মিলাদ কিয়াম সম্পর্কে দলিল ভিত্তিক আলোচনা পর্ব-৪

মিলাদ কিয়াম সম্পর্কে আলোচনা পর্ব-৪

পর্ব-৪

(১) হযরত আবু উমামা (রাঃ), হযরত আনাস (রাঃ) ও হযরত মাবিয়া (রাঃ) কর্তৃক বর্ণিত হাদিসগুলোতে বিশেষ ধরনের কিয়াম নিষেধ করা হয়েছে, মূল কিয়ামকে নিষেধ করা হয় নি।

যেমন: আজমীদের মতো কিয়াম,যাহা তাদের রাজা বাদশার সম্মানে মূর্তিবৎ নতজানু হয়ে দাঁড়িয়ে থাকার মতো,এ কিয়াম অবশ্যই নিষিদ্ধ করেছেন,মূল কিয়ামকে নিষিদ্ধ করেন নি। হুজুর সাঃ এ কথা বলেন নি যে, তোমরা কিয়াম করো না বরং বলেছেন আজমীদের মতো অর্থাৎ পারস্যবাসী অনারবীদের মতো কিয়াম করো না।

যেমন হাদিস শরীফে বলা হয়েছে; তোমরা গরুর মতো পানি পান করো না। এর অর্থ হলো পানি পান কর, তবে গরুর মতো নয়। অনুরূপ হাদীসের অর্থ হবে কিয়াম করো তবে আজমী পারস্যবাসী অনারবীদের মতো নয়। হযরত আনাস (রাঃ) বর্ণিত হাদিসে তাঁর ব্যক্তিগত অভিমত: রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামার ভাষ্য নয়। এই অপছন্দ ছিলো হুজুরের বিনয় মূলক, নিষেধমূলক নহে।

মিশকাত শরীফের ৪০৩ পৃ: ৫ নং হাশিয়ায় উক্ত হাদীসে বর্ণিত কিয়ামের ধরন সম্পর্কে মোল্লা আলী কারী (রহ:) মিরকাত গ্রন্থে বর্ণনা করেন:- “ক্বাওলুহু লিজালিকা আয় লিকিয়ামিহিম তাওয়াজ্জুয়ান লিরাব্বিহী মুখালিফাতান লি আদাতি মুতাকাব্বিরিন” অর্থাৎ, নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সাহাবাগণের ঐ ধরনের কিয়ামকেই অপছন্দ করতেন যে ধরনের বিনয়মূলক কিয়াম আল্লাহর জন্য করা হয় বা অহংকারী ব্যক্তিদের জন্য যে ধরনের বিনয়মূলক কিয়াম করা হয়, ঐ ধরনের কিয়াম তিঁনি নিঁজের জন্য অপছন্দ করতেন ও বিরোধিতা করতেন।

হযরত মাবিয়া (রাঃ)-এর বর্ণিত হাদিস হুজুরের বেলায় প্রযোজ্য নয় বরং অহংকারী ও দাম্ভিক ব্যক্তিদের জন্য প্রযোজ্য। রাসূলের এ নিষেধ ছিলো শর্ত সাপেক্ষে অর্থাৎ মূর্তির মতো কিয়াম নিষিদ্ধ, মূল কিয়াম নিষিদ্ধ নয়।

বায়হাকী শরীফ থেকে মিশকাত শরীফের ৪০৩ পৃঃ হযরত আবু হুরাইরা (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিঁনি বলেন, হযরত রাসূলে করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাদের সাথে মসজিদে নববীতে বসে হাদিস বর্ণনা করতেন। অতঃপর তিনি যখন দাঁড়াতেন আমরাও তাঁর সম্মানার্থে দাঁড়াতাম। এমনকি যতক্ষণ পর্যন্ত তিঁনি তাঁর কোনো বিবি ছাহেবার ঘরে প্রবেশ না করতেন ততক্ষণ পর্যন্ত আমরা দাঁড়িয়ে থাকতাম।

[বায়হাকী শুয়াবুল ঈমান থেকে মিশকাত শরীফের ৪০৩ পৃঃ কিয়ামের পক্ষে হাদিসগুলো বুখারী শরীফ ও মুসলিম শরীফে বর্ণিত হয়েছে।]

সুতরাং কিয়ামের পক্ষে-বিপক্ষে হাদিসগুলো একসাথে করে বিশ্লেষণ না করে ঢালাওভাবে কিয়াম নিষিদ্ধ বলার মধ্যে তো সততার প্রমাণ পাওয়া যায় না এবং এটা কোনো ঈমানদার আলেমের কাজ হওয়া উচিত নহে।

