খোদাপ্রাপ্তি জ্ঞানের আলোকে শাহ্সুফি হযরত ফরিদপুরী (কুঃ ছেঃ আঃ) ছাহেবের
লিখিত নসিহত শরীফের ৯ম খন্ডের “মুহাররম” ১০-১২ পৃষ্ঠার আলোচনা।
পর্ব-১ (পৃষ্ঠা: ১০-১২) আলোচনা:
কারবালার ইতিহাস যে শঠতার কলংকে লিপ্ত;তাহার সূত্রপাত হয় হযরত আলী(কঃ) এর সময়ে সিফ্ফিনের যুদ্ধে সন্ধির নামে প্রহসন ও তদীয় শাহাদাতের মাধ্যমে। হযরত ওসমান ( রাঃ) এর শাহাদাতের জন্য সিরিয়ার শাসনকর্তা মোয়াবিয়া ও তাহার নেতৃত্বাধীন কিছু লোক হযরত আলী (কঃ) কে মিথ্যাভাবে দোষারপ করিতে থাকে। তাহাদের কারসাজিতে মুসলিম সাম্রাজ্যে ইরাকের উত্তরঞ্চলে বিদ্রোহ দেখা দেয়। বিদ্রোহ দীর্ঘস্থায়ী হওয়ায় হযরত আলী ( কঃ) মদীনা হইতে কুফায় রাজধানী স্থানান্তরিত করেন।তাহার উদ্দেশ্য ছিল ক্ষিপ্ত হস্তে বিদ্রোহ দমন করা।
মোয়াবিয়া হযরত আলী (কঃ) এর রাজধানী কুফা আক্রোমন করিলেন – তাহাদের দাবি হইল হযরত ওসমান (রাঃ) ও হযরত রাসুলে করিম ( সাঃ) এর বিশিষ্ট ছাহাবা হযরত তালহা ( রাঃ) ও হযরত জুবায়ের ( রাঃ) এর হত্যার বিচার করিতে হইবে।হযরত আলী ( কঃ) এর অনুগত বাহিনী এবং সিরিয়ার শাসনকর্তা মোয়াবিয়া ও মিশরের শাসনকর্তা উমাইয়া বংশীয় আমর বিন আসের সম্মিলিত বাহিনী সিফ্ফিন নামক স্থানে পরস্পর মুখোমুখি হইলো। এই স্থানও ফোরাত নদীর তীরে অবস্থিত।যুদ্ধের পূর্ব মুহূর্তে মুসলমানদের রক্তপাত বন্ধের জন্য হযরত আলী (কঃ) শান্তি স্থাপনের উদ্দেশ্যে মীমাংসার প্রস্তাব দিলেন।
কিন্তু মোয়াবিয়া বলিলেন, তিনি হযরত ওসমান (রাঃ) ছাহেবের এর মৃত্যুর প্রতিশোধ নিতে আসিয়াছে।এই হত্যার জন্য যাহারা দায়ী বলিয়া তিনি দাবী করিতে লাগিলেন, তাহাদেরকে না পাওয়া পর্যন্ত তিনি দামেস্কে প্রতাবর্তন করিবেন না। এমন সকল ব্যক্তিকে তিনি হযরত ওসমান (রাঃ) এর হত্যার জন্য দায়ী করিতে লাগিলেন, যাহারা প্রকৃত অর্থে এ হত্যার জন্য দায়ী ছিলেন না। ত হযরত আলী ( কঃ) তাই উহাতে রাজি হইতে পারিলেন না। সুতরাং যুদ্ধ শুরু হইল। ক্রমে মুহরাম মাস আসিয়া গেল। এই মাস পবিত্র বিদায় মুসলমানগন এ মাসে যুদ্ধ করিতেন না। যুদ্ধ মোহারাম মাস উপলক্ষে স্থগিত হইল।
হযরত আলী (কঃ)এই সুযোগে আবারও যুদ্ধ বন্ধের জন্য মীমাংসার উদ্যোগ গ্রহন করিলেন। কিন্তু মোয়াবিয়া এবার হযরত ওসমান (রাঃ) এর হত্যার বিচারের মূল দাবী ত্যাগ করিয়া নতুন প্রস্তাব দিলেন। তিনি বলিলেন,বিনা রক্তপাতে যুদ্ধ বন্ধ হইতে পারে, যদি নতুনভাবে খলিফা নির্বাচন করা হয়।আর সেই উদ্দেশ্যেহয়রত ওমর (রাঃ) এর মৃত্যুকালে যে রুপ খলিফা নির্বাচনের জন্য একটি সাধারন সভা আহ্বান করা হইয়াছিল,ঐ রুপ সভার আহ্বান করা হউক। মোয়াবিয়া এ কথাও জানাইয়া দিলেন যে, ঐ সভায় তিনি নিজেই হযরত আলী ( কঃ) এর সহিত প্রতিদন্দতা করিবেন। হযরত আলী (কঃ) বলিলেন যে, খেলাফতের দাবী আর হযরত ওসমান( রাঃ) এর হত্যার বিচারের দাবি দুইটি- ভিন্ন ভিন্ন বিষয়। দুইটিকে এক করিলে চলিবেনা।
হযরত নবী করিম ( সাঃ) এর সকল সাহাবা মিলিযা হযরত আলী (কঃ) কে খলিফা নির্বাচিত করিয়া ছিলেন। তাই তাহার জীবদ্দশায় পূনরায় খেলাফত পরির্বতনের কথা উঠিতে পারে না। অথচ মোয়াবিয়া খেলাফত পরিবর্তনের দাবি তুলিল,পলে সন্ধির সকল চেষ্টা ব্যাথ হইল।
