মানব দেহস্থিত দশ লতিফার পরিচয় – ২য় পর্ব
মানব দেহস্থিত দশ লতিফার পরিচয় এবং খোদাপ্রাপ্তি সাধনায় ইহাদের ভূমিকাঃ- (৩ পর্বের -২য় পর্ব) খোদাপ্রাপ্তি জ্ঞনের আলোকে শাহ্ সূফী হযরত খাজাবাবা ফরিদপুরী (কুঃছেঃআঃ) ছাহেবের নসিহত।
লতিফায়ে রূহ-
ইহা আলমে আমর বা সূক্ষ্ম জগতের লতিফা। ইহার অবস্থান দক্ষিন বা ডান স্তনের অংগুলি নীচে। এই লতিফার মূল আরশের উপরে এবং মূলের মূল খোদাতায়ালার ‘ সিফাতে ছুবুতী এলাহিয়া ’তে সন্নিবেশিত আছে। এই সিফাতে ছুবুতী ঐ সমস্ত গুণ, যাহা খোদাতায়ালার জাতে ছাবেত থাকে। পীরে কামেলের তাওয়াজ্জুহ বলে ছালেক এই স্তরে পৌছাইলে সে বুঝিতে পারে যে তাহার নিজের কোন গুণ নাই। দর্শন, শ্রবণ, চিন্তন, বর্ণন, কল্পন, কথন, সৃজন সমস্তই খোদাতায়ালার গুণাবলী ।
বস্তুতঃ মানুষের নিজের বলিয়া কিছু নাই। তাহার সমস্ত গুনাগুণ খোদাতায়ালা হইতে ধার করা। খোদাতায়ালার আমানত যাহা মানুষ গ্রহণ করিল তাহা আল্লাহ্তায়ালার উক্ত গুণাবলী বই কিছুই নহে। এই লতিফার নূরের রং সোনালী। এই লতিফা হযরত নূহ (আঃ) ও হযরত ইব্রাহিম (আঃ) এর উপরে প্রথম প্রকাশ পায়। এই লতিফা হযরত নূহ (আঃ) ও হযরত ইব্রাহিম (আঃ) এর জেরে কদমের লতিফা বলা হয়। লতিফা রূহের বেলায়েত হাছিলকারীকে “ইব্রাহিমী মাশরাব ওলী”- অর্থাৎ হযরত ইব্রাহিম (আঃ)-এর ঘাটের ঘাটী বলা হয়।
লতিফায়ে ছের-
এই লতিফা আলমে আমরের লতিফা। এই লতিফা কালবের দুই অংগুলি পরিমাণ দূরে বুকের দিকে অবস্থিত। অর্থাৎ কালব এবং বক্ষস্থলের মধ্যবর্তী স্থানে লতিফায়ে জের অবস্থিত। ইহার আসল আরশের উপরে আসলের আসল খোদাতায়ালার শানে সন্নিবেশিত আছে। এই লতিফার নূর সাদা-অতি তেজস্কর। ইহা হযরত মুছা (আঃ) এর উপর প্রথম প্রকাশ পায়। তাই এই লতিফাকে হযরত মুছা (আঃ) এর জেরে কদমের লতিফা বলা হয়। লতিফা ছেরের বেলায়েত অর্জন কারীকে “মুছবী মাশরাব ওলী” অর্থাৎ হযরত মুছা (আঃ)- এর ঘাটের ঘাটী বলা হয়।
লতিফায়ে খফি-
