না। দিনরাত্রি অশ্রম্নসিক্ত নয়নে আল্লাহ ও রাসূল (দ.)’র প্রেমে বিভোর হয়ে থাকতেন। তাঁর অন্তর এবং জবান থাকত আল্লাহর জিকিরে অবিশ্রান্ত। দিনে—রাতে, শয়নে—স্বপনে, নিন্দ্রায়—জাগরণে তিনি আল্লাহর ধ্যানে সময় কাটাতেন। তিনি রাতব্যাপী ক্বিয়ামুল লাইল তথা ইবাদত বান্দেগীতে মশগুল থাকতেন। তন্দ্রাচ্ছন্ন হলে ঘুমিয়ে পড়তেন জাগ্রত হলে আবার ওজু বা তায়াম্মুম করে পুনরায় ইবাদতে মশগুল শামিল হতেন।
কাশফ ও কারামত—
তাঁর রূহানি ছোঁয়াতেই মানুষের মরা ক্বলবে মুহূর্তের মধ্যেই ‘আল্লাহ’ ‘আল্লাহ’ জিকির জারি হতো। তাঁর প্রশস্ত অন্তরে ছিলো আল্লাহর গুপ্ত রহস্যে ভরা, ইলমে লাদুন্নীর মত দুর্লভ জ্ঞান। তাঁর থেকে অগণিত কারামত প্রকাশিত হয়েছে, যা অবর্ণনীয়।
দ্বীনি খেদমত ও মানবসেবা —
সুন্নতি পদ্ধতিতে পরিবার—পরিজন, আত্মীয়—স্বজন, পাড়া—প্রতিবেশী, ভক্ত—আশেকদের খোঁজখবর রাখতেন। অন্যের বিপদে ঝাঁপিয়ে পড়তেন। রোগীদের অর্থ প্রদান বা বিভিন্নভাবে সেবা প্রদান করতেন। দেনাগ্রস্থদের কর্জমুক্ত হতে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিতেন। কন্যাদায়গ্রস্থদের আর্থিকভাবে সহযোগিতা করতেন। অভাবী ও গরীব মানুষদের ঘর—বাড়ী মেরামত ও নিমার্ণের জন্য সাহায্য করতেন। মানুষের দুঃখ—কষ্ট দেখলে অকাতরে সাহায্য করতেন এবং মানুষের বিপদ লাঘবের জন্য আল্লাহর দরবারে দোয়া করতেন। মানুষের চিকিৎসা সেবা নিশ্চিতকরণে এনায়েতপুর গ্রামে ডাক্তারখানার ব্যবস্থা করেছিলেন। পরবতীর্তে তাঁর নির্দেশনায় সিরাজগঞ্জের এনায়েতপুর গ্রামে ‘খাজা ইউনুছ আলী মেডিকেল কলেজ অ্যান্ড হাসপাতাল’ নামে একটি হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করা হয়। অভুক্ত লোকজন, মেহমান ও ভক্ত—আশেকানদের বিনামূল্যে আপ্যায়নের জন্য একটি লঙ্গরখানা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। বেলা নয়টা—দশটা এবং বাদে আছর সবার মাঝে খাবার পরিবেশন করতেন। রাতের খাবার গ্রহণ করাকে এবাদাতের অন্তরায় মনে করতেন। যা এখনও চালু আছে। ভবিষ্যত সম্পর্কে আল্লাহ তা’লা ভালো জানেন।
হজরত কেবলার দৃষ্টিতে শিক্ষিত সমাজ —
আল্লাহর এ মহান কুতুব, শিক্ষিত সমাজ এবং আলেম সমাজকে বেশ সম্মান করতেন।
মুসলিম জাতির কল্যাণে দোয়া মাহফিল—
মুসলিম উম্মাহর ঈমানী চেতনাকে উজ্জীবিত রাখার জন্য; রাসূলে করিম (দ.)’র নির্দেশে ওরস মাহফিল চালু করেছিলেন, যা ১০৮ বছর ধরে চলমান আছে। অদূর ভবিষৎ সম্পর্কে আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (দ.) ভালো জানেন। এ অনুষ্ঠানে সমস্ত নবী—রাসূল (আ.), আহলে বায়তে রাসূল (দ.), নবী করিম (দ.)’র বিবিগণ, সাহাবায়ে ক্বেরাম, আলেম—ওলামা, পীর—দরবেশ এবং সমস্ত মুসলমান নর—নারীর জন্য বিশেষ দোয়া করা হয়।
আল্লাহ পাকের শোকর গুজারী—
একটি খেজুর অথবা অর্ধাংশ খেজুর দ্বারা ইফতার ও সেহরী সমাধা করতেন। রোজাদার না হলে যৎকিঞ্চিৎ আহার করতেন আবার মাঝেমাঝে যৎকিঞ্চিৎ পানি ব্যতিত দিনের পর দিন কিছুই আহার করতেন না। তাঁর সম্মুখে খাবার পরিবেশন করা হলে আল্লাহর শুকর গুজারি করে শাহাদাত আঙ্গুলী নিমজ্জিত করে অঙ্গুলটি চুষয়ে নিতেন।
রাজনৈতিক চিন্তা-
