[বাংলা এই ভাবানুবাদ বরিশাল থেকে প্রায় ৫০ বছর আগে প্রকাশিত। এই দুর্লভ সংস্করণটি সরবরাহ করেছেন সুহৃদ (ব্যাংকার) নাঈমুল আহসান সাহেব। সম্পাদক – কাজী সাইফুদ্দীন হোসেন]
মসনবী শরীফ পর্ব-৫
“আয়ে বছানাদর দাহ ইছ তিছনা বে গোফত,
জানে উ বা জানে ইছতিছ নাস্ত জোফত।”
অর্থ: হে মানুষ, অনেক সময়ে ‘ইনশায়াল্লাহ’ মুখে না বলিলেও অন্তরে ইনশায়াআল্লাহ থাকে, অর্থাৎ ‘ইনশায়াল্লাহ’র অর্থ ও ভাব অন্তরে নিহিত থাকে এবং আল্লাহর উপর ভরসা রাখে, তাহাতেই আল্লাহ সন্তুষ্ট থাকেন। কিন্তু বিজ্ঞ ডাক্তার ও হেকিমরা নিজেদের দক্ষতার উপর ভর করিয়া অহঙ্কারে পরিপূর্ণ হইয়া আল্লাহর নাম ছাড়িয়া দিয়াছে।
“হারচে করদান্দ আজ ইলাজ ও আজ দাওয়া,
গাস্ত রঞ্জে আফ জুঁ ও হাজত না রওয়া।”
অর্থ: যতই ঔষধ ও দাওয়াই তদবীর করিয়াছেন, ততই রোগ বাড়িয়া চলিয়াছে। উদ্দেশ্য বিফল হইয়াছে। মানুষের চেষ্টা আল্লাহতায়ালা ব্যর্থ করিয়া দিয়াছেন।
“শরবত ও দাওয়ায়ে ও আছবাবে উ,
আজ তবিবানে বুরাদ ইকছার আবরু।”
অর্থ: রোগের যত প্রকার ঔষধ ও হেকিমী দাওয়া করা হইল, সমস্ত কিছুতেই ডাক্তার ও হেকীমগণের ইজ্জত গেল, কাহারও সম্মান বাকী রহিল না। সকলেই লজ্জিত হইয়া ফিরিয়া গেল।
“আঁফানিজাক আজ মরজে চুঁমুয়ে শোধ,
চশমে শাহে আজ আশকে খুন ছুঁজুয়ে শোদ।”
অর্থ: উক্ত দাসী রোগে কৃশ হইয়া চুলের ন্যায় হইয়া গিয়াছে। বাদশাহর অশ্রু রক্তে পরিণত হইয়া নহর হইয়া গিয়াছে, অর্থাৎ, বাদশাহ দাসীর শোকে কাঁদিতে কাঁদিতে তাঁহার নয়নের অশ্রু রক্তে পরিণত হইয়া প্রবাহিত হইতেছে।
“চুঁ কাজা আইয়াদ তবিবে অবলাহ শওয়াদ,
আঁদাওয়া দর নাছে খোদ গোমরাহ শওয়াদ।”
অর্থ: যখন খোদার নির্দেশ হইল, তখন তবিবগণ সকলেই বোকা বলিয়া প্রমাণিত হইল। ঔষধ-পত্র সকলই ক্রিয়াশূন্য মনে হইল।
“আজ কাজা ছার কাংগবীন ছফরা ফজুদ,
রউগানে বাদামে খুশ কি মী নামুদ।
আজ হুলিয়া কবজে শোদ ইতলাকে রফত,
আব আতেশরা মদদ শোদ হামচু নাফাত।”
অর্থ: বিজ্ঞ হেকিম ও ডাক্তারগণের চিকিৎসায় কোনো ফল লাভ হইল না। সে বিষয় উদাহরণ দিয়া মাওলানা বলিতেছেন যে, খোদার হুকুমে মাথায় চিরুনী করা সত্ত্বেও চুল এলোমেলো ও হলুদ বর্ণ থাকিয়া যায়। সুবাসিত বাদাম তৈল লাগান সত্ত্বেও চুল শুষ্ক হওয়া বৃদ্ধি পায়। ডাক্তারদের সর্বশক্তি বিফল গেল, এখন তাহাদের হাতে কোনো শক্তি নাই। রোগীর অবস্থা – যেমন আগুনে নাফাত নামক তৈল প্রাপ্ত হইয়াছে। (নাফাত এক প্রকার তৈল – স্প্রীটের ন্যায় আগুন জ্বলে)
