[বাংলা এই ভাবানুবাদ বরিশাল থেকে প্রায় ৫০ বছর আগে প্রকাশিত। এই দুর্লভ সংস্করণটি সরবরাহ করেছেন সুহৃদ (ব্যাংকার) নাঈমুল আহসান সাহেব। সম্পাদক – কাজী সাইফুদ্দীন হোসেন]
মসনবী শরীফ পর্ব-৮
তা তাওয়াই পেশে কাছ মকশায়ে রাজ,
বরকাছে ইঁ দরমকুন জে নেহর বাজ।
চুঁকে আছরারাত নেহাঁদর দেলে বুদ,
আঁ মুরাদাত জুদেতর হাছেলে বুদ্।
গোফ্তে পয়গম্বর কে হরকে ছারে নেহোফ্ত,
জুদে গরদাদ্ বা মুরাদে খেশে জুফ্ত।
দানা চুঁ আন্দর জমিন পেন্হা শওয়াদ,
ছের্রে উ ছের্রে সবজি বোস্তান শওয়াদ।
জররো ও নোক্রাহ্ গার না বুদান্দে নেহাঁ,
পরওয়ারেশ কায়ে ইয়াফ্ তান্দি জীরে কান।
অর্থ: মাওলানা পাঠকদিগকে উপদেশ দিয়া বলিতেছেন, যতদূর সম্ভব নিজের মনের কথা কাহারও নিকট প্রকাশ করিবে না এবং কাহারও নিকট তোমার মনের ভেদ-কথা খুলিয়া দিও না। তোমার মনে যাহা আছে, মনেই থাকুক। তবে উহা অতি শীঘ্রই কাজে পরিণত হইবে। কেননা, নবী করিম (দঃ) ফরমাইয়াছেন, যে ব্যক্তি মনের কথা গুপ্ত রাখে, তাহার উদ্দেশ্য অতি সহজেই হাসিল হইয়া যায়। যেমন, হাদীছে বর্ণিত আছে, “ইসতায়েনু ফীল হাওয়ায়েজে বিল কিতমান।” অর্থাৎ, তোমার মনোবাসনা পূর্ণ হওয়ার জন্য আল্লাহর নিকট চুপে চুপে সাহায্য প্রার্থনা কর। মওলানা আরও দুইটি বাহ্যিক দৃষ্টান্ত দিয়া বুঝাইয়া দিতেছেন, যেমন-শস্যের দানা যখন জমিনে ঢাকিয়া রাখা হয়, তখন দানা লুকাইয়া রাখার কারণে ঐ বাগান সুফলা শস্যে শ্যামলা ও মনোরম দৃশ্য ধারণ করে। এই রকমভাবে স্বর্ণ-রৌপ্য যদি মাটির নিচে না হইত, তবে খনিতে থাকিয়া কীরূপভাবে বৃদ্ধি প্রাপ্ত হইত? ইহা দ্বারা বুঝা যায় যে, সফলতা অর্জন করিতে হইলে গুপ্তভাবে চেষ্টা করিতে হয়; না হইলে কিছুতেই সফলতা অর্জন করা সম্ভব নহে।
ওয়াদাহাও লুৎফেহায়ে আঁ হেকীম,
করদ্ আঁ রঞ্জুরে রা আয়মন জেবীম।
অর্থ: হেকীম সাহেবের ওয়াদা এবং স্নেহপূর্ণ কথাবার্তায় রোগীর ভয় ও ভাবনা দূর হইয়া গেল।
ওয়াদাহা বাশদ্ হাকীকি দেল পেজীর,
ওয়াদাহা বাশদ্ মাজাজী তাছাগীর।
ওয়াদায়ে আহ্লে করম্ গঞ্জে রওয়ান,
ওয়াদায়ে না আহালে শোদ রঞ্জে রওয়ান।
ওয়াদাহা বাইয়েদ ওফা করদান তামাম,
ওয়ার না খাহি করদে বাশী ছরদো খাম।
অর্থ: মাওলানা ওয়াদার কথা বলিতেছেন, খাঁটি সত্য ওয়াদা লোকের প্রাণে লাগে। আর মিথ্যা ওয়াদায় লোকের মনে সন্দেহ উদয় হয়। সত্য ও ন্যায়বান লোকের ওয়াদায় লোকের সান্ত্বনা আসে এবং উপকার হয়। আর মিথ্যুকের ওয়াদায় লোকের কষ্ট হয়। অতএব, ওয়াদা করিলে পূর্ণভাবে আদায় করিবার চেষ্টা করিবে। যদি তুমি উহা না কর, তবে তুমি মিথ্যুক বলিয়া পরিগণিত হইবে এবং অপমানিত হইবে।
উক্ত ওলী দাসীর রোগ সম্বন্ধে অবগত হওয়া এবং রোগের কথা বাদশাহর সম্মুখে পেশ করা
আঁ হেকীমে মেহেরবান চুঁ রাজে ইয়াফ্ত,
ছুরাতে রঞ্জে কানিজাক বাজ ইয়াফ্ত।
বাদে আজাঁ বরখাস্ত আজমে শাহ্ করদ,
শাহ্রা জাঁ শাম্মায়ে আগহ্ করদ্।
অর্থ: যখন উক্ত হেকীম সাহেব রোগীর প্রকৃত অবস্থা অবগত হইলেন এবং রোগের অবস্থা বুঝিতে পারিলেন, তারপর ওখান হইতে উঠিয়া বাদশাহর নিকট গেলেন এবং বাদশাহকে কোনো রকমে রোগের অবস্থা সম্বন্ধে জানাইলেন।
শাহে গোফ্ত আক্নু বগো তদ্বীরে চিস্ত,
দর চুনিইঁ গম মুজেবে তাখিরে চিস্ত।
গোফ্তে তদ্বীরে আঁ বুদ কানে মরদেরা,
হাজের আরেম্ আজ পায়ে ইঁ দরদেরা।
মরদে জরগার রা বখাঁ জা আঁ শহ্রে দূর,
বাজ রু খেলায়াত বদেহ্ উরা গরুর।
কাছেদে বফেরেস্ত কা আখবারাশ কুনাদ,
তালেরে ইঁ ফজল ও ইছারাশ কুনাদ্।
তা শওয়াদ্ মাহ্বুবে তু খোশদেল বদু,
গরদাদ আছান ইঁ হামামুশ্কিল বদু।
চুঁ বা বীনাদ ছীমো জর আঁ বে তাওয়াঁ,
বহ্রে জর গরদাদ্ জেখানে ও মানে জুদা।
অর্থ: বাদশাহ্ রোগের কথা শুনিয়া বলিলেন, ইহার তদবীর কী, আমাকে বাতলাইয়া দেন। কেননা, এই প্রকার যাতনায় কোনো রকম বিলম্ব করার সম্ভাবনা নাই। হেকীম সাহেব উত্তর করিলেন, ইহার তদবীর শুধু এই যে, ঐ স্বর্ণকারকে এই রোগ হইতে মুক্ত করার জন্য হাযীর করা একান্ত দরকার। আপনি ঐ স্বর্ণকারকে সেই দেশ হইতে ডাকিয়া পাঠান। এবং তাহাকে মণি-মুক্তা ও স্বর্ণ ও রৌপ্য উপঢৌকন হিসাবে দান করিবেন বলিয়া প্রলোভন দেখাইয়া দূত পাঠাইয়া দেন। সে যেন স্বর্ণকারকে বলে যে বাদশাহ্ সমস্ত স্বর্ণকারদের মধ্যে তোমাকেই খুব পছন্দ করিয়াছেন এবং তোমাকে পুরষ্কৃত করার জন্য তাঁহার দরবারে তলব করিয়া পাঠাইয়াছেন। পুরস্কারের প্রলোভনে গরীব বেচারা আপনার দরবারে হাযীর হইবে। তাহা হইলে আপনার প্রিয়া তাহাকে দেখিয়া মনে আনন্দ পাইবে এবং সন্তুষ্ট হইবে। তাহার সহিত মিল-মিশ করিলে অতি সহজেই রোগ মুক্ত হইবে। চেহারা আকৃতি অতি মনোরম হইবে। যত প্রকার আপদ ও বিপদ আছে সবই দূর হইয়া যাইবে। যখন ঐ গরীব স্বর্ণকার এই স্বর্ণ, রৌপ্য ও মনি-মুক্তা দেখিবে, ইহার লোভে বাড়ী-ঘর ও মান-ইজ্জত ত্যাগ করিয়া চলিয়া আসিবে।
জর খেরাদরা ওয়ালাহ্ ওশায়েদা কুনদ।
খচ্ছা মোফ্লেছরা কে খোশ রেছওয়াকুনাদ।
জর আগার চে আকল মী আরাদ্ ওয়ালেকে,
মরদে আকেল বাইয়াদ্ উরা নেক নেক।
অর্থ: মাওলানা বলেন, স্বর্ণ মানুষকে পাগল করিয়া অপমানিত করে। বিশেষ করিয়া গরীবেরা খুব তাড়াতাড়ি লালসার জালে আবদ্ধ হইয়া লজ্জিত ও অপমানিত হয়। যদিও ধন-সম্পদ লোকের জ্ঞান বাড়াইয়া তোলে; কিন্তু সকলের জ্ঞান বাড়ে না। মাল দ্বারা জ্ঞান বাড়াইবার জন্য বিচক্ষণ জ্ঞানীর দরকার। কেননা, উহা সৎকাজে ব্যয় করা দরকার, যাহাতে দীন ও দুনিয়ার উপকার হয়। এজন্য চাই ধার্মিক ও সৎসাহসী হওয়া।
