মুজাদ্দেদ আলফেছানী (রাঃ) ছাহেবের কতিপয় পীর বা মোর্শেদ থাকা সত্ত্বেও বলা হয় যে, তাহার পীর স্বয়ং খোদাতায়ালা-কেন?
হযরত মুজাদ্দেদ আলফেছানী (রাঃ) ছাহেব পূর্বেই চিশতিয়া, কাদেরিয়া, কুবরাবিয়া, সোহ্ওয়ারদীয়া তরিকার নেছবত ও কামালিয়াত (পূর্ণতা) হাছিল করিয়া খেলাফত প্রাপ্ত হইয়াছিলেন। সর্বশেষে নকশবন্দীয়া তরিকার অন্যতম শ্রেষ্ঠ বুজুর্গ হযরত খাজা বাকীবিল্লাহ (রঃ) ছাহেবের সান্নিধ্যে ও খেদমতে থাকিয়া এই তরিকারও নেছবত ও খেলাফত প্রাপ্ত হন।
জাগতিক দৃষ্টিকোণ থেকে চিন্তা করিলে দেখা যায় যে, হযরত মুজাদ্দেদ আলফেছানী (রাঃ) ছাহেবের কতিপয় পীর বা মোর্শেদ ছিলেন। যেমন হযরত বাকীবিল্লাহ (রঃ) ছাহেব তাহার পীর ছিলেন, তেমনি তদীয় পিতা হযরত আব্দুল আহাদ (রঃ)-যাহার নিকট থেকে তিনি চিশতিয়া ও কাদেরিয়া তরিকার ছবক ও তালিম নেন, তিনিও তাহার পীর বা মোর্শেদ ছিলেন।
আবার হযরত মাওলানা ইয়াকুব (রঃ) ছাহেব ও হযরত শাহ সেকান্দার (রঃ) ছাহেবও তাহার মোর্শেদ বা পীর ছিলেন। কারণ তাহাদের নিকট থেকে তিনি “কুবরাবিয়া’ ও কাদেরিয়া তরিকার খেলাফত প্রাপ্ত হন। তথাপিও বলা হয় যে, আসমানের নীচে দুইজন সাধকের পীর স্বয়ং খোদাতায়ালা।
প্রথমতঃ রাসূলে করীম (সাঃ) এর পীর খোদাতায়ালা এবং দ্বিতীয়তঃ হযরত মুজাদ্দেদ আলফেছানী (রাঃ) ছাহেবের পীর স্বয়ং খোদাতায়ালা। রাসূলে করীম (সাঃ) এর পীর স্বয়ং খোদাতায়ালা, এই ব্যাপারে কাহারোও কোন দ্বিমত নাই। কিন্তু দুনিয়াতে মুজাদ্দেদ আলফেছানী (রাঃ) ছাহেবের একাধিক পীর বা মোর্শেদ থাকা সত্ত্বেও কেন বলা হয় যে, তাঁহার পীর খোদাতায়ালা নিজে?
মুলতঃ মুজাদ্দেদ আলফেছানী (রাঃ) ছাহেবের পূর্বে হাজার বছরের মধ্যে আগত ওলী আল্লাহ সকল খোদাপ্রাপ্তির রাস্তায় কঠোর তপস্যার মাধ্যমে যে পরিমান মারেফাত হাছিল করিয়াছিলেন-তাহা ছিল মারেফাতের বাহির আবরণ মাত্র। হাজার বছরের মধ্যে সাহাবাদের পরে দুই এক জন সাধক মাত্র বেলায়েতে কোবরার মারেফাত হাছিল করিয়াছিলেন। তাহা ছাড়া সকলেই তাঁহাদের মারেফাত শেষ করিয়াছেন বেলায়েতে ছোগরায়-যেখানে খুব সামান্য মারেফাতই মিলে।
কাজেই কাদেরিয়া, চিশতিয়া, কুবরাবিয়া, নকশবন্দীয়া-তথা প্রচলিত সমুদয় তরিকার নেছবত ও কামালিয়াত মুজাদ্দেদ (রাঃ) ছাহেব সিদ্ধ করেন ঠিকই; কিন্তু তাহাতে তিনি যে পূর্ণাংগ ও বিশুদ্ধ মারেফাত লাভ করেন-তাহা নয়। বরং সমস্ত তরিকার নেছবত হাছিল হওয়ার পরে মহান খোদাতায়ালা হযরত মুজাদ্দেদ আলফেছানী (রাঃ) ছাহেবকে পূর্ণাংগ মারেফাত রাজ্য ঘোরানের দায়িত্ব নিজেই নেন এবং ধীরে ধীরে মারেফাত কারখানার সমুদয় দফতর ঘুরাইয়া ঘুরাইয়া দেখান এবং সর্বশেষে নিছক জাতের সান্নিধ্য প্রদান করেন-যাহা চার খলিফার পরে হাজার বছরের ব্যবধান অন্তে হযরত শায়খ আহমদ সেরহিন্দকে দেওয়া হয়। তাই বলা হয়ঃ হযরত মুজাদ্দেদ আলফেছানী (রাঃ) ছাহেবের পীর স্বয়ং খোদাতায়ালা।
