মসনবী শরীফ পর্ব-৬ : মাওলানা জালালউদ্দিন রুমি (রহ:)

[বাংলা এই ভাবানুবাদ বরিশাল থেকে প্রায় ৫০ বছর আগে প্রকাশিত। এই দুর্লভ সংস্করণটি সরবরাহ করেছেন সুহৃদ (ব্যাংকার) নাঈমুল আহসান সাহেব।  সম্পাদক – কাজী সাইফুদ্দীন হোসেন]

মসনবী শরীফ পর্ব-৬

“বুদ আন্দর মানজারাহ শাহ মোন্তাজের,
তা বা বীনাদ আঁচে নামুদান্দ ছার।”

অর্থ: বাদশাহ অপেক্ষার পর অপেক্ষা করিতেছিলেন, তারপর দেখিলেন যে তিনি প্রকাশ্যে উপস্থিত হইয়াছেন।

“দীদে শখছে ফাজেলে পুর মায়ায়ে,
আফতাবে দরমিয়ানে ছায়ায়ে।”

অর্থ: বাদশাহ দেখিলেন যে, এক ব্যক্তি মারেফাতে পূর্ণ কামেল এবং দেখিতে সূর্যের চাইতেও অধিক জ্যোতির্ময় চেহারাবিশিষ্ট ব্যাক্তি উপস্থিত হইলেন।

“মী রছিদ আজ দূরে মানেন্দে হেলাল,
নীস্তে বুদো হাস্তে বর শেকলে খেয়াল।”

অর্থ: মনে হইল যেন তিনি বহুদূর হইতে চাঁদের ন্যায় উদিত হইলেন। যেমন কাঙ্ক্ষিত ব্যক্তির খেয়াল মনে করিয়া লোক অপেক্ষায় থাকে, সেই রকম অবিদ্যমান খেয়ালী ব্যক্তি যদি আসিয়া উপস্থিত হয়, তখন মানুষের খুব আনন্দ হয়। বাদশাহ সেই রকম আনন্দিত হইলেন।

“বর খেয়ালে ছুলেহ শাঁ ও জংগে শাঁ,
ওয়াজ খিয়ালে ফখরে শাঁ ও নংগে শাঁ।”

অর্থ: যেমন, যদি কেহ ভাল মনে করিয়া সুলেহ (সন্ধি) করে, আর যদি কোনো কারণে যুদ্ধ আবশ্যক মনে করে, তবে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হয়। যদি কোনো কৃতিত্বের কথা মনে পড়ে, তবে ফখর করিতে আরম্ভ করে এবং যদি কোনো দুর্নামের কথা ভাবে, তবে লজ্জিত হয়।

“আঁ খেয়ালাতে কে দামে আওলিয়াস্ত,
আকছে মহ রোবিয়ানে বুস্তানে খোদাস্ত।”

অর্থ: এখানে মাওলানা লোকের খেয়ালের কথা বর্ণনা করিতে যাইয়া বলিতেছেন যে, কোনো লোকের খেয়াল বৃথা বলিয়া প্রমাণিত হয়। কিন্তু আওলিয়া লোকের খেয়াল কখনও মিথ্যা বা বৃথা প্রমাণিত হয় না। কেননা, তাঁহারা অন্তরকে মোরাকাবা ও মোকাশাফা দ্বারা পরিষ্কার করিয়া ফেলেন। তৎপর আল্লাহর তরফ হইতে সব কিছুর ইলহাম (ঐশী প্রত্যাদেশ) তাঁহাদের অন্তরে পতিত হয়। আল্লাহর ইলম হইতে তাঁহাদের অন্তরে ইলমে গায়েবীর প্রতিবিম্ব হয়, সেই খেয়াল মোতাবেক তাঁহারা কাজ করেন ও কথা বলেন। এইরূপ বিদ্যাকে ইলমে লাদুন্নী বলা হয়।

“আখেঁয়ালেরা কে শহদর খাবে দীদ,
দররুখে মেহমান হামী আমদ পেদীদ।”

অর্থ: বাদশাহ স্বপ্নে যে সমস্ত আলামত দেখিয়াছিলেন, এই আগন্তুকের চেহারায় সেই আলামতসমূহ বিদ্যমান ছিল।

“নূরে হক জাহের বুদান্দ রুয়ে,
নেক বিঁ বাশি আগার আহালে দেলে।”

অর্থ: আগন্তুকের চেহারায় আল্লাহর নূর প্রকাশ পাইতেছিল। যদি তুমি নেককার ও নির্মল অন্তরসম্পন্ন হও, তবে উক্ত নূর দেখিতে পাইবে। আল্লাহর ওলির চেহারায় আল্লাহর নূর চমকিতে থাকে।

“আঁ ওয়ালিযে হক চু পযদা শোদ জে দূর,
আজ ছার আ পায়েশ হামী মীরিখত নুর।”

অর্থ: ঐ প্রকৃত ওলি যখন দূর হইতে আসিয়া উপস্থিত হইলেন, তাঁহার আপাদমস্তকে আল্লাহর নূর চমকিতে ছিল।

“শাহ বজায়ে হাজে বানে দর পেশে রফত,
পেশে আঁ মেহমানে গায়েবে খেশ রফত।”