চুঁকে সুরতান আজ হেকিমে আঁরা শনীদ,
পন্দে উরা আজ দেলও জান বরগুজীদ্।
গোফ্তে ফরমানে তোরা ফরমানে কুনাম,
হরচে গুই আঁ চুঁনা কুন আঁ কুনাম।
অর্থ: যখন বাদশাহ্ হেকিম সাহেবের নিকট এই পরামর্শ শুনিলেন, তখনই তাঁহার উপদেশ মানিয়া লইলেন এবং বলিলেন, আপনার নির্দেশকেই আসল নির্দেশ বলিয়া মনে করিয়া লইব এবং যাহা কিছু করিতে আদেশ করিবেন, উহাই করিব।
বাদশাহ্ স্বর্ণকারকে আনিবার জন্য বিচক্ষণ, জ্ঞানী ও সুচতুর দুইজন দূত সামারকান্দে পাঠাইলেন
পাছে ফেরেস্তাদ আঁ তরফ এক দো রাছুল,
হাজেকানে ও কাফিয়ানে ও বছ আদুল।
তা ছামারকান্দ আমদান্দ আঁ দো আমীর,
পেশে আঁ জরগার জেশাহানশাহ্ বসির।
বা আয়ে লতিফে উস্তাদ কামেলে মারেফাত,
ফাশ আন্দর শহরে হা আজ তু ছেফাত।
তক্ ফালানে শাহ্ আজ বরায়ে জরগিরী,
ইখ্তিয়ারাত করদ জিরা মেহ্তরী।
ইঁ নাকইঁ খেলায়াত বগীর ও জর ও ছীম,
চু বইয়াই খাছে বাশী ও নাদীম।
অর্থ: বাদশাহ্ স্বর্ণকারকে আনিবার জন্য বিচক্ষণ, জ্ঞানী ও সুচতুর দেখিয়া দুইজন দূত সামারকান্দে পাঠাইলেন। তাহারা উভয়েই উক্ত কাজের জন্য যথেষ্ট উপযুক্ত ছিলেন। এই দুইজনেই বাদশাহর নিকট হইতে শুভ সংবাদ লইয়া স্বর্ণকারের সম্মুখে উপস্থিত হইলেন এবং বলিলেন, হে স্বর্ণকার! তুমি অত্যন্ত সুচারুরূপে মনোহর স্বর্ণালঙ্কার তৈয়ার করিতে পার। তুমি তোমার কারিগরীতে অদ্বিতীয় বলিয়া প্রমাণিত হইয়াছ। তোমার সুখ্যাতি সমস্ত দেশে ছড়াইয়া পড়িয়াছে। তাই অমুক বাদশাহ কিছু স্বর্ণ অলঙ্কার তৈয়ার করার জন্য তোমাকে পছন্দ করিয়াছেন। কেননা, তুমি একাই এই স্বর্ণ শিল্পে প্রসিদ্ধ ব্যক্তি। এই লও তোমার পুরস্কার, উপঢৌকন ও মালমাত্তা। যখন তুমি বাদশাহ্র নিকট পৌছিবে, তখন তুমি বাদশাহ্র দরবারে বিশেষ বন্ধু বলিয়া পরিগণিত হইবে।
মরদো মালো খেলায়াত বেছইয়ারে দীদ,
গোর্রাহ শোদ আজ শহ্রো ফরজন্দাঁ বুরীদ্।
আন্দার আমদ শাদে মানে দর রাহে মরদ,
বেজুজ কানে শাহ্ কছ্দে জানাশ করদ।
আছপে তাজী বর নেশাস্ত ও শাদে তাখ্ত।
খুন বহায়ে খেশরা খেলায়াত শেনাখ্ত।
আয় শোদাহ্ আন্দর ছফ্রেহা ছাদ রেজা,
খোদ বা পায়ে খেশ্ তা ছাওয়ায়েল কাজা।
দর খেয়ালাশ মুলকো এজ্জো মেহতরী,
গোফ্তে আজরাইল রও আরে বরী।
অর্থ: স্বর্ণকার যখন অনেক ধন-সম্পদ ও মালমাত্তা দেখিল, তখন মালের জন্য পাগল হইয়া গেল। স্ত্রী, পুত্র হইতে বিদায় হইয়া আনন্দে আটখানা হইয়া চলিতে লাগিল। কিন্তু সে বুঝিতে পারে নাই যে, বাদশাহ্ তাহাকে হত্যা করিবে। ঘোড়ার উপর সওয়ার হইয়া আনন্দে চলিতে লাগিল। ঘোড়াটিকে উপহারস্বরূপ মনে করিয়াছিল। ঐ ঘোড়াই তাহার জানের বিনিময় ছিল। মাওলানা বলেন, ঐ ব্যক্তির ভ্রমণে মনের আনন্দে নিজের পায়ে হাটিয়া দুর্ভাগ্য মৃত্যুর দিকে চলিয়া যাইতেছে। তাহার মনে রাজত্ব, সম্মান ও নেতৃত্বের খেয়াল পরিপূর্ণ ছিল এবং আজরাইল নিজের ভাষায় বিদ্রুপ সহকারে বলিয়াছিলেন, চলো, নিশ্চয় তুমি রাজত্ব ও সম্মান পাইবে।
চুঁ রছিদ আজ রাহে আঁ মরদে গরীব,
আন্দার আওরদাশ বা পেশে শাহ্ তবীব।
ছুয়ে শাহানশাহ্ বোরদাশ খোশ বনাজ,
তা বছুজাদ বরছারে শামায়া তরাজ।
শাহ্দীদ উরা ও বছ তাজীম করদ্,
মাখজানে জর্রা বদু তাছলিমে কর্দ।
পাছ ফরমুদাশ কে বর ছাজাদ জে জর।
আজ ছেওয়ার ও তাওকে ও খলখাল ও কোমর।
হাম জে আনওয়ায়ে আওয়ানি বে আদাদ,
কানে চুনানে দর বজমে শাহেনশাহ্ ছাজাদ।
জর গেরেফ্ত আঁ মরদ ও শোদ মশগুলেকার,
বে খবর আজ হালতে আঁ কারেজার।
অর্থ: যখন স্বর্ণকার অনেক পথ অতিক্রম করিয়া আসিয়া পৌঁছিল, তখনই তবীব সাহেব তাহাকে বাদশাহ্র সম্মুখে নিয়া হাজির করিলেন। তবীব সাহেব অতি সন্তুষ্ট চিত্তে স্বর্ণকারকে লইয়া বাদশাহর নিকট গেলেন। এইজন্য যে, স্বর্ণকারকে দাসীর জন্য জ্বালাইয়া দিতে পারিবে। বাদশাহ্ তাহাকে দেখিবা মাত্র সম্মানিত করিলেন ও স্বর্ণের স্তুপ তাহার সম্মুখে হাজির করিয়া দিয়া বলিলেন, ইহা দ্বারা তুমি কঙ্কণ, হার, বালা ও পেয়ালা ইত্যাদি তৈয়ার করিবে, যাহা বাদশাহর দরবারে শোভা পায়। স্বর্ণকার স্বর্ণ নিয়া কাজে লাগিয়া গেল। কিন্তু প্রকৃত রহস্যের কথা বুঝিতে পারিল না।
পাছ হেকীমাশ গোফ্তে কায়ে ছুলতান মেহ,
আঁ কানিজাক রা বদী খাজা বদেহ্।
তা কানিজাক দর বেছালাশ খোশ শোদ,
আব বেছালাশ দাফেয় আঁ আতেশ শাওয়াদ।
অর্থ: তারপর হেকীম সাহেব বাদশাহ্কে বলিলেন, দাসীকে বিবাহ-সূত্রে স্বর্ণকারের কাছে দিয়া দেন। তাহা হইলে স্বর্ণকারের সহিত তাহার মিলনে বিরহ জ্বালা দূর হইয়া যাইবে।
শাহ্ বদু বখশীদ আঁ মাহ রুয়েরা,
জুফতে করদ আঁ হরদো ছোহবাত জুরেরা।
মুদ্দাত শশ্ মাহে মী রান্দান্দে কাম,
তাব ছোহবাত আমদ আঁ দোখতার তামাম।
অর্থ: বাদশাহ ঐ দাসীকে বিবাহসূত্রে স্বর্ণকারকে দিয়া দিলেন। এখন উভয়েই মিলন-বাসনার সুযোগ পাইল। আতএব, উভয়েই একে অন্যের থেকে ছয় মাস পর্যন্ত বাঞ্ছিত মিলনের ফল ভোগ করিল এবং দাসী সম্পূর্ণ সুস্থ হইয়া গেল।
“মাহবুবের মিলনে শরীর সুস্থ হওয়াটা ডাক্তারী বিধান।”
বাদে আজ আঁ আজ বহরে উ শরবতে বছাখত,
তা বখোরদ ও পেশে দখতর মী গোদাখত,
চুঁ জর ব খোরিয়ে জামাল উ নামানাদ,
জানে দোখতার দরু বালে উ না মানাদ।
চুঁকে জেশত ও নাখোশ ও রোখে জর শোদ,
আন্দেক আন্দেক আজ দেলে উ ছরদ শোদ।
অর্থ: ইহার পর বিজ্ঞ হেকীম সাহেব স্বর্ণকারকে পান করাইবার জন্য এক প্রকার শরবত তৈয়ার করিলেন। স্বর্ণকার ঐ শরবত পান করিত এবং দাসীর নিকট আসা-যাওয়া করিত। শরবত পান করার দরুন স্বর্ণকারের চেহারার রং ক্রমান্বয়ে খারাপ হইতে লাগিল। যখন স্বর্ণকারের চেহারা সম্পূর্ণভাবে কুশ্রী হইয়া পড়িল – পূর্বের সেই সৌন্দর্য্য আর বাকী নাই, তখন দাসীর মন আস্তে আস্তে স্বর্ণকার হইতে দূরে সরিয়া পড়িল এবং স্বর্ণকারকে খারাপ দৃষ্টিতে দেখিতে আরম্ভ করিল। অন্তর হইতে স্বর্ণকারের ভালোবাসা ভুলিয়া গেল।