(২) “রদ্দুল মুহ্তার ও হুজ্জাতুল্লাহিল বালেগাহ্” নামক কিতাবে উল্লেখ আছে যে, ক্বিয়াম তিন প্রকার-

(ক) ক্বিয়ামে তাকাব্বুরীঃ যেমন, হাদিস শরীফে ইরশাদ হয়েছে: “তোমরা আজমীদের মত (মাথা নীচু করে নমস্কারের ছূরতে) দাঁড়াইওনা।” এরূপ ক্বিয়াম শরীয়তে সম্পূর্ণ হারাম ও নাজায়েয।

দলিল
১.আবু দাউদ, ৫২৩০
২.আহমদ শরীফ, হাদিস নং-২১৬৬৭
৩.মিশকাতুল মাসাবীহ,৩/১৩৩২,হাদিস নং-৪৭০০
৪.মিরকাতুল মাফাতীহ শরহে মিশকাতুল মাসাবীহ, ৪/১৬৭৭, হাদিস নং-২৪১৮, ৭/২৯৭৪ হাদীস নং-৪৭০০
৫.কানযুল উম্মাল , ৯/২২৪,হাদিস নং-২৫৭৫৯
৬.মুসনাদে বাযযার, ১৩/১৮৯। হাদিস নং-৬৬৪২
৭.তুহফাতুল আহয়াজী ,৮/২৫

(খ) ক্বিয়ামে হুব্বীঃ “হযরত ফাতেমা রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহা ; হুজুর পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এঁর হুজরা শরীফে আসলে, হুজুর পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম (মুহব্বতে) দাঁড়িয়ে কপাল মুবারকে চুম্বন করে বসতেন ও বসাতেন। একে ক্বিয়ামে হুব্বী বলে।”

(গ) ক্বিয়ামে তা’যীমীঃ “হযরত ফাতেমা রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহা ও হযরত সাহাবা-ই-কিরাম রাদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমগণ; হুজুর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর তা’যীমের জন্যে দাঁড়াতেন।”

মূলতঃ ক্বিয়ামে তাকাব্বুরী শরীয়তে হারাম ও নাজায়েয। আর ক্বিয়ামে হুববী ও তা’যীমী শরীয়তে জায়েয ও সুন্নত।

(৩) ইসলামী শরীয়তে কিয়ামকে আবার তিনটি ধারায় বিভক্ত করা হয়েছে:

(ক) ফরয কিয়াম: ইবাদতের উদ্দেশ্যে আল্লাহ পাকের সম্মানে বিনয় সহকারে আবশ্যিকভাবে দাঁড়ানোকে ফরয কিয়াম বলা হয়। যেমন: দৈনন্দিন পাঁচ ওয়াক্ত ফরয নামাযে প্রত্যেক সামর্থবান ব্যক্তিকে আল্লাহর সম্মানে দাঁড়িয়ে নামায আদায় করতে হয়।নামাযে এ কিয়াম ফরয।

রোগ ভোগের ওযর ব্যতিত এ কিয়াম তরক করা চলে না।পবিত্র কুরআনে এ দিকে ইঙ্গিত করে বলা হয়েছে- ‘ওয়াকু-মু লিল্লাহি ক্বা-নিতীন।’ অর্থাৎ তোমরা আল্লাহর উদ্দেশ্যে ও তাঁর সম্মানে বিনয় সহকারে দাঁড়িয়ে যাও।

(খ) সুন্নত কিয়াম: ইবাদতের কিছু কিছু ক্ষেত্রে কিয়াম করা সুন্নত সাব্যস্ত হয়েছে। যেমন-রাসুল সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এঁর রওযা মোবারক যিয়ারতে দাঁড়ানো সুন্নত।
[ফতোয়ায়ে আলমগীরি,১ম খন্ড, কিতাবুল হজ্ব]

অনুরুপভাবে,মু’মিন বান্দাদের কবর যিয়ারতের সময়,আবে যমযমের পানি পানের সময় কিংবা কোন ধর্মিয় ও সম্মানিত নেতার আগমনে দাঁড়ানো সুন্নত।
[বুখারী ও মুসলিম শরীফ,বাবুল কিয়াম]

