[বাংলা এই ভাবানুবাদ বরিশাল থেকে প্রায় ৫০ বছর আগে প্রকাশিত। এই দুর্লভ সংস্করণটি সরবরাহ করেছেন সুহৃদ (ব্যাংকার) নাঈমুল আহসান সাহেব। সম্পাদক – কাজী সাইফুদ্দীন হোসেন]
মসনবী শরীফ পর্ব-৯
জরে কল্বো ওজরে নেকো দর ইয়ার,
বে মাহাক্ হরগেজ না দারাদ ইতেবার।
হরকেরা দর জানে খোদা বনেহা মাহাক,
মর ইয়াকিন রা বাজে দানাদ উ জে শাক।
আঁকে গোফ্ত ইছ তাফতে কলবাকা মোস্তাফা,
আঁকাছে দানাদ কে পুর বুদ আজওফা,
দরদেহানে জেন্দাহ্ খাশা কে জেহাদ,
আঁগাহ্ আর আমদ কে বেরুনাশ নেহাদ
দর হাজারাণে লোকমাহ্ এক খাশাক খোরদ,
চুঁ দর আমদ হেচ্ছে জেন্দাহ্ পায়ে বা বোরদ।
অর্থ: মাওলানা পুনঃ ভাল-মন্দ পরিষ্কার করিয়া বুঝাইয়া দিবার চেষ্টা করিতেছেন। তিনি বলেন, নেক ও বদের দৃষ্টান্ত হইতেছে যেমন খাঁটি স্বর্ণ ও ভেজালযুক্ত স্বর্ণ দেখিতে একই রংয়ের দেখায়। কিন্তু মূলতঃ অনেক পার্থক্য থাকে। পরখ করার জন্য কষ্টিপাথরের দরকার। ঐ রকমভাবে নেক ও বদ জানার জন্য জ্ঞানের আলো আবশ্যক। আল্লাহ্তায়ালা যাহার অন্তরে জ্ঞানের আলো দান করিয়াছেন, তিনি এই সমস্ত ভাল মন্দের গুণাগুণ বুঝিয়া লইতে পারেন। যেমন, নবী করিম (দঃ) ফরমাইয়াছেন – “তোমার যদি কোনো কাজ বা ঘটনায় সন্দেহ হয়, তবে তুমি তোমার অন্তরের আলো দিয়া উহা দেখ, তোমার অন্তরে যাহা ভাল মনে কর, সেই অনুযায়ী আমল কর।” কিন্তু, ইহা সবের জন্য নহে। বরং ঐ ব্যক্তির জন্য, যে ব্যক্তি খোদার আদেশ-নিষেধ পূর্ণভাবে পালন করেন এবং সর্বদা শরিয়াতের পা-বন্দী থাকেন। ঐরকম ব্যক্তি-ই নূরে এলাহী প্রাপ্ত হন, ইহাতে তাঁহার অন্তঃকরণ পবিত্র ও পরিচ্ছন্ন থাকে। সন্দেহের স্থলে সঠিক রায় দিতে পারেন। যেমন, জীবিত ব্যক্তির খানার মধ্যে যদি কোনো খড়-কুটা মিশ্রিত হইয়া লোকমার (গ্রাসের) সাথে মুখে যায়, তবে যেহেতু তার অনুভূতি শক্তি জীবিত আছে, স্পর্শ শক্তি দ্বারা হঠাৎ ধরিয়া ফেলিতে পারে, এবং সহজেই বাহির করিয়া ফেলে। এই রকমভাবে পবিত্র আত্মার ব্যক্তি সদা-সর্বদা খোদার নিকট হইতে আলো প্রাপ্ত হইতে থাকেন। উহা দ্বারা সন্দেহযুক্ত বিষয়ের ফায়সালা অতি সহজেই করিয়া ফেলিতে পারেন।
হেচ্ছে দুনিয়া নরদে বানে ইঁ জাহান,
হেচ্ছে উক্রা নরদে বানে আছে মান।
ছেহাতে ইঁ হেচ্ছে ব জুইয়াদ আজ তবীব,
ছেহাতে আঁ হেচ্ছে ব জুইয়াদ আজ হাবীব।
ছেহাতে ইঁ হেচ্ছে জে মায়া মুরিয়ে তন
ছেহাতে আঁ হেচ্ছে জে তাখ্রীবে বদন।
অর্থ: উপরে উল্লেখ করা হইয়াছে যে, স্পর্শ শক্তি দ্বারা বাহ্যিক বস্তুসমূহ উপলদ্ধি করা যায়। কিন্তু, আধ্যাত্মিক বস্তুসমূহ অনুধাবন করার জন্য অন্তরের শক্তির দরকার। অতএব, মাওলানা এখানে আধ্যাত্মিক অনুভূতি এবং ইহার ফজিলত সম্বন্ধে বলিতেছেন, জাগতিক স্পর্শ শক্তি দ্বারা পার্থিব বস্তুসমূহ পার্থক্য করিতে পারেন। কিন্তু আধ্যাত্মিক শক্তি ছাড়া পরকালের কিছুই হাসিল করা যায় না। আধ্যাত্মিক শক্তি অর্থ নূরে ইলাহী। আল্লাহর নূর-ই হইল পরকালের বিষয়বস্তু হাসিল করার অস্ত্র। অতএব, পরকালের শান্তি পাইতে হইলে ইহ-কালেই মারেফাতের আলো অন্তরে সঞ্চয় করিতে হইবে। ইহ-জগতে যেমন শরীর সুস্থ রাখার জন্য বিজ্ঞ ডাক্তারের ব্যবস্থাপত্র দরকার, তেমনি পরকালে আত্মার শান্তি পাইতে হইলে এখনই পীরে কামেলের পরামর্শানুযায়ী চলা আবশ্যক।
শাহে জানে মর জেছে মরা বীরাণ কুনাদ্,
বাদে বীরানাশ আবাদে আঁ কুনাদ্।
আয় খনকে জানে কে দর ইশ্কে মাল,
বজ্লে করদে উ খানে মানো মুলকো মাল।
করদে বীরাণ খানা বহ্রে গঞ্জে জর,
ওয়াজ হুমাঁ গঞ্জাশ কুনাদ মায়া মুর তর।
অর্থ: মারেফাতের আলো পাইবার জন্য প্রথমে পীরে কামেলের আদেশ অনুযায়ী শরিয়ত মোতাবেক যে সমস্ত রিয়াজাত ও মোশাহেদাত করিতে হয়, ইহাতে যদি শরীরের ক্ষতিও সাধন হয়, তবে ভীত হইবার কোনো কারণ নাই। কেননা, আল্লাহতায়ালা প্রথমে শরীরকে খারাপ করিয়া দিবে, পুনঃ ইহাকে রূহানী শক্তি দ্বারা সতেজ করিয়া তুলিবে এবং রূহানী হায়াত মিলিবে। ইহাতে শরীর ও প্রকৃত শান্তির জীবন পাইবে। কেননা, রূহানী হায়াতের দরুণ মুক্তি পাইবে এবং আল্লাহর নৈকট্য লাভ করিতে পারিবে। চিরকাল চিরশান্তিতে বেহেস্তে বাস করিতে পারিবে। উক্ত নেয়ামত এই শরীরের মারফতেই প্রাপ্ত হইবে। তারপর মাওলানা বলেন, যে ব্যক্তি পরকালে স্থায়ী শান্তির জন্য নিজের ইহকালের সমস্ত ধনদৌলাত খরচ করিয়া ফেলে, সে অতি উত্তম। পরকালের সামান (সামগ্রী) সে সজ্জিত করিয়া রাখিল। আখেরাতে বিপদের জন্য তাহাকে কোনো চিন্তাই করিতে হইবে না। শরীর খারাপ হওয়া এবং রূহ্ তাজা হওয়া সম্বন্ধে মাওলানা কয়েকটি উদাহরণ দিয়া দেখাইয়াছেন যে, যদি কাহারো ঘরের নিচে গচ্ছিত ধন থাকে, তবে ঐ ধন ঘর খুঁড়িয়া বাহির করিয়া ঐ সম্পদ দিয়া পুনরায় ঘর উত্তমরূপে মেরামত করিলে অতি সুন্দর হয়।
আবেরা বা বুরীদ ওয়াজুরা পাকে করদ,
বাদে আজ আঁ দর জুরে ওয়াঁ করদে আব খোরদ্।
পুস্তেরা বশে গাফ্ত পেকানেরা কাশীদে,
পুস্তে তাজাহ্ বাদে আজানাশ বর দমীদ।
কেলায়া বীরাণ করদ ওয়াজ কা ফেরেস্তাদ,
বাদে আজাঁ বর ছাখতাশ ছদ বুরজোছদ।