ইশকে হায়ে কাজ পায়ে রংগে বুদ,
ইশকে নাবুদ আকে বাত নাংগে বুদ।
অর্থ: মাওলানা বলেন, উপরের ঘটনা দ্বারা দেখা যায় যে স্বর্ণকারের রূপ-লাবণ্য লোপ পাওয়ার দরুন দাসীর ভালোবাসাও লোপ হইয়া গেল। ইহাতে বুঝা যায় যে, প্রেম ও ভালোবাসা শুধু রূপ-লাবণ্য দেখিয়া মোহে আবদ্ধ হয়, উহা প্রকৃতপক্ষে ইশ্ক বা প্রেম নয়। উহার শেষ ফল লজ্জিত ও নিরাশ হওয়া ছাড়া আর কিছুই নয়। অর্থাৎ, ইশ্কের ফলাফল যাহা প্রাপ্য, এ প্রকার ইশ্ক দ্বারা তাহা হাসিল করা যায় না, বরং উহার শেষফল দুঃখময় ও লজ্জাপূর্ণ। যখন ঐরূপ প্রেমের প্রকৃত অবস্থা প্রকাশ পায়, তখন আফসোস করে যে, আমি কী প্রকার পশুত্বের মধ্যে লিপ্ত ছিলাম।
ভাব: এখানে উপরোল্লিখিত ঘটনা দ্বারা বুঝা যায় যে ইশ্কে মাজাজী নিন্দনীয়। কারণ, উহার শেষফল হতাশা ও নিরাশা ব্যতীত কিছুই নয়। কিন্তু ইশ্কে মাজাজী ছাড়া ইশ্কে হাকিকী পয়দা হয়না। ইহা একটি স্বতঃসিদ্ধ নিয়ম।
প্রকাশ থাকে যে, ইশ্কে মাজাজী করিতে হইলে কয়েকটি নিয়মের অধীন থাকা দরকার; তাহা না হইলে ইশ্কে হাকিকী পয়দা হইবে না। যেমন, অন্যস্থানে ইহার শর্তাবলী বর্ণনা করা হইয়াছে।
ফাশ কানে হাম নাংগে বুদে ইয়াক্ছীর,
তা না রফ্তে বর ওয়ায়ে আঁ বদ দাওয়ারী।
অর্থ: মাওলানা বলেন, ইশ্কে মাজাজীর মধ্যে যদি শর্তসমূহ পালিত না হয়, তবে উহার পরিণতি একদম শোচনীয়। তদোপরি, যদি ইশ্কে মাজাজীর ব্যাপারে অপক্ক হয়, অথবা শীঘ্রই লোপ পায়, তবে তাহার অবস্থা আরো শোচনীয়রূপ পরিগ্রহ করে। যেমন, উল্লেখিত দাসী ও স্বর্ণকারের অবস্থা।
চুঁ দাওবিদ আজ চশমে হাম চুঁ জুয়ে উ,
দুশমনে জানে ওয়ায়ে আমদ রুয়ে উ।
দুশমনে তাউছ আমদ পররে উ,
আয়ে বছা শাহরা বকোশতা কররে উ।
অর্থ: মাওলানা বলেন, স্বর্ণকারের সৌন্দর্য তাহার জানের দুষমন ছিল। অর্থাৎ, সৌন্দর্যের কারণে এখন তাহাকে মৃত্যু বরণ করিতে হয়। তাই সে নিজের মৃত্যুর কথা মনে করিয়া দুঃখে তাহার চক্ষু হইতে নদীর স্রোতের ন্যায় অশ্রু বহিতেছে। যেমন, ময়ূর পাখীর প্রাণ বধের কারণ সুন্দর পাখা। সুন্দর পাখা না থকিলে তাহাকে কেহ শিকার করিত না। এ রকম অনেক বাদশাহ্ আছেন, যাহাদের নিহত হওয়ার কারণ তাহাদের শান-শওকাত ও দব্দবা। যদি তাহাদের শান-শওকাতের সুখ্যাতি না থাকিত, তবে তাহদের ভয় কাহারও অন্তরে থাকিত না এবং হত্যাও করিত না।
চুঁকে জরগার আজ মরজে বদ হালে শোদ,
ওয়াজ গোদাজাশ শখ্ছে উচুঁ নালে শোদ।
গোফতে মান আঁ আহুয়াম কাজ নাফে মান,
রীখত ইঁ ছাইয়াদ খুনে ছাফে মাঁন।
আয় মানে রু বাহ্ ছেহরা কাজ কমীন,
ছার বুরি দান্দাম বরায়ে পুস্তীন।
আয়ে মান আঁ পীলে কে জখমে পীলবান,
রীখতে খুনাম আজ বরায়ে উস্তোখান।
আঁকে কোশাছতাম পায়ে মা দুনেমান,
মী নাদানাদ কে নাখোছ পাদ খুনে মান।
বরনীস্ত এমরোজ ফরদা বর ওয়ায়েস্ত।
অর্থ: যখন স্বর্ণকার রোগে আক্রান্ত হইয়া খারাপ চেহারার হইয়া গেল এবং শরীর জীর্ণশীর্ণ হইয়া কলমের নিবের মত হইয়া গেল, তখন বলিতে লাগিল, আমার অবস্থা ঐ হরিণের ন্যায়, যাহার নাভীস্থল হইতে শিকারী সমস্ত রক্ত বাহির করিয়া নিয়াছে। অথবা ঐ হাতীর ন্যায়, যাহার হাড় নিবার জন্য হাতীর রক্ষক জখম করিয়া চলিয়াছে। যে ব্যক্তি আমাকে আমার চাইতে হীনতর মুনাফার জন্য হত্যা করিয়া চলিয়াছে; অর্থাৎ, হেকিম সাহেব আমাকে বাদশাহ্র উপকারের জন্য হত্যা করিতেছে। যে আনুপাতিকভাবে আমার চাইতে কম মরতবা রাখে। সে জানেনা যে আমার রক্ত বৃথা যাইবে না। আজ আমার ধ্বংস, কাল আমার হত্যাকারীর ধ্বংস অনিবার্য। আমার ন্যায় মানুষের রক্ত কখনও বৃথা যাইতে পারে না।
গারচে দেউয়ারে আাফগানাদ ছায়া দরাজ,
বাজে গরদাদ ছুয়ে উ আঁ ছায়া বাজ।
ইঁ জাহন কোহাস্ত ও ফেলে মান্দা,
ছুয়ে মা আইয়াদ নেদাহারা ছদা।
অর্থ: মাওলানা বলেন, ইহ-জগতের কর্মফল দেওয়ালের ছায়ার ন্যায়, প্রথমে ছায়া লম্বাভাবে পতিত হয়, তারপর আস্তে আস্তে ফিরিয়া আসিয়া নিজের উপর পতিত হয়। এই বিশ্বটা একটা পাহাড়ের ন্যায় এবং আমাদের কর্ম প্রতিধ্বনির ন্যায়। আওয়াজ দিবার পর নিশ্চয়ই প্রতিধ্বনি সৃষ্টি হয়। ঐ রকমভাবে আমাদের কর্মের ফলাফল আমাদের প্রতি-ই ফিরিয়া আসে।
ইঁ বদোফ্ত ও রফ্ত দরদম জীরে খাক,
আঁ কানিজাক শোদ জে ইশ্কো রঞ্জে পাক।
জাঁ কে ইশকে মরদেগানে পায়েন্দাহ্ নিস্ত,
চুঁ মুরদাহ্ ছুয়ে মা আয়েন্দাহ্ নিস্ত।
ইশ্কে জেন্দাহ দর রওয়াঁওদর বছর,
হরদমে বাশদ চুঁ গুন্চা তাজা তর।
ইশ্কে আঁ জেন্দাহ গুজী কো বাকীস্ত,
ওয়াজ শরাবে জান ফজাইয়াত ছাকীস্ত।
ইশ্কে আঁ বগুজী কে জুমলা আম্বিয়া,
ইয়াফতান্দ আজ ইশ্কে উ কারো কিয়া।
তু মগো মারা বদাঁ শাহ ইয়ারে নিস্ত,
বা করিমানে কারেহা দেশ ওয়ারে নিস্ত।
