মসনবী শরীফ পর্ব – ১১ : মাওলানা জালালউদ্দিন রুমি (রহ:)

মসনবী শরীফ পর্ব-১১

[বাংলা এই ভাবানুবাদ বরিশাল থেকে প্রায় ৫০ বছর আগে প্রকাশিত। এই দুর্লভ সংস্করণটি সরবরাহ করেছেন সুহৃদ (ব্যাংকার) নাঈমুল আহসান সাহেব।  সম্পাদক – কাজী সাইফুদ্দীন হোসেন]

দর একে গোফ্‌তাহ মকোশ ইঁ শামেয়রা,
কা ইঁ নজর চুঁ মামেয় আমদ জমেয় রা।
আজ নজর চুঁ বোগজারী ও আজ খেয়াল,
কোশতাহ্‌ বাশী নিমে শবে শামায় বেছাল।
দর একে গোফ্‌তাহ বকুশ বাকে মদার,
তা ইওজে বীনি একেরা ছদ হাজার।
কে জে কুস্তানে শামেয় জানে আফজুঁ শওয়াদ,
লাইলাতে আজ ছবরে তু মজনুন শওয়াদ।
তরকে দুনিয়া হরকে করদ আজ জোহদে খেশ,
বেশে আমদ পেশে উ দুনিয়াও পেশ।

অর্থ: অন্য এক জায়গায় লিখিয়াছে, নিজের মধ্যে যে শক্তি ও খেয়াল আছে, ইহা দূর করিও না। কেননা, ইহা মোমবাতির আলোর ন্যায়, ইহা বন্ধ করিয়া দিও না। যদি বন্ধ কর, তবে ঐ ব্যক্তির ন্যায় হইবে, যে ব্যক্তি মাশুকের সাথে মিলনের রাত্রে অর্ধ রাত্রিতে আলো নিভাইয়া ফেলিয়া দিয়াছে; যে আলো দিয়া মন্দ অনুমান করিয়া নিবে, উহা দূর করিয়া দিলে কেমন করিয়া সে আসল উদ্দেশ্য লাভ করিবে। অতএব, তোমাদের মধ্যে যে বুদ্ধি জ্ঞান আছে তাহা দূর করিও না। অন্য এক স্থানে লিখিয়া দিয়াছে, যে ব্যক্তি নিজের ইচ্ছায় দুনিয়া ত্যাগ করিয়াছে, সে এক দুনিয়ার পরিবর্তে লাখো দুনিয়া প্রাপ্ত হইয়াছে। অতএব, তুমি নিজের বুদ্ধি ও খেয়াল ত্যাগ করিতে মোটেও ভয় করিও না। কারণ, তুমি এই আকল ও বুদ্ধি ত্যাগ করিতে পারিলে লাখো গুণ বেশী মূল্যবান বস্তু পাইবে। অর্থাৎ, বুদ্ধি ত্যাগ করিতে পারিলে ভবিষ্যতে ইল্‌হাম পাইতে পারিবে এবং যত দিন পর্যন্ত তুমি বুদ্ধি ও বিবেক ত্যাগ করিয়া স্থায়ী থাকিতে পারিবে, ততদিন পর্যন্ত তোমার মাহবুব অর্থাৎ তোমার খোদা তোমার উপর সন্তুষ্ট থাকিবেন। এইটা হইল দ্বিতীয় নেয়ামত। যে ব্যক্তি নিজে চেষ্টা ও মেহনত করিয়া দুনিয়া ত্যাগ করিতে পারিবেন, সে নিজের কাছে দুনিয়াকে আরো বেশী পাইবে। এইভাবে জ্ঞান ত্যাগ করিতে পারিলে, ইহার বিনিময়ে অধিক মূল্যবান বস্তু পাইতে পারিবে। যেমন, খোদার তরফ হইতে ইলহাম প্রাপ্ত হওয়া, খোদার মাহবুব হওয়া ইত্যাদি।

