[বাংলা এই ভাবানুবাদ বরিশাল থেকে প্রায় ৫০ বছর আগে প্রকাশিত। এই দুর্লভ সংস্করণটি সরবরাহ করেছেন সুহৃদ (ব্যাংকার) নাঈমুল আহসান সাহেব। সম্পাদক – কাজী সাইফুদ্দীন হোসেন]
হযরত হুদ (আ:) এর জমানায় কওমে আদকে ধ্বংস করার কেচ্ছা
***
হুদ গেরদে মোমেনানে খত্তে কাশীদ।
নরমে মী শোদ বাদে কাঁ জামী রছীদ।
হরকে বীরু বুদ জে আঁ খত্তে জুমলারা
পারাহ্ পারাহ্ মীগাস্ত আন্দর হাওয়া।
হামচুনীঁ শায়বানে রায়ী মী কাশীদ
গেরদে বর গেরদে রমা খত্তে পেদীদ।
চুঁ ব জমায়া মী শোদ উ ওয়াক্তে নামাজ
তা নাইয়ারাদ গুরগে আঁ জাতর কাতাজ
হীচে গুরগে দর নাইয়ামদ আন্দরাঁ
গোছ পান্দে হাম না গাস্তি জে আঁ নেশাঁ।
বাদে হেরচে গোরগো হেরচে গোচকান্দ।
দায়েরাহ্ মরদে খোদা রা বুদে বন্দ্।
অর্থ: হযরত হুদ (আ:)-এর সময়ে যখন বায়ুর তুফান আসিয়াছিল, তখন তিনি মোমেনদের চতুর্পাশ্বে রক্ষা কবজস্বরূপ একটা রেখা টানিয়া দিলেন। বায়ু যখন ঐখানে আসিয়া পৌঁছিত, নরম হইয়া যাইত। কাফেরগণ যাহারা রেখার বাহিরে ছিল, তাহাদিগকে উর্ধ্বে উঠাইয়া ঠকর ঠকর করিয়া আছড়াইয়া টুকরা টুকরা করিয়া ফেলিয়াছিল। ইহা দ্বারা বুঝা যায় যে, বায়ু আল্লাহ্র হুকুমের বাধ্যগত। বুদ্ধিহীন পশুরাও আল্লাহ্র হুকুমের বাধ্যগত। যেমন মাওলানা একটা কেচ্ছা সংক্ষেপে বর্ণনা করিয়াছেন, শাইবান (রা:) একজন কামেল বোজর্গ ছিলেন, তিনি যখন জুমার নামাজ পড়িতে যাইতেন, তখন নিজের স্থানে বকরিদের চারিপার্শ্বে একটি রেখা টানিয়া দিতেন, যেন সেখানে কোনো নেকড়ে বাঘ আক্রমণ না করে। অতএব, সেই রেখার মধ্যে কোনো নেকড়ে বাঘ প্রবেশ করিত না এবং সেই রেখার মধ্য হইতে কোনো বক্রি বাহিরে যাইত না। যেমন নেকড়ে বাঘের উহার মধ্যে প্রবেশ করিবার কোনো লোভ হইত না, আর বকরিদেরও উহার মধ্য হইতে বাহির হইবার কোনো ইচ্ছা হইত না। লালসা বায়ুর ন্যায়, উহা হইতে বিরত থাকা সহজ নয়। ঐ খোদার প্রিয় বান্দার রক্ষণ-বেষ্টনীর মধ্যে আবদ্ধ হইয়া পড়িয়াছিল। নেকড়ে বাঘের লালসা অগ্রসর হয় নাই, আর বকরিদের লোভ বাহিরে যায় নাই।
***
হামচুনিঁ বাদে আজল বা আরেকানে
নরম ও খোশ হামচুঁ নছিমে গোলেস্তান।
আতেশে ইবরাহীম রা দানাদ আঁ নজদ্।
চুঁ গোজিদাহ হক বুদ চউনাশ গোজাদ।
জে আতেশ শাহওয়াত নাছুজাদ মরদে দীন্
বাকিয়ানেরা বোরদাহ্ তাকায়ারে জমীন
মউজে দরিয়া চুঁ বা আমরে হক বতখ্ত
আহলে মুছারা আজ কেবতী ওয়া শেনাখত।
খাকে কারুনরা চু ফরমান দর রছীদ।
বা জর ও তখতাশ্ ব কায়ারে খোদ কাশীদ্।
অর্থ: এখানে মাওলানা আনাছেরে আরবায়া আল্লাহ্র কুদরাতের বাধ্যগত বলিয়া প্রমাণ করিয়াছেন। যেমন হুজুর (দ:)-এর জমানায় বায়ু মোমিনদের জন্য নরম হইয়াছিল। এইরূপভাবে মৃত্যু কওমে আদের বায়ুর ন্যায় কামেল লোকের জন্য নরম ও শান্তিদায়ক হইয়া যায়। যেমন ভোরের হাওয়া বাগানে আনন্দায়ক হয়।
