[বাংলা এই ভাবানুবাদ বরিশাল থেকে প্রায় ৫০ বছর আগে প্রকাশিত। এই দুর্লভ সংস্করণটি সরবরাহ করেছেন সুহৃদ (ব্যাংকার) নাঈমুল আহসান সাহেব। সম্পাদক – কাজী সাইফুদ্দীন হোসেন]
মসনবী শরীফ পর্ব-১
“বিশনু আজ না এচুঁ হেকাইযে মিকুনাদ,
ওয়াজ জুদাই হা শিকাইয়েত মীকুনাদ।”
অর্থ: মাওলানা রুমী (রহ:) বলেন, বাঁশের বাঁশি যখন বাজে, তখন তোমরা মন দিয়া শোন, সে কী বলে। সে তাহার বিরহ বেদনায় অনুতপ্ত হইয়া ক্রন্দন করিতেছে।
ভাব: এখানে বাঁশের বাঁশি মানব-রূহের সাথে তুলনা করা হইয়াছে।মানব রূহ আলমে আরওয়াহের মধ্যে আল্লাহর পবিত্র স্থায়ী ভালোবাসায় নিমগ্ন ছিল। ইহ-জগতে আগমন করিয়া পার্থিব বস্তুর ভালোবাসার প্রভাবে আল্লাহর ভালোবাসা ভুলিয়া গিয়াছে। এখন যদি ঐশী ইচ্ছার আকর্ষণে বা কোনো কামেল লোকের সাহচর্যে অথবা কোনো প্রেমের কাহিনী পাঠে নিজের প্রকৃত গুণাবলী ও অবস্থার প্রতি সজাগ হয়, তখন খোদার প্রেমও চিরশান্তির জন্য অনুতপ্ত ও দুঃখিত হইয়া নিজের ভাষায় যে রূপ অনুশোচনা প্রকাশ করে, উহাকেই বাঁশি সুরের সাথে তুলনা করিয়া প্রকাশ করা হইয়াছে।মানব-রূহের বিভিন্ন গুণ আছে। যেমন-মহব্বতে রব্বানী, মারেফাতে ইলাহী ও জেকরে দায়েমী। ইহ-জগতে ইহার প্রত্যেকটিতেই কিছু না কিছু ক্ষতিগ্রস্ত হয় বলিয়া এক একটি স্মরণ করিয়া অনুতপ্ত হইয়া দুঃখ প্রকাশ করিতে থাকে। এইজন্য মাওলানা বলেন, বাঁশি কয়েক প্রকার বিরহের ব্যথা প্রকাশ করিতেছে।
“কাজ নাইয়াছতান তা মরা ব বুরিদাহআন্দ,
আজ নফিরাম মরদো জন নালিদাহআন্দ।”
অর্থ: বাঁশি বলে আমি বাঁশের ঝাড়ের মধ্যে আপন জনের সাথে সুখে শান্তিতে বসবাস করিতেছিলাম। সেখান থেকে আমাকে কাটিয়া পৃথক করিয়া আনা হইয়াছে। সেই জুদাইর কারণে আমি ব্যথিত হইয়া বিরহ যন্ত্রণায় ক্রন্দন করিতেছি। আমার বিরহ ব্যথায় মানবজাতি সহানুভূতির ক্রন্দন করিতেছে।
“ছিনাহ খাহাম শরাহ শরাহ আজ ফেরাক,
তা বগুইয়াম শরেহ দরদে ইশতিয়াক।”
অর্থ: বাঁশি বলিতেছে – আমার বিচ্ছেদের ব্যথা অনুভব করার জন্য ভুক্তভোগী অন্তরের আবশ্যক। পাষাণ অন্তঃকরণ আমার যাতনা অনুভব করিতে পারিবে না। তাই, যে অন্তঃকরণ বিচ্ছেদের ব্যথায় টুকরা টুকরা হইয়া গিয়াছে, সেই অন্তঃকরণ পাইলেই আমার ব্যথা ব্যক্ত করিবো। অন্যথায় আমার রোদন বৃথা যাইবে।
ভাব: যে ব্যক্তির রূহ আলমে আরওয়াহের ভালোবাসার কথা স্মরণ করিয়া কাঁদিতেছে, সেই ব্যক্তি-ই বাঁশির সুরের মর্ম অনুধাবন করিয়া মর্মাহত হইবে। অন্য কেহ সুরের মর্ম বুঝিতে পারিবে না।
“হরকাছে কো দূরে মানাদ আজ আছলে খেশ,
বাজে জুইয়াদ রোজে গারে ওয়াছলে খেশ।”
অর্থ: যে ব্যক্তি নিজের আপনজন হইতে দূরে সরিয়া পড়ে, নিশ্চয়ই সে আপন জনের সাথে মিলিত হইবার জন্য আকাঙ্ক্ষা রাখে। সেই রকম মানব রূহ ও আলমে আরওয়াহের স্থায়ী শান্তি হইতে বহু দূরে সরিয়া পড়িয়াছে, পুনঃ সেই স্থান পাইবার জন্য ব্যাকুল রহিয়াছে।
