মসনবী শরীফ পর্ব-৭ : মাওলানা জালালউদ্দিন রুমি (রহ:)

[বাংলা এই ভাবানুবাদ বরিশাল থেকে প্রায় ৫০ বছর আগে প্রকাশিত। এই দুর্লভ সংস্করণটি সরবরাহ করেছেন সুহৃদ (ব্যাংকার) নাঈমুল আহসান সাহেব।  সম্পাদক – কাজী সাইফুদ্দীন হোসেন]

মসনবী শরীফ পর্ব-৭

শামছো দর খারেজে আগার চে কাস্তে করদ,

মী তাওয়াঁ হাম মেছলে উ তাছবীরে করদ।

“লেকে আঁ শামছি কে শোদ বন্দাশ আছির,
নাবুদাশ দর জেহেনো খারেজে নজীর।”

অর্থ: যদিও পৃথিবীতে মাত্র একটি সূর্য দেখা যায়, কিন্তু উহা দ্বারা অনেক সূর্যের ছবি আঁকা যায়। কিন্তু হাকিকী সূর্য অর্থাৎ আল্লাহতায়ালা, যাহার অধীনস্থ ইহ-জগতের সূর্য, তাঁহার আকৃতি বা ছবি প্রকাশ্যে খেয়াল করা বা ছবি অঙ্কন করিয়া দেখান কখনও সম্ভব নহে।

“দর তাছওর জাতে উরা গঞ্জে কো,
তা দর আইয়াদ দর তাছাওর মেছলউ।”

অর্থ: আল্লাহতায়ালার জাতে পাকের ছবি অন্তরে অঙ্কন করা যায় না; তাই তাঁহার ন্যায় ছবি কোথায় পাইবে অর্থাৎ, সূর্যের ছবি সূর্যকে দেখিয়া অঙ্কন করা যায়, আর জাতে পাকে আল্লাহর আকৃতি অন্তরে বা জেহেনেও খেয়াল করা অসম্ভব, প্রকাশ তো দূরের কথা। অতএব, সূর্যের আলোর সাথে খোদার আলোর তুলনা করা খাটে না।

“সামছে তিবরিজি কে নূরে মতলকাস্ত
আফতাবাস্ত ও জা আনওয়ারে হকাস্ত”

অর্থ: এখানে মাওলানা নিজের তরিকার পীর মাওলানা সামছু্দ্দিন তিবরিজির প্রশংসা করিতেছেন, আমার মুরশেদ হজরত মাওলানা সামছদ্দিন তিবরিজি (রাঃ) এক সূর্যের ন্যায়। তাঁহার মধ্যে মারেফাতের আলো পরিপূর্ণ আছে। অর্থাৎ, তিনি একজন পূর্ণ কামেল ব্যক্তি। সূর্যের চাইতেও আলোতে তিনি পরিপূর্ণ। আল্লাহতায়ালা তাঁহাকে নূরে পরিপূর্ণ করিয়া দিয়া লোকের হেদায়েতের জন্য ইহ-জগতে পয়দা করিয়াছেন। অতএব, আমাদের উচিত তাঁহার নিকট হইতে ইলমে মারেফাত শিক্ষা করা।

“চুঁ হাদীছ রুয়ে সামছুদ্দিন রছিদ,
সামছে চারাম আছমান চার দর কাশীদ।”

অর্থ: যখন আমার ওস্তাদ সামছুদ্দিন তিবরিজির বর্ণনা প্রসঙ্গ আসিয়া পড়ে, তখন তাঁহার সম্মুখে আসমানের সূর্য লজ্জায় নত হইয়া যায়। কারণ, আকাশের সূর্য শুধু বাহ্যিক আলো দান করিতে পারে, আর আমার ওস্তাদ সামছু্দ্দিন বাহ্যিক ও অভ্যন্তরীন উভয় দিকের আলো দান করিতে পারেন।

“ওয়াজেব আমদ চুঁকে আমদ নামে উ,
শরাহ করদান রমজে আজ ইনয়ামউ।”

অর্থ: যখন তাঁহার বর্ণনার কথা আসিয়া পড়িয়াছে, তখন তাঁহার কোনো কোনো দানের কথা উল্লেখ করা একান্ত দরকার।

“ইঁ নাকাছে জানে দামানম বর তাফতাস্ত,
বুয়ে পিরাহামে ইউছুফ ইয়াফতাস্ত।”