অর্থ: মাওলানা দ্বিতীয় উদাহরণ পেশ করিতেছেন যে, কোনো নহরের পানি কয়েকদিনের জন্য বন্ধ করিয়া উহা উত্তমরূপে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করিয়া ঠিক করিয়া দিয়া তারপর উপর হইতে পানি প্রবাহিত করাইয়া দিলে ভাল হয়। তৃতীয় দৃষ্টান্ত, কাহারও শরীরে যদি তীরের লোহা ঢুকিয়া যায়, চামড়া কাটা ব্যতীত উহা বাহির করা সম্ভব না হয়, তখন চামড়া ফাঁড়িয়া লোহা বাহির করা হইল। এখন চামড়া ফাঁড়া ও ইহাতে যে কষ্ট হইল, উহা কয়েকদিন পর চামড়া জোড়া লাগিলে ও ব্যথা কমিয়া গেলে স্থায়ী শান্তি পাওয়া যায়। চতুর্থ মেসাল – যেমন, কোনো দুর্গ কাফেরদের দখলে আছে। অবরোধ করার সময়ে তোপ দিয়া ভাঙ্গিয়া চুরমার করিয়া ফেলা হয়। ভিতরে ঢুকিয়া শত্রু হত্যা করিয়া দুর্গ দখল করিয়া পরে শত শত গম্বুজ তৈয়ার করিয়া বহু দেয়াল নির্মাণ করা হয়। উপরোক্ত দৃষ্টান্তসমূহ দ্বারা বুঝা যায় যে, প্রথমে একদম ক্ষতি ও নোক্সান স্বীকার করিতে হয়। যে ব্যক্তি পরিণতি সম্বন্ধে অজ্ঞ, তাহর মন অসন্তুষ্ট হইয়া পড়ে। কিন্তু এইরূপ ক্ষতি ও ধ্বংসের মধ্যে প্রথম হইতে শেষ পর্যন্ত মঙ্গল নিহিত আছে। কেননা, সামান্য ক্ষতি স্বীকার করিয়া অধিক মুনাফা লাভ করা যায়, ভবিষ্যত মঙ্গলের জন্য বর্তমান ক্ষতি স্বীকার করার বিধান আছে। এইরূপভাবে শরীরের ক্ষতি স্বীকার করিয়া রূহের জীবনী শক্তি বৃদ্ধি করা উচিত।
কারে বে চুঁ রাকে কাইফিয়াত নেহাদ,
ইফে গোফ্তাম আজ জরুরাত মীজেহাদ।
গাহ্ চুনিইঁ ব নোমাইয়েদ ওগাহ্ জেদ্দেই,
জুজকে হয়রাণি নাবাশদ কারে দীন।
কামেলানে কাজ ছের্রে তাহ্কীকে আগাহান্দ,
বে খোদ ও হয়রান ও মস্তো আলাহান্দ।
অর্থ: মাওলানা বলেন, আল্লাহর মহব্বত হাসিল করার জন্য বান্দার চেষ্টা করা চাই। ঐ চেষ্টার পদ্ধতি হইল রিয়াজাত ও মোজাহেদাহ্। ইহা বান্দার জন্য শর্ত। অর্থাৎ, বান্দা রিয়াজাত ও মোজাহেদা করিতে করিতে আল্লাহর মহব্বত পাইতে পারে। কিন্তু, আল্লাহর জন্য বান্দার অন্তরে ইশ্কে এলাহি ঢালিয়া দিতে কোনো অসিলার দরকার হয় না। আল্লাহতায়ালা কোনো কাজের প্রশ্নে ‘কেন’ বা ‘কী করিয়া’র ধার ধারেন না। তিনি যাহা ইচ্ছা করেন, তাহা তখনই হইয়া যায়; কোনো কিছু শর্ত-মর্তের মুখাপেক্ষী নহেন। তাই মাওলানা বলিতেছেন, খোদার কাজের অবস্থা ও পদ্ধতি কে ঠিক করিতে পারে? তিনি বান্দাহ্কে কীভাবে গ্রহণ করিবেন, তাহা তিনি-ই জানেন। কিন্তু উপরে যে সব পদ্ধতির কথা বর্ণনা করা হইয়াছে, ইহা শুধু বান্দার আবশ্যকের জন্য। কেননা, মাহ্বুবের জন্য সর্বদা উদ্বেগ প্রকাশ করা চাই। ইহাই মাহ্বুবের দাবী।
খোদার মঞ্জুরী কোনো সময় একভাবে হয় না; এক এক সময় এক এক প্রকারে সম্পন্ন করেন। তাই দ্বীনের রাস্তায় হয়রানি ছাড়া আর কিছুই পাওয়া যায় না। সব সময়েই খোদার জন্য পেরেশান থাকিতে হয়। কোনো কোনো সময় প্রথম রিয়াজাত করিতে হয়। তারপর আল্লাহ্কে পাওয়া যায়। ইহাকে সালেহীনদের পথ বলে। আবার কোনো সময়ে আল্লাহর মহব্বত প্রথমেই পাইয়া থাকে। পরে রিয়াজাত ও মোজাহেদার জন্য আকাঙ্ক্ষা পয়দা হয়। ইহাকে জয্বার পথ বলে। এই অবস্থা সাধারণতঃ কোনো কামেল লোকের সাহচর্য অথবা কোনো বোজর্গ লোকের কাহিনী শুনিয়া অথবা খোদার ইচ্ছায় কোনো অসিলা ব্যতীতও অন্তরে খোদার ইশ্ক পয়দা হইতে পারে। তারপর আস্তে আস্তে রিয়াজাতের পদ্ধতির মধ্যে আসে। কামেল লোক যাহারা এই রহস্য অনুভব করেন, চাই নিজের মধ্যে হউক অথবা অন্য কাহারও মধ্যে দেখেন, তখন তাঁহারা সর্বদা হয়রান ও বেহুশ থাকেন।
নায়ে চুঁনা হয়রান কে পোস্তাশ ছুয়ে উস্ত,
বাল চুনিঁ হয়রান কে গরকে ও মস্তে দোস্ত।
আঁ একেরা রুয়ে উশোদ ছুয়ে দোস্ত,
ওয়া ইঁ এ কে বা রুয়ে উখোদ রুয়ে উস্ত।
অর্থ: মাওলানা বলেন, প্রকৃত কামেল ব্যক্তি আল্লাহর মহব্বতে বেহুশ থাকেন – ঐ রকম বেহুশ নয়, যাহারা আল্লাহর তরফ হইতে মুখ ফিরাইয়া রাখেন। অর্থাৎ, আল্লাহর মহব্বতের খেয়াল রাখে না। বরং কামেল লোক আল্লাহর ইল্মের মধ্যে ডুবিয়া হয়রান থাকেন। আল্লাহর ইশ্কে ডুবিয়া থাকা দুই প্রকার হইতে পারে। যেমন কেহ আল্লাহর মহব্বত চায়। অন্য প্রকার যেমন কেহ খোদ আল্লাহকেই চায়।
রুয়ে হরিয়েক মী নেগার মী দারে পাছ,
বুকে গরদী নূরে খেদমত রুশ নাছ।
দীদানে দানা ইবাদতে ইঁ বুদ,
ফত্হুল আবওয়াবে ছায়াদাতে ইঁবুদ।
অর্থ: মাওলানা বলেন, উপরোল্লিখিত দুই প্রকার অলি, আল্লাহর যে প্রকারই তোমার নসিবে মিলে প্রত্যেকের সহিত সাক্ষাৎ কর এবং তাঁহাদের সহিত আদব রক্ষা করিয়া চলো। তাঁহাদের খেদমত করো, তবে তুমি তাহাদিগকে খেদমত করার বরকতে আল্লাহর তরফ হইতে ইশ্কে নূর পাইতে পার। তারপর মাওলানা বলেন, কথিত আছে যে আলেমের সাথে সাক্ষাৎ করা ইবাদত। ঐ আলেমের অর্থ হইল আলেমে কামেল। মারেফাতে কামেল আলেমের সাথে সাক্ষাৎ করা ইবাদত-স্বরূপ। তাঁহাদের সেবা যত্ন করিলে নেক্বখ্তির দরজা খুলিয়া যায়। আল্লাহর নূর দেখিতে পাওয়া যায়।
খাঁটি কামেল পীর ও ভন্ড পীরের মধ্যে পার্থক্য করা
চুঁ বছে ইবলিছে আদম রুয়ে হাস্ত,
পাছ বহর দস্তে নাইয়া বদ দাদে দস্ত।
জাঁকে ছাইয়াদ আওরাদ বাংগে ছফীর,
তা পেরীবদ মোরগেরা আঁ মোরগে গীর।
বেশনুদ আঁ মোরগে বাংগে জেন্ছে খেশ,
আজ হাওয়া আইয়াদ বইয়াবদ দামোনেশ।
হরফে দরবেশাঁ বদ জাদ ও মরদে দূন,
তা বখানাদ বর ছলীমে জান ফেছুন।