অর্থ: বাদশাহ দারওয়ানের ন্যায় অভ্যর্থনা করার জন্য গায়েবী দরবেশের সম্মুখে উপস্থিত হইলেন।

“জাইফে গায়েবী রা চুঁ ইছতেক বাল করদ,
চুঁ শোফার গুইকে পেওস্ত উ বা ওয়ারদ।”

অর্থ: বাদশাহ যখন গায়েবী মেহমানের অভ্যর্থনা জানাইলেন, তখন এমনভাবে মিলিত হইলেন, যেমন চিনি দুধে মিশিয়া যায়; অথবা যেমন গোলাপ ফুল একটির সাথে অন্যটি মিলিয়া থাকে, সেইরূপ উভয় আল্লাহর অলি মিশিয়া গেলেন। কেননা, বাদশাহ-ও আল্লাহর অলি ছিলেন।

“আঁ একে লবে তেশনা দাঁ দিগার চুঁ আব,
আঁ একে মাহমুজ দাঁ দিগার শরাব।”

অর্থ: এখানে মাওলানা উভয়ের মিলনের কারণ বর্ণনা করিয়াছেন যে, তাঁহারা একজন অর্থাৎ বাদশাহ তৃষ্ণার্ত ছিলেন এবং মেহমান পানিস্বরূপ ছিলেন। একে অন্যের দিকে মুখাপেক্ষী ছিলেন। যখন প্রাপ্ত হইলেন, মিলিয়া গেলেন।

“হরদো বহরে আশনা আমুখতাহ,
হরদো জানে বে দোখতান বর দোখতাহ।”

অর্থ: এখানে মাওলানা উভয়ের ইলমে মারেফাত হাসিলের বর্ণনা দিয়া বলিতেছেন যে, তাঁহারা উভয়েই মারেফাতের সাগর ছিলেন। উভয়ের প্রাণ একে অন্যের সাথে এমনভাবে মিলিত ছিল, যেমন সেলাই ব্যতীত মিলিত রহিয়াছে।

“গোফতে মায়া শুকাম তু বুদাস্তি না আঁ,
লেকে কারে আজ কারে খীজাদ দর জাহাঁ।”

অর্থ: বাদশাহ মেহমানকে লক্ষ্য করিয়া বলিলেন, আপনি-ই আমার প্রকৃত মাশুক ছিলেন, উক্ত দাসী নয়। কিন্তু, এই পৃথিবীতে অসিলা ব্যতীত কোনো কাজ সফল হয় না বলিয়া উক্ত দাসীকে প্রকাশ্যে ভালোবাসিয়াছিলাম। ঐ দাসীর অসিলায় আপনাকে পাইলাম। নতুবা আপনাকে পাওয়া আমার পক্ষে সম্ভব ছিল না।

“আয়ে মরা তু মোস্তফা মান চুঁ ওমর,
আজ বরায়ে খেদ মাতাত বান্দাম কোমর।”

অর্থ: বাদশাহ মেহমানকে বলিলেন, হে বন্ধু! তুমি আমার নিকট হজরত মোহাম্মদ মোস্তফা (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম)-এর ন্যায় মুরশেদ, আর আমি হজরত ওমর (রাঃ)-এর ন্যায় খাদেম।

আল্লাহর অলির সহিত সর্বদা আদবের সাথে ব্যবহার করা ও বেয়াদবি করার কুফল সম্বন্ধে বর্ণনা

“আজ খোদা জুইয়াম তাওফিকে আদব,
বে আদব মাহরুম গাশত আজ লুৎফে রব।”

অর্থ: মাওলানা বলিতেছেন, খোদার নিকট আমি আদব শিক্ষার শক্তি কামনা করিতেছি। কেননা, বে-আদব আল্লাহর মেহেরবাণী হইতে বঞ্চিত থাকে।

ভাব: বাদশাহ আগন্তুক আল্লাহর অলির সাথে আদবের সহিত ব্যবহার করিয়াছেন বলিয়া আল্লাহর মেহেরবানী প্রাপ্ত হইয়াছেন। অতএব, আমাদেরও উচিত অলি-বুযূর্গের সাথে আদব সহকারে চলাফেরা করা। বে-আদবি করিলে আল্লাহর রহমত হইতে বঞ্চিত হইতে হয়। বালা-মুসিবতে গ্রেফতার হইতে হয়।

“বে-আদব তনহা না খোদরা দাস্ত বদ,
বলকে আতেশ দরহামা আফাক জাদ।”

অর্থ: বে-আদব শুধু নিজেরই ক্ষতি করে না, বরং সমস্ত দেশেই বে-আদবির আগুন ছড়াইয়া পড়ে। অর্থাৎ, বে-আদবির কুফল আগুনস্বরূপ। উক্ত আগুন সমস্ত দেশ জ্বালাইয়া পোড়াইয়া দেয়।

ভাব: যদি কোনো আল্লাহর অলির সাথে কেহ বে-আদবি করে, তবে ঐ দেশে যে বালা-মুসিবত পড়ে, উহা হইতে কেহ রেহাই পায় না। ভাল-মন্দ, নেককার-বদকার সকলেই বিপদগ্রস্ত হইয়া পড়ে। হয়তো কাহারও জন্য পরীক্ষাস্বরূপ; আর বদকারের জন্য গজব। কিন্তু কেহই উক্ত বালা হইতে রেহাই পাইবে না।

