মসনবী শরীফ পর্ব-২ : মাওলানা জালালউদ্দিন রুমি (রহ:)

[বাংলা এই ভাবানুবাদ বরিশাল থেকে প্রায় ৫০ বছর আগে প্রকাশিত। এই দুর্লভ সংস্করণটি সরবরাহ করেছেন সুহৃদ (ব্যাংকার) নাঈমুল আহসান সাহেব।  সম্পাদক – কাজী সাইফুদ্দীন হোসেন]

মসনবী শরীফ পর্ব-২

“রোজেহা গার রফত গো রাওবাকে নিস্ত
তু বেমাঁ আযে আঁকে চুঁতু পাকে নিস্ত।”

অর্থ: যদিও আমার অতীত জীবন বেহুদা কাটিয়া গিয়াছে, তথাপি আফসোসের কোনো কারণ নাই। কেননা, যাহা বেহুদা ছিল বা বিপদ-আপদ ছিল, তাহা চলিয়া গিয়াছে; এখন খাঁটি ও পবিত্র প্রেম বাকি রহিয়াছে।
ভাব: বহুদিন বিরহ, যাতনা ও বেদনার পর যদি বন্ধুর মিলন হয়, তবে পিছনের দুঃখ-কষ্টের জন্য আফসোস করিতে হয় না। কেননা, যাহা কিছু অনর্থক দুঃখকষ্ট ভোগ করার ছিল তাহা অতিক্রান্ত হইয়া গিয়াছে। এখন শুধু ভালোবাসা বা প্রেম স্থায়ী রহিয়াছে।

“হরকে জুজ মাহী জে আবশ ছায়েরে শোদ,
হরকে বেরোজী ইস্ত রোজশ দের শোদ।”

অর্থ: এখানে আশেকের প্রকার বর্ণনা করিতে যাইয়া মওলানা বলিতেছেন, এক প্রকার আশেক আছে, যাহারা মাশুকের কিছু প্রাপ্ত হইলেই তৃপ্তি লাভ করে। আরেক প্রকার আছে, যাহারা মাশুককে লাভ করিতে পারে নাই, তাহাদিগকে বে-রুজি বলা হইয়াছে। তাহাদের চেষ্টা বিফল হইয়াছে। তাহাদের জীবন বৃথা অতিবাহিত হইয়া গিয়াছে। উদ্দেশ্য পণ্ড হইয়া গিয়াছে।

ভাব: প্রেমিকের জন্য প্রেমের পথে চলিতে কখনও থামিতে হয় না, সর্বদা চলিতে থাকিলেই উদ্দেশ্য সফল হয়। নিরাশ হবার কোনো কারণ নাই।

“ওয়ার নাইয়াবদ হালে পোখতাহ হিচে খাম,
পাছ ছুখান কোতাহ বাইয়াদ ওয়াচ্ছালাম।”

অর্থ: বিফল ব্যক্তি কখনও সফল ব্যক্তির অবস্থা অনুভব করিতে পারে না। কামেল ব্যক্তির অবস্থা বিনা কামেল-ব্যক্তি কখনও বুঝিতে পারে না। এই জন্য উপরোল্লিখিত পূর্ণ প্রেমের উত্তেজনার ফলাফল বর্ণনা করা এখন সংক্ষেপ করিয়া শেষ করা হইল। শেষ করা-ই উত্তম।

“বন্দে বগছাল বাশ আজাদ আয়ে পেছার,
চান্দে বাঁশি বন্দে ছীমো বন্দে জর।”

অর্থ: মাওলানা বলেন, ওহে যুবক! তুমি যদি খোদার প্রেমে পরিপূর্ণতা লাভ করিতে চাও, তবে তুমি দুনিয়ার ধন-দৌলত ও স্বর্ণ-রৌপ্যের মহব্বত ত্যাগ কর; তবে খোদার ভালোবাসা লাভ করিতে পারিবে। কেননা, দুনিয়ার ধন-দৌলতের মহব্বত রাখিলে আল্লাহর মহব্বত হাসিল করা যায় না। দুনিয়ার ভালোবাসা আল্লাহর মহব্বত হইতে ফিরাইয়া রাখে।পার্থিব বস্তুর মহব্বত যত কম হইবে, ততই আল্লাহর মহব্বত বেশি হইবে। আস্তে আস্তে, ক্রমান্বয়ে কামেল হইতে থাকিবে।

“গার বা রিজি বহরেরা দর কুজায়ে,
চান্দে গুনজাদ কিসমতে এক রোজায়ে।”