অর্থ: এই সময় আমার প্রাণ আমার আঁচল (দামন) ধরিয়া রাখিয়াছে এবং আমার মুরশেদের কিছু প্রশংসা করার জন্য আমার প্রাণ উৎসুক রহিয়াছে।

“কাজ বরায়ে হক্কে ছোহবাত, ছালেহা,
বাজে গো রমজে আন্দাঁ খোস হালে হা।”

অর্থ: কেননা, বহু বৎসর সোহবতে থাকিয়া যে সব নেয়ামত হাসেল করিয়াছি, তাহার কিছু প্রকাশ করিতে ইচ্ছা রাখি।

“তা জমিনো আছেমাঁ খান্দাঁ শওয়াদ।
আকল ও রূহ দিদাহ ছদ চান্দাঁ শওয়াদ।”

অর্থ: কেননা, ঐ সমস্ত নেয়ামতের রহস্য বর্ণনা করিলে সমগ্র জগৎ আলোকিত হইয়া যাইবে। অর্থাৎ, মারেফাতে ইলাহির রহস্য বর্ণনা করিলে জগতের মানুষের অন্তর্জীবন সঞ্চার করিয়া তাজা হইয়া উঠে। স্বয়ং মাওলানার নিজের অন্তরও উহা দ্বারা উন্নতি লাভ করিবে।

“গোফতাম আয়ে দূরে উফতাদাহ আজ হাবিব,
হামচু বিমারে কে দূরাস্ত আজ তবীব।
লাতুকাল্লেকুলি ফা ইন্নি ফীল কানায়ে।
কেল্লাত আফহামী কালা আহছি ছানা।”

অর্থ: মাওলানা বলেন, আমি আমার নিজের অন্তরকে বলিলাম, হে অন্তর, তুমি তোমার বন্ধু মুরশেদ হইতে দূরে আছ। যেমন – রোগী ডাক্তার হইতে দূরে থাকিলে রোগের যন্ত্রণা ভোগ করে, তেমন তোমার মাহবুব হইতে দূরে পতিত হইয়া যন্ত্রণা ভোগ করিতেছ। তাই তিনি নিজ অন্তরকে লক্ষ্য করিয়া বলিতেছেন, আমাকে কষ্ট দিও না; কেননা, আমি বে-খোদীতে মশগুল আছি। আমার বুদ্ধি ও আক্কেল লুপ্ত হইয়া গিয়াছে। সেই কারণে আমার মুরশেদের প্রশংসা করার মত শক্তি পাইতেছি না।

ভাব: মাওলানা এখানে নিজের পীরে কামেলের কথা স্মরণ করিয়া তাঁহার কামালাতের কথা মনে পড়ায় অস্থির হইয়া পড়িয়াছেন এবং সেই হেতু তিনি বলিতেছেন, আমি বে-খোদীতে মশগুল আছি, আমার মাহবুব মুরশিদের প্রশংসা করার মত শক্তি এখন নাই। অতএব, হে মন! আমাকে এখন আমার শক্তির বাহিরে কষ্ট দিও না।

“কুল্লু শাইয়েন ফালাহু গাইরুল মুফিক,
ইন তাকাল্লাফ আও তাছাল্লাফ লা ইয়ালিক।”

অর্থ: বেহুশ ব্যক্তি যে মর্ম ব্যক্ত করে, উহা অতিরিক্ত অথবা অনুপযুক্ত বলিয়া মনে হয়।

“হরচে মী গুইয়াদ মোনাছেব চুঁ নাবুদ,
চুঁ তাকা্ল্লুফ নেকে নালায়েকে নামুদ।”

অর্থ: কেননা, বে-হুশ ব্যক্তি যাহা কিছু বলে, সময় উপযোগী হয় না বলিয়া লোকে অতিরঞ্জিত বলিয়া মনে করে। গুরুত্বহীন মনে করিয়া অবহেলা করে।

“মান চে গুইয়াম এক রগাম হুশইয়ারে নিস্ত,
শরাহ আঁ ইয়ারে কে উরা ইয়ারে নিস্ত।”

অর্থ: মাওলানা বলেন, আমি এ মাহবুবের কী প্রশংসা করিব, যাহার কোনো উপমা বা তুলনা নাই; তাঁহার কোনো শরীকও নাই। অর্থাৎ, আমি যখন আমার মুরশিদের কথা স্মরণ করিয়া জ্ঞানহারা হইয়া পড়িয়াছি এবং যাহার কামালাতের অসিলায় আল্লাহর মহব্বত হাসেল করিয়াছি, তখন ঐ আল্লাহর প্রশংসা কেমন করিয়া করিব, যাহার কোনো তুলনা নাই।