ইহা আলমে আমরের লতিফা। এই লতিফা রূহের দুই অংগুলি পরিমাণ দূরে বুকের দিকে অবস্থিত। এই লতিফার মূল আরশের উপরে এবং মূলের মূল খোদাতায়ালার “সিফাতে ছলবীয়া”তে সন্নিবেশিত আছে। এই মাকামে উন্নীত হইলে ছালেক বুঝিতে পারে যে, আল্লাহ্ পাক অব্যয়, অক্ষয়, চিরস্থায়ী, অপরিবর্তনশীল ইত্যাদি। এই লতিফার নূর কালো বর্ণের, তবে দৃষ্টিরোধক নয়। এই লতিফা হযরত ঈসা (আঃ) এর উপর প্রথম প্রকাশ পায়। তাই এই লতিফাকে হযরত ঈসা (আঃ) এর জেরে কদমের লতিফা বলা হয়। লতিফা খফির বেলায়েত হাছিলকারীকে “ঈসুবী মাশরাব ঐশী” অর্থাৎ হযরত ঈসা (আঃ)- এর ঘাটের ঘাটী বলা হয়।
লতিফায়ে আখফা-
ইহা বুকের মাঝখানে অবস্থিত। এই লতিফার মূল আরশের উপরে এবং মূলের মূল খোদাতায়ালার “শানে জামেয়ায়” সন্নিবেশিত আছে। ইহাকে তাইনে আওয়াল বা তাইনে ওজুদী বা হকিকতে আহম্মদী বলে, যাহা হকিকতে মোহাম্মদীর উৎপত্তি স্থল। ছালেক এই মাকামে উন্নীত হইলে খোদাতায়ালার এমনি নিবিড় ও ঘনিষ্ট সান্নিধ্য লাভ করে যাহা ভাষায় ব্যক্ত করা যায় না। এখানে গুণ ও শানের কোন প্রতিবন্ধকতা থাকে নাই। এই সম্পর্ককে ইংগিতেও বুঝানো যায় না। যাহা কেহ স্বীয় জ্ঞানে আনিতে পারে না, অনুভবও করিতে পারে না।
হযরত মোজাদ্দেদ আলফেছানী (রাঃ) বলেন যে, আহাদ ও আহম্মদ নামের মধ্যে যে মিমের ব্যবধান তাহা কেবল এই দুই নামের মধ্যেকার পার্থক্যই নির্ণয় করে। এই মাকামে উন্নীত হইলে ছালেকের সহিত আল্লাহ্তায়ালার সম্পর্ক অবর্ণনীয়। ইহা কেবলমাত্র আল্লাহ্তায়ালাই জানেন। এই লতিফার নূর সবুজ বর্ণের। এই লতিফা রাসূলে করীম (সাঃ) এর উপর প্রথম প্রকাশ পায়। তাই এই লতিফাকে রাসূলে করীম (সাঃ) এর জেরে কদমের লতিফা বলা হয়। লতিফা আখফার বেলায়েত অর্জনকারীকে “মহাম্মদী মাশরাব ওলী“ অর্থাৎ হযরত মোহাম্মদ মোস্তফা (সাঃ) এর ঘাটের ঘাটী বলা হয়।
আলমে আমরের উক্ত পঞ্চ বা পাঁচ লতিফা যথা- কালব, রূহ, ছের, খফি ও আখফাকে হযরত মোজাদ্দেদ আলফেছানী (রাঃ) সারপঞ্চক বলিয়া উল্লেখ করিয়াছেন।
আমাদের এই দেহ আব, আতস, খাক ও বাদ অর্থাৎ আগুন, পান, মাটি ও বাতাসের সমন্বয়ে তৈরী। আল্লাহ্পাক বিশেষ কৌশলে পরস্পর বিপরীতধর্মী এই চার উপাদান দ্বারা আমাদের দেহকে তৈরী করিয়াছেন। এই চারটি উপাদান পৃথক পৃথক ভাবে এক একটি লতিফা। এই চারটি লতিফার অবস্থান সর্ব দেহ ব্যাপী।