“মান বাহর জামিয়াতে নাঁলানে শোদাম,
জুফতে খোশ হালানো বদ হালানে শোদাম।”
অর্থ: বাঁশি বলিতেছে যে আমার দুঃখ ও ক্রন্দনের অবস্থা কাহারও নিকট অপ্রকাশ্য নাই। ভাল-মন্দ প্রত্যেকের নিকট-ই আমার অবস্থা প্রকাশ হইয়া রহিয়াছে।
“হরকাছে আজ জন্নে খোদ শোদ ইয়ারে মান
ওয়াজ দরুনে মান না জুস্ত আছরারে মান।”
অর্থ: প্রত্যেকেই নিজ নিজ অবস্থা অনুসারে আমার প্রতি সহানুভূতি প্রকাশ করিয়াছে।আমার জন্য দুঃখ প্রকাশ করিয়াছে।কিন্তু আমার অভ্যন্তরীণ প্রকৃত ব্যথা কেহ-ই বুঝিতে পারে নাই। আর কেহ ব্যথার কারণও অন্বেষণ করে নাই।
“ছিররে মান আজ নালায়ে মা দূরে নিস্ত,
লেকে চশমো গোশেরা আঁনূরে নিস্ত।”
অর্থ: বাঁশি বলিতেছে, আমার ক্রন্দন হইতে ক্রন্দনের রহস্য পৃথক নয়। কিন্তু প্রকাশ্য চক্ষু ও কর্ণে উহা দেখিবার সেই আলো ও শুনিবার সেই শক্তি নাই। অর্থাৎ, শুধু ইন্দ্রিয়ের দ্বারা উহা অনুভব করা যায় না। ইন্দ্রিয়ের সাথে অনুভূতি শক্তির দরকার। যাহার অনুভূতি শক্তি অতি প্রখর, সে-ই আমার ব্যথা অনুভব করিতে পারিবে। যেমন, ক্ষুধার্তের ক্ষুধার জ্বালা ইন্দ্রিয় দ্বারা অনুভব করা যায় না। ভুক্তভোগী ছাড়া অন্যে অনুভব করিতে পারে না। সেই রকম বাঁশির বিরহ ব্যথা ভুক্তভোগী ছাড়া অন্য কেহ বুঝিতে পারে না।
“তন জে জান ও জান জেতন মস্তুরে নিস্ত,
লেকে কাছরা দিদে জান দস্তুরে নিস্ত।”
অর্থ: উপরোক্ত ভাবকে আরো সম্প্রসারণ করিয়া বলিতেছে যে, যেমন দেহ হইতে আত্মা এবং আত্মা হইতে দেহ দূরে নয়, বরং একত্রিত; কিন্তু কাহকেও কেহ দেখিবার বিধান নাই; সেই রকম আমার কান্না হইতে কান্নার ভেদ ভিন্ন নয়। কান্নার অন্তর্নিহিত কান্নার ভেদ প্রকাশ পাইতেছে। কিন্তু শুধু চক্ষু ও কর্ণ দ্বারা বুঝিবার শক্তি নাই।
“আতেশাস্ত ইঁ বাংগে সায়ে ও নিস্তে বাদ,
হরফে ইঁ আতেশে নাদারাদ নিস্তে বাদ।”
অর্থ: বাঁশির সুর আগুনের ন্যায় অন্যের অন্তর প্রজ্জ্বলিত করিয়া চলিতেছে। বাঁশির সুরে যাহার অন্তঃকরণ জ্বলিয়া না উঠে, তাহার অন্তঃকরণ না থাকা-ই ভাল। এমন অন্তঃকরণ ধ্বংস হওয়া-ই উত্তম।
ভাব: প্রকৃত খোদা-প্রেমিকের সাহচর্যে থাকিলে, তাহার অন্তরেও খোদার প্রেম জাগরিত হইয়া উঠে।
“আতেশে ইশ্ কাস্ত কান্দর নায়ে ফাতাদ
জোশশে ইশ্ কাস্ত কান্দর মায়েফাতাদ।”
অর্থ: প্রেমের অগ্নি বাঁশির সুরে নিহিত আছে এবং প্রেমের উত্তেজনা শরাবের মধ্যে বিরাজ করিতেছে।
ভাব: আল্লাহর মহব্বত পবিত্র শরাব-স্বরূপ। যে ব্যক্তির মধ্যে আল্লাহর মহব্বত জ্বলিয়া উঠে, আল্লাহর জন্য পাগল হইয়া যায়, তাহাকেই আশেকে হাকিকী বলে।
“নায়ে হারিফে হরকে আজ ইয়ারে যুরিদ,
পরদাহায়েশ পরদাহায়ে মা দরিদ।”
অর্থ: যে ব্যক্তি প্রিয়জনের বিরহ যাতনায় জ্বলিতেছে, সেই ব্যক্তি-ই বাঁশির বন্ধুরূপে পরিগণিত হইয়াছে।