“শরহে ইঁ হেজরাণ ওইঁ খুনে জেগার,
ইঁ জমানে বুগজার তা ওয়াক্তে দিগার।”

অর্থ: মাওলানা নিজের অপরাগতা প্রকাশ করিয়া বলিতেছেন, আমার সমস্ত ধমনীতে আল্লাহর মহব্বতের রক্ত প্রবাহিত আছে, সর্বদা আল্লাহর দিদারের জন্য মুখাপেক্ষী আছে। এই বিরহ বেদনার অবস্থাতে ইশকের রহস্য বর্ণনা করা আমার পক্ষে সম্ভব নহে, যদি পারি অন্য সময়ে বর্ণনা করিব।

“কালা আতেয়েমনি ফা ইঁন্নি জায়েউন,
ওয়া আয়তাজেল ফাল ওয়াক্ত ছাইফুন কাতেয়ুন।”

অর্থ: মাওলানা বলেন, আমার প্রাণ বলিল যে আমি ক্ষুধার্ত, আমাকে খাদ্য দাও। শীঘ্র করিয়া দাও; কেননা সময় তরবারিস্বরূপ কর্তনকারী।

ভাব: মাওলানা বলেন, আমি নিজে বে-খোদীতে মশগুল; ইশকের রহস্য বর্ণনা করার মত শক্তি আমার নাই। কিন্তু আমার প্রাণে মানে না। প্রাণ বলে, আমি ক্ষুধার্ত, পিপাসার্ত। আমি ইশকের স্বাদ গ্রহণ করিতে চাই। আমাকে অতি শীঘ্র স্বাদ গ্রহণ করিতে দাও। নতুবা, সময় চলিয়া গেলে আর পাওয়া যাইবে না। সময় অমূল্য ধন।

“বাশদ ইবনোল ওয়াক্তে ছুফী আয়ে রফিক,
নিস্তে ফরদা গোফতান আজ শরতে তরিক।”

অর্থ: মন মাওলানাকে আরো বলে, হে সূফী! তুমি যে অবস্থায় আছ, এখনই তোমার ইশকের রহস্য বর্ণনা করা দরকার। ইশকের পথিকের পক্ষে কালকের জন্য ওয়াদা করা বিধানসম্মত নয়। অতএব, এখনই বলিয়া ফেল। আগামীর জন্য অপেক্ষা করিও না। উহা তরিকার পরিপন্থী।

“ছুফী ইবনোল হালে বাশদ দর মেছাল,
গারচে হরদো ফারেগে আন্দাজ মাহ ওছাল।”

অর্থ: সুফীকে ইবনোল হালের সহিত তুলনা দিয়া বলা হইয়াছে। তাহা না হইলে উভয়ের মধ্যে বেশ পার্থক্য আছে। যেমন – মাস ও বৎসরের মধ্যে পার্থক্য আছে।

“তু মাগার খোদ মরদে ছুফী নিস্তি,
নকদেরা আজ নেছিয়া খীজাদ নিস্তি।”

অর্থ: মন মওলানাকে বলিতেছে, তুমি ক্ষান্ত দিয়া বসিলে, বোধ হয় তুমি সুফী আদমী নহো। বর্তমান সময়কে অন্য সময়ের জন্য ফেলিয়া রাখিলে তাহা না হওয়ার মধ্যে পরিগণিত হয়।

“গোফতামাশ পুশিদাহ খোশতর ছেররে ইয়ার,
খোদ তু দর জিমনে হেকায়েত গোশেদার।”

অর্থ: মাওলানা বলেন, আমি আমার মনকে উত্তর দিলাম যে যদিও সময়ের মূল্য অনুধাবন করা একান্ত দরকার, কিন্তু উহার চাইতেও বেশী লক্ষ্য রাখা দরকার হিকমাতের দিকে।

“খোশতর আঁ বাশদ কে ছেররে দেল বরাঁ,
গোফতা আইয়াদ দর হাদীছে দীগারাঁ।”

অর্থ: মাশুকের ইশকের ভেদ অন্য রকম ঘটনা ও উদাহরণ দ্বারা বর্ণনা করা অতি উত্তম।

“গোফতে মকশুফ বরহেনা বেগলুল,
বাজে গো দফয়াম মদেহ আয় আবুল ফজল।”

