
মাওলা আলী (রাঃ) সিফফিন যুদ্ধ থেকে ফেরার পর খোৎবা
আমি আল্লাহ্র প্রশংসা করি তাঁর পরিপূর্ণ নেয়ামতের আশায়, তাঁর ইজ্জতের প্রতি আত্মসমর্পণের জন্য এবং পাপ থেকে নিরাপত্তা পাওয়ার আশায়। আমি তাঁর সাহায্যের জন্য মিনতি করি যেহেতু প্রয়োজনে তাঁর সাহায্যই যথেষ্ট। তিনি যাকে হেদায়েত প্রদান করেন সে কখনো বিপথগামী হয় না; আর যার প্রতি তিনি বিরূপ হন তার কোন প্রতিরক্ষা নেই। যাকে তিনি দয়া করেন সে সকল প্রয়োজনের উর্দ্ধে থাকে। তাঁর প্রশংসা সব কিছু হতে গুরুত্বপূর্ণ এবং সকল সম্পদ হতে মূল্যবান।
নাহ্জ আল-বালাগা, ইমাম আলী, আমিরুল মোমেনিন আলী, সিফফিন যুদ্ধ থেকে ফেরার পর এ খোৎবা,
আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, এক আল্লাহ্ ব্যতীত আর কোন মা’বাুদ নেই। তাঁর কোন সাদৃশ্য নেই। এ সাক্ষ্য এমন এক ব্যক্তির যার এখলা পরীক্ষিত এবং ইহার মূল উপাদান আমাদের ইমাম যা বিশ্বস্ত (মো’তাকাদ) হয়েছে। যত দিন তিনি আমাদের জীবিত রাখেন ততদিন আমরা এ বিশ্বাস আঁকড়ে ধরে রাখবো এবং কঠোর দুঃখ-দুর্দশা দ্বারা আমরা আক্রান্ত হলো তা মোবাবেলা করার জন্য বিশ্বাস পুঞ্জিভূত করে রাখবো। কারণ এটা ইমানের মূল ভিত্তি এবং কল্যাণকর কর্ম ও ঐশী সন্তুষ্টির প্রথম সোপান। এটা শয়তানের দূরে সরিয়ে রাখার উপায়।
আমি আরো সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, মুহাম্মদ (সঃ) তাঁর বান্দা ও রাসুল। অতি বিশিষ্ট দ্বীন, মো’জেজা, সংরক্ষিত দলিল, দীপ্তিশীল নূর, জ্বলজ্বল ঔজ্জ্বল্য, সন্দেহ-নাশক চুড়ান্ত নির্দেশাবলী, বিদ্যামান সুস্পষ্ট প্রমাণাদি, আল্লাহ্র আয়াতসমূহ দ্বারা ভীতি প্রদর্শন ও পাপের শাস্তির সতর্কাদেশসহ আল্লাহ্ তাঁকে প্রেরণ করেছেন। সে সময়ে মানুষ ছিল ফেতনা- ফ্যাসাদে লিপ্ত এবং তাতে দ্বীনের রজ্জু ছিন্ন হয়ে গিয়েছিল, ইয়াকিনের স্তম্ভসমূহ আলোড়িত হয়ে পড়েছিল, নৈতিক মূল্যবোধ অন্ধকারের অতল তলে তলিয়ে গিয়েছিল, নিয়ম-শৃংখলা ওলপ-পালট হয়ে পড়েছিল, প্রারম্ভ ছিল ক্ষীণ, পথ ছিল অন্ধকারাচ্ছন্ন, হেদায়েত ছিল অজানা এবং অজ্ঞতা (জাহেলিয়াত) ছিল বিরাজমান।