দর একে গোফতাহ আঁ চাত দাদে হক,
বর তু শিরীন করদ দর ইজাদে হক।
বর তু আছান করদ খোশ আঁরা বগীর
খেশতনরা দর মী গফন দর জে হীর।
দর একে গোফ্‌তাহ কে বোগজার জে আঁ খোদ
কা আঁ কবুলে তাব্‌য়া বুদে তু জেস্তাস্ত ও বাদ।
রাহ্‌ হায়ে মোখতালেফ আছান শোদাস্ত,
হর্‌ একে রা মিল্লাতে চুঁ জানে শোদান্ত।
গার মাইয়াচ্ছার করদানে হক রাহ্‌ বুদে,
হর জহুদো গবার আজু আগাহ্‌ বুদে।
দর একে গোফ্‌তাহ মাইয়াচ্ছার আঁ বুদ,
কে হায়াতে দেল গেজায়ে জানে বুদ।
হরচে জওকে তাব্‌য়া বাশদ চু গোজাস্ত,
বর নাইয়ারাদ হামচু শুরাহ্‌ রীয়ে ওকাস্ত।
জুজ পেশেমানী নাবাশদ রীয়ে উ,
জুজ খেছারাত পেশে না আরাদ বায়ে উ।
আঁ মাইয়াচ্ছার না বুদ আন্দর আকেবাত,
নামে উ বাশদ মোয়াচ্ছার আকেবাত।
তু মোয়াচ্ছোর আজ মুইয়াচ্ছার বাজে দাঁ,
আকেবাত বেংগার জামালে ইঁ ও আঁ।

অর্থ: এক কপিতে লিখিয়াছে, আল্লাহতায়ালা তোমাকে যে সমস্ত বস্তু দান করিয়াছেন, সবই তোমার জন্য হালাল। খোদাতায়ালা যাহা তোমার জন্য সহজ করিয়া দিয়াছেন, তুমি তাহা সন্তুষ্ট চিত্তে গ্রহণ কর। উহা ত্যাগ করিয়া নিজেকে বিপদগ্রস্ত করিও না। অন্য এক জায়গায় লিখিয়াছে, নিজের ইচ্ছা ত্যাগ করা চাই, কেননা তোমার ইচ্ছা কবুল করা খারাপ ও পাপ। কারণ, উহা হালাল হওয়া সম্বন্ধে কোন দলীল নাই। যদি শুধু কোনো বস্তু নিজের আত্মার কাছে সহজ বলিয়া মনে হওয়াই হালাল হওয়ার প্রমাণ হয়, অথবা সুন্দর হওয়া প্রমাণ হয়, তবে দুনিয়ার সমস্ত ধর্মই সুন্দর ও সত্য বলিয়া মনে করিতে হইবে। কেননা, বিভিন্ন পথে ঐ সমস্ত ধর্মাবলম্বীদের পথ সহজ বলিয়া মনে হয়। এইজন্য প্রত্যেক ব্যক্তির নিজ ধর্ম প্রাণের তুল্য প্রিয়। তবে সব ধর্মই সত্য এবং গ্রহণযোগ্য। কিন্তু এই রকম হওয়া একান্ত ভুল। খোদাতায়ালার যদি কোনো কাজ এইরূপভাবে আসান করিয়া দেওয়া পন্থা হইত, তবে ইহুদী ধর্ম সত্য বলিয়া প্রমাণ হইয়া যাইত। যাহা সহজ, তাহাই যদি সত্য হইত, তবে দুনিয়ায় কোনো পথভ্রষ্ট থাকিত না। ইহা দ্বারা বুঝা গেল যে, কোনো বস্তু সহজ ও আসান বলিয়া মনে হওয়া গ্রহণযোগ্য বলিয়া প্রমান করা যায় না। তৃতীয় এক জায়গায় লিখিয়াছে, কোনো কাজ সহজ হওয়া এবং উহা সত্য হওয়া প্রমাণ হয়, কিন্তু ইহাতে আত্মা বা ইচ্ছার কোনো প্রভাব থাকিবে না, বরং রূহ এবং কলবের ইচ্ছার উপর নির্ভর করিবে। কলবের হিসাবে সহজ হইল হায়াত এবং রূহুর হিসাবে সহজ হইল গেজা বা খোরাক। আকল বা নফসের ইচ্ছার কোনো ধর্তব্য নাই। কারণ, ইহারা সাময়িক ভালকে ভাল মনে করে, কিন্তু ক্ষণিক পরে তাহার কোনো নাম-নিশানা থাকে না। যেমন, লোনা জমিন কষ্ট করিয়া চাষ করা যায়, ফসল জন্মে না। মেহনত বরবাদ গুণাহ লাজেম। ইহা বিক্রি করিলেও লাভ হয় না। যদিও অবস্থা দৃষ্টে মনে হয় চাষ করা অতি সহজ এবং দেখিতে অতি সুন্দর, শেষ ফল ক্ষতিগ্রস্থ ও লজ্জিত হওয়া ব্যতীত কিছুই লাভ করা যায় না। তুমি সহজ ও কঠিনকে পার্থক্য করিতে শিক্ষা কর, এবং পরিণতির দিক দিয়া কোনটা ভাল ও মন্দ বুঝিতে চেষ্ট কর, তারপর তুমি ভালমন্দ বুঝিতে পারিবে।