যদিও তিনি রাজনীতির সাথে সরাসরি সম্পৃত্ত না থাকলেও সমসাময়িক বিশ্বব পরিস্থিতি সম্পর্কে অবগত থাকতেন। বৈশ্বিক রাজনীতি, সমাজনীতি ও অর্থনীতির খবরাখবর রাখতেন। কঠিন পরিস্থিতি সমাধানের জন্য এবং মুসলিম জাতির বিজয়ের জন্য সবসময় আল্লাহর দরবারে দোয়া করতেন। দোয়া হচ্ছে মুমিনদের জন্য অস্ত্র স্বরূপ। প্রয়োজনবোধে আল্লাহর শক্তির ফয়েজ জারি করে সমস্যা সমাধান করতেন।
ইসলামিক স্কলার ও চিন্তাবিদ—
আল্লাহ তা’লার ঘোষণা মতে তিনি যাঁর মঙ্গল চান; তাঁকে দ্বীনের জ্ঞান দান করেন। এ সূত্র ধরে বলা যায়— এ মহান মনীষী দুটি জ্ঞান অর্জন করেছিলেন একটি কুরআন—হাদিস ও ইজমা—ক্বিয়াস, অন্যটি ছিলো— আল্লাহ প্রদত্ত্ব নিগৃঢ় রহস্যময় জ্ঞান। এ জ্ঞান অত্যন্ত দুর্লভ ও ইন্দ্রিয় বহিভূর্ত জ্ঞান। প্রকৃত পক্ষে, অন্তরচক্ষু বিশিষ্ট ব্যক্তিরাই এ জ্ঞান লাভ করতে পারে। এ জ্ঞান দুনিয়ার কোন প্রতিষ্ঠানে পাওয়া যায়না। এ জ্ঞান শুধুমাত্র আল্লাহর প্রিয় বান্দা মকবুল অলি—আউলিয়ার সিনার মধ্যে নিহিত থাকে। এ জ্ঞানের সংযোগস্থল সরাসরি হজরত মুহাম্মদ সা.’র নূরানী সিনা মুবারকের সাথে সম্পৃত্ত। অবস্থার প্রেক্ষিতে এ দু’টি জ্ঞান তিনি জাতি—ধর্ম—বর্ণ নির্বিশেষে সকলের মাঝে বিতরণ করতেন। তবে ইলমে মারেফতের জ্ঞান শুধুমাত্র আল্লাহ ও তাঁর প্রিয় রাসূল দ. তালাশকারীদের মাঝে বিতরণ করতেন। আল্লাহর ইশারা ব্যতিত কোন কথা বলতেন না। প্রতিটি কথা ছিলো কুরআন ও হাদিসের রেফান্সযুক্ত। মনগড়া কোন কথা বা নীতিবাক্য করতেন না। কথার ফাঁকে ফাঁকে কুরআন—হাদিস ও আল্লামা রুমীর কবিতা উদ্ধৃতি পেশ করতেন। তাঁর প্রতিটি কথায় মুক্তা ঝড়ত।
মুরিদানদের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি—
তাঁর কাছে আগত ভক্ত—মুরিদান—মুহিব্বিনদের তিনি যথেষ্ট সমাদর করতেন। সকলকে বাবা! বলে সম্বোধন করতেন। মুরিদানদের রূহানী সন্তান হিসেবে আখ্যায়িত করতেন। তাঁদের সন্তানতূল্য মনে করতেন। তাঁদেরকে কেউ অন্যায়ভাবে বকাবকি বা প্রহার করলে তিনি খুবই ব্যথিত হতেন।
স্বভাব-চরিত্র—
হজরত কেবলা ছিলেন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম—এর জাহের এবং বাতেন গুণে পূর্ণ গুণান্বিত মহাপুরুষ। তাঁর মুবারক চেহারায় হামেশা নূর চমকাত। তিনি যে কোন কাজে, চলা ফেরায়, ইবাদত বন্দেগীতে হুজুর পুরনূর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর সুন্নতের পূর্ণ অনুসরণ করে চলতেন। তাঁর স্বভাব ছিল অতিশয় কোমল ও নম্র। শিক্ষিত অশিক্ষিত ইতর ভদ্র সকলেই তাঁর কাছে এসে শান্তি লাভ করতো। তিনি এমন সৎ স্বভাবের অধিকারী ছিলেন যে, শত্রুও তাঁর আচরণে কষ্ট পেতনা বরং শান্তি বোধ করতো। সত্যবাদিতা, পরহেজগারিতা, ধৈর্যশীলতা, পরোপকারিতা, ন্যায়পরায়ণতা, সরলতা, কোমলতা, বদান্যতা, একনিষ্ঠতা, একাগ্রতা, দৃঢ়তা, স্বচ্ছতা, দানশীলতা, পরিচ্ছন্নতা, সৌজন্যতা, নম্রতা, ভদ্রতা সবোর্পরি উত্তম আখলাকে পরিপূর্ণ ছিলো এ মহান মনীষীর জীবন। তিনি গরীবি হালতে অতিসাধারণ জীবনযাপনে অভ্যস্ত ছিলেন।
ইন্তেকাল—
বিংশ শতাব্দীর এ মহান আধ্যাত্মিক রাহবার ২রা মার্চ ১৯৫২ খ্রিষ্টাব্দ, ১৩৫৮ বঙ্গাব্দ ১৮ই ফাল্গুন, ৫ই জমাদিউস সানী ১৩৬৮ হিজরীর রোজ রবিবার বেলা ১২টা ১৫ মিনিটে ৬৪ বছর বয়সে অসংখ্য তরিকত অনুসন্ধানী ও দ্বীনের দাঈয়ী রেখে চিরদিনের জন্য আল্লাহর সান্নিধ্যে চলে যান। পূর্ববঙ্গের স্মরণকালের ইতিহাসে বৃহত্তর জানাজা ছিলো তাঁর। হে আল্লাহ! আপনার এ প্রিয় বান্দার মত জীবন গড়ার তৌফিক দান করুন, তার রূহানী ফয়ুজাত নসীব করুন।