কিন্তু এই ঘটনার দ্বারা ইহাই বোঝা যায় যে,মোয়াবিয়া যুদ্ধে আসিয়াছিলের রাজত্বের লিস্পা লইয়া। হযরত ওসমান (রাঃ) বা হযরত জুবায়ের ( রাঃ) এর হত্যার বিচারের দাবি ছিল একটি মিথ্যা বাহানা মাত্র। তাই সন্ধির চেষ্টা ভাঙ্গিয়া গেল।
মুহররম মাসের শেষে যুদ্ধ আবার প্রবল বেগে শুরু হইল। যুদ্ধে যখন মোয়াবিয়া পরাজয় সুনিশ্চিত, তখন তিনি এক নতুন কৌশল গ্রহন করিলেন। কিছু পক্ক কেশ বৃদ্ধ সৈন্য দিগের বর্শায় কোরআন শরীফ বাধিয়াসাদা পতাকা অর্থাৎ সন্ধি প্রস্তাবের প্রতীক হিসেবে পাঠাইলেন। বর্শার মাথায় কোরআন শরীফ বাঁধা দেখিয়া হযরত আলী ( কঃ) এর সৈন্য দলেন একটা অংশ আর যুদ্ধে যাইতে রাজি হইল না।
হযরত আলী (কঃ) তাহাদের বুজাইলেন; উহা মোয়াবিয়া নতুন কৌশল মাত্র ; যুদ্ধের শেষ মিমাংসা না হইলে নতুন বিপদ সৃষ্টি হইবে। তিনি শত চেষ্টা করিয়াও সৈন্যদের ঐ অংশকে আর যুদ্ধে পাঠাইতে পারিলেন না। যুদ্ধ স্থগিত করিতে তিনি বাধ্য হইলেন। নতুনভাবে সন্ধ্যি স্থাপনের চেষ্টা উদ্যোগ হইল। তিনি সৈন্যদের মধ্যে যুদ্ধ বিমুখ মনোভাব দেখিয়া ভগ্ন মন লইয়া রনক্ষেত্র ত্যাগ করিলেন। সেনাপতি মুসার উপর মীমাংসার ভার দিয়া চলিয়া গেলেন। মোয়াবিয়ার পক্ষে আসিলেন তাহার কূট শাসনকর্তা আমর। আমর মীমাংসার প্রস্তাব হিসেবে বলিলেন, যেহেতু হযরত আলী (কঃ) এর খেলাফতের আমলে কতিপয় এলাকায় বিদ্রোহ দেখা দিয়েছে; তাই হযরত আলী (কঃ) এবং তাহার প্রতিদন্ধি মোয়াবিয়া – এই উভয়কে বাদ দিয়া ভিন্ন কোন ব্যক্তিকে খেলাফতের ভার দিতে হইবে।
মুসা আমরের কূট চালের সামনে টিকতে পারিলন না।তিনি শান্তি স্থাপনের জন্য হযরত আলী করমুল্লাহ্ ওয়াজহু- এর খেলাফতের দাবী প্রত্যাহার করিতে সম্মত হইলেন এবং অপেক্ষমান মুসলিম সৈন্যগনকে তাহা জানাইতে আসিলেন। সেনাপতি মুসা যখন বলিলেন মীমাংসার শর্ত হিসেবে হযরত আলী ( কঃ) এর পক্ষ হইতে খেলাফতের দাবী রদ করা হইল– তখনই মোয়াবিয়ার সহযোগি আমর বলিয়া উঠিলেন, হযরত আলী (কঃ) এর প্রতিনিধি তাহার খেলাফতকে রদ করিয়াছেন, ফলে খেলাফতের আশন এখন শূন্য। আর তাই এক্ষনে, মোয়াবিয়া কে খলিফা নির্বাচিত করা হইল। মুসা ক্রুব্ধ হইয়া বলিলেন, সন্ধির প্রস্তাব অনুযায়ী তৃতীয় কোন ব্যক্তির খেলাফতের ভার গ্রহন করার কথা; কিন্তু মোয়াবিয়া সৈন্যদের উল্লাস ধ্বনিতে মুসার কন্ঠ তলাইয়া গেল। তাহার কথা কেহ শুনিতে পাইল না।
সন্ধির সঠতা সম্পর্কে সকলেই বুজিতে পারিল। হজরত আলী (কঃ) কুফায় ফিরে রাজত্ব করিতে লাগিলেন বটে; কিন্তু মোয়াবিয়া আর তার বশ্যতা স্বীকার করিল না। হযরত রাসুলে করিম ( সাঃ) এর আর্শিবাদ- ধন্য ও পূর্ণ স্মৃতিময় মদিনা শরীফ হইতে আরবের উত্তরঅঞ্চল রক্ষা করিবার উদ্দেশ্যে হযরত আলী (কঃ) কুফায় রাজধানী স্থানান্তর করেন- কিন্তু নবী (সাঃ) এর প্রতিষ্ঠিত কেন্দ্র হইতে দূরে যাইয়া, তিনি বিদ্রোহতো দমন করিতে পারিলেনই না ; বরং খেলাফত ও হস্তচ্যুত হইল।শেষ পর্যন্ত কুফাবাসী একদিন নামাজ রত অবস্থায় কুফার একটি মসজিদের মধ্যে হযরত আলী (কঃ) কেও হত্যা করিল।