তৎপর আলমে খলকের অবশিষ্ট লতিফা যাহার নাম নাফস। আগুন, পানি, মাটি ও বাতাসের সমন্বয়ে তৈরী পৃথক এক সত্ত্বা যাহার ধর্ম উক্ত চার উপাদান হইতে পৃথক। হাইড্রোজেন এবং অক্সিজেনের যৌগিকে যেমন ভিন্ন এক উপাদান পানির তৈরী হয়। এই পানির ধর্ম হাইড্রোজেন এবং অক্সিজেনের ধর্ম হইতে পৃথক। তেমনি এই নাফস, যাহার স্বভাব দৈহিক অন্যান্য উপাদানের ধর্ম হইতে পৃথক। যাবতীয় কু-চিন্তা এবং কু-কর্মের উৎস এই নাফস। কাম, ক্রোধ, লোভ, মোহ, মদ, মাৎসর্য, হিংসা, কিনা, রিয়া, কামনা, বাসনা ইত্যাদি সকল রিপুই এই নাফস হইতে উৎপত্তি। নাফসের স্বভাব আল্লাহ্তায়ালার বিরুদ্ধাচারন করা। আল্লাহ্তায়ালার নাফরমানীতেই তাহার শান্তি। আল্লাহ্তায়ালার দাসত্বের অস্বীকৃতি প্রদানই তাহার ধর্ম। দুনিয়ার ধন, জন, যশ, খ্যাতি, কর্তৃত্ব – এ সবই তাহার আকাংখা। নাফস চায় সকলের উপর কর্তৃত্ব করিতে। সকল সৃষ্টিই তাহার অধীন হইয়া থাকিবে আর সে সকলের উপর সর্দারি করিবে – ইহাই তাহার কাম্য।
হযরত মোজাদ্দেদ আলফেসানী (রাঃ) ছাহেব বলেন যে , “নাফসের এই স্বভাব খোদায়ী দাবী বই কিছুই নহে। প্রত্যেকের নাফসই তাই এক একটি ফেরাউন ।” কাজেই এই নাফসের হাত হইতে মুক্ত না হওয়া পর্যন্ত কাহারোও কোন নিস্তার নাই ।
আল্লাহ্ তায়ালা হযরত আদমের দেহ তৈরী করিয়া তাহার ভিতরে রূহ ফুকিয়া দিলেন। রূহ হযরত আদম (আঃ) এর দেহে প্রবেশ করিয়া অন্ধকার দেখিয়া দেহ হইতে বাহির হইয়া আসিল। দেহের সেই অন্ধকারে থাকিয়া যাইতে রূহ অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করিল। তৎপর আল্লাহ্তায়ালার ইশারায় হযরত আদম (আঃ) এর দেহে নূরে মোহাম্মদী প্রবেশ করিল। নূরে মোহাম্মদীর আকর্ষণে তখন রূহ মানব দেহে রহিয়া গেল। এই ভাবে আল্লাহ্পাক তাঁহার নিজস্ব কৌশলে নাফসের সাথে রূহের মিলন ঘটাইলেন। অন্ধকারের সহিত আলোর সংমিশ্রণ করিলেন। তৎপর নাফসের সহিত রূহের প্রেমের সম্পর্ক গড়িয়া দিলেন। রূহ ঊর্ধ্ব জগতের উপাদান। রূহের উৎস আল্লাহ্পাকের সেফাতে এরাদত। রূহ আল্লাহ্তায়ালার চরিত্রে চরিত্রবান। রূহের ভিতর ভাল গুণ ব্যতীত খারাপ কোন স্থান নাই। রূহের আবাস্থল আমরে রাব্বী।