“ছুছতিয়ে দেল শোদ ফেজুঁ ও খাব কম,
ছুজাশে চশম ও দেল পুর দরদো গম।”
বাদশাহর অবস্থা বর্ণনা করিতে যাইয়া মওলানা বলিতেছেন যে, দাসীর অবস্থা দেখিয়া বাদশাহ নিরাশ হইয়া পড়িয়াছেন এবং আহার-নিদ্রা ত্যাগ করিয়াছেন, অন্তর ও চক্ষু জ্বালা-যন্ত্রণায় পরিপূর্ণ হইয়া গিয়াছে।
হেকীমগণের দাসীর চিকিৎসায় অপরাগতা প্রকাশ পাওয়ায় বাদশাহর অবশেষে আল্লাহর দরবারে প্রার্থনা করা ও স্বপ্নে এক অলির সাক্ষাৎ লাভ করা এবং নিজের বিপদ হইতে মুক্তি পাওয়া।
শাহ চু ইজ্জে আঁ তবিবান রা বদীদ,
পা বরহেনা জানেবে মাছজীদ দাওবীদ।”
অর্থ: বাদশাহ যখন হেকীমদিগকে চিকিৎসায় অপারগ দেখিলেন, তখন খালি পদে খোদার মসজিদের দিকে দৌড়াইয়া গেলেন।
“বকত দর মাছজিদে ছুয়ে মিহরাব শোদ,
ছিজদাহ গাহ আজ শকে শাহ পুর আবে শোদ।”
অর্থ: বাদশাহ মসজিদে যাইয়া মিহরাবের মধ্যে সেজদায়ে পতিত হইয়া এমনভাবে খোদার নিকট কাঁদিতে লাগিলেন যে, সেজদার জায়গা বাদশাহর অশ্রুজলে ভাসিয়া গেল।
“চুঁব খশে আমদ জে গরকাবে ফানা,
খোশ জবান ব কোশদ দর মদেহ ও ছানা।”
অর্থ: বাদশাহ কাঁদিতে কাঁদিতে বেহুশ হইয়া গিয়াছিলেন। যখন হুশ আসিল, তখন উঠিয়া আল্লাহর গুণ-গান ও প্রশংসা করিতে লাগিলেন।
“কাসে কমিন বখশিশাস্ত মুলকে জাহাঁ,
মানচে গুইয়াম চুঁ তুমি দানি নেহাঁ।”
অর্থ: বাদশাহ বলিতেছেন, হে খোদা! তুমি যে আমাকে দুনিয়ার বাদশাহী দান করিয়াছ, ইহা তোমার পক্ষে নগণ্য দান। আমি যাহা বলিতেছি, তুমি ইহার প্রকৃত রহস্য জানো।
“হালেমা ও ইঁ তবিবানে ছার বছার,
পেশে লুতফে আমে তু বাশদ হাদর।”
অর্থ: আমার এবং হেকিমগণের অবস্থা, অর্থাৎ, আমি এবং হেকিমগণ যে তোমার উপর ভরসা করি নাই, ইহা তোমার নিকট মহা পাপের কাজ বলিয়া প্রমাণিত হইয়াছে। আমাদের উভয়ের চেষ্টা তোমার সাধারণ দানের সম্মুখে ব্যর্থ হইযাছে। আমি শাস্তি ভোগ করার উপযুক্ত হইয়াছি। তুমি যদি দয়া করিয়া ক্ষমা করিয়া দাও, তবে ইহা তোমার পক্ষে কিছুই নহে। ক্ষমা করা তোমার পক্ষে অতি সহজ।
“আঁয়ে হামেশা হাজতে মারা পানাহা,
বারে দিগার মা গলতে করদেম রাহ।”
অর্থ: বাদশাহ আল্লাহর কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করিয়া ক্ষমা চাহিতেছেন; বলিতেছেন, হে খোদা, তুমি আমার সব সময়ের জন্য আশ্রয়স্থান। যদিও আমি বারংবার ভুল করিয়া পথভ্রষ্ট হইয়া থাকি, তথাপিও তোমার আশ্রয় ছাড়া আমার কোনো ভরসা নাই।