অর্থ: ঐ স্বর্ণকার তাহার বক্তব্য পেশ করিয়া মরিয়া গেল। দাসী তাহার প্রেম হইতে মুক্তি পাইল। বিরহ যাতনা দূর হইল। কেননা, মৃত লোকের প্রেম স্থায়ী নয়। যেমন, মৃত ব্যক্তি পুনঃ ফিরিয়া আসিবে না। কিন্তু, জীবিত ব্যক্তির প্রেম স্থায়ী, যেমন ‘হাইউল কাইউম’। আল্লাহ্তায়ালা চিরজীবী। তাঁহার প্রেমও চিরস্থায়ী। প্রেম রূহ্তে সর্বদা শক্তি যোগায়। অতএব, জীবিতের প্রেম করা চাই, যে সর্বদা জীবিত ও স্থায়ী। শরাব যেমন প্রাণে শান্তি ও আনন্দ দেয়, তেমনি প্রেম রূহ্কে শান্তি ও শক্তি দান করে। অতএব, ঐ চিরজীবীর ইশ্ক শিক্ষা করো, যাহার ইশ্কের দরুন সমস্ত আম্বিয়াগণ ইজ্জত ও সম্মানের অধিকারী হইয়াছেন। কিন্তু তুমি মনে করিও না যে, খোদার দরবার পর্যন্ত পৌঁছা আমার ন্যায় মানুষের কাজ নয়। কেননা, দয়ালুর নিকট কোনো কাজ-ই কঠিন নয়। তুমি যদি একাগ্র চিত্তে থাক, তবে তোমাকে তিনি দয়া করিয়া গ্রহণ করিবেন। কেননা, খোদাতায়ালা নিজেই বান্দার প্রতি দয়াপরবশ হইয়া বলিয়াছেন, আমার বান্দা যদি আমার দিকে এক বিঘত অগ্রসর হয়, তবে আমি তাহার দিকে এক হাত অগ্রসর হই। এইরূপভাবে বান্দা নিজে যতখানি অগ্রসর হইবে, আল্লাহ্তায়ালা দয়া করিয়া তাহার দিকে দ্বিগুণ-তিনগুণ বেশী অগ্রসর হইবেন।
আল্লাহর ইশারায় বিষ প্রয়োগে স্বর্ণকারের মৃত্যুর ঘটনা
কোস্তানে আঁ মরদে বর্ দস্তে হেকীম,
নায়ে পায়ে উমেদে বুদ ওনায়ে জেবীম।
ও না কুস্তান্ আজ বরায়ে তবেয় শাহ্,
তা নাইয়া মদ্ আ মরদে ইল্হাম আজ ইলাহ্।
অর্থ: ঐ স্বর্ণকারকে বিষপান করাইয়া হত্যা করা হেকীম সাহেবের কোনো স্বার্থের জন্য নহে যে, বাদশাহ্র নিকট হইতে পুরস্কার লাভ করিবে অথবা বাদশাহ্র তরফ হইতে কোনো ভীতির কারণও ছিল না এবং বাদশাহ্র সন্তুষ্টির জন্যও ছিল না। শুধু আল্লাহর ইশারায় হত্যা করা হইয়াছিল।
আঁ পেছার রা কাশে খেজরে বা বুরিদে হল্ক,
ছের্রে আঁরা দর্ নাইয়াবদ্ আমে খল্ক।
অর্থ: এই উদাহরণ, যেমন, হজরত খিজির (আঃ) এক বালককে হত্যা করিয়া ফেলিয়াছিলেন। তাহার ভেদ অনুধাবন করা সর্বসাধারণের পক্ষে সহজ নয়।
আঁকে আজ হক্কে ইয়াবদ্ আও ওহিয়ে খেতাব,
হরচে ফরমাইয়াদ্ বুদে আইনে ছওয়াব।
আঁকে জানে বখ্শাদ্ আগার বকুশাদ রওয়াস্ত।
নায়েব্যস্ত ও দাস্তে উ দাস্তে খোদস্ত।
অর্থ: এই কাজের প্রমাণ হওয়া চাই – আল্লাহর নিকট হইতে ওহি বা ইল্হাম প্রাপ্ত হওয়া। আল্লাহ্ যাহা বলিবেন তাহাই সত্য এবং সঠিক। যিনি জান দান করেন, তিনি মৃত্যুও দিতে পারেন। অর্থাৎ, আল্লাহতায়ালা রূহ্ প্রদান করিতে পারেন এবং তিনি-ই উহা কবজ করাইতে পারেন। যাহা হউক, প্রতিনিধির কাজও তাঁহার কাজ। সেই হেতু, আমাদের আপত্তি করার কোনো কারণ নাই।
হাম্চু ইস্মাইলে পেশাশ ছার রনেহ্,
শাদ্ ও খান্দাঁ পেশে তেগাশ্ জান্ বদেহ্।
তা বে মানাদ্ জানাত্ খান্দাঁ তা আবাদ্,
হাম্চু জানে পাকে আহ্মদ বা আহাদ্।
অর্থ: মাওলানা এখানে হযরত ইস্মাইল (আঃ) ও আমাদের প্রিয় নবী হজরত মোহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম)-এর দৃষ্টান্ত পেশ করিয়া বলিতেছেন, যেমন হজরত ইস্মাইল (আঃ) মৃত্যুর সম্মুখে নিজের গর্দান রাখিয়া দিলেন, হাসি-মুখে তরবারির নিচে নিজের জান দিয়া দিলেন। কেননা, তিনি জানিতেন যে মাহ্বুবের নৈকট্য লাভ করিতে পারিলেই চিরদিন প্রাণ শান্তিতে থাকিতে পারিবে। যেমন, হজরত মোহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম) আহ্কামে ইলাহির উপর সন্তুষ্ট চিত্তে রাজী থাকিয়া পূর্ণভাবে আমল করিয়া খোদার সন্তুষ্টি লাভ করিয়াছেন।
আশেকানে জামে ফরাহ্ আঁগাহ্ কাশান্দ,
কে বদস্তে খেশে খুবানে শানে কুশান্দ।
অর্থ: প্রেমিকরা ঐ সময় সন্তুষ্টি লাভ করে, যে সময় মাশুক নিজের হাতে তাহাকে হত্যা করে।
ভাব: খোদার প্রেমিক ঐ সময় সান্ত্বনা পায়, যে সময় পীরে কামেল প্রিয় মুরশেদ রিয়াজাতের কঠিন পদ্ধতি বাতলাইয়া দেন এবং উহা দ্বারা কু-রিপুগুলি দমন হইয়া যায়। তখন সে স্থায়ী শান্তি লাভ করিতে থাকে। তাহাতেই সে তৃপ্তি পায়। অতএব, কামেল পীরের নির্দেশে কঠিন রিয়াজাতে অভ্যস্ত হওয়া দরকার।
শাহ্ আঁ পায়ে শাহ্ওয়াত্ না কর্দ,
তু রেহা কুন্ বদ্ গুমানে ও না বোরাদ্।
তু গুমানে করদী কে করদ্ আলুদেগী,
দর ছাফ্ গাশ্কে হেলাদ্ পালুদেগী।
বহ্র আঁ নাস্ত ইঁরিয়াজাত ওইঁ জাফা,
তা বর আরাদ্ কো রাহে আজ্ নাক্ রাহ্ জাফা।
বোগ্জার আজ্ জন্নে খাতা আয় বদ্গুমান,
ইন্নাবাজা জ্জান্নে ইসমারা বখাঁন।
বহ্রে আঁ নাস্তে ইম্তেহানে নেক্ ও বদ্
তা বজুশাদ্ বর ছারে আরাদ্ জর্রে জাবাদ্।
গার না বুদে কারাশে ইল্হামে ইলাহ্,
উ ছাগে বুদে দরান্দাহ্ না শাহ্।
পাকে বুদ্ আজ শাহ্ওয়াতে ও হেরছো ও হাওয়া,
নেকে করদ্ উ লেকে নেক্ বদ্নমা।
অর্থ: বাদশাহ্ ঐ হত্যা কু-রিপুর তাড়নায় করেন নাই। তোমরা তাঁহার প্রতি খারাপ ধারণা করিও না। তুমি হয়ত ধারণা করিবে যে বাদশাহ ঐ কাজ পাপের কাজ করিয়াছেন। কিন্তু, এই ধারণা ভুল। কেননা, বাদশাহ রিয়াজাত দ্বারা অন্তর সাফ তথা পুতঃপবিত্রতা হাসিল করিয়াছেন। আত্মিক পরিশুদ্ধির রিয়াজাতের মধ্যে কোনো খারাপ কাজের ধারণা থাকিতে পারে না। এই জন্যই রিয়াজাত ও মোজাহেদাহ্ চর্চা করা হয়। ইহা দ্বারা নেক কাজের গুণ সঞ্চয় হয়। বদ কাজের ক্ষমতা লোপ পায়। যেমন, রৌপ্যকার রূপা গলাইয়া আবর্জনা, ময়লা পরিষ্কার করে, গলানো কাজ রিয়াজাতের ন্যায় ময়লা জুদা হওয়া তাসফিয়া-স্বরূপ। অতএব, তোমাদের খারাপ ধারণা করা চাই না। কেননা, আল্লাহতায়ালা কী বলিয়াছেন, খেয়াল করা চাই। তিনি বলিয়াছেন, কোনো কোনো সন্দেহ নিশ্চয়-ই পাপ। ভাল-মন্দের পরীক্ষা এইজন্য করা হয় যে, প্রত্যেককেই পৃথকভাবে জানা যায়। যেমন, স্বর্ণ গরম পাইয়া উত্তপ্ত হইতে থাকিলে আবর্জনা ও ময়লা সমস্ত উপরে আসিয়া ভাসিতে থাকে এবং সহজেই বাহির করিয়া ফেলিয়া দেওয়া যায়। এখন দেখা যায় যে, বাদশাহ্র কাজ যদি ইল্হাম অনুযায়ী না হইত, তাহা হইলে তাহাকে স্বার্থের কুত্তা বলা হইত। বাদশাহ কী করিয়া হইত? প্রকৃতপক্ষে বাদশাহ্ লোভ-লালসা হইতে পবিত্র ছিলেন। তিনি যাহা কিছু করিয়াছেন, ভালই করিয়াছেন, কিন্তু প্রকাশ্যে খারাপ দেখায়।