“মায়েদাহ আজ আছমান দরমী রছিদ,
বেশারাও বায়ে ওবে গোফতও শনিদ।”

অর্থ: যেমন হজরত মূসা (আ:)-এর যুগে আল্লাহতায়ালা মেহেরবানী করিয়া বনি ইসরাইলদের জন্য বিনা মেহনতে ও বিনা ক্রয়-বিক্রয়ে মান্না ও সালওয়ার খাঞ্চা নাজেল হইত। উহার সহিত বেয়াদবি করার ফলে আল্লাহতায়ালা খাঞ্চা পাঠানো বন্ধ করিয়া দিলেন।

“দরমিয়ানে কওমে মুছা চান্দে কাছ,
বে-আদব গোফতান্দ কোছির ও আদাছ।”

অর্থ: কয়েকজন লোকে বে-আদবির সাথে বলিয়াছিল, আমরা মান্না ও সালওয়ায়ে সন্তুষ্ট নহি। আমরা পেঁয়াজ, রসুন ও মশুর ডাল ইত্যাদি চাই। ইহাতে খোদার দানের প্রতি বেয়াদবি করা হইয়াছে বলিয়া আল্লাহতায়ালা মান্না-সালওয়া বন্ধ করিয়া দিলেন। এই ঘটনা পবিত্র কুরআনে উল্লেখ আছে।

“মুনকাতে শোদ খানো নানে আজ আছমাঁ,
মানাদ রঞ্জে জেরাও বেলও বেলও দাছেমাঁ।”

অর্থ: আসমান হইতে মান্না ও সালওয়া নাজেল হওয়া বন্ধ হইয়া গেল। রইলো শুধু কাস্তে-কোদাল দিয়া কৃষি খামার করিয়া খাইবার কষ্ট। বিনা কষ্টে আর খাইতে পারিবে না।

“বাজে ঈসা চুঁ শাফায়াত করদে হক,
খানে ফেরেস্তাদ ও গণিমাত বর তরক।”

অর্থ: বহুদিন পর হজরত ঈসা (আ:)-এর যুগে, ঈসা (আ:)-এর শাফায়াতের কারণে খাঞ্চা নাজেল হওয়ার দোওয়া কবুল হইল এবং পুনরায় গণিমাত ও খাঞ্চা জমিনে নাজেল হইল।

“মায়েদাহ আজ আছমান শোদ আয়েদাহ,
চুঁকে গোফত আনজেল আলাইনা মায়েদাহ।”

অর্থ: পুনঃ ঐ খাঞ্চা আসমান হইতে নাজেল হইল। যখন ঈসা (আ:) আল্লাহর দরবারে দোওয়া করিলেন, হে খোদা, আমাদের উপর তুমি পুনঃ মান্না ও সালওয়া নাজেল করো।

“বাজে গোস্তেখানে আদব ব গোজাস্তান্দ,
চুঁ গাদায়ানে জোলহা বর দাস্তান্দ।”

অর্থ: ফের বেয়াদবরা বেয়াদবি করিলে খাঞ্চা নাজেল হওয়া বন্ধ হইয়া গেল। কারণ, তাহারা খাওয়ার পর যে খানা বাকি থাকিত, উহা উঠাইয়া রাখিয়া জমা করিত। খোদার তরফ থেকে হুকুম ছিল যে, বাকি খানা ইয়াতীম মিসকীনের মধ্যে বিতরণ করিয়া দিও। কিন্তু, তাহারা উহা নিজেদের জন্য জমা করিয়া রাখিত।

“করদে ঈছা লাবা ইঁশাঁ রাকে ইঁ,
দাযেমাস্ত ও কম না গরদাদ আজ জমিন।”

অর্থ: হজরত ঈসা (আ:) তাহাদিগকে অতি বিনয় সহকারে বুঝাইয়া দিলেন যে, এই খাঞ্চা তোমাদের জন্য সব সময় নাজেল হইবে। তোমরা উহা হইতে উঠাইয়া রাখিয়া জমা করিও না।

“বদগুমানী করদান ও হেরচে আওয়ারী,
কুফরে বাশদ পেশে খানে মাহতারি।”

অর্থ: খাঞ্চা নাজেল হয়, কিন্তু তাহারা খারাপ ধারণা করিল যে আগামীতে এই খাঞ্চা নাজেল হয় কিনা সন্দেহ। এই কারণে লোভে পড়িয়া কিছু কিছু জমা করিতে লাগিল। খোদার দান খাঞ্চার উপর সন্দেহ করায় কুফরি করা হইল। খোদার ওয়াদার উপর তাহাদের বিশ্বাস স্থাপন করা হইল না। এইজন্য কাফের হইতে খোদার নেয়ামত উঠাইয়া নেওয়া হইল।

“জাঁ গাদা রুইয়ানে নাদিদাহ জাজ,
আঁদরে রহমতে বর ইঁশাঁ শোদ ফরাজ।”