অর্থ: অনেক শয়তান মানুষের সুরতে আছে। যেমন, আল্লাহ্তায়ালা নিজেও দুই প্রকার শয়তানের কথা বলিয়াছেন। এক প্রকার মানুষ জাতি শয়তান এবং অন্য প্রকার জিন জাতি শয়তান। এইজন্য পরীক্ষা ব্যতীত কাহারও হাতে বায়আত হইতে হইবে না।
মাওলানা উদাহরণ দিয়া বুঝাইতেছেন, যেমন শিকারীর কৌশল হইল, বনে শিকার করিতে যাইয়া জানোয়ারের ন্যায় আওয়াজ দেয়। জানোয়ারকে ধোকা দিয়া কাছে আনয়ন করে। ইহারা নিজ জাতির আওয়াজ শুনিয়া নিকটে আসে এবং জালে আবদ্ধ হইয়া কষ্টে পতিত হয়। ধোকাবাজ ভণ্ড পীরের স্বভাবও ঐ রকম। কামেল পীরের ন্যায় কথাবার্তা বলিয়া সভা গরম করে, যাহাতে সাদাসিধা মানুষদিগকে ধোকায় ফেলিতে পারে। সরল অন্তঃকরণ বিশিষ্ট মুখাপেক্ষী ব্যক্তি সহজেই ফাঁদে পড়িয়া আবদ্ধ হয় এবং পথভ্রষ্ট হইয়া জাহান্নামের পথিক হয়। অতএব, সাবধান! পীর পরীক্ষা না করিয়া কেহ পীর ধরিবে না।
কারে মর্দাঁ রওউশনি ও গর্মীয়াস্ত,
কারে দুনাঁ হীলা ও বেশরমীয়াস্ত।
অর্থ: মাওলানা বলেন, কামেল পীরের ঈমানের আলো ও আল্লাহর ইশ্ক আছে। ইতর মানুষের অভ্যাস শুধু ধোকাবাজী করা ও লজ্জাহীন কাজ করা।
ভাব: মাওলানা এখানে কামেল পীরের নমুনা সংক্ষেপে বর্ণনা করিয়াছেন। নিম্নে বিস্তারিত বর্ণনা দেওয়া হইল। যেমন প্রকাশ্য রোগের চিকিৎসার জন্য বিজ্ঞ চিকিৎসকের দরকার এবং তাহার নিজের শরীর সুস্থ ও সবল থাকা আবশ্যক। কেননা, চিকিৎসক নিজে যদি রোগী হয়, তাহা হইলে চিকিৎসার সঠিক বিধান দিতে পারিবে না। কেননা, ডাক্তারী বিধান আছে, “রোগীর বিধানও রোগী।” চাই সে বিজ্ঞ ডাক্তার হউক, তাহার রায় ভরসাযোগ্য নয়। এবং যদি চিকিৎসক সুস্থ ও সবল হয়, কিন্তু সে চিকিৎসাবিদ্যা জানে না, তাহার রায়ও কার্যকরী নহে। এই রকমভাবে অভ্যন্তরীণ রোগের জন্য এমন পীরে কামেলের দরকার, যে নিজে মোত্তাকী ও নেককার এবং ফাসেক ও বদকার নয়। অন্যকেও ভাল করিতে জানে। আর যদি পীর বদকার ও বদ আকিদার হয়, তবে তাহার উপর কেহ বিশ্বাস স্থাপন করিতে পারে না যে, সে অপরকে ভাল করিতে পারে। বরং ধারণা জন্মিবে, সে যেমন নিজে বদ অপরকেও সেই রকম বদ বানাইতে চেষ্টা করিবে। অপরকে সৎকাজের উপদেশ দিবে না। কারণ নিজে মনে করিবে – আমি যখন আমল করি না, অপরকে করিতে বলিলে সে আমাকে মনে মনে কী বলিবে? বরং সে নিজে ভাল থাকিবার জন্য বদ আমলকে নেক আমল বলিয়া দেখাইতে চেষ্টা করিবে। ইহাতে গোমরাহী আরও বাড়িয়া যাইবে। ইহা ছাড়া বদকারের শিক্ষায় কোনো ক্রিয়া হয় না, আল্লাহর রহমত নাজেল হয় না। ঐ রকমভাবে যদি নিজে নেককার হয় এবং নেক আমল করে; কিন্তু বাতেনী শিক্ষা দেওয়ার পদ্ধতি না জানে, তবে তাহার দ্বারাও তালেব (অন্বেষণকারী) উপকৃত হইতে পারিবে না। অতএব, পীরে কামেল এমনভাবে হইতে হইবে যে, নিজে নেককার ও নেক আমল করে। নেককার কামেলের সাহচর্যে অনেক দিন পর্যন্ত থাকিয়া তাঁহার খেদমত করিয়া উকৃত হইয়াছে এবং বহু বিজ্ঞ কামেল লোকে তাঁহার প্রশংসা করে; এমন ব্যক্তির নিকট ইল্মে মারেফাত শিক্ষা করিতে হইবে। তবেই অন্তরে আল্লহর মহব্বত সৃষ্টি হইবে। আল্লাহর তরফ হইতে অন্তরে আলো প্রাপ্ত হইবে।
শেরে পশমীন আজ বরায়ে গাদ কুনান্দ,
বু মুছাইলাম রা লকবে আহ্ম্মদ কুনাদ।
বু মুছাইলাম রা লকবে কাজ্জাব মানাদ,
মর্ মোহাম্মদ রা উলুল আলবাব মানাদ।
আঁ শরাবে হক্কে খাত্তামাশ মেশকে নাব,
বাদাহ্ রা খাত্তামাশ বুদ গান্দো আজাব।
অর্থ: মাওলানা বলেন, মিথ্যা ভণ্ড পীর নেক্কার লোকের বেশ ধরিয়া দুনিয়ার অর্থ উপার্জনের জন্য ঘুরিয়া বেড়ায়। অশিক্ষিত জনসাধারণ তাহাকে প্রকৃত কামেল লোক বলিয়া মনে করে। যেমন, মুসাইলামা ভণ্ড নবী দাবি করিয়া অজ্ঞ জনসাধারণকে ধোকায় ফেলিয়াছিল। অবশেষে মিথ্যুকের লজ্জিত হইতে হইয়াছিল এবং মৃত্যুবরণ করিতে বাধ্য হইয়াছিল। তাহার উপাধি পৃথিবীতে শ্রেষ্ঠ মিথ্যুক চিরদিন থাকিবে। আর আমাদের সত্য নবী হজরত মোহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম) চিরদিনই সত্যের সাধক ও আল্লাহ্র প্রিয় বান্দা হিসাবে পরিচিত থাকিবেন।
তিনি মোহরকৃত খাঁটি শরাব (শরবত)-এর ন্যায়। তাঁহার মোহর খুলিলেই সুগন্ধি চতুর্দিকে ছড়াইয়া পড়ে। নবী করিম (দঃ) যখন কথাবার্তা বলিতেন তখন সুগন্ধির ন্যায় চতুর্দিকে শান্তি ছড়াইয়া পড়িত। তাঁহার কথার রহস্য বুঝিতে পারিলে, মানুষ বেহুশ হইয়া যাইত।
এক ইহুদী বাদশাহ গোমরাহীর কারণে নাসারাদিগকে হত্যা করার কেচ্ছা
বুদ শাহে দরজহুদে আঁ জুলমে ছাজ,
দুশ্ মনে ঈছা ও নাছরানে গোদাজ।
আহাদে ঈছা বুদ ও নওবাতে আঁ উ,
জানে মুছ উ ও মুছা জানে উ।
শাহে আহ্ওয়াল কর্দ দর্রাহে খোদা,
আঁ দুদে মাছাজে খোদাই রা জুদা।
অর্থ: ইহুদীদের মধ্যে একজন জালেম বাদশাহ ছিলেন। তিনি হজরত ঈসা (আঃ)-এর শত্রু ছিলেন ও নাসারাদিগের ঘাতক ছিলেন। সে সময় হজরত ঈসা (আঃ)-এর নবুওয়াতের সময় ছিল। কিন্তু বাদশাহ ঈসায়ী দ্বীন মানিতেন না। হজরত মুসা (আঃ)-এবং ঈসা (আঃ) নবুওয়াতের দিক দিয়া এক ছিলেন। কিন্তু ঐ বাদশাহ নিজের গোমরাহীর দরুন ধর্ম সম্বন্ধে উভয়ের ধর্মকে পৃথক পৃথক করিয়া দেখাইতেন এবং হজরত মুসার (আঃ) ধর্ম সত্য বলিয়া প্রচার করিতেন ও হজরত ঈসা (আঃ)-এর ধর্ম মিথ্যা বলিয়া প্রকাশ করিতেন। প্রকৃত পক্ষে উভয় ধর্মই এক বলিয়া পবিত্র কুরআন সাক্ষ্য দেয়।