গোর্ খেজের্ দর্ বহারে কেশ্তি রা শেকাস্ত,
ছদ্ দরুস্তী দর্শেকাস্তে খেজেরে হাস্ত।
ও হাম্ মূছা বা হামা নূরো ও হুনার,
শোদ্ আজ আঁ মাহ্জুব তুবে পর্ মপর্।
অর্থ: যদিও খিজির (আঃ) দরিয়ার মাঝে নৌকা ছিদ্র করিয়া দিয়াছিলেন, কিন্তু খিজিরের ছিদ্র করাই নৌকার উত্তম হেফাজাত ছিল এবং হজরত মূসা (আঃ) মারেফাত ও নবুয়তে পরিপূর্ণ জ্ঞান থাকা সত্ত্বেও হজরত খিজিরের (আঃ) কাজের ভেদ বুঝিয়া উঠিতে পারেন নাই। অতএব, তোমরা পাখা ব্যতীত উড়িতে চেষ্টা করিও না।
আঁ গোলে ছুরখাস্ত তু খুনাশ মখাঁ,
মস্তে আকলাস্ত উতু মজনুনাশ মখাঁ।
অর্থ: কোনো কোনো সময় নেক-কর্ম ও বদ-কর্ম একই রকম দেখায়। যেমন, লাল গোলাপ এবং রক্ত একই রং দেখায়, কিন্তু পাক আর না-পাকির মধ্যে পার্থক্য আছে। ঐ রকম এক ব্যক্তি জ্ঞানে ও মারেফাতে পরিপূর্ণ বিধায় বে-খোদীতে মশগুল এবং অন্য ব্যক্তি পাগল, জ্ঞানহারা; উভয়কেই এক রকম দেখায়, কিন্তু উভয়ের মধ্যে আকাশ-পাতাল ব্যবধান আছে। অতএব, বাহ্যিক দৃষ্টিতে এক রকম দেখাইলে উভয়কে এক রকম মনে করা ঠিক নহে।
গারবুদে খুনে মোছলমান কামে উ,
কাফেরাম গার বুরদামে মান নামে উ।
মী বলার জাদ আরশে আজ মদেহ্ শাকী,
বদগুমান গরদাদ জে মদাহাশ মোত্তাকী।
অর্থ: মাওলানা বলেন, যদি ঐ ব্যক্তির মুসলমান হত্যা করা উদ্দেশ্য হইত, তবে আমার পক্ষে তাহার নাম লওয়াও কুফরী হইত। কেননা, হাদীসে বর্ণিত হইয়াছে যে, যদি কোনো ব্যক্তি ফাসেক ব্যক্তির প্রশংসা করে, তবে আল্লাহতায়ালা রাগান্বিত হন এবং আল্লাহর আরশ কাঁপিয়া উঠে এবং ফাসেকের প্রশংসায় নেক লোক খারাপ বলিয়া প্রমাণিত হয়।
শাহবুদ ওশাহে বছ আগাহ্বুদ,
খাছ বুদ ও খাচ্ছায় আল্লাহ বুদ।
অর্থ: বাদশাহ বাদশাহ-ই ছিলেন, এবং আল্লাহর অলিও ছিলেন। আল্লাহর খাস বান্দা হিসাবে মহাপ্রভুর নিকট প্রিয় ছিলেন।
আঁ কাছেরা কাশ চুনিইঁ শাহে কোশাদ।
ছুয়ে তখতো ও বেহতরিইঁ জায়ে কাশাদ।
অর্থ: মাওলানা বলেন, হয়ত স্বর্ণকারকে হত্যা করায় স্বর্ণকারের উপকার হইয়াছে। যেমন, খিজির (আঃ) বালককে হত্যা করিয়াছিলেন, বালকের উপকারের জন্য। সেই রকম স্বর্ণকারকে তার পরকালের শান্তির জন্য হত্যা করা হইয়াছে; যাহা ইহকালের বাদশাহীর চাইতেও মঙ্গলময়।
কহর খাছে আজ বরায়ে লুৎফে আম,
শরায়ামী দারাদ রওয়া বুগজারে গাম।
অর্থ: সর্বসাধারণের উপকারের জন্য ব্যক্তিগত ক্ষতি স্বীকার করা মোহাম্মদী শরিয়াতে জায়েজ আছে। ইহাতে কাহারও আপত্তি করা উচিত না।
গার নাদীদে ছুদে উ দর কাহারে উ,
কায়ে শোদে আঁ লুৎফে মতলক্ কাহারে উ।
তেফ্লে মী লারজাদ জেনেশে ইহ্তে জাম,
মাদারে মুশফেক আজাঁ গম শাদে কাম।
নীমে জানে বোস্তানাদ ও ছদ জানে দেহাদ,
আঁচে দরু হিম্মাত নাইয়ায়েদ আঁ দেহাদ্।
তু কিয়াছ আজ শেখ মগিরি ওয়ালেকে,
দুর দুর উফতাদাহ্ বে নেগার তু নেক।
পেশতর আতা বগুইয়েম কেচ্ছা।
বুকে ইয়াবি আজ বইয়া নাম্ হেচ্ছা।
অর্থ: মাওলানা বলেন, অস্থায়ী প্রাণ চলিয়া গেলে স্থায়ী প্রাণ পাওয়া যায়। ইহাতে যাহার সাহস নাই, তাহাকেও প্রাণ দিতে হইবে। তাহা হইলে স্থায়ী জীবন লাভ করিতে পারিবে। অর্থাৎ, যদিও প্রকাশ্যে দেখা যায় যে স্বর্ণকার মৃত্যুমুখে পতিত হইয়াছে, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে সে চিরস্থায়ী জীবন লাভ করিয়াছে। এইজন্য তুমি বুজর্গ আদমীকে তোমার নিজের ন্যায় অনুমান করিও না। তুমি বোজর্গবৃন্দের মহত্ব অনুভব করা হইতে বহু দূরে অবস্থান করিতেছ। এ সম্বন্ধে আমি একটি গল্প বলিব। আশা করি এই গল্প দ্বারা উল্লিখিত ঘটনা তুমি পরিষ্কারভাবে বুঝিতে পারিবে।
একজন বাক্কলী দোকান্দার ও একটি তোতা পাথী, এবং তোতা পাখীর দোকানের তৈল ফেলিয়া দেওয়া, বাক্কলী দোকানদারের জিজ্ঞাসা করায় তোতার চুপ করিয়া থাকা
বুদ বাক্কএল মর উরা তুতী,
খুশ নাওয়া ও ছবজো গুইয়া তুতী
বর দোকানে বুদে নেগাহবানে কানে,
নক্তাহ্ গোফ্তে বা হামা ছওদা গারানে।
দর খেতাবে আদমী নাতেক বুদে,
দর নাওয়ায়ে তুতীয়াঁ হাজেক বুদে।
অর্থ: মাওলানা বলেন, এক আতর বিক্রেতার একটি তোতা পাখী ছিল। পাখীটি সুমধুর সুরে আওয়াজ দিতে পারিত। আতর বিক্রেতা তোতাকে দোকান দেখাশুনার জন্য রাখিত। ঐ তোতা মানুষের ন্যায় খরিদ্দারদের সাথে কথা-বার্তা বলিতে জানিত। পাখীটি কথা বলার দিক দিয়া মানুষের ন্যায় ছিল। এবং সুমধুর গান করিতে সক্ষম সুচতুর তোতা পাখী ছিল।
খাজা রোজে ছুয়ে খানা রফতাহ্ বুদ,
দর দোকানে তুতী নেগাহবানে নামুদ।
গোরবায়ে বরজুস্ত নাগাহ্ আজ দোকান,
বহরে মুশে তুতীক আজ বীমে জান।
জুস্তে আজ ছদরে দোকান ছুয়ে গেরীখ্ত,
শীশাহায়ে রৌগানে গোল রা বরীখ্ত।
অর্থ: একদিন মালিক তোতাকে দোকান দেখাশুনা করার জন্য রাখিয়া বাড়ী চলিয়া গেল। হঠাৎ, একটা বিড়াল একটা ইদুর শিকার করার জন্য লম্ফ দিয়া পড়িল। তোতা দোকানের মাঝখানে গদীতে বসা ছিল। বিড়ালের ভয়েতে নিজের প্রাণ রক্ষার জন্য লম্ফ দিয়া এক পার্শ্বে যাইয়া বসিল। সেখানে আতরের শিশিগুলি রাখা ছিল। তোতার পাখা ও পায়ে লাগিয়া সমস্ত শিশি পড়িয়া গেল।
আজ ছুয়ে খানা বইয়া মদ খাজাশ,
বর দোকানে বনেশাস্ত ফারেগে খাজাওশ।
দীদে পুর রৌগানে দোকান ওজামা চরব,
বর ছারাশ জাদ গাস্ত কুল জে জরব।
অর্থ: বাড়ী হইতে যখন মালিক আসিল এবং নিশ্চিন্তে দোকানে বসিল, তখন দেখিতে পাইল যে, সমস্ত দোকান এবং যে সমস্ত ফরাশ কাপড় বিছানো ছিল সবই তৈলে সিক্ত হইয়া গিয়াছে। মালিক নমুনা দেখিয়া বুঝিল যে, এই সব কাণ্ড ঐ তোতার কারণেই হইয়াছে। রাগান্বিত হইয়া তোতাকে এত পরিমাণ মারিল যে, তোতার ‘পর’ (পালক) সবই উড়িয়া গেল। অবশেষে টাক-পড়া হইয়া গেল।