দর একে গোফ্‌তাহ কে উস্তাদে তলব,
আকেবাত বীনি নাবাইয়াদ দর হছব।
আকেবাত দীদান্দ হর গোঁ মিল্লাতে,
লা জরাম গাস্তান্দ আছীরে জিল্লাতে।
আকেবাত দীদান নাবাশদ দস্তে বাফ্‌
ওয়ার না কায়ে বুদে জেদীনে হা ইখ্‌ তিলাফ।
দর একে গোফ্‌তাহ কে উস্তাহাম তুই,
জাঁকে উস্তারা শেনাছা হাম তুই।
মরদে বাশ ও ছোখ্‌রায়ে মরদা মশো,
রুছারে খোদগীর ওছারে গরদান মশো।
চশমে বর ছাররাতে ব দার ও আজ খেলাফ,
দূরে শো তা ইয়াবি আজ হক্কে ইতেলাফ।

অর্থ: এক নোছখায় লিখিয়াছে, শেষ ফল বুঝিবার শক্তি অর্জন করার জন্য উস্তাদ ধর। কেননা, উস্তাদ ব্যতীত পরিণতি বুঝিবার শক্তি অর্জন করা যায় না। শুধু বংশীয় ফজিলত ও বিদ্যা শিক্ষা করিলে পরিণতি সম্বন্ধে জ্ঞান অর্জন করা যায় না। প্রত্যেক ধর্মের বিশ্বাসী ধার্মিকগণ নিজেদের ধর্মের পরিণতি সম্বন্ধে নবীদের অনুসরণ ছাড়া বিশেষ এক পদ্ধতি বাহির করিয়া লইয়াছে। যাহাতে তাহারা শেষ পর্যন্ত লজ্জিত ও অপমাণিত হইয়াছে। কিন্তু সত্য প্রকাশ পায় নাই। পরিণতি চিন্তা-ভাবনা করিয়া দেখা সহজ কাজ নয়। তাহা না হইলে ধর্মসমূহের মধ্যে এত মতানৈক্য সৃষ্টি হইত না। অতএব, একজন পথপ্রদর্শকের আবশ্যক। আর এক জায়গায় লিখিয়া দিয়াছে, উস্তাদ কী? তুমি নিজেই উস্তাদ। নিজে খুব চিন্তা ভাবনা করিয়া কাজ করো। কেননা শেষ পর্যন্ত তুমি-ই ত উস্তাদ পছন্দ করিয়া লইবে। যদি তোমার পছন্দ-ই ঠিক না হয় তবে তোমার উস্তাদ পছন্দ করাও ঠিক হইবে না। তবে কেমন করিয়া উস্তাদ পছন্দ করিয়া লইবে। অবশেষে তোমার চিন্তা-ই যদি ঠিক হয় এবং গ্রহণযোগ্য হয়, তবে উস্তাদের আবশ্যক কী? উস্তাদের অনুসরণ করিতে হইবে কেন। অতএব, দৃঢ় সংকল্পবদ্ধ ব্যক্তি হও, অপরের মুখাপেক্ষী হইও না। নিজের অভিজ্ঞতা অনুযায়ী কাজ করো। পথ প্রদর্শক তালাশ করিতে কষ্ট করিও না। নিজের অন্তঃকরণের মতানুযায়ী কাজ করো। উহার বিরুদ্ধে কোনো কাজ করিও না। তাহা হইলে আল্লাহর প্রিয় বান্দা হইতে পারিবে।

