বর্তমান বিশ্বে সম্যকগুরুর নেতৃত্ববিহীন আদর্শহীন সমাজ ব্যবস্থা’র পরিপ্রেক্ষিতে মাওলা সুফি সদর উদ্দিন আহমদ চিশতী’র কয়েকটি অমিয় নির্ঝর বাণী চিরন্তনী তুলে ধরা হইলঃ
১.
হে মানুষ জানিয়া রাখঃ মানুষ মরিয়া পঁচিয়া গেলেই তাহার মৌলিক অস্তিত্ব শেষ হইয়া যায় না। উহা সুক্ষ্মভাবে সম্পূর্ণরূপে অস্তিত্বশীল হইয়া থাকে। পতন ঘটে স্থূলদেহের, মন-মস্তিষ্কের উৎকর্ষের পতন ঘটে না। উহাকে মানব বীজরূপে আল্লাহ সংরক্ষিত করিয়াই রাখেন।
২.
গাছের মধ্যে যেমন আগুন লুকাইয়া রাখা হইয়াছে, না জ্বালাইলে উহা চোখে দেখা যায় না, সেইরূপ মানুষের মধ্য হইতে পুনরায় মানুষ তৈরি করিবার এমন ব্যবস্থা রহিয়াছে যাহা সাধারণ মানুষের চোখে পড়ে না। আগুন সুক্ষ্মভাবে গাছের মধ্যে নিহিত রহিয়াছে। মৃতগাছের মধ্য হইতে উহা জ্বালাইলেই জ্বলিয়া উঠে। তেমনই মানুষের মধ্যকার সুক্ষ্ম শুক্রকীটের মাধ্যমে পুনরায় সেই মানুষটকেই তৈরি করিয়া লইবার ব্যবস্থা আল্লাহর প্রতিনিধিস্থানীয় লোকদের ক্ষমতার অধীন করিয়া রাখা হইয়াছে। (দ্র. সূরা ইয়া-সিনঃ৮০)
৩.
সৎ কর্মের অভ্যাস মজ্জাগত করিয়া লইলে মানুষের বীজের মধ্যে সেই স্বভাব কার্যকরী হইতে থাকে, কারণ যেমন মানুষ তেমনই তাহার শুক্রীট। সৎ অভ্যাস এবং সৎ স্বভাবের দ্বারা ইহার দ্রুত পরিবর্তন ঘটে যাহা বৃক্ষ বা অন্য জীবের মধ্যে তেমন দ্রুত ঘটে না।
বৃক্ষ-বীজের মধ্যে যেমন পূর্ণ বৃক্ষ বিরাজ করে মনুষ্য-বীজের মধ্যেও পূর্ণ একটি সমগুণের মানুষ বিরাজ করে। কিন্তু এই দুইয়ের মধ্যে অনেক প্রভেদ। ইহা আল্লাহর একটি বিশেষ দয়া বা রহমত যে, মানুষকে তিনি ভালমন্দ নির্বাচনের অধিকার এবং ইহার উপর প্রবল ইচ্ছাশক্তি দান করিয়াছেন। এই ইচ্ছাশক্তির সাহায্যে সে তাহার স্বভাবের মধ্যে মৌলিক পরিবর্তন আনয়ন করিতে পারে। মানুষের গড়া স্বভাবকে আল্লাহর গড়া স্বভাবে পরিণত করিতে পারে।
মানুষের মধ্যে বীজরূপে নিহিত তাহার জন্মগত গুণাবলী ভুলাইয়া দিয়া আল্লাহ তাহাকে নিষ্পাপ ফেরেস্তারূপে জাহান্নামের পরীক্ষা ক্ষেত্রে সংশোধনের জন্য পাঠাইয়া থাকেন। সদ্যজাত শিশুর মধ্যে পিতা-মাতার স্বভাব-চরিত্র বীজরূপে রহিয়াছে কিন্তু পূর্ববর্তী সকল অন্যায় ভুলাইয়া দিয়া সংসার ক্ষেত্রে তাহাকে ফেরেস্তা বানাইয়া পাঠান হইয়া থাকে। আল্লাহ কর্তৃক প্রবর্তিত ন্যায়-নীতির শাসনের মধ্যে সে বড় হইতে থাকিলে সেই পরিবেশে পাপ তাহাকে স্পর্শ করিবে না এবং অন্তরে নিহিত পিতা-মাতা হইতে প্রাপ্ত পাপের স্বভাব জাগ্রত হইবার সম্ভাবনা থাকিবে না। বৃক্ষের ব্যাপারে এইরূপ নহে।
বৃক্ষ তাহার বংশের স্বভাব লইয়া বড় হইয়া উঠিবে। মিষ্টি ফল টক এবং টক ফল মিষ্টি হইয়া উঠিবে না। স্থান পরিবর্তনের দ্বারা স্বল্প পরিবর্তন হইতে পারিবে। কিন্তু মানুষ তাহার গুণাবলীকে আল্লাহর গুণাবলীর অনুকরণ দ্বারা সম্পূর্ণ সুন্দর গড়িয়া লইতে পারে। ইহার উপযুক্ত ক্ষেত্র তৈরী করার জন্য রাষ্ট্র ও সমাজে ‘উলিল আমর’* এর শাসন একান্ত প্রয়োজন। এইজন্য আমাদের সকল কলুষের বিরুদ্ধে জেহাদ করা এবং দেশকে আল্লাহর শাসনাধীন করিয়া গড়িয়া তোলা মানব জাতির সর্ব প্রধান কর্তব্য।”
– সদর উদ্দিন আহমদ চিশতী ~ কোরান দর্শন।