রোজ কে চান্দে ছুকান কোতাহ করদ,
মরদে বাক্কাল আজ নাদামাত আহ্করদ।
রেশে বর মী কুনাদ ও গোফ্ত আয়ে দেরেগ,
কা আফ্তাবে নেয়ামাতাম শোদ জীরে মেগ।
দস্তে মান বশে কাস্তাহ বুদে আঁ জমান,
চুঁ জাদাম মান বর ছারে আঁ খোশ জবান।
হাদীয়াহা মী দাদ হর দরবেশ রা,
তা বইয়ায়েদ নূতকে মোরগে খোশেরা।
অর্থ: কয়েকদিন পর্যন্ত তোতা রাগ হইয়া কথা বলা ত্যাগ করিয়া দিয়াছে। ইহাতে আতর বিক্রেতা অত্যন্ত দুঃখিত ও লজ্জিত হইল এবং শুধু নিজের দাড়ী ও চুল অঙ্গুলি দিয়া মোচড়াইতেছিল আর আফসোস করিতেছিল, আহা! আমার দোকানের রৌনাক চলিয়া যাইতেছে। যেমন, বাদলা দিনে সূ্র্যের কিরণ ঢাকিয়া যায়, জমিনের চাকচিক্য কমিয়া যায়, সেই রকম আমার দোকানের রৌশনি চলিয়া যাইতেছে। আমি যখন ইহাকে মারিতে ছিলাম, তখন আমার হাত ভাঙ্গিয়া গেল না কেন? সে গরীব-মিসকীনকে দান-খয়রাত করিতে আরম্ভ করিল, যাহাতে তোতা পুনঃ কথা বলিতে আরম্ভ করে।
বাদে ছে রোজ ও ছে শবে হয়রান ও জার,
বর দোকানে বনেশাস্তাহ বুদ নাও উমেদ ওয়ার
বা হাজারাঁ গোচ্ছা ওগম গাস্তে জোফ্ত,
কা আয়ে আজব ইঁ মোরগেকে আইয়াদ গোফ্ত।
মী নামুদ আঁ মোরগেরা হর গোঁ শেগাফ্ত,
ওয়াজ তায়াজ্জুব লবে বদান্দান মী গেরেফ্ত।
ওয়া মী দমে মী গোফ্ত বা উ হর ছুখান,
তাকে বাশদ আন্দর আইয়াদ দর ছুখান।
বর উমেদে আঁকে মোরগে আইয়াদ বগোফ্ত,
চশমে উরা বা ছুয়ারে মী করদে জুফ্ত।
অর্থ: এইভাবে তিন দিন তিন রাত্রি অতিবাহিত হইবার পর আতর বিক্রেতা অত্যন্ত চিন্তিত ও দুঃখিত অবস্থায় নিরাশ হইয়া দোকানে বসিয়া ভাবিতেছিল যে, দেখি তোতা কোন্ সময় কথা বলে। নানা প্রকারের আশ্চর্যজনক বস্তু তাহাকে দেখাইতেছিল এবং অবাক হইয়া দাঁতে অঙ্গুলি কাটিতেছিল। তোতার সাথে নানা প্রকারের রং ঢং-এর কথাবার্তা বলিতেছিল, যাহাতে তোতা কথা বলিয়া উঠে। উহার কথা বলার আশায় সম্মুখে রং বেরংয়ের ছবি নিয়া দেখাইতেছিল। কিন্তু কিছুতেই ফল হইতেছিল না।
জও লাকিয়ে ছার বরহেনা মী গোজাস্ত,
বা ছারে বে মুচু পোস্ত তাছে ও তাস্ত।
তুতী আন্দর গোফতে আমদ দর জমান,
বাংগে বর দরবেশে জাদ কে আয়ফুলান।
আজ চে আয়ে কুল বাকেলানে আ মিখ্তি,
তু মাগার আজ শিশায়ে রৌগান রীখ্তি।
আজ কিয়াছাশ খান্দাহ্ আমদ খলকেরা,
কো চ খো পেন্দাস্তে ছাহেবে দল্কেরা।
অর্থ: তিন দিন পরে আতর বিক্রেতা নিরাশ অবস্থায় দোকানে বসিয়াছিল। এমন সময় ছেঁড়া কম্বল পরিধানকারী মাথায় টাক পড়া এক দরবেশ ঐ দোকানের সম্মুখে দিয়া যাইতেছিল। তাহার মাথা শকুনের মাথার ন্যায় পরিষ্কার ছিল। তোতা তাহাকে দেখিবামাত্র বলিয়া উঠিল; ওহে দরবেশ! তোমার মাথায় টাক! কীভাবে তোমার মাথায় টাক পড়িয়াছে? মনে হয়, তুমি কাহারো আতরের শিশি ঢালিয়া ফেলিয়াছ। লোকে তোতার এই কথা শুনিয়া হাসিয়া উঠিল এবং বলিল, দেখো, এই তোতা দরবেশকেও নিজের মত মনে করিয়াছে যে, এই ব্যক্তিও আমার ন্যায় আতর ফেলিয়া দিয়াছে। তাহাতে মার খাইয়া মাথার চুল উঠিয়া গিয়াছে।
কারে পাকাঁরা কিয়াছ আজ খোদ মসীর,
গারচে মানাদ দর নাবেস্তান শের ও ছির।
জুমলা আলম জেইঁ ছবাব গোমরাহ্ শোদ্,
কমকাছে জে আবদালে হক্কে আগাহ্ শোদ।
আশকিয়ারা দীদায়ে বীনা নাবুদ,
নেক ও বদ দর দীদাহ্ শানে একছাঁ নামুদ।
হামছেরী বা আম্বিয়া বর দাস্তান্দ,
আওলিয়ারা হামচু খোদ পেন্দাস্তান্দ।
গোফ্তে ইঁনাফ মা বাসার ইঁশাঁ বাসার,
মাও ইঁশাঁ বস্তাহ্ খা বীমো খোর।
ইঁ নাদানেস্তান্দ ইঁশাঁ আজ আমা,
হাস্তে ফরকে দরমিয়ানে বে মুনতাহা।
অর্থ: তোতা পাখির ঘটনা উল্লেখ করার পর মাওলানা পাঠকদিগকে উপদেশ দিতে যাইয়া বলিতেছেন, বুজর্গ লোকের কাজ দেখিয়া নিজের কাজের উপর ’কিয়াস’ করিওনা। কেননা, খেয়াল করিয়া দেখ, যদিও শব্দ ‘শীর’ ও ‘সীর’ লিখনে একই বানান, কিন্তু অর্থের দিক দিয়া দিন-রাত পার্থক্য। শীর অর্থ দুধ। আর সীর অর্থ রসুন। এই রকম মানুষ হিসাবে যদিও বুজর্গ লোক ও অন্য লোক একই রকম দেখায়, কিন্তু আমলের দিক দিয়া অনেক পার্থক্য আছে। তাই, নিজের উপর অন্যকে কিয়াস করা অথবা অন্যকে নিজের মত মনে করা ভুলের শামিল। হইতে পারে সে তোমার চাইতে উত্তম, অথবা তোমার চাইতে অধমও হইতে পারে। তাই, কাহাকেও কেহর ন্যায় অনুমান করা উচিত না। অধিকাংশ লোক ঐ রকম মনে করে বলিয়া পথভ্রষ্ট হইয়া গিয়াছে। তাহারা আওলিয়াদের অবস্থা সম্বন্ধে কিছুই জানিতে পারে নাই। বদলোকের চক্ষে দেখিবার শক্তি নাই। তাহারা ভাল ও মন্দকে একই রকম দেখে। এইজন্য কাফেরেরা আম্বিয়া আলাইহেচ্ছাল্লাম-গণকে নিজের সমতুল্য মনে করিয়া বলিত, নবীগণ মানুষ, আমরাও মানুষ। তাহারা খায়, ঘুমায়; আমরাও খাই, ঘুমাই। তাহাদের মধ্যে ও আমাদের মধ্যে পার্থক্য নাই। কাফেরদের অন্তর ত্যাড়া-বাঁকা ছিল বলিয়া নবীদের মোজেজা ও কার্যকলাপ চক্ষে ধরা পড়িত না। আম্বিয়া আলাইহিচ্ছাল্লাম ও সাধারণ মানুষের মধ্যে সীমাহীন পার্থক্য বিদ্যমান রহিয়াছে। দেখিবার মত শক্তি চক্ষে না থাকিলে কাহারও দোষ দেওয়া চলে না।
হর দো এক গোল খোরাদ জাম্বুর ও নহল,
লেকে জীইঁ শোদ নেশও জাঁ দীগার আছল।
হর দো গুণ আহু গেয়া খোরদান্দ ও আব,
জীইঁ একে ছারগীন শোদ ও জাঁ মেশকে নাব।
হরদো নে খোরদান্দ আজ এক আবখোর,
আঁ একে খালি ও আঁ পুর আজ শাকার।
ছদ হাজারানে ইঁ চুনিঁ আশবাহ বী,
ফরকে শানে হাফতাদ ছালাহ্ রাহ্ বী।