অর্থ: ঐ কারণে লোভীদের নাফরমানীর জন্য সকলের উপর খাঞ্চা নাজেল হওয়া বন্ধ হইয়া গেল। চিরদিনের জন্য এই পৃথিবীতে খোদার তরফ হইতে রহমতের খাঞ্চা নাজেল বন্ধ হইয়া গেল।

“মান্না ছালওয়া জে আছমান শোদ মুনকাতেয়,
বাদে আজাঁ জানে খান নাশোদ কাছ মুন্তাফেয়।”

অর্থ: মান্না সালওয়া আসমান হইতে নাজেল হওয়া বন্ধ হইয়া গেল। ইহার পর কাহারও জন্য ঐ খাঞ্চা হইতে উপকৃত হওয়া আর ভাগ্যে জোটে নাই।

“আবর না আইয়াদ আজ পায়ে মানা জাকাত,
ওয়াজ জেনা উফতাদ ওবা আন্দর জেহাদ।”

অর্থ: যেমন হাদীসে বর্ণনা করা হইয়াছে যে যখন লোকে যাকাত দেওয়া বন্ধ করিয়া দিবে, তখন ঐ দেশে আর আল্লাহর রহমতের মেঘ বর্ষণ হইবে না। আর যে দেশে জেনা (অবৈধ যৌনাচার) প্রচলন হইবে, সেখানে প্লেগ, কলেরা ও বসন্ত মহামারীরূপে দেখা দিবে।

“হরচে আইয়াদ বর তু আজ জুলমাত ও গম,
আঁজে বেবাকী ও গোস্তাখী ইস্ত হাম।”

অর্থ: যাহা কিছু তোমাদের উপর বিপদ-মুছিবত আসে, উহা তোমাদের নাফরমানী ও বেয়াদবির দরুন আসে। কিন্তু কতক লোকের নাফরমানীর দরুন সর্বসাধারণের উপর বালা আসিয়া পড়ে।

“হরকে বেবাকী কুনাদ দর রাহে দোস্ত,
রাহজানে মরদানে শোদ ও নামরদা উস্ত।”

অর্থ: যে ব্যক্তি আহকামে শরীয়াতের মধ্যে নাফরমানী ও বেয়াদবি করে, সে ব্যক্তি ডাকাতের ন্যায় কাপুরুষ।

“”হরকে গোস্তাখী কুনাদ আন্দর তরীক,
গরদাদ আন্দর ওয়াদীয়ে হাচরাত গরীক।”

অর্থ: যে ব্যক্তি মারেফাতের তরীকার মধ্যে বেয়াদবি ও গোস্তাখি করে, সে সর্বদা দুঃখপূর্ণ কূপে ডুবিয়া থাকে। জীবনে কখনও শান্তি পায় না।

“আজ আদান পুরনূর গাস্তাস্ত ইঁ ফালাক,
ওয়াজ আদাবে মায়াছুম ও পাক আমদ মালাক।”

অর্থ: আসমান খোদার সম্মুখে আদব আদায় করার দরুন আল্লাহতায়ালা তাহাকে চন্দ্র, সূর্য ও তারকারাজি দ্বারা সুসজ্জিত করিয়া দিয়াছেন এবং ফেরেস্তারা ইলমে আসমা পরীক্ষার সময় আদবের সহিত উত্তর করায় তাহাদিগকে বে-গুণাহ করিয়া দিয়াছেন।

“বদজে গোস্তাখী কুছুফে আফতাব,
শোদ আজাজিলে জে জুরায়াতে রদ্দে বাব।”

অর্থ: বদলোকের গুণাহের দরুন সূর্যগ্রহণ হয়। আজাজিল অহঙ্কারের দরুন মরদুদ শয়তানে পরিণত হইয়া আল্লাহর দরবার হইতে বিতাড়িত হয়।

“হালে শাহ ও মেহমানে বর গো তামাম,
জাঁকে পায়ানে না দারাদ ইঁ কালাম।”

অর্থ: আদবের ফজিলত ও বেয়াদবির দুরবস্থার বর্ণনার সীমা নাই। এখন বাদশাহ ও আগন্তুক মেহমানের ঘটনা বর্ণনা করা দরকার।

(বাদশার ওলির সহিত সাক্ষাৎ করা, যে ওলিকে তিনি স্বপ্নে দেখিয়াছিলেন।)

“শাহ চুঁ পেশে মেহমানে খেশে রফত,
শাহেবুদ ওয়ালেকে বাছ দরবেশ রফত।”

অর্থ: বাদশাহ যখন নিজের মেহমানের সম্মুখে গেলেন, তখন তিনি যদিও বাদশাহ ছিলেন, তবু ফকিরানা ভাবে অতি বিনয়ের সতি সাক্ষাৎ করিলেন।

“দাস্তে বকোশাদ ও কেনারা নাশ গেরেফত,
হামচু ইশকে আন্দর দেল ও জানাশ গেরেফত।”

অর্থ: যখন বাদশাহ মেহমানের সম্মুখে গেলেন, যাওয়া মাত্র উভয় হাত দ্বারা মেহমানকে জড়াইয়া ধরিয়া কোলাকুলি করিলেন। যেমন ইশককে দেল ও জানের মধ্যে স্থান দেয়। অর্থাৎ, মেহমানকে অন্তরাত্মা দিয়া ভালোবাসিয়া ফেলিলেন।