দর একে গোফ্‌তাহ কে ইঁ জুমলা তুই,
মী নাগোঞ্জাব দরমীয়ানে মা দুই।
ইঁ হামা আগাজে মা ও আখের একে ইস্ত,
হরকে উ দো বীনাদ আহ্‌ওয়ালে মরদে কীস্ত।
দর একে গোফ্‌তাহ কে ছদ এক চুঁ বুদ,
ইঁ কে আন্দেশাদ মাগার মজনুন বুদ।
হরি একে কওলিস্ত জেদ্দে এক দীগার,
ইঁ বজেদ্দে উ জে পায়ানে তা বছার।
চু একে বাশদ বগো জহর ও শাক্কর
মোখ্‌তাফে দর মায়নি ওহাম দর ছুর।
দর মায়ানি ইখ্‌তেলাফ ও দর ছুর,
রোজ ও শব বীঁ খার ও গোল ছংগো ও গহর।

অর্থ: এক কপিতে লিখিয়া দিয়াছে, এই বিশ্বজগতে যাহা কিছু বিদ্যমান দেখিতেছ, ইহা এবং স্বয়ং আল্লাহ এক। আমাদের মধ্যে দ্বিতীয়ের স্থান নাই। তাই আমাদের আরম্ভ এবং শেষ উভয় অবস্থা-ই এক। যে ব্যক্তি পৃথক পৃথক মনে করে, ইহা শুধু তাহার মানসিক খেয়াল। অর্থাৎ, সমস্ত সৃষ্ট বস্তু এক বলিয়া রায় দিল। অন্য এক স্থানে লিখিয়া দিয়াছে, শত শত বস্তু কেমন করিয়া এক হইতে পারে। পাগল ব্যতীত এমন কথা কেহ চিন্তাও করিতে পারে না। প্রত্যেক কথাই একে অন্যের বিপরীত। পা হইতে মাথা পর্যন্ত একে অন্যের বিরোধী। যেমন, বাস্তবে ধরিয়া লওয়া হউক, বিষাক্ত বস্তু ও মিষ্টি; ইহারা কেমন করিয়া পরস্পর একই বস্তু হয়। নিশ্চয়ই ইহারা ক্রিয়ার দিক দিয়া এবং সুরতের দিক দিয়া পরস্পরবিরোধী। এই রকমভাবে প্রত্যেক জিনিসেই বিশেষত্বের দিক দিয়া বিভিন্ন প্রকারে বিভক্ত। যেমন, দিবা-রাত্রি, কাঁটা ও ফুল, পাথর ও মূল্যবান ধাতু প্রত্যেকেই বিশেষত্বের দিক দিয়া একে অন্যের বিরোধী।

তাজে জহর ও আজ শোক্কর দর না গোজারী,
কায়ে তু আজ গোলজার ওয়াহ্‌ দাতে বু বরী।
ওয়াহ্‌দাত আন্দর ওয়াহদাত আস্ত ইঁ মস্‌নবী,
আজ ছামাক রো তা ছামাক আয়ে মায়ানবী।