মাওলানা রুমী বলিতেছেন, বাঁশির সুরের অন্তর্নিহিত মর্মে আমার অন্তর্নিহিত বেদনা জ্বলিয়া উঠিয়াছে।
ভাব: প্রত্যেক মানব-রূহ আলমে আরওয়াহ্ হইতে ইহ-জগতে আসিয়া আল্লাহর মহব্বত হইতে দূরে নিপতিত হইয়া মানব দেহের মধ্যে থাকিয়া সে সর্বদা আল্লাহর নৈকট্য লাভের জন্য বাঁশির ন্যায় ক্রন্দন করিতেছে। কিন্তু, মানবজাতি দুনিয়ার মহব্বতে পড়িয়া উক্ত রূহের অবস্থা অনুভব করিতে পারে না। যদি কোনো কামেল লোকের সাহায্য অবলম্বন করিয়া দুনিয়ার মহব্বত অন্তর হইতে বিদূরিত করিতে পারে, তখন সে রূহের অবস্থা অনুভব করিতে পারিবে।
“হামচু নায়ে জহরে ও তরইয়াকে কেদীদ,
হামচু নায়ে ও মছাজে ও মুশ্ তাকে কেদীদ।”
অর্থ: বাঁশির সুরের ক্রিয়ার কথা যখন উপরে উল্লেখ করা হইয়াছে, তাই মাওলানা এখন বলিতেছেন, বাঁশির সুরের ন্যায় মৃত অন্তরকে জীবিত করিতে অন্য কোনো তরিয়াক বা অমোঘ ঔষধ নাই। বাঁশির সুরের ন্যায় উপযুক্ত উত্তেজনাকারী আর কিছু দেখা যায় না।
“নায়ে হাদীসে রাহে পোর খুন মী কুনাদ,
কেচ্ছাহায়ে ইশকে মজনুন মী কুনাদ।”
অর্থ: বাঁশির সুরে প্রেমের রাস্তা রক্তাক্ত করিয়া তুলে। সে প্রকৃত আশেকের অবস্থা বর্ণনা করিতে থাকে।
“মোহররমে ইঁ হুশে জুযবে হুশে নিস্ত।
মর জবান রা মুশতারি চুঁ গোশে নিস্ত।”
অর্থ: বাঁশির কেচ্ছা দ্বারা ইহা পরিষ্কার বুঝা যায় যে, প্রকৃত আশেকের নিকট মাশুক ব্যতীত অন্য কাহারও খেয়াল না থাকা-ই ইশকের সুস্থ জ্ঞানের লক্ষণ।
ভাব: প্রকৃত খোদা-প্রেমিক খোদা ব্যতীত অন্য কাহারও খেয়াল না করা-ই খাঁটি বান্দার পরিচয়।
যেমন – মুখে কথা বলিলে কর্ণেই শুনে, অন্য কোনো অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের শুনার অধিকার নাই; সেইরূপ খাটি আশেকের মাশুক ব্যতীত অন্য কাহাকেও তলব করার অধিকার থাকে না।
“গার না বুদে নালায়ে নায়ে রা সামার,
নায়ে জাহান রা পুর না করদে আজ শাক্কর।”
অর্থ: যদি বাঁশির ক্রন্দনে কোন ফল লাভ না হইত, তবে ইহ-জগতে বাঁশির সুর মধুরতায় পূর্ণ হইত না।
ভাব: আশেকের ইশকের দরুন যাহা লাভ করা যায়, বাঁশির সুরের দরুন উহাই হাসিল করা যায়।
“দরগমে মা রোজেহা বেনাহ-শোদ,
রোজেহা বা ছুজেহা হামরাহ শোদ।”
অর্থ: বাঁশি বলে, আমার বন্ধুর বিরহ-যাতনার দুঃখে আমার জীবনকাল অনর্থক কাটিতেছে। জীবনকাল দুঃখময় হইয়া অতিবাহিত হইতেছে।
ভাব: প্রকৃত বন্ধু অন্বেষণকারী বন্ধুর মিলনেও শান্তি পায় না। কেননা, মিলনের অনেকগুলি স্তর আছে। ঐগুলি অতিক্রম করার জন্য সর্বদা ব্যস্ত থাকে। অতএব, প্রকৃত আশেকের জন্য কোনো অবস্থা-ই শান্তি বা তৃপ্তির নয়। সদা-সর্বদা পরিপূর্ণতা লাভের জন্য ব্যাকুল থাকে।
মসনবী শরীফ
মূল: মাওলানা জালালউদ্দিন রুমি (রহ:)
অনুবাদক: এ, বি, এম, আবদুল মান্নান
মুমতাজুল মোহদ্দেসীন, কলিকাতা আলিয়া মাদ্রাসা।
সূত্রঃ https://mishukifti.wordpress.com/