“লেকে গুফতি গারচে মী দানেম ছারাত,
জুদে হাম পয়দা কুনাশ বর জাহেরাত।”
অর্থ: বাদশাহ আল্লাহকে সম্বোধন করিয়া বলিতেছেন, হে খোদা, তুমিই তো বলিয়াছ যে আমি সবারই রহস্যভেদ জ্ঞাত আছি। তবে আমার নিজের অন্তরের ব্যথা প্রকাশ্যে মুখ দিয়া বর্ণনা করার আবশ্যক মনে করি না। কিন্তু, তুমি বান্দাদিগকে তোমার নিকট প্রকাশ করিয়া বলার জন্য আদেশ করিয়াছ, তাই আমি প্রকাশ করিলাম।
“চুঁ বর আওরদ আজ মিয়ানে জানো খোরোশ,
আন্দর আমদ বহরে বখশায়েশে বজোশ।”
অর্থ: যখন বাদশাহ কান্নাকাটি করিয়া চুপ হইয়া তন্দ্রায় নিমগ্ন হইলেন, তখন আল্লাহতায়ালা রহমতের জোশ আসিয়া বাদশাহকে ক্ষমা করার খোশ-খবরি দান করিলেন।
“দর মিয়ানে গেরিয়া খাবাশ দর রেবুদ,
দিদে দর খাবে উকে পীরে রো নামুদ।
গোফতে আয়শাহ মুশদাহ হাজতাত রওয়াস্ত,
গার গরিবি আইয়েদাত ফরদাজ মাস্ত।”
অর্থ: বাদশাহ যখন কান্নার মধ্যে নিদ্রায় স্বপ্ন দেখিতেছিলেন, তখন দেখিলেন যে একজন বৃদ্ধ পীর তাঁহার সম্মুখে হাজির হইলেন এবং বলিলেন, হে বাদশাহ! তোমার বাসনা পূর্ণ হইয়া গিয়াছে। যদি কোনো মুসাফির আগামীকাল আমার তরফ হইতে তোমার সম্মুখে আসে, তবে তাহাকে সত্য বিজ্ঞ হেকিম বলিয়া মনে করিও।
“চুঁকে উ আইয়াদ হাকীমে হাজে কাস্ত,
ছাদেকাশ দাঁ কো আমিন ও ছাদেকাস্ত।
দর ইলাজাশ ছেহরে মতল করা বা বিনি,
দর মেজাজশ কুদরাতে হকরা বা বিনি।”
অর্থ: কেননা, তিনি একজন সুনিপূণ বিজ্ঞ হেকিম আসিবেন। তাঁহাকে সত্য বলিয়া জানিও, তিনি একজন আমানাতদার ও সত্যবাদী। তাঁহার চিকিৎসার ব্যবস্থায় তুমি যাদুমন্ত্রের ন্যায় উপকার পাইবে। ঐ তবিবের মেজাজে ও কার্যে আল্লাহর কুদরাতের নমুনা দেখিতে পাইবে। তাঁহার চিকিৎসায় তোমার রোগী সুস্থ হইয়া উত্তম স্বাস্থ্য লাভ করিবে।
“খোফতাহ বুদ ইঁ খাবে দিদে আগাহ শোদ,
গাস্তাহ মামলুকে কানিজাক শাহেশোদ।”
অর্থ: বাদশাহ নিদ্রিত অবস্থায় এই স্বপ্ন দেখিয়া খুশি হইলেন। এতদিন পর্যন্ত দাসীর চিন্তায় নিমগ্ন ছিলেন, এখন চিন্তামুক্ত হইলেন।
“চুঁ রছিদ আঁ ওয়াদাহগাহ ও রোজে শোদ,
আফতাব আজ শরকে আখতার ছুজেশোদ।”
অর্থ: যখন ওয়াদা পূরণের দিন আসিয়া উপস্থিত হইল, সেইদিন ভোরে তিনি দেখিলেন, সূর্যের চাইতেও উজ্জ্বল চেহারাবিশিষ্ট এক ব্যক্তি উপস্থিত হইলেন।
মসনবী শরীফ
মূল: মাওলানা জালালউদ্দিন রুমি (রহ:)
অনুবাদক: এ, বি, এম, আবদুল মান্নান
মুমতাজুল মোহদ্দেসীন, কলিকাতা আলিয়া মাদ্রাসা।
সূত্রঃ https://mishukifti.wordpress.com/