অর্থ: মাওলানা দুনিয়ার লোভীর পরিণতি সম্বন্ধে বলিতে যাইয়া বলিতেছেন যে, অধিক লালসা করায় কোনো ফলোদয় হয় না। যেমন, সমস্ত সমুদ্রের পানি যদি একটি সামান্য পেয়ালার মধ্যে ঢালা হয়, তবে উহার মধ্যে পেয়ালা আন্দাজ পানি থাকিবে, অতিরিক্ত পানি উহাতে কিছুতেই থাকিবে না; শুধু একদিনের পরিমাণ পানি থাকিতে পারে।
ভাব: এখানে পিয়ালাকে মানুষের অদৃষ্টের সাথে তুলনা করা হইয়াছে। যাহার অদৃষ্টে যে পরিমাণ নির্দিষ্ট করা আছে, উহার চাইতে কিছুতেই সে বেশি পাইবে না। অতএব, অধিক লোভ-লালসায় মত্ত হওয়া কোনো উপকারে আসে না, বরং খোদার মহব্বত হইতে বঞ্চিত হইতে হয়।

“কুজায়ে চশমে হারিছান পুর না শোদ,
তা ছাদাপে কানে না শোদ পুর দুর না শোদ।”

অর্থ: লোভী ব্যক্তির চক্ষু কোনো সময়েই পরিপূর্ণ হয় না। অর্থাৎ, লালসার আশা মিটে না, কখনও তৃপ্তি লাভ করিতে পারে না। যদি ইহ-জগতে যাহা পায় তাহাতে তৃপ্তি লাভ না করে, তবে ঝিনুকের ন্যায় যদি এক ফোঁটা বৃষ্টি পাইয়া তৃপ্তি লাভ করিয়া মুখ বন্ধ না করে, তাহা হইলে সে কী-রূপে পূর্ণ এক খণ্ড মূল্যবান মুক্তায় পরিণত হইতে পারিবে? অতএব, আল্লাহর তরফ হইতে বান্দার কিসমতে যাহা কিছু মাপা হয়, তাহাতেই সন্তুষ্টি লাভ করিয়া ধৈর্য্ ধারণ করিয়া থাকিলে খোদার প্রিয় বান্দা বলিয়া পরিগণিত হইতে পারে।

“হরকেরা জামা জে ইশকে চাকে শোদ,
উ জে হেরচো আয়েবে কুল্লি পাকে শোদ।”

অর্থ: যে ব্যক্তির জামা ইশকের কারণে ফাঁড়িয়া গিয়াছে, সে ব্যক্তির অন্তর লোভ-লালসা ও অন্যান্য কু-ধারণা হইতে পবিত্র হইয়া গিয়াছে।

ভাব: যে ব্যক্তির অন্তর খোদার মহব্বতে পরিপূর্ণ হইয়া গিয়াছে, তাহার অন্তঃকরণ হইতে পার্থিব বস্তুর ভালোবাসা দূর হইয়া গিয়াছে। তিনি প্রকৃত কামেল হইতে পারিয়াছেন।

“শাদে বশ্ ইশকে খোশ্ ছুদায়ে মা
আয়ে তবিবে জুমলায়ে ইল্লাত হায়ে মা।”

অর্থ: এখানে মাওলানা ইশকের প্রশংসা করিতে যাইয়া বলিতেছেন, হে ইশক! তোমাকে ধন্যবাদ দিতেছি। কারণ, তোমার অসিলায় অভ্যন্তরীণ কু-ধারণাসমূহ বিদূরিত হয়। তোমার-ই কারণে অন্তঃকরণ পবিত্র হয়। অতএব, হে চিকিৎসক! তোমাকে আমার আন্তরিক ধন্যবাদ জ্ঞাপণ করিতেছি।

“আয়ে দাওয়ায়ে নাখুত ও নামুছে মা,
আয়ে তু আফলাতুনো জালিয়ে নুছেমা।”

অর্থ: হে ইশক, তুমি আমার কু-ধারণা ও কু-প্রবৃত্তির ঔষধস্বরূপ। তুমি আমার পক্ষে জালিয়ানুসের ন্যায় একজন বিজ্ঞ ডাক্তার। অর্থাৎ, প্রকৃত প্রেমিক ব্যক্তি কোনো সময়ে অ-সুন্দর বা না-পছন্দ কাজ করিতে পারেন না। খাঁটি প্রেমের কারণে না-পছন্দ গুণসমূহ তাহার অন্তর হইতে বিদূরিত হইয়া যায়।

“জেছমে খাক আজ ইশকে বর আফলাকে শোদ,
কুহে দর রকছে আমদ ও চালাক শোদ।”

অর্থ: মাটির শরীর খোদার ইশকের দরুন আকাশ ভ্রমণ করিয়াছে। মুছা (আঃ)-এর ইশকের দৃষ্টিতে তূর পর্বতের প্রাণ সঞ্চার হইয়াছিল এবং ইশকের জোশে ফাটিয়া চূর্ণ-বিচূর্ণ হইয়া গিয়াছিল ও হজরত মূছা (আ:) বে-হুশ হইয়া রহিলেন।

“ইশকে জানে তুরে আমদ আশেকা,
তুরে মস্তো খাররা মুছা ছায়েকা।”