গোফ্তে উস্তাদ আহ্ওয়ালেরা কান্দার আ,
রু বরু আর আজ ওছাকে আঁ শিশারা।
চুঁ দরুঁ রফ্ত আহ্ওয়ালে আন্দার খানা জুদ,
পিশা পেশে চশ্মে উ দুমী নামুদ।
গোফ্তে আহ্ওয়ালে জাঁদু শিশা গো কুদাম,
পেশে তু আরাম বগো শারহাশ তামাম।
গোফ্তে উস্তাদ আঁদু শিশা নিস্তে রাও,
আহ্ওয়ালি বুগ্জার ও আফ্জুবিঁ মশো।
গোফ্তে আয় উস্তা মরা তায়ানা মজান,
গোফ্তে উস্তা জাঁ দু একরা দর শেকান।
চুঁ একে বশেকাস্ত হরদো শোদ জে চশ্মে।
মরদে আহ্ওয়াল গর্দাদ আজ মাইলানে ওখশমে।
শীশা একবুদ্ ও বচশমাশ দো নামুদ,
চুঁ শেকাস্ত উ শীশারা দীগার নাবুদ।
অর্থ: কোনো এক ওস্তাদ তাহার এক ত্যাড়া ছাত্রকে ঘরের মধ্যে যাইয়া একখানা আয়না আনিতে বলিলেন। ছাত্র ঘরের মধ্যে যাইয়া একখানা আয়নাকে দুইখানি দেখিল। ওস্তাদ সাহেবের কাছে আসিয়া বলিল, সেখানে দুইখানা আয়না আছে, কোন্ খানা আনিব? ওস্তাদ বলিলেন, দুইখানা নয়, একখানা; ত্যাড়ামি ছাড়িয়া দাও। ছাত্র বলিল, আপনি আমাকে দোষারোপ করিবেন না, সেখানে প্রকৃতপক্ষে দুইখানা আয়না আছে। ওস্তাদ বলিলেন, যদি দুইখানা থাকে, তবে একখানা ভাঙ্গিয়া ফেল, অন্যখানা নিয়া আস। ছাত্র যাইয়া যেই মাত্র একখানা ভাঙ্গিয়া ফেলিল, তখন আর অন্য খানাও দেখে না। মাওলানা বলেন, এইভাবে মানুষ নিজের স্বার্থের খাতিরে অথবা ক্রোধের বশবর্তী হইয়া ত্যাড়া হইয়া যায়। ভুল পথে চলে। আয়না একখানাই ছিল, কিন্তু ত্যাড়ামির কারণে দুইখানা দেখা যাইত।
এই রকমভাবে মানুষের অন্তঃকরণ যদি লোভের কারণে অথবা অন্য কোনো স্বার্থ সিদ্ধির জন্য বাঁকা হইয়া যায়, তাহা দ্বারা কোনো সময়ই সঠিক পথ অবলম্বন করা যায় না।
চশ্মো ও শাহ্ ওয়াত মরদরা আহ্ওয়াল কুনাদ,
জে ইস্তেকামাত রূহেরা মোবদাল কুনাদ।
চুঁ গর্জে আমদ হুনার পুশিদাহ্ শোদ,
ছদ্ হেজাব আজ দেল বছুয়ে দীদাহ্ শোদ,
চুঁ দেহাদ কাজি ব দেল রেশওয়াত কারার,
কায়ে শেনাছাদ জালেমে আজ মাজলুমে জার।
অর্থ: ক্রোধ এবং লালসা মানুষকে ভুল পথে ধাবিত করে। আত্মাকে স্থির থাকিতে দেয় না, অন্তরে বে-কারারী আসে। কেননা, এই দুইয়ের কারণে স্বার্থপরতা অধিক বৃদ্ধি পায়। সৎবুদ্ধি লোপ পায়। জ্ঞানের উপর হাজার হাজার আবরণ আসিয়া পড়ে। সৎপথ হইতে অন্ধ হইয়া যায়। অন্তঃকরণ অন্ধ হইয়া সং ও ন্যায় দেখিতে পায় না। অন্তঃকরণের দিক দিয়া চক্ষুও অন্ধ হইয়া যায়। কেননা, অনেক সময় অন্তরের সাথে চক্ষুর যোগাযোগ আছে। যেমন, কোনো কাজী সাহেব যদি ঘুষ গ্রহণ করিয়া বসে, তবে ন্যায়কারী ও অন্যায় কারীকে পার্থক্য করিতে পারে না।
শাহে আজ হেক্দে জহুদানা চুঁনান,
গাস্থে আহ্ওয়াল কালামানে ইয়া রাব্বে আমান
ছাদ হাজারানে মোমেন মাজলুম গাস্ত,
কে পানাহ্ হাম দীনে মূছা রাও পাস্ত।
অর্থ: ঐ বাদশাহ হিংসা ও গোমরাহীর দরুণ এরূপ অন্ধ হইয়া ভুল পথে গিয়াছিল যে, আল্লাহর লক্ষ লক্ষ মুমিন বান্দাকে হত্যা করিয়াছিলেন এবং নিজে ধারণা করিতেন যে, হজরত মূসা (আঃ)-এর ধর্মের সাহায্য করিতেছেন। ইহুদীরা হিংসায় এবং ক্রোধে অত্যন্ত কঠিন হয়। ইহুদীদের মত নিষ্ঠুর জাতি আর দুনিয়াতে নাই।
এক বুদ্ধিমান উজির কর্তৃক গোমরাহ্ বাদশাহ্কে ধোকা দেওয়া
আঁ উজিরেয় দাস্তেগেবরু ও উশ্ওয়াহ দেহ্ ,
কো বর আবে আজ মক্কর বরস্তে গেরাহ্।
গোফ্তে তরছায়ানে পানাহে জান কুনান্দ,
দীনে খোদরা আজ মালেক পেনহা কুনান্দ।
কমকোশ ইঁশারা কে কোস্তানে ছুদে নিস্ত,
দীনে নাদারাদ বুয়ে মেশ্ক ও উদে নিস্ত।
ছেররে পেনহাস্ত আন্দর ছাদ গেলাফ্,
জাহেরাশ বা তুস্ত ও বাতেন বরখেলাফ।
অর্থ: ঐ বাদশাহর একজন সুচতুর উজির ছিল। কথায় বলে, সে এমন চতুর ও চালাক ছিল যে পানির উপর গিরা দিতে পারিত। সে বলিল, নাসারাগণ নিজেদের প্রাণ রক্ষার জন্য নিজের ধর্ম অন্তরে গুপ্ত রাখিবে। অতএব, তাহাদিগকে হত্যা করা বন্ধ করুন, হত্যা করায় কোনো উপকার হইবে না। ধর্মের মধ্যে এমন কোনো সুগন্ধি নাই, যাহার ঘ্রাণ লইয়া অনুভব করা যাইবে যে তাহার ধর্ম কী? ধর্ম অন্তর্নিহিত বস্তু। উহা প্রকাশ্যে অনুভব করা মুশকিল। হয়ত আপনার সাথে প্রকাশ্যে আপনার ধর্মের কথা প্রকাশ করিবে। অন্তরে উহার বিপরীত থাকিবে। আপনি কেমন করিয়া উহা অনুমান করিবেন? এইরূপভাবে নাসারাগণ প্রকাশ্যে আপনার ধর্ম স্বীকার করিবে, কিন্ত তাহাদের অন্তরে নিজেদের ধর্ম থাকিবে। আতএব, আপনি কিছুতেই নাসারার ধর্ম বিলোপ করিতে পারিবেন না। এখন হইতে অসহায় নাসারাদিগকে হত্যা করা বন্ধ করুন।
শাহে গোফ্তাশ পাছ বগো তদবীরে চিস্ত,
চারাহায়ে ইঁ মক্কর ওইঁ তাজবীরে চীস্ত।
তা নামানাদ দর জাহাঁ নাছরাণী,
নায়ে হো বদা দীনো নায়ে পেনহানী।
অর্থ: বাদশাহ্ উজিরকে বলিলেন, তবে তুমি বল, এই মক্করবাজী ও ধোকাবাজীর কী তদবীর হইতে পারে। যাহাতে এই পৃথিবীতে কোনো নাসারা ধর্মাবলম্বী মানুষ না থাকিতে পারে। চাই প্রকাশ্যে হউক অথবা গুপ্তভাবে হউক, কোনো ভাবেই নাসরাণী ধর্ম পৃথিবীতে থাকিতে পারিবে না।
গোফ্তে আয়শাহ্ গোশ ও দস্তামরা ববোর,
বীনাম বশেগাফ্ ও লবোদর হুক্মে মুর।
বাদে আজ আঁ দরজীরে দার আওয়ার মরা,
তা বখাহাদ এক শাফায়াগার মরা।
বর মোনাদী গাহ্ কুন ইঁকারে তু,
বর ছারে রাহে কে বাশদ চারে ছ।
