আশেকে রাসূল হযরত ওয়াইসী (রহ.)
মুমিনের জন্য ভালোবাসার মূল কেন্দ্র প্রাণাধিক প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম। তাঁর প্রতি ইশক মহব্বত রাখাই ঈমান। আল্লাহ তাআলা বান্দার জন্য তাঁর ভালোবাসা লাভে প্রিয় নবীর প্রতি গভীর প্রেম ও অনুসরণকেই ঈমানের পূর্বশর্ত করেছেন। প্রকৃত মুমিন হতে হলে দুনিয়ার সব কিছু থেকে হুজুর পূরনূর (সা.)-কে বেশি ভালবাসতে হবে। কেননা, দুনিয়াতে ভালোবাসার যতো কিছু আছে তার সবই তাঁর কারণে প্রেমময়। হযরত জালাল নূরী আল্ সুরেশ্বরী (রহ.) তাঁর জীবনকাব্যে লিখেছেন-
এ সুন্দর ভূবনে তুমি হে প্রিয় নবী
সৃষ্টির সেরা তাই রাসূলে রাব্বাী।
না হইলে প্রেম তব না হইত ধরা
এ বিশ্ব প্রেমময়, তাইতো আমরা।
মুমিনের জীবনে প্রিয় নবী (সা.)-এর প্রতি মহব্বতের গুরুত্ব অপরিসীম। মহব্বতে রাসূল ঈমানের রূহ, মুমিনের জীবনের অন্যতম লক্ষ্য। এই ইশ্ক ও মহব্বত ছাড়া ঈমানের পূর্ণতা আসবে না। আল্লাহর প্রিয় হাবীব রাসূল (সা.) বলেছেন, তোমাদের কেউ ততক্ষণ পর্যন্ত মুমিন হতে পারবে না, যতক্ষণ না আমি তার নিকট তার পিতা-মাতা, সন্তান-সন্ততি ও সমস্ত মানুষ থেকে অধিক প্রিয় হব।
যুগে যুগে অলি-আউলিয়া, গাউস, কুতুব, সিদ্ধপুরুষগণ প্রিয় নবী (সা.)-এর ইশক, মহব্বতে ব্যাকুল হয়ে জীবন উৎসর্গ করেছেন। তাদের অন্যতম হচ্ছেন, জগদ্বিখ্যাত অলিয়ে মুকাম্মেল, কুতুবুল এরশাদ রাসূলনোমা হযরত শাহ্ সূফী সাইয়্যেদ ফতেহ আলী ওয়াইসী (রহ.)। তিনি চট্টগ্রাম জেলার চুনতি গ্রামে ১৮২৫ খৃষ্টাব্দ মোতাবেক ১২২৩ বঙ্গাব্দে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁহার পিতার নাম হযরত মাওলানা সাইয়্যেদ ওয়ারেস আলী শহীদ (রহ.)।
রাসূলনোমা হজরত ওয়াইসী (রহ.) সদা-সর্বদা রাসূল (সা.)-এর প্রেমে বিভোর থাকতেন। সাধনা জীবনের সূচনায় কোনো এক সময় দীর্ঘদিন তার সঙ্গে হজুর পূরনূর (সা.)-এর সাক্ষাৎ (দিদার) না হওয়ায় তিনি বিরহ-বিচ্ছেদে অস্থির হয়ে হুগলী নদীতে আত্মোৎসর্গ করতে চেয়েছিলেন। অবশেষে রাহমাতাল্লিল আলামীন দয়াল নবীজি (সা.) হাজির হয়ে তাকে সান্তনা দান করেন এবং তাঁর নিবেদন স্মরণ করা মাত্রই সাক্ষাৎ দিতে সম্মতি জ্ঞাপন করেন।
উক্ত ঘটনাই প্রমাণ করে হযরত ফতেহ আলী ওয়াইসী (রহ.) কত উঁচুস্তরের আশেকে রাসূল ছিলেন। তিনি রাসূল (সা.)-এর জীবনাদর্শের ধারক ও বাহক ছিলেন। রাসূল পাক (সা.)-এর প্রতি ইশক মহব্বতের নিদর্শনস্বরূপ তিনি দুর্লভ ‘রাসূলনোমা উপাধি লাভ করেন। এর অর্থ হল যিনি সদা-সর্বদা রাসূল পাক (সা.)-এর দিদার লাভ করেন এবং অন্যকে ও দেখাতে পারেন।