অর্থ: উপরে বস্তুসমূহের তারতম্য ও একত্বের কথা বর্ণনা করা হইয়াছে। তাই মাওলানা এখানে খোদার একত্বের কথা বলা প্রয়োজন মনে করিয়া তাওহীদের কথা বলিতেছেন, যতক্ষণ পর্যন্ত তুমি জহর ও চিনির কথা ত্যাগ করিয়া অর্থাৎ এই বহুরূপী বিশ্ব হইতে তোমার খেয়াল ফিরাইয়া আল্লাহর দিকে না ফিরাইবে, ততক্ষণ পর্যন্ত এক বাগিচার সুঘ্রাণ লইতে পারিবে না। অর্থাৎ, তাওহীদের স্বাদ গ্রহণ পারিবে না। কেননা, নফ্‌স একই সময়ে দুই দিকে খেয়াল করিতে পারে না। পরিপূর্ণভাবে আল্লাহর ধ্যান না করিলে আল্লাহর মহব্বত পাওয়া যায় না। এই মসনবী শরীফে আল্লাহর একত্ব সম্বন্ধেই বেশীর ভাগ বর্ণনা করা হইয়াছে। এই জন্য তালেবের চাই ইহ-জগতের খেয়াল ত্যাগ করিয়া উর্ধ্ব জগতের পরিপূর্ণ খেয়াল করা; তবেই তাওহীদের স্বাদ গ্রহণ করিতে পারিবে।

জী ইঁ নমতে জী ইঁ নূয়ে দাহ তুমার ও দো,
বর নাবেস্ত আঁ দীনে ঈছারা আদদ।

অর্থ: এখানে মাওলানা কপিসমূহের বর্ণনা শেষ করিয়াছেন। তিনি বলেন যে, এই রকম ভাবে ঐ দুশমনে ঈসায়ী ধর্মের বারো কপি লিপিবদ্ধ করিয়া দিয়াছে।

দেখিতে বিভিন্ন পথ, প্রকৃত পক্ষে বিভিন্ন পথ নয়-ইহার বর্ণনা

উজে একে রংগী ঈছা বু নাদাস্ত
ওয়াজ মেজাজে খানু ঈছা আখু নাদাস্ত।
জামায়ে ছদ রংগে আজাঁ খামে ছাফা,
ছাদায়ে ও এক রংগে পাস্তি চুঁ জিয়া।
নিস্তে এক রংগী কাজু খীজাদ মালাল,
বাল মেছালে মাহী ও আবে জেলাল।
গারচে দর খুশ্‌কী হাজারাঁ রংগে হাস্ত,
মাহীয়াঁ রা বা পেইস্ত জংগে হাস্ত।

অর্থ: মাওলানা বলেন, ঐ ইহুদী উজিরের অজ্ঞতা বশতঃ হজরত ঈসা (আ:)-এর খোদার একত্ব প্রচার সম্বন্ধে কোনো জ্ঞান ছিল না এবং ঈসা (আ:)-এর বাতেনী বিদ্যার খবর রাখিত না। তাহা না হইলে ঈসা (আ:) যে মুসা (আ:)-এর বিরুদ্ধে লোকদিগকে শিক্ষা দেন না তাহা বুঝিত। বরং হজরত ঈসা (আ:) ও মুসা (আ:) একই পথে লোকদিগকে ডাকিতেন। হজরত ঈসা (আ:) নানা প্রকার মতের লোকদিগকে এক তাওহীদের পথে আনিতেন। যেমন, আলো প্রকৃতপক্ষে এক রংয়ের হয়। অনুভব করার দিক দিয়া অনেক প্রকার দেখা যায়। সর্বদা একই অবস্থায় থাকিলে লোকেরা মনে বিরক্তি বা অসুস্থতা বোধ করে। তাই মাওলানা বলিতেছেন এই এক রং এমন এক রং নয়, যাহাতে লোক অশান্তি মনে করে, বরং ইহার উদাহরণ যেমন মাছ এবং মিঠা পানি। মিঠা পানিতে মাছ সর্বদা বাস করিতে ভালোবাসে, কোনো সময়ই অশান্তি মনে করে না। যদিও স্থলে নানা প্রকার রং আছে, তথাপি মাছ কোনো সময় স্থলে তথা শুকনায় বাস করিতে পারে না। এইরূপভাবে তাওহীদপন্থীরা সব সময়ে আল্লাহর পথে থাকিতে ভালোবাসেন। আল্লাহর সাথে যোগাযোগ রাখিতে কোনো সময়েই তাঁহারা অশান্তি বা কষ্ট বোধ করেন না।