“দস্তো ও পে শানিয়াশ বুছিদান গেরেফত,
ওয়াজ মোকামে ওরাহে পুরছিদান গেরেফত।”

অর্থ: বাদশাহ মেহমানের হাত ও কপালে চুম্বন করিতে আরম্ভ করিলেন। কোথা হইতে কোন্ পথে আসিয়াছেন জিজ্ঞাসাবাদ করিতে লাগিলেন।

“পোরছ পরিছানে মী কাশিদাশ তা বা ছদর,
গোফতে গঞ্জে ইয়াফ তাম আখের বা ছবর।”

অর্থ: জিজ্ঞাসাবাদ করিতে করিতে বাদশাহ মেহমানকে লইয়া সিংহাসনে যাইয়া উপস্থিত হইলেন এবং মেহমানকে বলিলেন যে, আমি আমার ধৈর্যের দরুন আমার মূলধনের খাজিনা পাইয়াছি।

“ছবর তলখো আমদ ওয়ালেকিন আকেবাত,
মেওয়া শিরিন দেহাদ পুর মোনফায়াত।”

অর্থ: ধৈর্য ধারণ করা যদিও কষ্টকর, কিন্তু উহার শেষফল অত্যন্ত উপকারজনক মিষ্টি ফল-স্বরূপ।

“গোফতে আয়ে হাদিয়ায়ে হক ও দাফে হরজ,
মায়ানি আছ ছবরো মিফতাহুল ফরজ।”

অর্থ: বাদশাহ মেহমানকে বলিতেছেন, হে আল্লাহর দান, আপনি আমার দুঃখ-কষ্ট দূরকারী। অর্থাৎ, ধৈর্য ধারণ করা-ই দুঃখ-কষ্ট দূর হওয়ার চাবিস্বরূপ।

“আয়ে তাকায়ে তু জওয়াবে হর ছওয়াল,
মুশ কিল আজ তু হল্লে শওয়াদ বে কীল ও কাল।”

অর্থ: বাদশাহ মেহমানকে বলিতেছেন, হে বরকতওয়ালা! আপনার সাক্ষাতে আমার প্রত্যেক বিপদ মুসিবত দূর হইয়া যাইবে। আমি কিছু বর্ণনা করিতেই আমার সমস্ত বিপদ ও মুসিবত আসান হইয়া যাইবে।

“তরজ মানে হরচে মারা দর দেলাস্ত,
দস্তেগীর হরকে পায়াশ দর গেলাস্ত।”

অর্থ: বাদশাহ বলেন, যাহা কিছু আমার অন্তরে আছে, উহা আপনি-ই নিজে বর্ণনা করিবেন। এবং আমি যে যে বিষয়ে বিপদগ্রস্ত আছি, আপনি-ই উহার সাহায্যকারী।

ভাব: আল্লাহর অলির নিকট প্রকাশ্যে কিছু বর্ণনা করা দরকার হয় না। কারণ, তাঁহারা আল্লাহর তরফ হইতে ইলহাম বা কাশফ দ্বারা সব কিছু মা’লুম করিয়া নিতে পারেন।

“মারহাবা; ইয়া মোজতবা, ইয়া মোরতজা,
ইন তাগেব জায়াল কাজা দাকাল ফাজা।”

অর্থ: হে পবিত্র ও প্রিয়! তোমার আগমন আমার আনন্দের বিষয়। তুমি যদি আমা হইতে দূর হইয়া যাও, তবে আমার মৃত্যু অনিবার্য এবং আমার ইহ-জীবন বৃথা।

“আনতা মাওলাল কওমে মান লা ইয়াশতাহী,
কদর দে কাল্লা লা ইন লাম ইয়ান তাহী।”

অর্থ: আপনি মানবের হিতাকাঙ্ক্ষী ও সাহায্যকারী। আপনার প্রতি যাহার আকাঙ্ক্ষা নাই, সে নিশ্চয় ধ্বংস হইয়া যাইবে।

ভাব: আল্লাহর অলিদের প্রতি ভালোবাসা ও মহব্বত রাখা চাই; না হইলে আল্লাহতায়ালা অসন্তুষ্ট হইয়া তাহার অবনতি ঘটান।

[বাদশাহ ঐ তবিবকে রোগীর নিকট নিয়া যাওয়া এবং রোগীর অবস্থা দেখা।]

“চুঁ গোজাস্ত আঁ মজলেছ ও খানে করম,
দস্তে উ ব গেরেফত ও বোরদো আন্দর হেরেম।”

অর্থ: কথাবার্তার পর খানা-পিনা শেষ করিয়া মেহমানকে নিয়া অন্দরমহলে চলিয়া গেলেন।

“কেচ্ছা রঞ্জুর ও রঞ্জুরে ব খানাদ,
বাদে আজ আঁ দরপেশে রঞ্জুরশ নেশানাদ।”

অর্থ: রোগীর রোগের কথা বর্ণনা করিয়া তারপর রোগীর নিকট তাঁহাকে বসাইয়া দিলেন।

“রংগে রো ও নবজো কারুরা বদীদ,
হাম আলামাত ও হাম আছ বাবাশ শনীদ।”