তিনি বাঙালির সন্তান হয়েও রাসূল (সা.)-এর প্রেমে বেহুল বেকারার হয়ে ফারসি ভাষায় ‘দিওয়ানে ওয়াইসী’ কিতাব রচনা করেছেন। যার প্রতিটি শব্দ অসংখ্য নিবেদিত প্রাণ মোতিপূর্ণ ঝিনুক, প্রতিটি হরফে হাজারো মূল্যবান হীরা-চুন্নী এবং চমকিত উন্নত রত্ন খচিত রয়েছে। নবী প্রেমে নিঃসৃত প্রত্যেকটি গজল ও কাসিদা সবাইকে মুগ্ধ করে। গ্রন্থটিতে রয়েছে ১৭৫টি গজল এবং ২৩টি কাসিদা। এর প্রথম গজলের প্রথম দু’টি লাইনে তিনি লিখেছেন-
মাশরেকে হুব্বে মুহাম্মদ মাতলায়ে দিওয়ানে মা,
মাতলায়ে খুরশিদে এশকেশ সিনায়ে সুজানে মা ॥
অর্থ : মুহাম্মদ (সা.)-এর প্রেমের আলোতেই আমার কাব্যের সূচনা,
তার প্রেমের সূর্যোদয়েই আমার মনের জ্বালা-যন্ত্রণা ॥
তিনি প্রথম গজলের শেষ দু’টি লাইনে লিখেছেন-
ওয়াইসিয়া আয দ্বীন ও ঈমা ই কদর দানিম ও বস
দ্বীনে মা ইশকে মুহাম্মদ হুব্বে উ ঈমানে মা
অর্থ : হে ওয়াইসী! দ্বীন ও ঈমান সম্পর্কে এতটুকু জানি এবং তাই যথেষ্ট যে,
আমাদের দ্বীন হল মুহাম্মদ (সা.)-এর ইশক ও তার প্রতি প্রেমই হচ্ছে আমাদের ঈমান।
এভাবে তিনি রাসূল পাক (সা.)-এর নূরানী সত্তার প্রেমে বিগলীত হয়ে হৃদয়ের আর্তনাদকে বাহ্যিক রূপ দিয়েছেন।
নবী প্রেমের অফুরন্ত ভা-ার পবিত্র দিওয়ানে ওয়াইসী কাব্যগ্রন্থটি বিশুদ্ধ বর্ণনার স্থপতি, প্রতিটি ছত্র উচ্চস্তরের বিশুদ্ধ কালামের প্রতিশ্রুতির কষ্ঠিপাথর। গ্রন্থের প্রতিটি পঙ্ক্তি, শব্দ ও ছত্রে রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর প্রেমের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত ফুটে উঠেছে। যা পাঠ করে যে কেউ নিঃসন্দেহে রাসূল (সা.)-এর প্রকৃত আশেক ও প্রেমিক হতে পারবেন ইনশাআল্লাহ্।
এই মানব শ্রেষ্ঠ কোতবোল ইরশাদ রাসূলনোমা হযরত ওয়াইসী (রহ.) ৬৩ বছর বয়সে ১৮৮৬ খৃঃ ৬ই ডিসেম্বর মোতাবেক ২০শে অগ্রহায়ণ ১২৯৩ বাংলা ইন্তিকাল করেন। কলিকাতার মানিকতলায় মুন্সিপাড়া লেন, লালা বাগানে তাঁহার রওজা মোবারক অগনিত তরিকত পন্থীর জিয়ারতস্থান। প্রতি বৎসর তাঁর ইন্তিকাল দিবস উপলক্ষে এই স্থানে পবিত্র উরস মোবারক উদযাপিত হয়। প্রতি বছরের ন্যায় এ বছর ৬ ডিসেম্বর বুধবার সাতগাঁও সুরেশ্বরীয়া দরবার শরীফ, সাতগাঁও, শ্রীনগর, চৌধুরী রোড (ঢাকা মাওয়া মহাসড়ক সংলগ্ন) হযরত ওয়াসাইসীপাক (রহ.)-এর ১৩৬তম পবিত্র উরস মাহফিল উদযাপিত হবে।
লেখক: আব্দুল হাকিম সুরেশ্বরী।