অর্থ: উপরোক্ত ভাব সম্প্রসারণ করিতে যাইয়া মাওলানা কয়েকটি দৃষ্টিন্ত দিয়া বলিতেছেন, মৌমাছি ও বল্লা দুইটি পোকা একই ফুল হইতে মধু পান করে। কিন্তু একটিতে শুধু কাটিতে জানে, অন্যটি মধু দান করে। দ্বিতীয় উদাহরণ, দুই প্রকার হরিণ প্রত্যেকেই জঙ্গলের ঘাস খায় ও পানি পান করে। এক প্রকারে শুধু লাদই পায়খানা করে। অন্য প্রকার হইতে মেশকে আম্বর পাওয়া যায়। তৃতীয় উদাহরণ, একই স্থানের মাটির রস পান করিয়া দুই প্রকারের গাছে বিভিন্ন ফল প্রদান করে; যেমন, নারিকেল গাছে নারিকেল দেয় এবং খেজুর গাছে সুমিষ্ট রস দান করে। এই রকম শত সহস্র উদাহরণ দেখা যায় এবং উহাদের মধ্যে অনেক পার্থক্য বিদ্যমান। অতএব, ইহা পরিষ্কারভাবে বুঝা গেল যে দুইটি বস্তু বা প্রাণী কোনো কোনো দিক দিয়া এক হইলেও অন্যদিক দিয়া পার্থক্য থাকে।
ইঁ খোরাদ গরদাদ পলিদী জু জুদা,
ও আঁ খোরাদ গরদাদ হামা নূরে খোদা।
ইঁ খোরাদ জে আইয়াদ হামা বুখলো ও হাছাদ,
ও আঁ খোরাদ জে আইয়াদ হামা ইশ্কে আহাদ।
অর্থ: মাওলানা বলেন, এইভাবে বুঝিয়া লও যে নেক্কার বদকারের মধ্যে অনেক পার্থক্য আছে। বদকার খায়, ঘুমায়, তাহার মধ্যে অপবিত্র ও অন্যায় বৃদ্ধি পায়। অন্তরে কৃপণতা ও হিংসা বাড়িয়া যায়। নেক্কার পানাহার করে; তাঁহার খোদার মহব্বত বৃদ্ধি পায়।
ইঁ জমিন পাক ও আঁ শু রাহাস্ত ও বদ,
ইঁ ফেরেস্তা পাক ও আঁ দেওয়াস্ত ও দাদ।
হরদো ছুরাত গার বাহাম মানাদ রওয়াস্ত,
আবে তলখো ও আবে শিরিন রা ছেফাত।
জুযকে ছাহেবে জওকে নাশে নাছাদ শরাব,
উ শেনাছাদ আবে খোশ আজ শুরাহ্ আব।
জুযকে ছাহেবে জওক নাশে নাছাদ তাউম,
শহদরা নাখোরদাহ্ কে দানাদ জে মুম।
অর্থ: এখানেও মাওলানা নেক্কার ও বদকারের পার্থক্য বর্ণনা করিয়াছেন। তিনি বলেন, নেক ব্যক্তি পাক জমিনের ন্যায়। আর বদকার লবণাক্ত জমিনের মত। এইরূপভাবে একজন নেক্কারকে ফেরেস্তার সহিত তুলনা করা যাইতে পারে। এবং বদকারকে শয়তান বা হিংস্র জন্তুর সাথে তুলনা করা যায়। এরূপ পার্থক্য থাকা সত্ত্বেও যদি প্রকাশ্যে যে কোনো দিক দিয়া সামঞ্জস্য থাকে, তবে তাহা অসম্ভব নহে। যেমন মিঠা পানি ও লবণাক্ত পানির মধ্যে কত পার্থক্য। প্রকাশ্যে পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার দিক দিয়া যদিও একই রকম হয়। কিন্তু স্বাদ ও মজার পার্থক্য অনুভব করা সকলের পক্ষে সম্ভব নয়। যাহার স্বাদ গ্রহণের শক্তি ঠিক আছে, সেই-ই ইহা পার্থক্য করিতে পারিবে যে, কোন্ পানি মিঠা আর কো্ পানি লবণাক্ত। এই রকম মুম এবং মধুর স্বাদের পার্থক্য ঐ ব্যক্ত করিতে পরিবে, যে ইহা পান করিয়োছে এবং খাইয়াছে, সে ব্যতীত কেহই অনুমান করিতে পারিবে না।
অতএব, যাহার মধ্যে ইশ্কে মারেফাতের অভ্যন্তরীণ শক্তি সতেজ ও প্রখর না হইবে, সে কখনও নেক ও বদকারের পার্থক্য করিতে পারিবে না।
ছেহের্ রা বা মোজেজাহ্ করদাহ্ কিয়াছ,
হরদোরা বর মকর পেন্দারাদ আছাছ।
ছাহেরানে বা মূছা আজ ইস্তিজাহ্ হা,
বর গেরেফতাহ্ চুঁ আছায়ে উ আছা।
জিইঁ আছা তা আঁ আছা ফরকিস্ত জরফ,
জিইঁ আমল তা আঁ আমল রাহি শগরাফ।
লায়নাতুল্লাহে ইঁ আমল রা দর কাফা,
রহ্মাতুল্লাহে আ আমল রা দর ওফা।
অর্থ: এখানে প্রকাশ্যে কাজ দেখিয়া অনুমান করা ভুল। এই সম্বন্ধে মাওলানা বলেন, ফেরাউন যাদুবিদ্যা এবং নবীদের মোজেজাকে এক রকম বলিয়া ধারণা করিয়াছে এবং উভয় কাজকেই ধোকাবাজী ও সম্মোহন বলিয়া ধারণা করিয়াছে; এইজন্য ফেরাউনের যাদুকরগণ হজরত মুসা (আঃ)-এর লাঠির সম্মুখে তাহাদের লাঠি নিয়া প্রতিদ্বন্দ্বিতা করিতে উদ্যত হইয়াছিল। কিন্তু লাঠিদ্বয়ের মধ্যে দিন-রাত পার্থক্য ছিল। হজরত মুসা (আঃ)-এর আমল এবং যাদুকারদের আমলের মধ্যে তুলনা ছিল না। যাদুকারদের আমলের প্রতি খোদার অভিশাপ নাজেল হইত এবং হজরত মুসা (আঃ)-এর আমলের প্রতি খোদার রহমত নাজেল হইত। কেননা, তিনি খোদার হুকুম পালন করিয়াছিলেন। খোদাতায়ালা তাঁহাকে লাঠি জমিনে ফেলিয়া দিতে আদেশ করিয়াছিলেন।
কাফেরানে আন্দর মরে বুজিনা তাবায়া,
আফতে আমদ্ দরুণে ছীনা তামায়া।
হরচে মরদাম মী কুনাদ্ বুজিনা হাম,
আঁকুনাদ্ কাজ মরদে বীনাদ্ দমবাদম।
উ গুমান্ বোরদাহ কেমান্ করদাম চু উ,
ফরকে রাকায়ে দানাদ্ আঁ আস্তিজাহ্রু।
ইঁ কুনাদ্ আজ আমরে ও আঁবহ্রে ছাতীজ,
বর্ছারে আস্তিজাহ্ রুইয়ানে খাকে রীজ।
অর্থ: মাওলানা বলেন, কাফের লোক মোসলমানের কাজের সহিত বানরের ন্যায় প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে। ইহাতে তাহাদের লালসার কারণে অন্ধকারাচ্ছন্ন হইয়া যায়। ইহাও এক প্রকার বিপদ। কেননা, ভবিষ্যতে আর কখনও প্রকৃত অবস্থা দেখিবার শক্তি হইবে না। বানর শুধু হিংসার বশবর্তী হইয়া মানুষে যাহা করে, তাহা অনুকরণ করে, এবং মনে করে যে আমিও মানুষের ন্যায় করিলাম। কিন্তু উভয় প্রকার কাজের মধ্যে যে পার্থক্য হয়, উহা কেমন করিয়া সে বুঝিবে? মানুষ তো খোদার নির্দেশ অনুযায়ী অথবা নিজের জ্ঞান দ্বারা হিতের জন্য কোন কাজ করে। চাই সে মঙ্গল শরিয়ত অনুযায়ী-ই হউক অথবা শরিয়তের বিরুদ্ধেই হউক। যে ভাবেই হউক, হয়ত পার্থিব মঙ্গল অথবা পরকালের মঙ্গলের জন্য চিন্তা করিয়া করে। কিন্তু বানরের কাজের মধ্যে ইহার কোনোটাই নাই। শুধু মানুষের অনুকরণ করাটাই তাহার উদ্দেশ্য। মাওলানা বলেন, এই প্রকার হিংসুক লোকের মুখের উপর ধুলি নিক্ষেপ করা উচিত। এইরূপভাবে সৎকাজ ও অসৎ কাজ প্রকাশ্যে একই রকম দেখায়। কিন্তু ফলাফল হিসাবে বহুৎ পার্থক্য দেখা যায়।
আঁ মুনাফেক্ বা মোয়াফে্কদর্ নামাজ,
আজ পায়ে ইস্তিজাহ্ আইয়াদ্ নায়ে নাইয়াজ।