অন্যদিকে নাফস হইল আলমে খালকের উপাদান। যাবতীয় কু-কর্মের কর্তা এই নাফস। খারাপ ভিন্ন ভালোর কোন স্থান এই নাফসের ভিতর নাই। আল্লাহ্পাক বলেন, “নাফস আমার শত্রু, তোমরা নাফসের সহিত শত্রুতা কর।” কাজেই রূহের একান্ত ইচ্ছা, এই নাফসকে তাহার কু- স্বভাব হইতে মুক্ত করিয়া, ঊর্ধ্ব জগতের নূরে আলোকিত করিয়া ঊর্ধ্ব জগতের নূরে আলোকিত করিয়া ঊর্ধ্বলোকের পানে লইয়া যাইবে। আল্লাহ্তায়ালার প্রেমিক বানাইবে। কিন্তু হিতে বিপরীত হইল। রূহ নাফসে আম্মারাকে হেদায়েত করিতে আসিয়া নিজেই নাফসের প্রেমে পড়িয়া গেল। নাফসের দাসত্ব করা শুরু করিল। নাফসের যাহা ভাল লাগে, রূহেরও তাই ভাল লাগে। নাফসের প্রেমে পড়িয়া নাফসের ভাল লাগাই রূহের ভাল লাগায় পরিণত হইল। নাফসের কর্মসূচীই রূহের কর্মসূচী হইল। কিন্তু কথাতো ইহা ছিল না। দুইয়ের স্বভাবও এক ছিল না। রূহের যাহা প্রিয়, নাফসের তাহা অ-প্রিয়। রূহের জন্য যাহা মধুর, নাফসের তাহা তিক্তকর। নাফস সর্বদাই আল্লাহ্তায়ালার বিরুদ্ধাচারণ করিতে ভালবাসে। নাফস আল্লাহ্তায়ালার শত্রু ।
আল্লাহ্ বলেন, “তোমরা নাফসের সাথে বন্ধুত্ব করিও না, তোমরা নাফসের দাসত্ব করিও না।” এই দুনিয়ার যশ, খ্যাতি, ধন-সম্পদ কর্তৃত্ব সকলই নাফসের কাম্য। নাফস এই দুনিয়াকে সুন্দর রূপে সাজাইয়া রূহের সম্মুখে উপস্থিত করিল। ফলে রূহও দুনিয়ার প্রেমে পড়িল। নাফসকে ইমানদার বানাইতে আসিয়া নিজেই ঈমান হারাইয়া ফেলিল। খোদাতায়ালার কথা, নূরময় জগতের কথা, নিজস্ব আবাস স্থলের কথা – সবই ভুলিয়া গেল। দুনিয়ার প্রেমে মত্ত হইয়া নাফসের দাসত্ব করা শুরু করিল । এই অবস্থা চলিতে থাকিলে রূহের ধ্বংস অনিবার্য। নাফসের সাথে, নাফসের সাহায্যকারী দুনিয়ার সংগে, আল্লাহ্তায়ালার ক্রোধানলে পড়িয়া অনন্তকাল দোজখের আগুনে দগ্ধ হইতে হইবে।
কাজেই নাফসে আম্মারার কবল হইতে রূহকে মুক্ত করিবার জন্য একজন সাহায্যকারীর প্রয়োজন। সেই সাহায্যকারী হিসাবে যুগে যুগে দুনিয়াতে নবী রাসূলের আবির্ভাব ঘটিয়াছে। নবুয়তের দরজা বন্ধ হইয়া যাওয়ার পর তাঁহাদেরই চরিত্রে চরিত্রবান করিয়া আল্লাহ্তায়ালা ওলীয়ে কামেল সকলকে প্রেরণ করিতেছেন পথ ভ্রষ্ট মানব সকলকে তথা মানব রূহকে নাফসে আম্মারার দাসত্ব হইতে মুক্ত করাইয়া, দুনিয়ার অধীনতাকে অস্বীকার করাইয়া আল্লাহ্মুখী করিবার জন্য।
গ্রন্থসূত্র- শাহ্ সূফী হযরত খাজাবাবা ফরিদপুরী (কুঃছেঃআঃ) ছাহেবের “নসিহত- সকল খন্ড একত্রে। নসিহত নং- ২০ , পৃষ্ঠা নং- ২১১,২১২ ও ২১৩।”