আঁ গাহাম্ আজ খোদ বর আঁতাশহরে দূর।
তা দর আন্দাজাম দর ইঁশাঁ শার ও শোর।
কারে ইঁশাঁ ছার বছের শুরীদাহ গীর।
দরমীয়ানে শাঁ ফেতনা হায়ে আফ্গানাম,
কাহর মান হয়রান বমানাদ দরফানাম।
আঁচে খাহাম্ করদে বা নাছরা নীয়াঁ,
আঁ নমী আইয়াদ কনুঁ আন্দর বয়াঁ।
চুঁ শুমা রান্দাম আমীন ও মোক্তাদা,
দামে দীগার গুন নেহাম শানে পেশে পা।
ওয়াজে হীলে ব্ফেরেমে ইঁশাঁ রা হামাহ,
ওয়া আন্দার ইঁশাঁ আফগানাম্ ছাদ ও মদমাহ।
তা বদস্তে খেশে খুন খেশে তন,
বর জমীনে রী জানাদ কোতা শোদ ছুখান।
অর্থ: উজির বলিল, উহার তদবীর এই যে, আপনি কড়া হুকুম দিয়া আামার হাত ও কান কাটিয় ফেলুন। নাক এবং ওষ্ঠ ছিঁড়িয়া ফেলিয়া ফাঁসির কাষ্ঠের নিচে হাজির করিবেন। যাহাতে লোকে মনে করিবে যে, ইহাকে ফাঁসি কাষ্ঠে চড়ান হইবে। তারপর কেহ আমাকে সুপারিশ করিয়া ছাড়াইয়া নিবে। এই ঘটনা সর্বসাধারণের সম্মুখে বসিয়া হইতে হইবে। তারপর আমাকে আপনার নিকট হইতে বহুদূরে কোনো গ্রামে বাহির করিয়া দিবেন। তারপর দেখিবেন, আমি সেখানে বসিয়া নাসারানীদের মধ্যে কী মত ও পথ প্রকাশ করি। যখন তাহারা আমার ধর্ম গ্রহণ করিতে আরম্ভ করিবে, তখন মনে করিবেন যে তাহাদের ধর্ম বিলীন হইয়া গিয়াছে। তাহাদের মধ্যে এমন ফেতনা ঢালিয়া দিব, যাহাতে শয়তানেও আমার ধোকাবাজী সম্বন্ধে কিছু বুঝিয়া উঠিতে পারিবে না। মোট কথা, নাসারাদের মধ্যে যে সব কাজ করিব, তাহা এখন ভাষায় প্রকাশ করিতে পারিতেছি না। যখন তাহারা আমার উপর পূর্ণ আস্থা স্থাপন করিবে এবং আমাকে তাহাদের নেতা মনে করিবে, তখন তাহাদের সম্মুখে অন্য রকম আর একটা বিস্তার করিব। আমার ফেরেববাজীতে সকলেই ধোকায় পড়িয়া যাইবে। তাহাদের মধ্যে অনেক পাণ্ডা লাগাইয়া দিব, যাহাতে তাহারা পরস্পর মারামারি কাটাকাটি করিয়া মারা যায়, তবেই কেচ্ছা শেষ হইয়া যায়।
পাছ বগুইয়াম মান বা ছেররে নাছরানিয়াম,
আয়ে খোদায়ে রাজে দাঁ মী দানেম।
শাহে ওয়াকেফ গাস্ত আজ ঈমানে মান,
ওয়াজ তায়াচ্ছুব করদ্ কছ্দে জানে মান।
খাস্তাম তা দীনে জে শাহ্ পেন্হা কুনাম,
আচেঁ দীনে উস্ত জাহের আঁ কুনাম।
শাহে বুয়ে বোরাদ আজ আছরারে মান,
মোত্তাহেম শোদ পেশে শাহ গোফ্তারে মান।
গোফ্ত গোফ্তে তু চু দর নানে ছুজানাস্ত,
আজ দেলে মান তা দেলে তু রওজানাস্ত।
মান আজাঁ রওজানে বদীদাম হালে তু,
হালে তু দীদাম্ না নুশেম কালে তু।
অর্থ: উজির বলিল, যখন আমার অবস্থা এইরূপ করা হইবে, তখন আমি নাসারাদিগকে বলিব, আমি অন্তরে নাসারা ধর্ম গুপ্তভাবে পোষণ করিতেছিলাম। ইহার উপর আমি খোদার কসম করিয়া বলিব, হে খোদা! তুমি আলেমুল গায়েব, তুমি-ই সব কিছু জানো। বাদশাহ কোনো রকমে আমার ধর্ম সম্বন্ধে জ্ঞাত হইয়া গেলেন এবং আমাকে প্রাণে বধ করিবার ইচ্ছা করিলেন। আমি অনেক চেষ্টা করিয়াছিলাম যে, আমার নিজের ধর্ম বাদশাহর নিকট গুপ্ত রাখিয়া এবং প্রকাশ্যে বাদশাহর ধর্ম মানিয়া চলিব। কিন্তু, বাদশাহ আমার অন্তরের ভাব বুঝিয়া ফেলিয়াছেন। আমার মুখের কথা তাঁহার সম্মুখে বিশ্বাসযোগ্য হইল না। তিনি আমাকে বলিলেন, তোমার মুখের কথায় আমার অন্তরে এমনভাবে কাঁটা বিদ্ধ হয়, যেমন ধরিয়া লও, রুটির মধ্যে এমনভাবে কাঁটা ভরিয়া দেওয়া যাহা দেখা যায় না। কিন্তু যে রুটি খায় যদিও সে কাঁটা দেখিতে পায় না, চিবানোর সময় কাঁটা অনুভব করিতে পারে। এই রকম ভাবে তোমার মুখের কথায় মিথ্যা মিশ্রিত। আামার অন্তরে সর্বদা সন্দেহ বাড়িয়া চলিয়াছে, আমার অন্তর দিয়া তোমার মনের অবস্থা ধরিয়া ফেলিয়াছি। সেই দিন হইতেই তোমার প্রকৃত অবস্থা বুঝিতে পারিয়াছি। আমার জ্ঞান দ্বারা তোমার গুপ্ত ধারণাসমূহ বুঝিতে পারিয়াছি। এইভাবে নাসারাদের নিকট ঘটনা পেশ করিব।
গার নাবুদে জানে ঈছা চারাহাম,
উ জহুদানা ব করদে পারাহাম।
বহরে ঈছা জানে ছোপারাম ছার দেহাম,
ছদ হাজারানে মান্নাতাশ বর খোদ নেহাম।
জানে দেরেগাম নিস্ত আজ ঈছা ওয়ালেকে,
ওয়াকেফাম বর ইল্মে দীনাশ নেকে নেক।
হায়ফে মী আইঁয়াদ মরাকা ইঁ দীনে পাক,
দরমীয়ানে জাহেলানে গরদাদ হালাক।
শোকের ইজ্দেরা ও ঈছারা কে মা,
গাস্তায়েম ইঁ দীনে হক্কেরা রাহনুমা।
আজ জহুদাঁ ওয়াজ জহুদী রাস্তায়েম,
তা ব-জুন্নারে মীয়ানে রা বস্তায়েম।
দাওরে দাওরে ঈছা আস্ত আয় মরদে মাঁন,
বেশনুবীদ আছরারে কীশে উ বজাঁন,
কা ই শাহ্ বে দীনে জালেশ বছ আদুয়াস্ত,
মী নাদানাদ হীচ দুশমনরা জে দোস্ত।
ইঁ নোছকে মী গোফ্ত বা নাছরানিয়াঁ,
লেকে বুদাশ দেল বছুয়ে শাহ কাশী।
লেকে বুদাশ দেল বছুয়ে শাহ কাশাঁ।
গোফ্তে শাহ্রা কা আয় শাহানশাহ্ ছবর কুন,
তা মান ইশাঁরা কুনাম আজ বীখেও বন।