অর্থ: মাওলানা বলেন, আমার অন্তর আমাকে বলিল যে তুমি ইশকের রহস্য প্রকাশ করিয়া বল, কোনো অংশ গোপন করিও না। ইশারায় বা সংক্ষেপে বলিলে তাহাতে তৃপ্তি আসে না। হে বিজ্ঞ! পরে বলার আশা রাখিও না। যাহা বলার এখনই বিস্তারিত বর্ণনা কর।

“বাজে গো আছরারো রমজে মুজছালীন,
আশকারা বেহ কে পেনহা ছেররে দীন।”

অর্থ: ইহার পর রছুলগণের প্রেরণের রহস্য এবং উদ্দেশ্য বর্ণনা কর। কেননা, ধর্ম্মের রহস্য ও ভেদ গুপ্ত রাখার চাইতে প্রকাশ করা উত্তম।

ভাব: আল্লাহতায়ালা কর্তৃক যুগে যুগে নবী বা রছুল প্রেরণের উদ্দেশ্য ছিল ইহাই যে, তাঁহার প্রিয় বান্দাগণ ইহ-জগতের মহব্বতে আল্লাহর মহব্বত ভুলিয়া না যায়। ভ্রান্ত ব্যক্তিদিগকে আল্লাহর প্রেমের আলো দান করিয়া ইশকের আকর্ষণে আল্লাহর প্রতি অনুরাগী থাকিবে। আল্লাহ ছাড়া অন্য কাহাকেও মা’বুদ বলিয়া মানিবে না। সর্বগুণী ও সর্বশক্তিমান অদ্বিতীয় আল্লাহতায়ালা-ই উপাসনা পাইবার উপযোগী।

“পরদাহ বরদার ও বরহেনা গো কে মান,
মী নাকোছ পেম বা আছনামে বা পিরহান।”

অর্থ: যদি কোনো ব্যক্তি পিরহান পরিধান করিয়া মূর্তির সহিত ঘুমায়, তবে ঐ ব্যক্তি এবং মূর্তির মধ্যে একটি পর্দার পার্থক্য থাকে। ঐ রকমভাবে মূল ঘটনা এবং উদাহরণগুলি ঢাকা থাকিলে প্রকৃত রহস্য বুঝা যায় না। তাই, ইশকের মূল রহস্য পরিষ্কার করিয়া বর্ণনা করা আবশ্যক।

“গোফতাম আজ উরইয়ান শওরাদ উ দর জাহান,
নায়ে তু মানি নায়ে কিনারাত নায়ে মিঞা।”

অর্থ: যদি ইশকের ভেদ এই দুনিয়ায় প্রকাশ পায়, তবে সমস্ত জাহান ধ্বংস হইয়া যাইবে।

“আরজু মীখাহ লেকে আন্দাজা খাহ,
বর নাতাবাদ কোহেরা এক বরগেকাহ।
তানা গরদাদ খুনে দেল জানে জাহাঁ,
লবে বা বন্দ ও দিদাহ বরদোজাইঁ জমান।”

অর্থ: মাওলানা বলেন, হে মানুষ! তুমি যদি চাও তবে তোমার শক্তি অনুযায়ী চাও। কেননা, একটি বাঁশের পাতার উপর একটা পাহাড়ের ওজন সহ্য হয় না। তাই তোমার যদি চাইতে হয়, তবে তোমার শক্তি মোওয়াফিক তলব কর। নতুবা, সমস্ত জাহান ছারখার হইয়া যাইবে। অতএব, এখন তুমি চুপ করিয়া থাক।

“আফতাবে কাজওয়ায়েইঁ আলম ফরুখত,
আন্দেকে গার বেশে তাবাদ জুমলা ছুখত।
ফেতনা ও আশুব ও খুঁনরিজি মজু,
বেশে আজইঁ আজ শামছে তিবরিজি মগো।”

অর্থ: সূর্য, যাহা দ্বারা এই পৃথিবী আলোকিত হয়, তাহা যদি আরও কিছু নিকটে আসিয়া যায়, তবে সমস্ত জাহান পুড়িয়া ছারখার হইয়া যায়। যখন প্রকাশ্য সূর্যের প্রখরতা পৃথিবী সহ্য করিতে পারে না, তখন কেমন করিয়া হাকিকী সূর্য অর্থাৎ আল্লাহর ইশকের প্রখরতা কেমন করিয়া বরদাস্ত করিবে। এইজন্য ইশকের পূর্ণ রহস্যের কাহিনী ইহ-জগতে বর্ণনা করা সম্ভব নয়। ইহার স্বাদ যে ব্যক্তি গ্রহণ করিয়াছেন, তিনি-ই নিজে নিজে স্বাদের মর্যাদা অনুভব করিতেছেন।