অর্থ: পরবর্তী লাইন-দ্বয়ে মাওলানা পরিষ্কার করিয়া বর্ণনা করিয়া দিয়াছেন, যেমন হজরত মূসা (আ:)-এর খোদার প্রেমপূর্ণ দৃষ্টি যখন তূর পর্বতের উপর পতিত হইল, তখন-ই তূর পর্বত ইশকের ক্রিয়ায় নড়া-চড়ার শক্তি পাইল এবং নাচিতে আরম্ভ করিল। অবশেষে সে চূর্ণ-বিচূর্ণ হইয়া পড়িল এবং মূসা (আঃ) খোদার জ্যোতির প্রভাবে বে-হুশ হইয়া রহিলেন।

“বা লবে ও মছাজে খোদ গার জোফতামে,
হামচু নায়ে মান গোফতানিহা গোফতামে।”

অর্থ: উপরোক্ত লাইন-দ্বয়ে মাওলানা ইশকের ফজিলত ও শওকাত বর্ণনা করিতেছিলেন এবং খুব ভালভাবে ইশকের মরতবা বর্ণনা করার ইচ্ছা ছিল। কিন্তু, তিনি যখন ভাবিলেন যে ইশকের রহস্য ও শওকাত বাহ্যিক ইন্দ্রিয় দ্বারা অনুভব করা সম্ভব নয়, প্রকৃত আশেক না হইলে ইশকের স্বাদ গ্রহণ করিতে পারে না; ইশকের মধ্যে এমন গুরুত্বপূণ রহস্য আছে, যাহা বয়ান করিলে কোনো কোনো লোক বেঈমান হইয়া যাইবার আশষ্কা আছে, তখন তিনি নিজের কৈফিয়ৎ হিসাবে ওজর বর্ণনা করিতেছেন যে যদি আমার সম্মুখে আমার বর্ণনা শুনার জন্য কোনো খাঁটি আশেক থাকিত, তবে আমি বাঁশির ন্যায় ইশকের কেচ্ছা বর্ণনা করিতাম।

“হরফে উ আজ হামজবানে শোদ জুদা,
বে নাওয়া শোদ গারচে দারাদ ছদ নাওয়া।”

অর্থ: যে ব্যক্তি নিজের ভাষা-ভাষী হইতে বিচ্ছিন্ন হইয়া পড়ে, তখন সে সম্বলহীন অবস্থায় অসহায় হইয়া পড়ে। যদিও তাহার নিকট শত ধন-দৌলত থাকে, তথাপিও সে নিজেকে অসহায় মনে করে। কেননা, সে নিজের মনোবাসনা প্রকাশ করিতে পারে না।

“চুঁকে গোল রফতো গুলিস্তান দর গুজাস্ত,
নাশ নুবি জীঁ পাছ জে বুলবুল ছার গুজাস্ত।”

অর্থ: মাওলানা উপরোক্ত ভাবের বর্ণনায় দৃষ্টান্ত দিয়া বলিতেছেন, দেখ, যখন ফুল ফোটার মৌসুম চলিয়া যায়, তখন ফুলের বাগিচা ফুলশূন্য হইয়া পড়ে এবং দেখিতে অসুন্দর দেখায়। বুলবুল পাখি আর গান করিতে আসে না। কারণ ফুলের সুঘ্রাণের আকর্ষণে সে গান করিতে আসিত। এখন ফুল ফোটে না আর সে-ও গান গাহিতে আসে না। এইরূপভাবে যদি শ্রোতা আকর্ষণকারী প্রেমিক না হয়, তবে বর্ণনাকারীও বর্ণনা করিতে স্বাদ পায় না। অতএব, বর্ণনা হইতে বিরত থাকে।

“ছেররে পেনহা নাস্ত আন্দর জীরো বাম,
ফাশ আগার গুইয়াম জাহাঁ বরহাম জানাম।”

অর্থ: মাওলানা বলিতেছেন, আমি যে কাহিনী চুপে চুপে নিম্নস্বরে বা উচ্চস্বরে বর্ণনা করিতেছি, ইহার ভেদ ও রহস্য আওয়াজের ভিতরে নিহিত আছে। যদি প্রকাশ্যে বর্ণনা করি, তবে সমস্ত জাহান ধ্বংস হইয়া যাইবে।

মসনবী শরীফ
মূল: মাওলানা জালালউদ্দিন রুমি (রহ:)
অনুবাদক: এ, বি, এম, আবদুল মান্নান
মুমতাজুল মোহদ্দেসীন, কলিকাতা আলিয়া মাদ্রাসা।

সূত্রঃ https://mishukifti.wordpress.com/

→ মসনবী শরীফ সবগুলো পর্ব

আরো পড়ুনঃ
Sufibad24.com | WhatsApp চ্যানেল

Sufibad24.com | Telegram Channel