কীস্তে মাহী চীস্তে দরিয়া দর মেছাল,
তা বদাঁ মানাদ মালিকে আজ্জোজাল।
ছদ হাজারাণে বহর ও মাহী দর অজুদ,
ছেজদাহ্‌ আরাদ পেশে আঁ দরিয়ায়ে জুদ।

অর্থ: উপরে আল্লাহর তাওহীদকে সাগরের সহিত তুলনা করা হইয়াছে। কেহ আবার কম বুদ্ধির দরুণ আল্লাহকে সাগরের ন্যায় না বুঝিয়া বসে। এই জন্য এখানে মওলানা বলিতেছেন, সাগরের সাথে আল্লাহর মারেফাতের তুলনা খাটে না। কেননা, বিশ্বের সমস্ত সাগর একত্রিত করিয়া উহার ন্যায় আরো হাজার হাজার সাগর বিদ্যমান হইলেও খোদার সম্মুখে নগণ্য বলিয়া মনে হইবে। শুধু আংশিকভাবে কোনো এক দিক দিয়া আল্লাহর তাওহীদকে সাগরের সহিত তুলনা করা হইয়াছে। এই রকমভাবে কোনো কোনো আরেফ লোক আল্লাহতায়ালাকে সূর্য অথবা সাগর বা অন্যান্য বস্তুর সহিত তুলনা করেন। ঐরূপ তুলনা সর্ব দিক দিয়া করা হয় না। কোনো বিশেষ সম্বন্ধের জন্য করা হয়।

চান্দে বারাণে আতা বারাণে শোদাহ,
তা বদাঁ আঁ বহর দূর আফ্‌শা শোদাহ।
চান্দে খুরশীদ করমে আফ্‌রুখতাহ,
তাকে আবর ও বহরে জুদে আমুখতাহ্‌।
চান্দে খুরশীদ করমে তাবাঁ শোদাহ্
তা বদাঁ আঁ জররাহ ছার গরদান শোদাহ্‌।
পর তু দানেশ জাদাহ্‌ বর আব ও তীন,
তা শোদাহ দানা পেজী রান্দাহ জমীন।
খাকে আমীন ও হরচে দরওয়ে কাস্তী,
বে ভেয়ানাত জেছে আঁ পর দাস্তী।
ইঁ আমানাত জাঁ আমানাত ইয়াফতাস্ত,
কা আফতাবে আদলে বরওয়ারে তাফতাস্ত।
তা নেশানে হক নাইয়ারাদ নও বাহার,
খাকে ছেররেহা রা না করদাহ আশেকার ।
আঁ জামাদে কো জামাদে রা বদাদ,
ইঁ খবরে হা ও ইঁ আমানাত ওয়াইঁ ছাদাদ।
আঁ জামাদ আজ লুৎফে চুঁ জানে মী শওয়াদ,
জেমহ্‌রীর কহর পেন্‌হা মী শওয়াদ।
আঁ জামাদে গাস্তে আজ ফজলাশ লতিফ,
কুল্লু শাইয়েম্‌ মেন জরীফেন হু শরীফ।
মর জামাদে রা কুনাদ ফজলাশ খবীর,
আকেলারা করদাহ্‌ কাহার আও জরীর।