অর্থ: উজির আরো বলিল, আমি নাসারাদের মধ্যে এই কথা বলিব যে, যদি ঈসা (আ:)-এর পবিত্র রূহ আমার সাহায্যকারী না হইত, তবে ঐ বাদশাহ্ আমাকে টুকরা টুকরা করিয়া ফেলিতেন। আমি তো ঈসা (আ:)-এর জন্য আমার গর্দান ও প্রাণ দিতে প্রস্তুত। বরং ঈসা (আ:)-এর জন্য প্রাণ দিতে পারিলেই আমি নিজেকে ধন্য মনে করিব। কারণ, মনে করিব যে, আমার জান আল্লাহতায়ালা কবুল করিয়া নিয়াছেন। প্রাণ বাঁচাইবার জন্য আমার ধর্ম গোপন করি নাই। হজরত ঈসা (আঃ)-এর জন্য আমার জান মান্নত করিতে কোনো প্রকার আফসোস নাই। কিন্তু কথা হইল এই, আমি আপনাদের ধর্ম সম্বন্ধে খুব জ্ঞান রাখি। আমার শুধু এতটুকু দুঃখ হয় যে, এই পবিত্র ধর্ম এরূপ অজ্ঞ জাহেলদের দরুণ নষ্ট হইয়া যাইতেছে। কেহ জানিতেও পারিল না যে, আমার প্রাণ ধ্বংস হইয়া গেল। খোদাতায়ালার এবং হজরত ঈসা (আ:)-এর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করিতেছি যে, আমি এই ধর্মের একজন পথপ্রদর্শক হইয়াছি এবং ইহুদীদের মধ্য হইতে মুক্তি পাইয়াছি ও ঈসায়ী ধর্ম্মের চিহ্নশুল গলায় বাঁধিয়া ঝুলাইতে পারিয়াছি। এই যুগ হজরত ঈসা (আ:)-এর ধর্মের যুগ। ইহার কথা তোমাদের মনোযোগ দিয়া শোনা উচিত। এই পাপী অত্যাচারী বাদশাহ্ ঈসায়ী ধর্মের পরম শত্রু। শত্রু ও মিত্রের কোনো পার্থক্য করিতে পারেনা – মহাপাপী ও বে-তমীজ। এই কথা বাদশাহর সম্মুখে নাসারার দিক দিয়া বলিতেছিল। সে নিজে বাদশাহ্র লোক ছিল এবং বাদশাহ্র ধর্মেই দীক্ষিত ছিল। অবশেষে উজির বলিল, আপনি একটু অপেক্ষা করুন, দেখিবেন যে নাসারাদিগকে সমূলে ধ্বংস করিয়া দিব।
নাসারাদের উজিরের ধোকায় পতিত হওয়া
চুঁ উজির ইঁ মকর রা বর শাহ্ শুমারাদ,
আজ দেলাশ আন্দেশাহ্ রা কুল্লি ছাতারাদ।
করদে বা উয়ে শাহ্ আঁকারেকে গোফ্ত,
খলকে হয়রান মানাদ্ জা আঁ রাজে নেহুফ্ত।
করদে রেছ ওয়ারেশ মীয়ানে আঞ্জুমান,
তাকে ওয়াকেফ শোদ ব হালাশ মরদ ও জন।
রানাদ উরা জানেবে নাছ রানিয়াঁ,
করদে দর দাওয়াতে শুরু উ বাদে আজাঁ।
হালে আলম ইঁ চুনিস্ত আয় পেছার,
আজ হাছাদ মী খিজাদ ইঁহা ছার ব ছার।
অর্থ: যখন উজিরের ধোকা দেওয়ার বর্ণনা বাদশাহ্র সম্মুখে পেশ করা শেষ হইল, তখন বাদশাহ্র মনের যাবতীয় সন্দেহ দূর হইল এবং উজিরের প্রতি উহাই করা হইল, যেরূপ সে করিতে বলিয়াছিল। সর্বসাধারণের সম্মুখে উজিরকে এমন শাস্তি দেওয়া হইয়াছিল যে, সকলে দুঃখিত হইয়া পড়িয়াছিল। তারপর উজিরকে নাসারাদের বস্তির দিকে তাড়াইয়া দেওয়া হইয়াছিল। সেখানে থাকিয়া উক্ত উজির নাসারাদের মধ্যে প্রচার আরম্ভ করিয়া দিয়াছিল। যেভাবে সে পূর্বে প্রস্তাব দিয়া রাখিয়াছিল।
মাওলানা পাঠকবৃন্দকে বলিতেছেন, তোমাদের সাবধান হওয়া উচিত। দুনিয়ার অবস্থা এইরূপ হইয়া থাকে। হিংসার বশবর্তী মানুষ নানা প্রকারের ধোকা দিতে আরম্ভ করে; যদিও সে নিজে ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তথাপি সেদিকে ভ্রুক্ষেপ করে না।
ছদ হাজারাণে মরদে তরছা ছুয়ে উ,
আন্দেক আন্দেক জামা শোদ দরকোয়ে উ।
উ বয়ানে মী করদ বা ইশাঁ বরাজ,
ছারান আংগুলি উন ও জুন্নারো ও নামাজ।
উ বায়ান মী করদা বা ইশাঁ ফছীহ্,
দায়েমান জে আফয়ালে ও আকওয়ালে মছীহ্।
চুঁ চুনা দীদান্দ তরছায়ানাশ জার
মী শোদান্দ আন্দর গমে উ ইশকেবার।
উ বজাহের ওয়াজে আহকামে বুদ,
লেকে দর বাতেনে ছফীর দামে বুদ।
অর্থ: লক্ষ লক্ষ নাসারানী অল্প অল্প করিয়া উজিরের নিকট জমা হইল। উজির তাহাদিগকে চুপে চুপে ইঞ্জিল কেতাব, তসবীহ-তাহলীল ও নামাজের রহস্য প্রাঞ্জল ভাষায় বুঝাইতে লাগিল। সর্বদা ঈসা (আ:)-এর উপদেশাবলী ও কার্যকলাপ সম্বন্ধে আলোচনা করিত। নাসারাগণ যখন দেখিল যে, বাদশাহ উজিরের হাত, নাক ও কান কাটিয়া বেচারাকে মর্মান্তিক শাস্তি প্রদান করিয়াছেন; ইহাতে তাহারা অত্যন্ত অনুতপ্ত হইল। কিন্তু এ পাপিষ্ঠ প্রকাশ্যে নসীহতকারী ছিল, আর অন্তরে প্রকৃতপক্ষে ধোকাবাজ ও মক্করবাজ ছিল। যেমন, শিকারী বনে ফাঁদ পাতিয়া পাখীর ডাক ডাকে এবং পাখী নিজ জাতির ডাক শুনিয়া শীঘ্র করিয়া নামিয়া আসিয়া ফাঁদে আবদ্ধ হইয়া যায়।
বহরে ইঁ বাজে ছাহাবা আজ রছুল,
মুলতাবেছ বুদান্দ মক্রে নফছে গাউল।
কুচাহ আমীজাদ জে আগরাজে নেহাঁ,
দর ইবাদাতে হাউ দর ইখলাছে জাঁ।
ফজলে তায়াতে রা না জুছতান্দী আজু।
আয়বে বাতেন রা বজুছতান্দে কেনো।
মাও বমাও জররাহ্ জররা ম্করে নফছ,
মী শেনাছীদান্দ চুঁ গোল আজ ফারকাছ।
গোফ্তে জাআঁ ফছলে হুজাইফা বা হাছান,
তা বদাঁ শোদ ওয়াজ ও তাজকীরাশ হাছান।
মুশেগা ফানে ছাহাবা জুমলা শান,
খীরাহ্ গাস্তান্দে দরাঁ ওয়াজে ও বয়ান।
অর্থ: যেহেতু কোনো কোনো সময় শত্রুর ফেরেব ও ধোকাবাজী অনুভব করা যায় না। যেমন, নাসারাগণ উক্ত উজিরের ফেরেব সম্বন্ধে জ্ঞাত হইতে পারে নাই। এই রকমভাবে আমাদের নফ্সও আমাদের শত্রু। আমাদিগকে ধোকা দিবার সম্ভাবনা আছে। হয়ত কোনো সময়ে নফ্সের শত্রুতা আমরা বুঝিতে পারিব না, পথভ্রষ্ট হইয়া যাইব; এইজন্য কোনো কোনো সাহারায়ে কেরাম (রা:) হুজুর (দঃ)-এর কাছে নফ্সের ধোকা সম্বন্ধে অনুসন্ধান করিতেন যে, আমাদের ইবাদত এবং সততার মধ্যে কী কী স্বার্থপরতা থাকিতে পারে? যেমন হাদীস শরীফে বর্ণিত আছে, হজরত হুজাইফা ইবনে ইয়ামান (রা:) বলিয়াছেন, প্রত্যেকেই হুজুর (দ:)-এর নিকট নেক কাজের অনুসন্ধান করিতেন। আমি বদ কাজ সম্বন্ধে জানিতে চেষ্টা করিতাম। কেননা, তাহা হইলে আমি উহা হইতে বিরত থাকিতে পারিব। ইবাদতের ফজিলত সম্বন্ধে তত আগ্রহ করিয়া জানিতে চাহিতাম না। নফ্সের খারাবি সম্বন্ধে হুজুরের নিকট জিজ্ঞাসা করিয়া এমনভাবে পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে জ্ঞাত হইয়াছিলাম যে, যেমন ফুলের প্রত্যেক পাঁপড়িকে পৃথক পৃথক করিয়া জানিয়া লওয়া। নফ্সের খারাবী সম্বন্ধে কিছু বিদ্যা হজরত হাসান বসরী (রা:)-এর কাছে বর্ণনা হইয়াছে। তাহাতেই তাঁহার শিক্ষা অতি সুন্দর হইয়াছে। সাহাবাগণ (রা:) প্রত্যেকেই তাহা পছন্দ করিয়াছেন।