অর্থ: তবিব সাহেব রোগীর চেহারা, রং ও স্নায়ুর গতিবিধি পরীক্ষা করিয়া দেখিলেন, এবং রোগের নমুনা ও কারণসমূহ শ্রবণ করিলেন।

“গোফতে হর দারু কে ইঁশা করদান্দ,
আঁ ইমারাত নিস্ত বিরান করদন্দ।”

অর্থ: পূর্বোক্ত ডাক্তার ও হেকিম সাহেবেরা রোগ চিনিতে পারেন নাই। অতএব, তাঁহারা যে ঔষধ প্রয়োগ করিয়াছেন, উহাতে বিপরীত ক্রিয়া করিয়াছে এবং তাহার অবস্থার আরও অবনতি ঘটিয়াছে।

“বে খবর বুদান্দ আজ হালে দরুঁণ,
আস্তাইজল্লাহা মিম্মা ইয়াফতারুণ।”

অর্থ: তবীব আরও বলিলেন, আগেকার ডাক্তার ও হেকীমগণ রোগীর অভ্যন্তরীণ অবস্থা বুঝিতে পারেন নাই। তাঁহারা যে বৃথা ঔষধপত্র করিয়াছেন, উহার জন্য আল্লাহর কাছে পানাহ চাহিতেছি।

দীদে রঞ্জ ও কাশফে শোদ বরওয়ায়ে নে হুফত,
লেকে নেহাঁ করদ ও বা ছুলতান না গোফত।

অর্থ: এই বিজ্ঞ তবীব রোগী দেখিলেন এবং রোগীর অভ্যন্তরীণ গুপ্ত রহস্য সম্বন্ধে অবগত হইলেন। রোগী কিন্তু রোগের অবস্থা গুপ্ত রাখিয়াছে। বাদশাহর কাছে বলে নাই।

“রঞ্জাশ আজ ছাফরাও আজ ছওদা নাবুদ,
বুয়ে হর হিজাম পেদীদ আইয়াদ জেদুদ।”

অর্থ: রোগীর রোগ হলুদ ও কাল মিশ্রিতের জন্য নয়, যেমন-প্রত্যেক কাষ্ঠের ঘ্রাণে কাঠের পরিচয় পাওয়া যায়; যখন উহা জ্বালায় তখন উহার ধূয়ার ঘ্রাণ নিলেই পরিচয় পাওয়া যায়।

“দীদ আজ জারিয়াশ কো জারে দেলাস্ত,
তন খোশাস্ত আম্মা গেরেফতারে দেলাস্ত।”

অর্থ: বিজ্ঞ তবীব ছাহেব দেখিলেন যে, রোগীর ক্রন্দনে তাহার অন্তরের ব্যথা প্রকাশ পায়। শরীর সুস্থ আছে কিন্তু অন্তরে ব্যথা নিহিত।

“আশেকী পয়দাস্ত আজ জারীয়ে দেল,
নিস্তে বিমারী চুঁ বিমারিয়ে দেল।”

অর্থ: প্রেমিক হওয়াটা অন্তরের ব্যথা। অন্তরের ব্যথার চাইতে কোনো বেদনা-ই কঠিন নহে।

“ইল্লাতে আশেক জে ইল্লাত হায়ে জুদাস্ত,
ইশকে ইছতের নাবে আছরারে খোদাস্ত।”

অর্থ: মাওলানা বলিতেছেন, প্রেমিক হওয়ার কারণ অন্যান্য রোগের কারণ হইতে পৃথক। প্রেমিক হওয়ার কারণ খোদার রহস্য ইশকের দরুন খোদার ভেদ জানা যায়।

“আশেকী গার জিইঁ ছার ওগার জাআছারাস্ত,
আকেবাত মারা বদাঁ শাহ রাহ্ বরাস্ত।”

অর্থ: মাওলানা বলেন, ইশক মাজাজী হউক, আর হাকিকী হউক, যে ভাবেই হউক না কেন শেষফল খোদাকে চেনা যায়। খোদার ভালোবাসা লাভ করা যায়। যেমন আমাদের অবস্থা। আমাদিগকে শেষ পর্যন্ত হক-তায়ালাকে পরিচিত করিয়া দিয়াছেন।

“হরচে গুইয়াম ইশকেরা শরাহ ও বয়ান,
চুঁ বা ইশ্কে আইয়াম খজল বাশাম আজ আঁ।”

অর্থ: মাওলানা বলেন, ইশক অনুভব করার বস্তু। অনুভূতির বস্তু লাভ করিতে বুঝ-শক্তি ও স্বাদ গ্রহণের শক্তি প্রখর হওয়া চাই। শুধু লিখনে ও বর্ণনায় যথেষ্ট নয়। তাই, আমি যখন ইশ্কের ব্যাখ্যা বর্ণনা করি, তখন নিজের অনুভূতির দিক দিয়া লজ্জিত হই। কারণ, ইশকের ব্যাখ্যা ও বর্ণনা যে পরিমাণেই করি না কেন, ইশকের গুণাগুণ ও স্বাদ তাহার চাইতে অধিক, তাই নিজে নিজে তখন লজ্জিত হই।

“গারচে তাফছীরে জবান রৌশন গারাস্ত,
লেকে ইশ্ক বে জবান রৌশান তরাস্ত।”