অর্থ: এখানে মাওলানা আল্লাহ্‌ জাল্লাশানুহুর আজমাত ও সমস্ত মাখলুকাতের তাঁহার দিকে মুখাপেক্ষী হওয়ার কথা বর্ণনা করিতেছেন; সমুদ্র আমাদিগকে মুক্তা দেয় এই ক্ষমতা আল্লাহতায়ালা ইহাকে রহমতের বৃষ্টি দান করিয়া দিয়াছেন। অতএব, সমুদ্রকে মুক্তা দান করার গুণ আল্লহ্‌তায়ালার দানের ফায়েজের বরকত। দরিয়া এবং মেঘ আমাদিগকে যে পানি দান করে, এই দানের ক্ষমতা আল্লাহ্‌তায়ালা মেহেরবানী করিয়া ইহাদিগকে তাপ দান করিয়াছেন, সেই দরুন ইহারা পানি দান করার ক্ষমতা প্রাপ্ত হইয়াছে। আতএব, দরিয়া ও মেঘের দানের ক্ষমতা আল্লাহতায়ালার দানের ফায়েজের ফল। সূর্য আসমানে তপ্ততা লাভ করিয়াছে, যাহার আলোতে সমস্ত পৃথিবী আলোকিত হয়। ইহা আল্লাহর অনুগ্রহে তাঁহার তাপের ক্ষমতাপ্রাপ্ত হইয়াছে বলিয়া আলো দান করিতে শিখিয়াছে; এবং জমিন যে বীজ বপণ স্বীকার করিয়া লইয়াছে, ইহার কারণ আল্লাহ্‌তায়ালার এলেমের প্রতিবিম্ব কাদা, মাটি ও পানির উপর পতিত হইয়াছিল। অতএব, এলেমের গুণের স্বাভাবিক চাহিদা অনুযায়ী জমিন বীজ গ্রহণ করা স্বীকার করিয়া লইয়াছিল। মাটির মধ্যে যে আমানতের গুণ দেখা যায়, এই মাটি এমন আমানতদার যে, যে প্রকারের দানা বপন করিবে, সে-ই প্রকারের ফল দান করিবে। কোনো দানাকে পরিবর্তন করিয়া অন্যরকম ফল দান করিবে না। এই আমানত রক্ষার শক্তি আল্লাহতায়ালার আমানতের সেফাত হইতে প্রাপ্ত হইয়াছে। আল্লাহতায়ালা আদেল ও পূর্ণ আমানতদার। জমিন আরও একটি গুণের অধিকারী আছে, উহা হইল, আল্লাহর এলেম সম্বন্ধে সর্বদা জ্ঞাত থাকা। যেমন, আল্লাহতায়ালা যতক্ষণ পর্যন্ত বসন্ত মৌসুমের ফরমান জারী না করিবেন, ততক্ষণ পর্যন্ত জমিন শাক-সব্জী ও ফুল-ফল বাহিরে প্রকাশ করে না। আল্লাহতায়ালা এমন দাতা যে, পাথরকে এমন বিদ্যা দান করিয়াছেন, যদ্বারা সে প্রাণীদের ন্যায় হইয়া যায়। জ্ঞানে ও আমলে প্রাণীদের ন্যায় কাজ করে। আল্লাহতায়ালার মেহেরবানীর সেফাত যখন পাথরের মধ্যে প্রকাশ পায়, তখন পাথরের শক্ত ক্রিয়াও সবুজে পরিণত হইয়া যায়। অর্থাৎ, শক্ত পাথর আল্লাহর রহমতের ফায়েজের কারণে মানুষের প্রতি মেহেরবান ও দানশীল হইয়া পড়ে। যে বস্তু উত্তমের নিকট হইতে পাওয়া যায় উহা উত্তম-ই হয়।

জান ও দেলরা তাকতে আঁ জুশে নিস্ত,
বাকে গুইয়াম দর জাহাঁ এক গোশে নিস্ত।
হর কুজা গুশে বুদ আজওয়ায়ে চশমে গাস্ত,
হরকুজা ছংগেবুদ আজওয়ায়ে এশাম গাস্ত।
কেমিয়া ছাজাস্ত চে বুদ কেমিয়া,
মোজেজাহ্‌ বখ্‌শাস্ত চে বুদ ছেমিয়া।
ইঁ ছানা গোফ্‌তান জে মান তরকে ছানাস্ত,
কা ইঁ দালীল হাস্তি ও হাস্তি খাতাস্ত।
পেশে হাস্ত উ ববাইয়াদ নিস্তে বুদ,
চীস্তে হাস্তী পেশে উ কোর ও কাবুদ।
গার না বুদে কো রা আজু বগোদাখ্‌তে,
গার মী খুরশীদ রা ব শেনাখ্‌তে।
দরনাবুদে উ কাবুদ আজ তাজিয়াত,
কায়ে ফাছার দে হামচুয়েখইঁ নাহিয়াত।