নাসারাদের ইহুদী উজিরের অনুসরণ করা
দেল বদু দাদান্দ তর ছায়ানে তামাম,
খোদ চে বাশাদ কুয়াতে তাকলিদে আম।
দরুদরুনে ছীনা মহ্রাশ কাশতান্দ্,
নায়েবে ঈছাইয়াশ মী পেন্দাশতান্দ।
উ বছেরে দজ্জাল এক চশমেল আইন,
আয়ে খোদা ফরইয়াদ রছ নেয়ামালমুঈন।
অর্থ: সকল নাসারা উক্ত উজিরের অনুসরণকারী হইয়া গেল। প্রকৃতপক্ষে, অজ্ঞ লোকের অনুসরণের কোনো স্থায়িত্ব নাই। না বুঝিয়া শুনিয়া শুধু মনের খেয়াল মোতাবেক যাহার সহিত ইচ্ছা করে তাহার সাথেই মত দেয়। নিজেদের অন্তরে উজীরের মহব্বতের দানা বপণ করিয়া লইয়াছে এবং তাহাকে হজরত ঈসা (আ:)-এর প্রতিনিধি মনে করিতে লাগিল।
প্রকৃতপক্ষে, সে একজন অভিশপ্ত দাজ্জাল ছিল। অর্থাৎ, ঈসা (আ:)-এর বিরুদ্ধে ছিল, দাজ্জালের ন্যায় পথভ্রষ্টকারী ছিল। এইরূপভাবে, আমরাও নফ্স ও মানব রূপধারী শয়তানের ধোকায় পতিত হই। এই জন্য মাওলানা দুঃখিত হইয়া আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করিতেছেন, হে খোদা! আমাদিগকে সাহায্য করিও, তুমি-ই প্রকৃত সাহায্যকারী।
ছদ হাজারানে দামো ও দানাস্ত আয়ে খোদা,
মা চু মোরগানে হারীছ বে নাওয়া।
দম বদম পা বস্তাহ দামে তু আয়েম,
হরিয়েকে গার বাজু ছীমোরগী শওয়েম।
মী রাহানে হরদমে মারা উ বাজ,
ছুয়ে দামে মী রওয়েম আয়বে নাইয়াজ।
অর্থ: মাওলানার শেষ মোনাজাত। তিনি বলিতেছেন, হে খোদা! হাজার হাজার ও লক্ষ লক্ষ শিকারীর জাল-ফাঁদ বিছান আছে ও লক্ষ লক্ষ দানা ছড়ান আছে, আর আমরা মানুষ, আমাদের অবস্থা লোভী পাখীর ন্যায় – একেক সময় একেক নতুন ফাঁদে আবদ্ধ হইয়া যাই। আমরা বাজ পাখী বা উট পাখী-ই হইনা কেন, তোমার দয়ায় সব সময় ঐ জাল বা ফাঁদ হইতে বাহির করিয়া রাখ। কিন্তু আমরা আবার অন্য ফাঁদের দিকে অগ্রসর হইতে থাকি। অর্থাৎ, আমরা নফ্স ও শয়তানের রকমারী ধোকায় পতিত হইতে থাকি।
মা দরী আমবারে গুন্দাম মী কুনেম,
গন্দাম জমায়া আমদাহ গম মী কুনাম।
মী নাইয়ান্দাশেম মা জমেয় উহুশ,
কে ইঁ খলল দর গুন্দাম আস্ত আজ মকরে মূশ।
মূশ তা আমবারে মা হোফরাহ্ জাদাস্ত,
ও আজ ফনাশ্ আমবারে মা খালী শোদাস্ত।
অর্থ: মাওলানা বলেন, আমাদের দৃষ্টান্ত এইরূপ যে, আমরা গন্দমের স্তুপ জমা করি, কিন্তু উহা আমরা পাইনা; জানোয়ারের ন্যায় আমাদের বুদ্ধি নাই যে আমাদের এই ক্ষতি ফেরেববাজ ইঁদুরের দ্বারা সাধিত হইয়াছে। ইঁদুরে গন্দমের স্তুপ পর্যন্ত গর্ত করিয়া লইয়াছে। ইহারা সমস্ত গন্দম খালি করিয়া লইয়াছে।
এই রকমভাবে আমরা রনক কাজ করিতে থাকি, কিন্তু উহার বরকত ও ক্রিয়া কোনো কিছুরই নাম-নিশানা দেখিতে পাই না। কারণ, নফ্স ও ধোকাবাজ শয়তানের ধোকায় পড়িয়া স্বার্থপর ব্যাধির সাগরে সব ধোওয়াইয়া নিয়া যায়।
আউয়াল আয় জানে দাফে শররে মূশে কুন,
ওয়া আঁ গাহাঁ দর জমে গন্দামে জুশে কুন।
বেশনু আজ আখ্বারে আঁ ছদরে ছদুর,
লা ছালাতা তাম্মা বিল হুজুর।
গার না মূশে দোজদে দর আম্বারে মাস্ত,
গন্দামে আমালে চালছালাহ্ কুজাস্ত।
রীজাহ্ রীজাহ্ ছেদকে হররোজে চেরা,
জামায়া মী না আইয়াদ দরী আমবারে মা।
অর্থ: মাওলানা বলেন, সর্বপ্রথম নফ্স ও শয়তানের ধোকা হইতে নিজেকে বাঁচাও। তারপর রিয়া ব্যতীত খাঁটি নিয়তে নেক আমল করিতে থাক। আস্তে আস্তে নেক আমল জমা হইতে থাকিবে এবং উহা আল্লাহর নিকট কবুল হইবে। ইহার প্রমাণস্বরূপ মাওলানা হাদীসের উদ্ধৃতি দিয়া বলিতেছেন, হুজুর (দঃ) ফরমাইয়াছেন: একাগ্রচিত্ত ছাড়া নামাজ কখনও আল্লাহর দরবারে কবুল হয়না। নফ্সের স্বার্থপরতা ও শয়তানি ধোকা আত্মা হইতে দূর করিতে হইবে। না হইলে কোনো নেক কাজ আল্লাহ্র নিকট গ্রহণীয় হইবে না। যদি আমাদের নেক আমলের স্তুপের মধ্যে নফ্স ও শয়তান নামক ইঁদুর না থাকিত, তবে আমাদের নেক আমলের ক্রিয়া ও বরকত কোথায় গেল? ইহার ক্রিয়া মহব্বতে ইলাহী এবং দুনিয়াকে খারাপ জানা, এইরূপ ক্রিয়া, আমাদের অন্তরে সৃষ্টি হইল না কেন। যদি প্রত্যহ একটু একটু করিয়া নেক আমল জমা হইত, তবে এক স্তুপে পরিণত হইত।
বছে ছেতারাহ্ আতেশ আজ আহান জাহীদ,
ও আঁ দেল ছুজীদাহ্ পীজ রফ্ত ও কাশীদ।
লেকে দর জুলমাত একে দুজদে নেহাঁ,
মী নেহাদ আংগাস্তে বর ইস্তারে গাঁ।
মী কোশাদ ইস্তারে গাঁরা এক ব এক,
তাকে না ফেরুজাদ চেরাগে বর ফালাক।
অর্থ: মাওলানা বলেন, মানুষ নিজের হাত, পা ও অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ দ্বারা অনেক প্রকার নেক আমল করে। ইহা দ্বারা অন্তরেও কিছু আলো প্রতিফলিত হয়। কিন্তু, অজ্ঞতার অন্ধকারে কু-রিপুগুলি ও শয়তান গুপ্ত শত্রু চোরস্বরূপ অন্তরে নিহিত আছে। উহারা নেক আমলগুলি সমস্ত মুছিয়া ফেলে। যাহাতে নেক আমলের ক্রিয়া অন্তরে স্থায়ীভাবে না থাকিতে পারে, সেজন্য সর্বদা চেষ্টা করিতে থাকে। যেমন, কাহারও ঘরে অন্ধকারে যদি কোনো চোর ঢোকে আর ঘরের মালিক টের পাইয়া উঠিয়া এক টুকরা কয়লার আগুন লইয়া শুকনা ছোবরা অথবা তুলা নিয়া ঐ অগ্নিখণ্ডের নিচে রাখিয়া ফুৎকার দিয়া জ্বালাইতে চেষ্টা করে, যে আলোতে চোরকে স্বচক্ষে দেখিবে। এমন সময় চোর অন্ধকারের মধ্যে চুপ করিয়া আসিয়া মালিকের নিকট বসিয়া ফুৎকারের সাথে যে অগ্নিকণাগুলি নির্গত হয়, তাহা হাত দিয়া আস্তে নিভাইয়া দেয়। যাহাতে মালিক অগ্নিকণার আলোতে চোরকে এবং তাহার মালামাল দেখিতে না পায়। এই রূপভাবে মানুষের অন্তঃকরণের মধ্যে কু-রিপুগুলি ও শয়তানি দাগাবাজী গুপ্তভাবে আছে। তাহারা লোকের নেক আমলগুলি হাত দিয়া চাপিয়া মুছিয়া ফেলে, যাহাতে নেক আমলের কোনো ক্রিয়া অন্তরে প্রতিফলিত না হইতে পারে এবং নেক আমলগুলি আল্লাহর দরবারে স্বীকৃতি লাভ করিতে না পারে, সেজন্য তাহারা সর্বতোভাবে চেষ্টা করিতে থাকে। এই অজ্ঞতার অন্ধকার সম্বন্ধে আমরা জ্ঞাত নহি।