মানুষ আল্লাহ্র অবাধ্য হয়ে শয়তানের সমর্থক হয়ে পড়েছিল এবং ইমান পরিত্যক্ত বিষয় ছিল। ফলতঃ দ্বীনের স্তম্ভ ধ্বসে পড়েছিল। ইমানের সামান্য চিহ্নও দেখা যাচ্ছিলো না- এর সকল পথ বিনষ্ট হয়ে পড়েছিল এবং প্রকাশ্য রাস্তাসমূহ ধ্বংসস্তুপে পরিণত হয়েছিল। মানুষ আল্লাহ্র নাফরমানি করে শয়তানের অনুগত হয়ে পড়েছিল এবং শয়তানের পথ অনুসরণ করতেছিলো। শয়তানের জলাধার থেকে পানি সংগ্রহে মানুষ আগ্রহান্বিত ছিল। এ সকল মানুষের মাধ্যমে শয়তানের বিজয় পতাকা উড্ডিয়মান হয়েছিল এবং এরাই মানুষকে ফেতনা-ফ্যাসাদের দিকে ঠেলে দিয়েছিলো।
ফলে মানুষ এদের খুরের নীচে দলিত হয়েছিল এবং মানুষের ওপর দাম্ভিক পদভরে দাঁড়িয়েছিলো। অনৈতিকতা পায়ের আঙ্গুলে ভর করে দাঁড়িয়েছিলো। মানুষ সম্পূর্ণরূপে পথভ্রষ্ট, জটিল, অজ্ঞ ও বিপথগামী হয়ে পড়েছিল যেন তারা কল্যাণকর ঘরের (কাবা) কুপ্রতিবেশী (কুরাইশ)। নিদ্রার পরিবর্তে তারা ছিল জাগ্রত এবং তাদের চোখে সুর্মার পরিবর্তে ছিল পানি। তারা এমন এক সমাজ ব্যবস্থায় ছিল যেখানে জ্ঞানীগণ ছিল লাগাম পরিহিত এবং অজ্ঞরা ছিল সম্মানিত।
জেনে রাখো, রাসুলের আহ্লুল বাইত হলো আল্লাহ্র গুপ্ত বিষয়ের (সির্র) ধারক, আল্লাহ্ সম্পর্কীয় জ্ঞানের মূলধারা, প্রজ্ঞার কেন্দ্রবিন্দু, আল্লাহ্র কিতাবের উপত্যকা ও তাঁর দ্বীনের পর্বত। তাঁদের মাধ্যমেই আল্লাহ্ তাঁর দ্বীনের বক্রপিঠ সোজা করলেন এবং দ্বীনের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের কম্পমান অবস্থা দূরীভূত করলেন।
মনে রেখো, মোনাফেকগণ পাপ কর্ম ও অধার্মিকতা বপন করেছে এবং তাতে প্রবষ্ণরূপ পানি সিঞ্চন করেছে; ফলতঃ নিজেদের ধ্বংরূপ ফসল কর্তন করেছে। ইসলামী উম্মাহ্র কাউকে আহলুল বাইতের সমকক্ষ হিসাবে গ্রহণ করা যাবে না। কেউ তাঁদের অনুগ্রহভাজন হয়ে থাকলেও তাকে তাঁদের সমতুল্য মনে করা যাবে না। তাঁরা হলেন দ্বীনের ভিত্তিমূল ও ইমানের স্তম্ভ। তাঁদের কেউ ডিঙ্গিয়ে যেতে চাইলে আবার ফিরে আসতে হয় তাঁদের কাছে। আবার পশ্চাদে পড়ে থাকে তারা তাঁদের অনুসরণ করতে হয়। মূলতঃ তাঁরা রাসুলের বেলায়েতের অধিকারের প্রধান বৈশিষ্ট্য সম্পন্ন। রাসুলের আমানত ও উত্তরাধিকার তাঁদেরই অনুকূলে। কাজেই ন্যায় ও সত্যেরত অনুসারীগণকে তাঁদের দিকে প্রত্যাবর্তন করতে হবে।