দর নামাজে দর রোজায়ে ও হজ্জো জেহাদ,
বা মুনাফেক্ মোমেনানে দর্ বুর দোমাত।
মুমে নাঁরা বুরদে বাশদ্ আকেবাত,
বর মুনাফেক্ মাতে আন্দর আখেরাত।
গার্চে হরদো বরছারিয়েক্ বাজীয়ান্দ,
লেকে বাহাম মরুজী ও রাজিয়ান্দ।
হরিয়েকে ছুয়ে মাকামে খোদ্ রওয়াদ্,
হরিয়েকে বর উফুকে নামে খোদ্ রওয়াদ্।
অর্থ: উপরে যাহাদিগকে বানরের সহিত তুলনা করা হইয়াছে, এখানে তাহাদের সম্বন্ধে মাওলানা বলেন, মুনাফেকের দল মোসলমানদের সহিত প্রতিদ্বন্দ্বিতা করিয়া রোজা-নামাজ আদায় করে। কোনো কোনো সময় মোনাফেকেরা জয়লাভ করে। কিন্তু শেষফল, পরকালে মুসলমানদেরই ভাগ্যে জয়লাভ হইবে এবং মোনাফেকদের অদৃষ্টে পরাজয়ের গ্লানি লিখা আছে। মুসলমানেরা বেহেস্তে চলিয়া যাইবে, আর মোনাফেকরা জাহান্নামের নিচু স্তরে পতিত হইবে।
মোমেনাশ খানেশে জানাশ খোশ শওয়াদ,
দর মোনাফেক তন্দোপুর আতেশ শওয়াদ।
নামে আঁ মাহবুবে আজ জাতে ওয়ায়ে আস্ত,
নামে ইঁ মাব্গুছ জআফাতে ওয়ায়ে আস্তে।
মীমো ও ওয়াও ওমীমো নূন তাশরীফে নীস্ত,
লফজে মোমেন জুয্ পায়ে তারীফে নিস্ত।
গার মোনাফেক খানেশ ইঁ নামে দূন,
হামচু কাসদম মী খালাদ দর আন্দরূন।
গার না ইঁ নামে ইশতে ফাকে দোজখাস্ত,
পাছ চেরা দর ওয়ায়ে মজাকে দোজখাস্ত।
অর্থ: মাওলানা “মোনাফেক” ও “মোমেন” শব্দদ্বয়ের তাৎপর্য বর্ণনা করিতে যাইয়া বলিতেছেন, যদি কোনো ব্যক্তিকে মোমেন বলা হয়, তবে সে অত্যন্ত খুশী হয়। আর যদি কাহাকেও মোনাফেক বলা হয়, তবে সে রাগে অগ্নিবৎ রূপ ধারণ করে। ইহার কারণ শুধু শব্দের পার্থক্যের কারণে নয়, বরং অর্থের কারণে। কেননা, মোমেন শব্দ যে লোকের নিকট প্রিয় উহা শব্দের খাতিরে নয়। উহার অর্থ দ্বারা যে গুণ বুঝা যায়, সেই গুণ বা সিফাত লোকের নিকট প্রিয়। আর “মোনাফেক” শব্দ শুধু শব্দের দিক দিয়া অপ্রিয় নয়। ইহার অর্থে যে সব দোষ প্রকাশ পায়, তাহা লোকের কাছে অপ্রিয় বলিয়া অসন্তুষ্ট হয়। অক্ষর মীম, ওয়াও, মীম এবং নূনের মধ্যে কোনো বুজর্গী নাই। “মোমেন” শব্দ শুধু ঐ প্রিয় সিফাত বা গুণের চিহ্ণ মাত্র। এইরূপভাবে কাহাকেও যদি মোনাফেক বলা হয়, তবে সে যে রাগান্বিত হয়, তাহা শুধু উক্ত কারণেই, অন্য কিছু নয়। কেননা, মোনাফেক শব্দ দ্বারা অপ্রিয় বস্তু বা দোষ বুঝায়, যাহা দোজখে যাইবার উপযুক্ত। দোজখীদের নামের জন্যই মোনাফেক শব্দ বানান হইয়াছে। এইজন্য মোনাফেক বলিলেই লোকে অত্যন্ত রাগান্বিত হয়।
জেছ্তি ইঁ নামে বদ আজ হর্ফে নীস্ত,
তল্খী আঁ আরে বহ্রে আজ জরাফে নীস্ত।
অর্থ: মাওলানা বলেন, শব্দের উক্ত ক্রিয়া শব্দ বা অক্ষরসমূহের ক্রিয়া নয়, বরং অর্থের ক্রিয়া। দ্বিতীয় লাইনে ইহার উদাহরণ দিয়া বলিতেছেন যে, শব্দ যেমন পেয়ালা আর অর্থ যেমন পানি। নদীর পানি যদি লবণাক্ত হয়, তবে নদীর কারণেই হয়। উহাতে পেয়ালার কোনো ক্রিয়া থাকে না। এইরূপভাবে শব্দ দ্বারা যে খারাপ বৈশিষ্ট্য বুঝা যায়, উহা শব্দের কারণে নয়, বরং অর্থের কারণেই খারাপ বলিয়া মনে হয়। শব্দের ক্রিয়া অর্থের মধ্যে প্রভাব বিস্তার করে না।
হরফে জরফে আমদ দরু মায়ানি চু আব,
বহ্রে মায়ানি ইন্দাহু উম্মুল কিতাব।
বহ্রে তল্খো ও বহ্রে শিরিন হাম উনান,
দরমিয়ানে শানে বজরখে লাইয়াবগিয়ান,
ও আঁকে ইঁ হরদো জে এক আছলি রওয়ান
বরগোদাজ জিই হরদো রোতা আছল আঁ।
অর্থ: অক্ষরগুলি অর্থের পাত্রস্বরূপ। যেমন, পেয়ালা পানির পাত্র, সমুদ্র অর্থ ঐ পবিত্র জাত, যাহার নিকট ‘উম্মুল কিতাব’ আছে; অর্থাৎ আল্লাহ্তায়ালা। আল্লাহ্তায়ালাকে মাওলানা এখানে সমুদ্রের সহিত তুলনা করিয়াছেন। কেননা, সমুদ্র হইতে যে রকমে পানি সূর্য কিরণে বাষ্প হইয়া মেঘে পরিণত হয় এবং পরে বৃষ্টিরূপে জমিতে পতিত হইয়া পুনঃ ঐ পানি গড়াইয়া যাইয়া সমুদ্রের পানির সাথে মিলিত হয়, সেই রকম প্রত্যেক সৃ্ষ্ট বস্তু ও জীব আল্লাহর নিকট হইতে সৃষ্টি হইয়া আসে এবং শেষ পর্যন্ত আল্লাহ্র নিকটই প্রত্যাবর্তন করে। আল্লাহর নিকটই ‘উম্মুল কিতাব’ অর্থাৎ পবিত্র কুরআন মওজুদ আছে।
ভাব: ইহ-জগতের সৃষ্ট বস্তুসমূহ দেখিয়া সৃষ্টিকর্তার জাতের দিকে লক্ষ্য করিতে হইবে। বস্তুসমূহ হইতে খেয়াল ফিরাইয়া আল্লাহ্র প্রতি খেয়াল নিবদ্ধ করিতে হইবে। তাঁহার রং-বেরংয়ের কুদরত এবং নানা প্রকার শিল্পের রহস্য বুঝিতে চেষ্টা করিবে। প্রত্যেক বস্তুর পার্থক্য আয়ত্ত্ব করিতে শিখিবে। লবণাক্ত দরিয়া অর্থাৎ খারাপ বৈশিষ্ট্য এবং মিষ্টি পানি দরিয়া অর্থাৎ উত্তম গুণাবলী উভয়েই প্রকাশ্যে একইভাবে প্রবাহিত হইতেছে। কোনো কোনো সময়ে একই রকম বলিয়া সন্দেহ হইয়া যায়। যেমন বদান্যতা ও অযথা খরচ। কৃপণতা ও মিতব্যয়ী পরস্পর একই রকম বলিয়া মনে হয়। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এক নয়। ইহার মাঝখানে এমন একটি আবরণ আছে, যাহার দরুন একই বলিয়া বিবেচিত হইতে পারে না। ঐ স্তবক এমন একটি গুণ, যাহা দ্বারা সদৃশ বস্তুর পার্থক্য করা সহজ হইয়া পড়ে। যেমন, বদান্যতা দ্বারা অপরের উপকার সাধিত হয়। আর অপব্যয় দ্বারা নিজের আত্মার গরিমা বৃদ্ধি পায়। এই রকম অন্যান্য গুণের মধ্যেও পার্থক্য করা চলে। কিন্তু উভয়েই এক আল্লাহর সৃষ্ট, আল্লাহর নিকট হইতে প্রবাহিত হইবার শক্তি পায়। অতএব, এইসব গুণাগুণ সৃষ্টির রহস্য অনুধাবণ করিয়া আল্লাহর দিকে মনোনিবেশ করা অতি সহজ।
মসনবী শরীফ
মূল: মাওলানা জালালউদ্দিন রুমি (রহ:)
অনুবাদক: এ, বি, এম, আবদুল মান্নান
মুমতাজুল মোহদ্দেসীন, কলিকাতা আলিয়া মাদ্রাসা।
সূত্রঃ https://mishukifti.wordpress.com/