“ইঁ নাদারাদ আখের আজ আগাজ গো,
রদ্দেতামামে ইঁ হেকাইয়েত বাজ গো।”

অর্থ: এই ইশকের রহস্যের বর্ণনা আরম্ভ করিয়া ইহার শেষ নাই। অর্থাৎ, প্রেমের রহস্যের ঘটনা বর্ণনা করিয়া শেষ করা যায় না। ইহার বর্ণনা পুনরাবৃত্তি ব্যতীত গতি নাই। তাই এখন শেষ করাই কর্তব্য।

আগন্তুক অলি দাসীকে নিয়া বদশাহর নিকট হইতে একাকী হইবার প্রস্তাব এবং দাসীর রোগ ও যন্ত্রণা সম্বন্ধে তদারক করা

“চুঁ হেকিম আজ ইঁ হাদীছে আগাহ শোদ,
ওয়াজ দরুণে হাম দাস্তানে শাহ শোদ।
গোফতে আয়শাহ খেলওয়াতি কুন খানা রা,
দূর কুন হাম খেশও হাম বেগানাহ রা।
কাছ নাদারাদ গোশে দর দহলিজেহা,
তা বা পুরছাম জিইঁ কানিজাক চীজেহা।”

অর্থ: যখন আগন্তুক হেকিম সাহেব উক্ত দাসীর ঘটনাসমূহ জানিতে পারিলেন এবং বাদশাহর অভ্যন্তরীণ অবস্থা বুঝিতে পারিলেন, তখন হেকিম সাহেব বাদশাহকে বলিলেন, আপনি এই ঘর হইতে আপনার আপনজন ও বেগানাদিগকে দূরে সরাইয়া দেন এবং কেহ যেন এই ঘরের প্রতি কানও রাখিতে না পারে। আমি এই দাসীর নিকট অনেক কিছু জিজ্ঞাসা করিয়া জানিতে চাই।

“খানা খালি করদে শাহা ও শোদ বেরুঁ,
তা বখানাদ বর কানিজাকে উফেছুঁন।
খানা খানি মান্দো এক দিয়ার নায়ে,
জুজ তবীব ও জুজ হুমাঁ বিমার।”

অর্থ: বাদশাহ তখন তখন-ই সকলকে ঘর হইতে বাহির করিয়া দিলেন এবং নিজেও ঘর হইতে বাহির হইয়া গেলেন। ঘরে হেকিম সাহেব এবং উক্ত রোগী ছাড়া আর কেহই রহিল না।

“নরমে নরমক গোফতে শহরে তু কুজাস্ত,
কে ইলাজো রঞ্জেহর জুদাস্ত।
ও আন্দার আঁ শহর আজ কারাবাত কীস্তাত,
খুশী ও পেওয়েস্তেগী বা চিস্তাত।
দস্তে বর নবজাশ নেহাদ ও এক বএক,
বাজ মী পুরছীদ আজ জওরে ফালাক।”

অর্থ: হেকিম সাহেব স্নেহ ভরে নরম নরম সুরে দাসীকে জিজ্ঞাসা করিতে লাগিলেন, তোমার দেশ কোথায়? কেননা, প্রত্যেক দেশের রোগ এবং চিকিৎসা পৃথক পৃথক। ঐ দেশে তোমার আত্মীয় এগানার মধ্যে কাহার কাহার সাথে মিল-ঝুল আছে। কার কার সাথে চলা ফিরা করিতে শান্তি পাইতে ও আনন্দ অনুভব করিতে। হেকিম সাহেব রোগীর কব্জা হাতের মধ্যে ধরিয়া জিজ্ঞাসা করিতে লাগিলেন, কী কারণে তোমার এই রোগ হইল?