(গ) মুবাহ কিয়াম: দুনিয়াবি প্রয়োজনে কিয়াম করা মুবাহ বা জায়েয।যেমন: দাঁড়িয়ে কাজ করা। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ বলেন:‘যখন তোমরা নামায থেকে অবসর হবে -তখন জমীনে রিযিকের তালাশে ছড়িয়ে পড়।’ আলোচ্য আয়াতে ছড়িয়ে পড়ার জন্য দাঁড়ানো পূর্বশর্ত। কারণ দাঁড়ানো ছাড়া ছড়িয়ে পড়া সম্ভব নয়। তাই দাঁড়ানোর নির্দেশটি হলো মুবাহ।

(৪) ক্বিয়াম আরবি শব্দ। এর অর্থ সোজা হয়ে দাঁড়ানো। আল্লাহ পাক কুরআন মজীদের বিভিন্ন আয়াতে ক্বিয়ামের বর্ননা দিয়ে বলেছেন:

(ক) আল্লাহ পাক ইরশাদ করেন: وَقُومُوا لِلَّهِ قَانِتِينَ

“ওয়াক্বূ-মূ লিল্লাহি কা-নিতীন” অর্থাৎ আল্লাহর আনুগত্য প্রকাশের জন্য দন্ডায়মান হও।
[সূরা বাক্বারা, আয়াত নং ২৩৮]

(খ) আল্লাহ পাক আরও ইরশাদ করেন:

يَذْكُرُونَ اللَّهَ قِيَامًا وَقُعُودًا وَعَلَىٰ جُنُوبِهِمْ

“ইয়াযকুরুল্লাহা কিয়ামান ওয়াক্বু‘ঊদান ওয়া আ’লা জুনুবিকুম” অর্থাৎ তোমরা দাঁড়িয়ে,বসে এবং করটের উপর ভর করে আল্লাহর জিকির কর।

[সূরা আলে ইমরান, আয়াত নং ১৯১]

(গ) আল্লাহ পাক আরও ইরশাদ করেন:

وَالَّذِينَ يَبِيتُونَ لِرَبِّهِمْ سُجَّدًا وَقِيَامًا

“ওয়াল্লাযীনা ইয়াবীতূনা লিরাব্বিহীম সুজ্জাদাঁও ওয়াকিয়ামা” অর্থাৎ এবং যারা রাত আতিবাহিত করে তাদের প্রতিপালকের উদ্দেশ্যে সিজদাবনত ও দন্ডায়মান অবস্থায়।
[সূরা ফুরক্বান, আয়াত নং ৬৪]

(ঘ) আল্লাহ পাক অন্যত্র ইরশাদ করেন:

يَاأَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا إِذَا قِيلَ لَكُمْ تَفَسَّحُوا فِي
الْمَجَالِسِ فَافْسَحُوا يَفْسَحِ اللَّهُ لَكُمْ ۖ وَإِذَا قِيلَ انْشُزُوافَانْشُزُوا يَرْفَعِ اللَّهُ الَّذِينَ
آمَنُوا مِنْكُمْ وَالَّذِينَ أُوتُوا الْعِلْمَ دَرَجَاتٍۚ

হে ইমানদারগণ! যখন তোমাদেরকে বলা হয়-“মজলিসের মধ্যে জায়গা প্রশস্ত করে দাও”, তখন তোমরা জায়গা (ছেড়ে দিয়ে) প্রশস্ত করে দেবে। আর যখন বলা হয়-“দাঁড়িয়ে যাও-তখন দাঁড়িয়ে যাবে”।
[সূরা মুজাদালাহ,আয়াত নং ১১]

উদ্ধৃতি: নাসিরুদ্দিন আলবানী কুরআনে বর্ণিত উপরোক্ত ‘কিয়াম’ দ্ধারা নামাজের কিয়ামকেই বুঝিয়েছেন। কিন্তু আল্লামা ইমাম জালালুদ্দীন সুয়ুতি তাফসীরে জালালাঈন শরীফে উক্ত আয়াতের ব্যাখ্যায় ‘মিনাল খাইরাত’ দ্বারা সর্ব প্রকার নেক কাজকে বুঝিয়েছেন এবং বলেছেন, কোন মজলিশ কিংবা যে কোন প্রকার নেক কাজের জন্য দাঁড়াতে বলা হলে দাঁড়ানো আবশ্যক।