তাই দেখা যায়, মারেফাত কারখানার ব্যাপক ও বিস্তৃতি জ্ঞান লাভের পরে তিনি যখন হযরত বাকীবিল্লাহ (রঃ) ছাহেবের সাথে দেখা করিতে দিল্লীতে আসেন, তখন হযরত বাকীবিল্লাহ (রাঃ) ছাহেব তদীয় মুরীদ, মারেফাত রাজ্যের বাদশাহ হযরত মুজাদ্দেদ আলফেছানী (রাঃ) ছাহেবের সাথে এক অদ্ভূত আচরণ করেন। মুরীদের প্রতি এমন আদব প্রদর্শন করেন, মনে হয় তিনিই যেন হযরত মুজাদ্দেদ আলফেছানী (রাঃ) ছাহেবের মুরীদ।
তিনি মাঝে মাঝে হযরত মুজাদ্দেদ আলফেছানী (রাঃ) ছাহেবকে মুয়াল্লেমের (মোর্শেদের) মত বসাইয়া নিজে সমুদয় খলিফা ও মুরীদসহ ফয়েজ লাভের আশায় তাহার হালকায় বা মজলিসে বসিতেন। তিনি পীর ও মোর্শেদ হওয়া সত্ত্বেও মুরীদ হযরত মুজাদ্দেদ আলফেছানী (রাঃ) ছাহেবের প্রতি এতই আদব দেখাইতেন যে, তাহার নিকট জোড় হাতে দাঁড়াইয়া থাকিতেন এবং তাহার নিকট হইতে ফিরিয়া আসিবার সময় এমনভাবে আসিতেন যেন মুজাদ্দেদ আলফেছানী (রাঃ) ছাহেবের প্রতি পৃষ্ঠ প্রদর্শন করা না হয়।
ইহা দৃষ্টে অন্যান্য মুরীদেরা বিরক্ত হইয়া তাঁহাদের পীর হযরত বাকীবিল্লাহ (রঃ) ছাহেবের নিকট কারণ জানিতে চাহিলে তিনি বলিলেন, “যদি তোমরা স্বীয় ঈমানের নিরাপত্তা কামনা কর, তাহা হইলে তাঁহার প্রতি আদব প্রদর্শনের জন্য বিশেষ খেয়াল রাখ। কেননা তিনি রূহানী সূর্য স্বরূপ, তাঁহার নূরের আলোকে আমাদের ন্যায় হাজার হাজার তারকা নিস্প্রভ।”
অন্যদিকে হযরত মুজাদ্দেদ আলফেছানী (রাঃ) ছাহেব তাঁহার প্রতি তদীয় পীর ও মোর্শেদের আদব প্রদর্শনের এই আশ্চর্য অবস্থা দেখিয়া ভীষণ লজ্জা পাইতেন এবং তদীয় পীরকে অত্যন্ত আদব ও বিনয়ের সাথে বলিতেন, “হুজুর, এই দীন হীন গোলামের প্রতি আপনার এই রূপ আদব ও শিষ্টাচার প্রদর্শনের জন্য আমার খুবই লজ্জা ও অনুশোচনা হয়।”
ইহার উত্তরে হযরত বাকীবিল্লাহ (রঃ) ছাহেব বলিতেন, “আমি যাহা কিছু করিতেছি তাহা আল্লাহতায়ালার নির্দেশ ক্রমেই করিতেছি। আমি গায়েব (অদৃশ্য) হইতে এই রূপ করিবার জন্য আদিষ্ট হইতেছি।”
হযরত মুজাদ্দেদ আলফেছানী (রাঃ) ছাহেব যে কত উচুস্তরের ওলী তাহা উপরোক্ত আলোচনা হইতে সহজেই বোধগম্য হয়।
খোদাপ্রাপ্তি জ্ঞানের আলোকে শাহ্সূফী হযরত ফরিদপুরী (কুঃছেঃআঃ) ছাহেবের নসিহত-৮ এর “মুজাদ্দেদ আলফেছানী (রাঃ) ও খাজা বাকীবিল্লাহ (রঃ)” কিতাব পৃষ্ঠা: ২৩, ২৪ ও ২৫ হতে তুলে ধরা হয়েছে।
→ নসিহত: মুজাদ্দেদ আলফেছানী (রাঃ) ও খাজা বাকীবিল্লাহ (রঃ) এর সব গুলো অধ্যায়
আরো পড়ুন:
→ পীরের প্রতি মুরিদের আদব সর্ম্পকে মোজাদ্দেদ আলফেছানী রা: এর উপদেশ