“চুঁ কাছেরা খারেদর পায়াশ খালাদ,
পায়ে খোদরা বর ছারে জানু নেহাদ।
ওয়াজ ছারে চুজান হামী জুইয়াদ ছারাশ,
ওয়ার নাইয়াবাদ মী কুনাদ আজ লবে তয়াশ,
খারেদর পা শোদ চুঁনি দেশওয়ার ইয়াব,
খারে দর দিল চুঁ বুয়াদ দাদাহ জওয়াব”

অর্থ: মাওলানা বলেন, যখন কোনো ব্যক্তির পায়ে কাঁটা ঢুকিয়া যায়, তবে পা খানা হাটুর উপর উঠাইয়া রাখে এবং সূঁচের মাথা দিয়া কাঁটার মাথা তালাশ করে। যদি কাঁটার মাথা না পায়, তবে নিজের মুখের লালা দিয়া ভিজাইয়া দেয়। যখন প্রকাশ্যে পায়ের একটি কাঁটা তালাশ করিতে এত কষ্ট করিতে হয়, তবে অন্তরে যদি কাহারও কাঁটা বিধিয়া যায়, তাহা হইলে কীরূপে উহা অনুমান করা যায় ভাবিয়া দেখা উচিত।

“খারে দেলরা গার বদীদে হর খাছে,
দাস্ত কে বুদে গাম্মাঁরা বর কাছে।”

অর্থ: যদি কোনো অজ্ঞান লোকে অন্তরের কাঁটা দেখিতে পাইত, তবে প্রত্যেকেই বুঝিতে পারিত এবং উহার প্রতিকার করিতে পারিত। চিন্তার কোনো কারণ থাকিত না। কিন্তু অন্তরের কাঁটা দেখা ও তাহার অবস্থা বুঝা সকলের পক্ষে সম্ভব নহে; ইহার জন্য কামেল পীরের দরকার। এইজন্য অন্তরের রোগের প্রতিকার জন্য প্রত্যেকের উচিত কামেল পীরের অন্বেষণ করা। কামেল পীর ব্যতীত কেহ অন্তরকে সুস্থ করিতে পারে না।

“কাছ বজীরে দূমে খর খারে নেহাদ,
খর না দানাদ দাফে আঁ বরমী জোহাদ।
বর জোহুদ ও আঁখারে মোহকাম তর জানাদ,
আকেলে বাইয়াদ কে খারে বর, কানাদ।
খর জে বহরে দাফে খারে আজ ছুজ ও দরদ,
জুফতা মী আন্দাখত ছদ জা জখম করদ।
আঁ লাকাদ কে দাফে খারে উকানাদ,
হাজেকে বাইয়াদ কে বর মারকাজে তানাদ।”

অর্থ: যদি কোনা ব্যক্তি গাধার লেজের নিচে একটা কাঁটা ঢুকাইয়া দেয়, গাধা তো ঐ কাঁটা বাহির করার পদ্ধতি জানে না। কাঁটার যন্ত্রণায় গাধা ছটফট করে এবং লাফাইতে থাকে এবং যখন লাফাইতে আরম্ভ করে, তখনই তাহার কাঁটা অধিক ঢুকিয়া মজবুত হয়। ঐ কাঁটা বাহির করার জন্য বুদ্ধিমান জ্ঞানীর দরকার। ঐ গাধা কাঁটার যন্ত্রণায় হাত পা আছাড় মারিতে থাকে এবং জায়গা ব-জায়গায় জখম হইয়া পড়ে। লাথি মারায় তাহার কাঁটা বাহির করার কোনোই উপকার হয় না। কোনো বিজ্ঞ লোকের দরকার, যে নির্দিষ্ট কাঁটার স্থান লক্ষ্য করিয়া কাঁটা বাহির করিতে পারে।

“আঁ হেকীম খারেচীন উস্তাদে বুদ,
দস্তে মীজাদ জা বজায়ে আজমুদ।
জাঁ কানিজাক বর তরিকে রাস্তে বাঁ
বাজ মী পুরছিদ হালে পাছে তাঁ
বা হেকীমে উ রাজেহা মী গোফতে ফাস,
আজ মোকামে খাজেগান ও শহরে তাস।”

অর্থ: উক্ত হেকিম সাহেব অন্তরের-কাঁটা বাহির করায় খুব ওস্তাদ ছিলেন। স্নায়ুর উপর এখানে সেখানে হাত রাখিয়া সবকিছু অনুমান করিলেন। ঐ দাসীকে সত্য কথা বলিতে বলিয়া ভালোবাসার সূত্রে অতীত কাহিনী সম্বন্ধে জিজ্ঞাসা করিতে লাগিলেন। দাসী হেকিম সাহেবের নিকট পরিষ্কার করিয়া সমস্ত ঘটনা বর্ণনা করিল। নিজের বাড়ির কথা, মনিবের অবস্থা এবং কোথায় কোথায় বিক্রয় হইয়াছে, সকল ঘটনাই খুলিয়া বলিয়া দিল।