অর্থ: এখানে মাওলানা আল্লাহতায়ালার কুদরতের ভেদ ও তাঁহার শান বর্ণনা করিয়া বলিতেছেন, আল্লাহ্‌তায়ালার কুদরতের ভেদ ও রহস্য বুঝিতে যাইয়া যে উত্তেজনা সৃষ্টি হয়, তাহা অন্তরে ও প্রাণে সহ্য করার শক্তি নাই। আমি কিছু ভেদ বর্ণনা করিতাম, কিন্তু কাহার নিকট বয়ান করিব, সমস্ত দুনিয়ায় একটি কানও শোনার মত নাই। যদি বলি, তবে এন্‌কার করিয়া বসিবে, তাহাতে সে কাফের হইয়া যাইবে। তাই মওলানা কবুল করার মত কানের ফজিলত সম্বন্ধে বর্ণনা করিতেছেন, যে ব্যক্তি দৃঢ় বিশ্বাসের সহিত শোনে, তাহার শোনার কান তৈয়ার হইয়া যায়, এবং ইলমে ইয়াকীন পয়দা হয়। যে অন্তর পাথরের ন্যায় শক্ত হয়, উহাও ইলমে ইয়াকীন দ্বারা শ্রবণ করিলে অন্তর নরম হইয়া কামেল হইয়া যায়। ইল্‌মে ইয়াকীন এমন বস্তু, যাহা দ্বারা প্রকাশ্যে স্বচক্ষে দেখা যায়। অসম্পূর্ণ হইতে পূর্ণতা লাভ করা যায়। ইহাও আল্লাহর কুদরতের রহস্য। তাই মাওলানা কীমিয়ার কথা বলিতেছেন, কীমিয়া প্রকৃত পক্ষে কী? উহা জাতে পাকের কুদরত। ঐ কুদরতে খোদার দরুণ অসম্পূর্ণ ব্যক্তি পূর্ণতা লাভ করে। এবং কীমিয়া প্রকৃত আল্লাহ্‌ পাকের মোজেজা দান করা। মাওলানা বলেন, নিজের তারীফ নিজে না করাই প্রশংসা। কেননা, নিজের প্রশংসা করাই নিজের অস্তিত্ব প্রমাণ করে। ফানা-ফীল্লাহ্‌র মধ্যে নিজের অস্তিত্ব থাকিতে পারে না। নিজের অস্তিত্ব থাকা দূষণীয়। ব্যক্তির অস্তিত্ব আল্লাহ্‌র সম্মুখে নিস্তি হইয়া যায়। আল্লাহর সম্মুখে যদি ব্যক্তির অস্তিত্ব বাকী থাকে, তবে মনে করিতে হইবে অন্তরের দিক দিয়া সে অন্ধ। যদি সে অন্ধ না হইত, তবে দুনিয়ার বিপদ মুসিবতে গ্রেফতার হইত না, দুনিয়ার প্রতি আকৃষ্ট হইত না। মৃতের ন্যায় অন্ধ বলিয়া খোদার তাজাল্লি দেখিতে পায় না। তাজিয়া পরিধান করিয়া দুনিয়ার ফেতনায় আবদ্ধ হইয়া পড়িয়াছে।

মসনবী শরীফ
মূল: মাওলানা জালালউদ্দিন রুমি (রহ:)
অনুবাদক: এ, বি, এম, আবদুল মান্নান
মুমতাজুল মোহদ্দেসীন, কলিকাতা আলিয়া মাদ্রাসা।

সূত্রঃ https://mishukifti.wordpress.com/

→ মসনবী শরীফ সবগুলো পর্ব

আরো পড়ুনঃ
Sufibad24.com | WhatsApp চ্যানেল

Sufibad24.com | Telegram Channel