অর্থ: মাওলানা বলেন, যদিও প্রত্যেক বস্তুর মূল বৃত্তান্ত বর্ণনা দ্বারা প্রকাশ পায়, কিন্তু, ইশক বর্ণনা ব্যতীত বেশি প্রকাশ পায়। অনুভব করিলেই মর্যাদা বুঝিতে পারে।

“চুঁ কলম আন্দর নাবেস্তান মী শেতাফত,
চুঁ বা ইশ্কে আমদ কলম বর খোদ শেগাফত।”

অর্থ: কেননা, যখন কলম নিয়া অন্যান্য বিষয় লিখিতে বসি, তখন কলম খুব তাড়াতাড়ি চলে। আর যখন ইশক সম্বন্ধে লিখিতে আরম্ভ করি, তখন কলম নিজে নিজেই ফাটিয়া যায়, লিখা যায় না। অর্থাৎ, ইশকের ক্রিয়া এমন, যাহার কারণে লিখিতে বসিলেই কলম ফাটিয়া চৌচির হইয়া যায়। ইশক লিখার বস্তু নয়, অনুভব করার বস্তু (বিষয়)।

“চুঁ ছুখান দর ওয়াছফে ইঁ হালত রছিদ,
হাম কলম বশেকাস্ত ওহাম কাগজ দরিদ।”

অর্থ: যখন ইশক সম্বন্ধে বর্ণনার অবস্থা এইরূপ যে, লিখিতে বসিলে কলম ফাটিয়া যায় এবং কাগজ ছিঁড়িয়া যায়, তাই উহার বর্ণনা দেওয়া অসম্ভব। শুধু অনুভূতি শক্তি দ্বারা অনুভব করিতে হয়।

“আকাল দর শরাহশ চু খরদর গেল বখোফত,
শরাহ ইশ্ক ও আশেকী হাম ইশক গোফত।”

অর্থ: মাওলানা বলেন, জ্ঞান যখন ইশকের বর্ণনা করিতে অক্ষম – যেমন, গাধা কাদা-মাটিতে আটকাইয়া গেলে চলিতে অক্ষম; তাই ইশকের বয়ান ইশক নিজেই করিতে পারে। অর্থাৎ, ইশক যাহার অন্তরে হাসিল হয়, তাহাকে দেখিলেই ইশকের অবস্থা বুঝা যায়।

“আফতাব আমদ দলিলে আফতাব,
গার দলিলাত বাইয়াদ আজওয়ায়ে রুমতাব।”

অর্থ: মাওলানা আরও প্রমাণ পেশ করিয়া ইশকের রহস্য সম্বন্ধে দৃষ্টান্ত দিতেছেন যে, সূর্য উদিত হইলে সূর্য নিজেই তাহার প্রমাণ। যদি কেহ সূর্যের প্রমাণ চায়, তবে তাহাকে নিজেই বাহির হইয়া রৌদ্রের প্রখরতা অনুভব করিতে হইবে। অন্য কেহ তাহাকে বর্ণনা দিয়া বুঝাইতে পারিবে না। কেননা, সূর্য কেমন – এই প্রশ্নের উত্তর কেহ বর্ণনা দিয়া বুঝাইতে চেষ্টা করিলে সে কিছুতেই সূর্যের হাকিকাত বুঝিবে না। অতএব, তাহাকে বাহির হইয়া সূর্যের হাকিকাত অনুভব করিতে হইবে।

“আজ ওয়ায়ে আর ছায়া নেশানে মী দেহাদ,
শামছো হরদমে নূরে জানে মী দেহাদ।”

অর্থ: মাওলানা বলিতেছেন, জাহেরী সূর্য কোনো কোনো সময় গায়েব হইয়া যায়, তখন অন্ধকার আসে বা ছায়া পতিত হয়। কিন্তু, হাকিকী সূর্য সব সময়ে রূহকে আলো প্রদান করে।