অগ্নি হজরত ইব্রাহিম (আ:)-কে স্পর্শ করে নাই। কেননা, তিনি আল্লাহ্র বন্ধু ছিলেন। কেমন করিয়া তাঁহার ক্ষতি করিবে? এইরূপভাবে যে ব্যক্তি ধার্মিক, সে কখনও কু-রিপুর অগ্নিতে দগ্ধ হয় না। অন্যান্য লোকদিগকে কু-রিপু জাহান্নামে নিয়া পৌঁছাইয়া দেয়। আল্লাহতায়া কু-রিপুগুলিকে ধার্মিকদের উপর জয়ী হইতে পাঠান নাই। নীল নদের তুফান আল্লাহর আদেশ মান্য করিয়া হজরত মূসা (আ:)-এর অনুচরবর্গকে ফেরাউনের দল হইতে পার্থক্য করিয়া চিনিয়া লইয়াছিল। মূসা (আ:)-এর অনুসারীদিগকে পার হইবার পথ দেখাইয়া দিয়াছিল এবং ফেরাউনের দলকে ডুবাইয়া দিল। কারুণের দেশের মাটিকে যখন আল্লাহ্র আদেশ দেওয়া হইল, তখন তাহাকে, তাহার ধনসম্পদ ও সিংহাসন সহ নিজের পেটের মধ্যে টানিয়া লইল।
***
আব ও গেল্ চুঁ আজ দমে ঈছা চরীদ,
বাল ও পর ব কোশাদ ও মোরগে শোদ পেদীদ্
হাস্তে তাছবীহাত বজায়ে আব ও গেল,
মোরগে জান্নাত শোদ জে নফখে ছেদকে দেল।
আজ দেহানাত চুঁ বর আমদ হামদে হক,
মোরঘে জান্নাত ছাখতাশ রব্বুল ফালাক।
অর্থ: পানি ও কাদায় যখন হজরত ঈসা (আ:)-এর ফুঁক হইতে বরকত টানিয়া লইল, তখন আল্লাহর কুদরাতে পালক ও পাখা নির্গত হইয়া পাখী হইয়া উড়িয়া গেল। এইরূপে মাটির হাকীকাত হইতে প্রকৃত পাখী হবার উদাহরণ দিয়া মাওলানা বলিতেছেন, তোমাদের তাসবীহ (সোবহানাল্লাহ) বলা যেমন মাটির তাসবীহ বলা একইরূপ। কিন্তু সত্য দেলের ফুঁকে মাটি বেহেস্তী পাখী হইয়া উড়িয়া গেল। এই রকম যখন তোমার মুখ দিয়া আল্লাহর প্রশংসা বাহির হয়, তখন আল্লাহ তোমাকে বেহেস্তী পাখীতে পরিণত করেন।
***
কোহেতুর আজ নূরে মূছা শোদ বরকছ
ছুফীয়ে কামেল শোদ ওরাস্তে উজে নকছ।
চে আজব গার কোহে ছুফী শোদ্ আজিজ
জেছমে মুছা আজ কুলুখী বুদ্ নীজ।
অর্থ: তুর পর্বত হজরত মূসা (আ:)-এর নূরের তাজাল্লির দরুন নাচিতে আরম্ভ করিয়াছিল। নূরে মূসা এই জন্য বলা হইয়াছে যে, ঐ নূরে এলাহীর আসল উদ্দেশ্য ছিল মূসা (আ:) । ঐ তূর পর্বত নূরে ইলাহীর তাজাল্লির বরকতে খাঁটি পূর্ণ সূফী হইয়া গিয়াছিল এবং পাথর হিসাবে তাহার মধ্যে যে ত্রুটি ছিল, উহা দূর হইয়া গেল। অর্থাৎ, সে এখন আর পাথর রহিল না। এখন সে খোদার প্রিয় সূফী হইয়া গেল। অবস্থার সামঞ্জস্যের দিক দিয়া আশ্চর্যের বিষয় কিছুই নহে। অবশেষে হজরত মূসা (আ:)-এর মাটির দেহও মাটি দিয়া গঠিত ছিল। যদি তিনি খোদার প্রিয় সূফী হইতে পারেন, তবে পাহাড় কেন সূফী হইতে পারিবে না? অতএব, তূর পর্বতের খোদার প্রিয় সূফী হওয়া সম্বন্ধে কোনো আশ্চর্যের ব্যাপার হইতে পারে না। ইহা দ্বারা প্রমাণ পাওয়া যায় যে, ইহ-জগতে যাহা কিছু সৃষ্টি আছে, সবই আল্লাহর কুদরাতের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। আল্লাহর কুদরাতের বাহিরে কোনো কিছুই দেখা যায় না।
মূল: মসনবী শরীফ ২য় খন্ড – মাওলানা জালাল উদ্দিন রুমী (রহ:)।
ভাষান্তর: এ, বি, এম, আবদুল মান্নান।
মুমতাজুল মোহদ্দেসীন, কলিকাতা আলিয়া মাদ্রাসা।