“ছুয়ে কেচ্ছা গোফতানাশ শী দাস্তে গোশ,
ছুয়ে নজো জুস্তানাশ মী দাস্তে হুশ।
তাকে নজা আজ নামে কে করদাদ জাহাঁ,
উ বুয়াদ মকছুদে জানাশ দরজাহাঁ।”

অর্থ: হেকিম সাহেব তাঁহার কান দাসীর কথার প্রতি রাখিলেন এবং দাসীর কব্জার হরকতের দিকে খেয়াল দিলেন। কেননা, তিনি পরীক্ষা করিবেন যে, কাহার নামে তাহার স্নায়ুর গতি অস্বাভাবিকভাবে নড়িয়া উঠে। সেই-ই তাহার মাশুক বা মাহবুব বলিয়া বিবেচিত হইবে অর্থাৎ যাহার বিরহ বেদনায় এত অসুস্থ হইয়া পড়িয়াছে।

“দোস্তানে শহরে খোদারা বর শুমারদ,
বাদে আজাঁ শহরে দিগার রা নামে বুরাদ।
গোফতে চুঁ বেরুদী শোদী আজ শহরে খেশ,
দরকুদামে শহরে বুদস্তী তু বেশ।
নামে শহরে বোরাদ ও জাঁহাম দর গোজাস্ত,
রংগে রুয়ে ও নজে-উ-দিগার না গাস্ত।
খাজে গাঁনো শহরেহা রা এক বএক,
বাজে গোফত আজ জায়ে ও নানো নেমক।
শহ্‌রে শহ্‌র ও খানা খানা কেচ্ছা করদ,
নায়ে রগাশ জাম্বীদ ও নায়ে রুখে গাস্ত জরদ্‌।”

অর্থ: হেকিম সাহেব উক্ত দাসী দ্বারা তাহার নিজ দেশ ও জানাশুনা আত্মীয়-স্বজনের সম্বন্ধে পরিচয় নিলেন। তারপর অন্য এক দেশের কথা উল্লেখ করিলেন। হেকিম সাহেব জিজ্ঞাসা করিলেন, তুমি যখন নিজ দেশ ছাড়িয়া অন্য দেশে গেলে, তখন কোন্ দেশে বেশি দিন থাকিলে? তারপর উক্ত দাসী এক শহরের নাম উল্লেখ করিল। তারপর আর এক শহরের নাম করিল। কিন্তু তাহাতে চেহারার কোনো পরিবর্তন হইল না এবং স্নায়ুর গতিবিধির কোনো পার্থক্য পাওয়া গেল না। তারপর এক এক করিয়া সকল মুনিবের অবস্থা, সকল দেশের ও জায়গার কাহিনী এবং খাদ্য খাদকের পার্থক্য বর্ণনা করিল। দেশ দেশান্তরের কাহিনী ও প্রত্যেক ঘরের অবস্থা পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে বয়ান করিল। কিন্তু, তাহার স্নায়ুর গতিবিধির কোনো পরিবর্তন অনুভব করা গেল না বা চেহারার রংগের কোনো পরিবর্তন দেখা গেল না।

“নব্‌জে উ বরহালে খোদ বদ বে গোজান্দ,
তা বা পুরছীদ আজ ছামারকান্দে চু কান্দ।
নব্‌জে জুস্ত ওরুয়ে ছোরখাশ জরদ শোদ,
কাজ ছামারকান্দিয়ে জরগার ফেরুশোদ।
উ ছরদে বর কাশীদ আঁ মা হারওয়ে,
আব আজ চশমাশ রওয়াঁশোদ হামচু জুয়ে।
গোফ্‌তে বাজারে গানাম আঁজা আওয়ারীদ,
খাজা জরগার দর আঁ শহ্‌রাম খরীদ।
দরবরে খোদ দাস্ত ছে মাহ ও ফরুখত্‌,
চুঁ বগোফ্‌ত ইঁ জানাশ গম বর ফরুখত্‌।”