রাসূল (সঃ) আহলুল বাইত সম্পর্কে আমিরুল মোমেনিন বলেন যে, বিশ্বের কোন ব্যক্তিকে আহলুল বাইতের সমকক্ষতায় আনা যাবে না এবং মহত্বে তাঁদের সমতুল্য কাউকে মনে করা যাবে না। কারণ এ বিশ্বে তাঁদের অনুগ্রহে ভরপুর। তাঁদের নিকট হতে প্রাপ্ত হেদায়েত ও দিক নির্দেশনার মাধ্যমেই বিশ্ব চিরন্তন নেয়ামত পেতে পারে। তাঁরা হলেন দ্বীনের ভিত্তি ও দু’দেয়ালের সংযোগ স্থাপক প্রাস্তর। তাঁরা হলেন দ্বীনের বাঁচার জন্য পুষ্টিকর খাদ্য স্বরূপ। তাঁরা ইমান ও প্রজ্ঞার এমন শক্তিধর স্তম্ভ যে, সংশয় ও অজ্ঞতার যে কোন ঝড় ফিরিয়ে দিতে পারে।
তাঁরা অতিবর্তী ও পশ্চাদবর্তী পথ সমূহের মধ্যে এমন এক মধ্যপথ যে পথে না আসা পর্যন্ত কেউ ইসলামের অন্তর্ভূক্ত হতে পারে না। বেলায়েত ও নেতৃত্বের অধিকারের বৈশিষ্ট্য ও শ্রেষ্ঠত্ব তাঁদের আছে। ফলে উম্মার অভিভাবকত্ব ও পৃষ্ঠপোষকতা করার অধিকার আর কারো নেই এ কারণে রাসূল (সঃ) তাঁদেরকে তাঁর উত্তরাধিকারী ও তাঁর বেলায়েতের অধিকারী বলে ঘোষণা করেছিলেন। ইবনে আবিল হাদীদ লিখেছেন যে, আমিরুল মোমেনিনের বেলায়েত সম্পর্কে সন্দেহের কোন অবকাশ নেই কিন্তু উত্তরাধিকার বলতে রাষ্ট্রক্ষমতার উত্তরাধিকার বুঝায় না যদিও শিয়াগণ এরকম ব্যাখ্যাই করে থাকেন। এ উত্তরাধিকার দ্বারা রাসুলের শিক্ষার উত্তরাধিকার বুঝায়।
হাদীসের মত গ্রহণ করলেও রাসুলের শিক্ষার লক্ষ্য অর্জনের প্রয়োজনীয়তার কারণে খেলাফতের দায়িত্ব অন্য কারো ওপর বর্তায় না। কারণ শিক্ষা প্রদান খেলাফতের অত্যাবশ্যকীয় শর্ত। রাসুলের (সঃ) খলিফার প্রধান ও গুরুত্বপূর্ণ কাজ হলো ন্যায় বিধান করা, ধর্মীয় আইনের সমস্যাদির সমাধান করা, জটিল বিষয়ের ব্যাখ্যা প্রদান ও ধর্মীয় দন্ডসমূহের প্রয়োগ। যদি রাসূলের ডেপুটি হতে এ সমস্ত বিষয় সরিয়ে নেয়া হয় তবে তার অবস্থান রাজ্য শাসকের (দুনিয়াদার শাসক) পর্যায়ে নেমে আসবে। ধর্মীয় কর্তৃত্বের কিলক হিসাবে তাকে আর গ্রহণ করা যাবে না। সুতরাং হাদীদের ব্যাখ্যা ভিত্তি হীন। রাসুলের (সাঃ) অছিয়ত খেলাফত ব্যতীত অন্য কিছুর জন্য নয়। বেলায়েত দ্বারা সম্পদ ও জ্ঞানের উত্তরাধিকার বুঝায় না- সঠিক নেতৃত্বকে বুঝায় যা আহলুল বাইত হওয়ার কারণে আল্লাহ্ নিজেই গুণাবলীর পরিপূর্ণতা দান করেছেন।
নাহ্জ আল-বালাগা
মূলঃ আমিরুল মোমেনিন আলী ইবনে আবি তালিব
সংঙ্কলনঃ আশ-শরীফ আর-রাজী
ইংরেজি অনুবাদঃ সৈয়দ আলী রেজা
বাংলা অনুবাদঃ জেহাদুল ইসলাম
পৃষ্ঠা নং ১২-১৩।