এ জন্য মিলাদ মাহফিলে ‘যিকরে বেলাদত’ বা হুজুর সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর দুনিয়াতে আগমনের কথা শুনে সম্মানার্থে কিয়াম করা হয়। ফেকাহ ও ফতোয়া মোতাবেক এটি মোস্তাহাব। মোস্তাহাব হলেও একে খাটো করে দেখার কোন সুযোগ নেই। সাহাবায়ে কেরামও নবীজীর প্রতি এরূপ সম্মান প্রদর্শনের বিরল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলেন।

আবার নবী করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম ও বদর যুদ্ধে অংশ নেয়া সাহাবীদেরকেও বিশেষভাবে সম্মান দিতেন।একবার কতিপয় বদরী সাহাবী রাসুল সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর খেদমতে হাযির হয়ে সালাম দিলেন এবং বসার সুযোগ না পেয়ে হুজুরের সম্মুখভাগে এবং আশেপাশে দাঁড়িয়ে রইলেন। অন্যান্য সাহাবীরা বদরী সাহাবীদের সালামের জবাব দিলেন সত্য, কিন্তু তাঁদের বসার ব্যবস্থা করে দিতে পারলেননা।

হুজুরের আশেপাশে বসে থাকা অপরাপর সাহাবীরাও নিকটতম স্থান ত্যাগ করে দুরবর্তী স্থানে বসতে রাজী ছিলেন না। এ পরিস্থিতি হুজুরের জন্য অত্যন্ত পীড়াদায়ক মনে হলো। অত:পর নিকটে বসা সাহাবীদের নাম ধরে ধরে তিনি বদরী সাহাবীদের বসার জায়গা দেয়ার আহ্বান করলেন। সাহাবীরা রাসুল সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম-এর আহ্বানে সাড়া দিলেন কিন্তু নিকটতম স্থান ত্যাগ করার জন্য মনে কষ্ট পেলেন।

রাসুলে করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম তাদের মনোবেদনা টের পেলেন এবং বদরী সাহাবীদের প্রতি এরূপ সম্মান প্রদর্শনের জন্য কোরআনের উপরোক্ত আয়াত স্মরণ করিয়ে দিয়ে বললেন,–“তোমরা তোমাদের নবীর নির্দেশে বদরী সাহাবীদের সম্মানে জায়গা ছেড়ে দিয়েছো -আল্লাহ তোমাদের জন্য বেহেশতে এর চেয়েও প্রশস্ত জায়গা করে দিবেন।”

আল্লামা সাভী (রহ:) মন্তব্য করেন- ‘আয়াতখানা যদিও কতিপয় সাহাবীর শানে নাযিল হয়েছে, কিন্তু এটা দ্বারা সমস্ত উম্মতকেই শিক্ষা দেয়া হয়েছে। শানে নুযুল খাস হলেও হুকুম ছিল আ’ম বা ব্যাপক। সুতরাং ইলমের মজলিশ, যিকিরের মজলিশ, নামাযের জামাত, যুদ্ধক্ষেত্র ও অন্যান্য নেক কাজের সমস্ত মজলিশ অত্র আয়াতের অন্তর্ভুক্ত। যে কোন উত্তম মজলিশে দাঁড়াতে বললে দাঁড়িয়ে যাবে।-এটাই কোরআনের নির্দেশ। কাজেই আয়াত দ্বারা প্রমানিত হয়, হুজুরের মিলাদ একটি উত্তম অনুষ্ঠান। উক্ত অনুষ্ঠানে হুজুরের প্রতি তা’যীম ও সম্মানার্থে দাঁড়িয়ে যাওয়া’ই কোরআনের দাবী।

– কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন: সুন্নীয়তের নয়ন মনি অধ্যক্ষ এম এ জলিল (রহঃ), মিলাদ ও কিয়ামের বিধান।

আরো পড়ুনঃ ↓

» মিলাদ কিয়াম সম্পর্কে দলিল ভিত্তিক আলোচনা পর্ব-১

» মিলাদ কিয়াম সম্পর্কে দলিল ভিত্তিক আলোচনা পর্ব-২

» মিলাদ কিয়াম সম্পর্কে দলিল ভিত্তিক আলোচনা পর্ব-৩

» মিলাদ কিয়াম সম্পর্কে দলিল ভিত্তিক আলোচনা পর্ব-৪

» মিলাদ কিয়াম সম্পর্কে দলিল ভিত্তিক আলোচনা পর্ব-৫

আরো পড়ুনঃ
Sufibad24.com | WhatsApp চ্যানেল

Sufibad24.com | Telegram Channel