ভাব: মাওলানা ইশকের তুলনা সূর্যের সাথে করিতে যাইয়া হঠাৎ সূর্য হইতে আল্লাহর নূরের দিকে ফিরিয়া গিয়াছেন এবং বলিতেছেন, সূর্যকে দেখিয়া সূর্যের প্রখরতা বুঝা যায়। আবার যখন গায়েব হইয়া যায়, তখন ছায়া আসে; উহা সূর্যকিরণের বিপরীত বা বিরুদ্ধ। এই বিরুদ্ধ দ্বারা সূর্যের প্রকৃত গুণাগুণ অনুভব করা যায়। কিন্তু হাকিকী সূর্য, অর্থাৎ, আল্লাহতায়ালা, তিনি আলোস্বরূপ। যেমন, তিনি নিজেই পবিত্র কালামে উল্লেখ করিয়াছেন, “আল্লাহ নূরুছ ছামাওয়াতে ওয়াল আরদে”। অর্থাৎ, আল্লাহতায়ালা আছমান জমিনের একটি আলো স্বরূপ। তাই মাওলানা আল্লাহকে হাকিকী আলো বলিয়াছেন। সেই আলো সূর্য হইতে পৃথক। কারণ, তিনি সর্বদা আরেফীনদের অন্তরে আলো দান করিতেছেন। কোনো সময়েই কোনো মুহূর্তে আলো দান করা বন্ধ হয় না। কিন্তু, ‍সূর্য গায়েব হইয়া গেলে আলো দান হইতে বিরত থাকে। তাই মাওলানা বলেন, সূর্যের আলোর সাথে আল্লাহর আলোর তুলনা করা পরিপূর্ণভাবে ঠিক হয় না, যদিও আলো দান হিসাবে একই। সূর্যের আলো অস্থায়ী, অসম্পূর্ণ; আর আল্লাহর আলোর পরিপূর্ণ, স্থায়ী। সূর্যের বিরুদ্ধে ছায়া আছে, ছায়া দ্বারা সূর্যের হাকিকাত বুঝা যায়। কিন্তু, আল্লাহর কোনো বিরুদ্ধ নাই, যদ্বারা আল্লাহকে জানা যায়। আল্লাহকে জানিতে হইলে, তাঁহার নিজ গুণ দ্বারা জানিতে হইবে ও অনুভব করিতে হইবে। আল্লাহতায়ালা সদা সর্বদা ইহ-জগতে আলো দান করিতেছেন বলিয়া তাঁহাকে চিনা ও বুঝা সহজসাধ্য নয়। কেননা, পূর্বেই বলা হইয়াছে, তাঁহার বিরুদ্ধ নাই যে তাহা দ্বারা তাঁহাকে সহজে জানা যাইবে। আল্লাহকে পাইতে হইলে সূক্ষ্ম ও সতেজ অনুভূতি থাকা দরকার। সতেজ অনুভূতি শক্তি না থাকিলে আল্লাহকে পাওয়া যায় না।

“ছায়া খাব আরাদ তোরা হামচুঁ ছামার,
চুঁ বর আইয়া শামছু ইনশাক্কাল কামার।”

অর্থ: এখানেও মাওলানা সূর্য ও জাতে পাকের আলো দানের পার্থক্য সম্বন্ধে বলিতে যাইয়া বলিতেছেন যে, সূর্য যখন ডুবিয়া যায়, তখন পৃথিবীতে ছায়া ঘনাইয়া আসে এবং অন্ধকার হইয়া যায়। ঐ অন্ধকারে লোকের নিদ্রা আসে এবং কাজ-কারবার ত্যাগ করিয়া শুইয়া পড়ে। কিন্তু, জাতে পাকের আলো সব সময়ই আলো দান করিতেছেন। তাঁহার আলো দান বন্ধ হইলে বা পৃথিবী হইতে গায়েব হইয়া গেলে, ইহ-জগত কিছুতেই টিকিয়া থাকা সম্ভব হইত না। সৃষ্টি জগত সবই ধ্বংস হইয়া যাইত। জাতে পাক সব সময়ই বিদ্যমান, তাঁহার ভূত-ভবিষ্যৎ নাই। সর্বদা একই ভাবে আছেন ও চিরকাল থাকিবেন। তাই মাওলানা বলিতেছেন, সূর্যের ছায়া মানুষের অবশতা আনয়ন করিয়া নিদ্রায় নিমগ্ন করে। যেমন, রাজা-বাদশাহগণের কেচ্ছা-কাহিনী নিদ্রা আনয়ন করে। কিন্তু জাতে পাকের আলো কোনো সময়ই আলো দান হইতে বিরত থাকে না। যদি বিরত থাকিতেন, তবে ইহ-জগতের কিছুই বিদ্যমান থাকিত না। কেননা, নূরে ইলাহির প্রভাবে ইহ-জগতের সব কিছুই সৃষ্ট। যেমন, চন্দ্র সূর্য হইতে আলো প্রাপ্ত হইয়া আলোকিত হয়, তেমনি খোদার আলো পাইয়া সৃষ্ট জগতের সকলেই সৃষ্টি হইয়াছে। তাঁহার আলো না পাইলে কোন কিছুই সৃষ্টি হইতে পারিত না।

“খোদ গরিবী দর জাহাঁ চুঁ শামছে নিস্ত,
শামছে জানে বাকী ইস্ত কোরা আমছে নিস্ত।”

অর্থ: সূর্য পৃথিবীতে মুসাফিরের ন্যায় আসে এবং যায়। অর্থাৎ, প্রত্যহ সূর্য উদিত হয় এবং সন্ধ্যায় অস্ত যায়, সেই কারণে আজ আর কাল সৃষ্টি হয়। কিন্তু প্রকৃত সূর্য আল্লাহতায়ালা, তিনি কখনও অস্ত যান না। সর্বদা আছেন, সৃষ্টি জগতে সব সময় আলো দান করিতেছেন এবং সর্বদা অনন্তকাল পর্যন্ত থাকিবেন।

মসনবী শরীফ
মূল: মাওলানা জালালউদ্দিন রুমি (রহ:)
অনুবাদক: এ, বি, এম, আবদুল মান্নান
মুমতাজুল মোহদ্দেসীন, কলিকাতা আলিয়া মাদ্রাসা।

সূত্রঃ https://mishukifti.wordpress.com/

→ মসনবী শরীফ সবগুলো পর্ব

আরো পড়ুনঃ
Sufibad24.com | WhatsApp চ্যানেল

Sufibad24.com | Telegram Channel