চুঁ এনায়েতাত বুদ বা মা মুকিম,
কায়ে বুয়াদ বীমে আজাঁ দুজ্দে লাইম।
গার হাজারানে দামে বাশদ দর কদম,
চুঁ তু বা মাই না বাশদ হীচে গম।
অর্থ: এখানে মাওলানা আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করিতেছেন যে, যদিও কু-রিপর তাড়না ও শয়তানের ধোকা অত্যন্ত বিপজ্জনক, তথাপি তুমি যদি তোমার রহমত আমাদের উপর সর্বদা বর্ষণ করিতে থাক, তবে আমাদের ঐ শত্রু হইতে কোনো ভয়ের কারণ নাই। যদি আমাদের প্রত্যেক পায়ে হাজারো ফাঁদের জাল বিছানো থাকে এবং তুমি যদি আমাদের সাথে থাক; তবে কোনো ভয়ের কারণ নাই। উপরোক্ত বর্ণনা দ্বারা বুঝা যায় যে, বান্দার নিজের মারেফাত ও মোজাহেদার উপর ভরসা করা চলিবে না। খোদার রহমতের উপর ভরসা রাখিতে হইবে।
হরশবে আজ দামে তন আরওয়াহ্ রা,
মী রেহানী মী কুনী আল ওয়াহ্রা।
মী রেহান্দ আরওয়াহ্ হর শবে জীইঁ কাফাছ,
ফারেগানে নায়ে হাকেম ও মাহকম কাছ।
শবে জে জেন্দানে বে খবর জেন্দানিয়াঁ,
শবে জে দৌলাত বে খবর ছুলতানিয়াঁ।
নায়েগমে ও আন্দেশায়ে ছুদ ও জিয়া,
নায়ে খেয়ালেইঁ ফুলান ও আঁ ফুলা।
অর্থ: মাওলানা বলেন, হে খোদা, তুমি যদি চাও, তবে আমাদিগকে শয়তানি খেয়াল ও কু-রিপুর তাড়না হইতে বিরত রাখিতে পারো। যেমন, প্রত্যহ রাত্রিতে আমাদের রূহকে পিঞ্জিরাস্বরূপ দেহ হইতে মুক্ত করিয়া দাও। আমাদের রূহসমূহ দেহের মধ্যে আবদ্ধ থাকে। প্রত্যেক দিন-রাত্রে কয়েদখানাস্বরূপ দেহ হইতে রূহগুলিকে মুক্ত করিয়া দাও। তাহারা নিশ্চিন্তে সর্বত্র ভ্রমণ করিয়া বেড়ায়। তাহাদের কোনো হাকেম বা মাহ্কুম থাকে না। কয়েদিদের কয়েদখানার কথা মনে থাকে না। বাদশাহদের ধন-দৌলাত ও রাজত্বের কথা খেয়াল থাকে না। কাহারো লাভ-লোকসানের খেয়াল থাকে না, কোনো আত্মীয়-এগানার কথা মনে পড়ে না; সেইরূপভাবে আমাদিগকে অভ্যন্তরীণ চিন্তা হইতে মুক্ত করিয়া দিলে তোমার কোনো ক্ষতি হয় না। তোমার পক্ষে আমাদিগকে আমাদের অভ্যন্তরীণ শত্রুর বিপদ হইতে মুক্ত করিয়া দেওয়া মোটেই কঠিন কাজ নয়।
আরেফের অবস্থার দৃষ্টান্ত ও পবিত্র কুরআনের আয়াতের অর্থ
আল্লাহু ইয়াতাওয়াক্কাল আন্ফুছুহীনা মাওতেহা ওয়াল্লাতী লাম তামুত ফী মানামেহা।
হালে আরেফ ইঁ বুদ ব খাবে হাম,
গোফ্তে ইজদে হাম রুকুদুন জী মরদাম।
খোফ্তাহ আজ আহ্ওয়ালে দুনিয়া রোজও শব,
চুঁ কলম দর পাঞ্জায়ে নকলীবে রব।
আঁকে উ পাঞ্জা না বীনাদ দর রকম,
ফেলে পেন্দারাদ বা জাম্বাশ আজ কলম।
অর্থ: মাওলানা আরেফ ও কামেল লোকের অবস্থা বর্ণনা করিয়া বলিতেছেন, অন্যান্য লোক যেমন নিদ্রিত অবস্থায় দেহ হইতে মন বিচ্ছিন্ন হইয়া যায়, তেমনিভাবে খাঁটি কামেল লোকের জাগ্রত অবস্থায়ও দেহ হইতে মন বিচ্ছিন্ন থাকে। অর্থাৎ, ইহ-জাগতিক যে সমস্ত বস্তু আল্লাহর মহব্বত হইতে বিরত রাখে, সে সমস্ত বস্তুর প্রতি কামেল লোকের খেয়াল থাকে না। যে সমস্ত কাজ অথবা কথাবার্তা আল্লাহ হইতে দূরে সরাইয়া রাখে, সেদিকে তাঁহাদের মোটেই খেয়াল থাকে না। ঐ সমস্ত কাজ হইতে আরেফ-ব্যক্তি সর্বদা বিরত থাকেন। যেমন, আল্লাহ্তায়ালা আসহাবে কাহাফ সম্বন্ধে বলিয়াছেন, তোমরা তাহাদিগকে চক্ষু খোলা অবস্থায় দেখিয়া জাগ্রত মনে করিও না। প্রকৃতপক্ষে তাঁহারা নিদ্রিত অবস্থায় আছেন। অর্থাৎ, জাগ্রত অবস্থায় থাকিলেও তাঁহারা দুনিয়ার হাল-হকিকত হইতে অজ্ঞাত রহিয়াছেন। সেইরূপভাবে, আরেফ লোক জাগ্রত থাকিয়াও দুনিয়ার অবৈধ কাজ হইতে বিরত রহিয়াছেন। তাঁহারা দিবা-রাত্রি দুনিয়ার অবৈধ কার্যসমূহ হইতে নিদ্রিত আছেন। আরেফ লোক আল্লাহ্র এমন বাধ্যগত, যেমন লেখকের হাতে কলম বাধ্যগত থাকে। লেখক যেভাবে ইচ্ছা করে, সেই ভাবে ঘুরাইতে ফিরাইতে পারে। কলমকেও সেইভাবে ঘুরিতে ফিরিতে হয়। আরেফ লোকও আল্লাহর মর্জি মাফিক চলাফিরা করেন। আল্লাহর ইচ্ছা অনুযায়ী কাজ-কর্ম সমাধা করেন। আর যাহারা কলমের হাতকে না দেখে, তাহারা মনে করে যে, কলম নিজেই নড়াচড়া করিয়া লিখে। তাই তাহারা প্রত্যেক কাজকে নিজের ইচ্ছাধীন মনে করিয়া যাহা ইচ্ছা তাহাই করিতে পারে। খোদার আদেশ-নিষেধের প্রতি ভ্রুক্ষেপ করে না। খোদার আদেশ-নিষেধ অমান্য করিয়া যাহা ইচ্ছা তাহাই করিতে অভ্যস্ত হয়। খোদার খুশী ও না-খুশীর প্রতি লক্ষ্য রাখে না। এই প্রকারের লোকই গণ্ড-মূর্খ ও গোমরাহ্ বলিয়া পরিচিত।
মসনবী শরীফ
মূল: মাওলানা জালালউদ্দিন রুমি (রহ:)
অনুবাদক: এ, বি, এম, আবদুল মান্নান
মুমতাজুল মোহদ্দেসীন, কলিকাতা আলিয়া মাদ্রাসা।
সূত্রঃ https://mishukifti.wordpress.com/