অর্থ: উক্ত দাসী বর্ণনা করিতে করিতে যখন সামারকান্দ দেশের কথা উল্লেখ করিতে লাগিল, তখনই তাহার স্নায়ুর গতি বৃদ্ধি পাইলো এবং চেহারার রং লাল-হলুদে মিশ্রিত হইয়া গেল। কেননা, ঐ সামারকান্দে একজন স্বর্ণকার তাহার মনিব ছিল। সে তাহাকে বিক্রয় করিয়া ফেলিয়াছে এবং তাহার সাক্ষাৎ হইতে দূরে রহিয়াছে। ইহা বলিয়া সে দীর্ঘ নিঃশ্বাস ত্যাগ করিল এবং চক্ষুদ্বয় হইতে নদীর স্রোতের ন্যায় অশ্রু প্রবাহিত হইতে লাগিল। সে আরও বলিতে লাগিল, কোনো এক সওদাগার আমাকে আনিয়া ঐখানে এক স্বর্ণকারের নিকট বিক্রয় করিয়াছিল। স্বর্ণকার আমাকে খরিদ করিয়া রাখিয়াছিল। তিন মাস পর্যন্ত আমাকে তাহার নিকট রাখিয়াছিল। তাহার পর আমাকে বিক্রয় করিয়া ফেলিল। ইহা বলিয়া দাসী বিরহ যন্ত্রণার অগ্নিতে প্রজ্বলিত হইয়া উঠিল।

“চুঁজে রঞ্জুর আঁ হেকীম ইঁ রাজে ইয়াফ্‌ত,
আছ্‌লে আঁ দরদে ও বালা রা বাজে ইয়াফ্‌ত।
গোফ্‌তে কোয়ে উ কুদামাস্ত ও গোজার,
উ ছারপল গোফ্‌ত ও কোয়ে গাতফার।”

অর্থ: যখন হেকীম সাহেব রোগীর এই রহস্য জানিতে পারিলেন এবং ঐ প্রকৃত মূল অবস্থা বার বার অনুভব করিতে লাগিলেন, তখন হেকীম সাহেব দাসীর নিকট জিজ্ঞাসা করিলেন, ঐ স্বর্ণকারের বাড়ী কোন্ পথে ও কোন্ মহল্লায়? দাসী বলিল, ছেরপলের পথে গাতফার মহল্লায় তাহার বাড়ী।

“গোফ্‌তে আঁগাহ আঁ হেকীমে বা ছওয়াব,
আঁ কানিজাক রা কে রাস্তি আজ আজাব।
চুঁকে দানাস্তেম কে রঞ্জাত চিস্ত জুদ,
দর ইলাজাতে চেহের হা খাহাম্‌ নামুদ।
শাদে বাশ্‌ ও ফারেগ ও আয়মান কে মান,
আঁ কুনাম বাতু কে বারানে বাচে মন।
মান গমে তুমী খোরাম্‌ তুগ্‌মে মখোর,
বর তু মান মুশফেক্‌ তরাম্‌ আজ ছদ পেদার।
হানো হাঁ ইঁ রাজে রা বা কাছ মগো,
গারচে আজ শাহ্‌ কুনাদ্‌ বছ জুস্তে জু।”

অর্থঃ- যখন হেকীম সাহেব রোগীর অবস্থা বিস্তারিতভাবে জানিতে পারিলেন, তখন ঐ দাসীকে বলিলেন, তুমি অতি শীঘ্রই তোমার কষ্ট হইতে রেহাই পাইবে। যেহেতু আমি তোমার রোগ কী, উহা ধরিতে পারিয়াছি। অতি শীঘ্রই উহার ঔষধ করা হইবে এবং যাদুর ন্যায় ক্রিয়া প্রাপ্ত হইবে। অতএব, তুমি সন্তুষ্ট হও; নির্ভয় ও নিশ্চিন্ত থাক। আমি তোমার বিষয়ে এমন ব্যবস্থা করিব, যেমন বাগানে বৃষ্টি পতিত হইলে বাগান উপকৃত হয়, তেমনি তুমি আমার ব্যবস্থা দ্বারা উপকৃত হইবে। আমি তোমার জন্য চিন্তা করিতেছি, তুমি চিন্তা করিও না। আমি তোমার দুঃখ লাঘবের জন্য শত পিতার চাইতেও দয়াবান। কিন্তু সাবধান, সাবধান! এই রহস্যের কথা কাহারও নিকট প্রকাশ করিবে না, এমন কি স্বয়ং বাদশাহ্‌ শত চেষ্টা করিলেও যেন জানিতে না পারেন।

মসনবী শরীফ
মূল: মাওলানা জালালউদ্দিন রুমি (রহ:)
অনুবাদক: এ, বি, এম, আবদুল মান্নান
মুমতাজুল মোহদ্দেসীন, কলিকাতা আলিয়া মাদ্রাসা।

সূত্রঃ https://mishukifti.wordpress.com/

→ মসনবী শরীফ সবগুলো পর্ব