মুরিদের নাফসকে সংশোধন করার জন্য পীরের অস্ত্র।
নাফসকে সংশোধন করিবার জন্য পীরে কামেলের কাছে চারিটি অস্ত্র আছে। ইহাদের মধ্যে প্রথম অস্ত্র “তাওয়াজ্জুয়ে এনেকাছী”, দ্বিতীয় অস্ত্র তাওয়াজ্জু-এ-এলকায়ী, তৃতীয় অস্ত্র “তাওয়াজ্জুয়ে এসলাহী” এবং চতুর্থ অস্ত্র “তাওয়াজ্জুয়ে এত্তেহাদী”। এই “তাওয়াজ্জুয়ে-এত্তেহাদীর” দ্বারা পীরে কামেল তদীয় মুরীদের কালব বা দেলকে সম্পূর্ণভাবে আল্লাহর দিকে ঘুরাইয়া আল্লাহ্তায়ালার গুণে গুণান্বিত করাইয়া দিতে পারেন; আল্লাহর চরিত্রে চরিত্র গঠন করাইয়া দিতে পারেন।
তোমরা জান, এক রাত্রিতে গাউসুল আজম হযরত আব্দুল কাদের জিলানী (রাঃ) ছাহেবের গৃহে এক চোর চুরি করিবার জন্য গিয়াছিল। কিন্তু গাউসুল আজম (রাঃ) ছাহেবের গৃহে প্রবেশ করিয়াই সেই চোর তাহার দৃষ্টি হারাইয়া ফেলে ও অন্ধ হইয়া যায়। সে আর চোখে দেখিতে পাইল না। তাই সে আর বাহিরে বাহির হইবার পথ খুঁজিয়া পাইল না। এমতাবস্থায় সেই চোর এক কোনে বসিয়া ভয়ে বিহবল হইয়া কাঁদিতে লাগিল ও আল্লাহতায়ালার জেকেরে নিমগ্ন হইল। সারা রাত ধরিয়া সেই চোর আল্লাহর নিকট ক্রন্দন করিতে লাগিল। নিশীর শেষভাগে আল্লাহপাক গাউসুল আজম (রাঃ) ছাহেবকে জানাইলেন, “হে গাউসুল আজম! আজ রাত্রিতে এই বাগদাদ শহরে যে ব্যক্তি ঘুমায় নাই ও সারা রাত্রি ধরিয়া আল্লাহ্তায়ালার জেকেরে কাটাইয়াছে; তাহাকে তাওয়াজ্জুহ দ্বারা আপনি ওলীর দরজায় পৌঁছাইয়া দিন।”
হযরত গাউসুল আজম (রাঃ) ছাহেব তদীয় অন্তর্দৃষ্টি দ্বারা দেখিলেন, সমগ্র বাগদাদ শহরে সকল ব্যক্তিই ঘুমন্ত ও আল্লাহর জেকের হইতে গাফিল। একমাত্র ব্যতিক্রম ঐ আগন্তক। তখন হযরত গাউসুল আজম (রাঃ) ছাহেব এক খাদেমকে বলিলেন, “আমার ঘরে একটা চোর চুরি করার জন্য ঢুকিয়া অন্ধ হইয়া গিয়াছে। সেই চোর এখন আল্লাহর জেকেরে মত্ত। তাহাকে তুমি ধরিয়া নিয়া আস।” সেই ব্যক্তিকে যখন হযরত গাউসুল আজমের নিকট আনা হইল; সে ক্ষমা চাইয়া বলিল, আমি ভুল করিয়াছি, আমি না বুঝিয়া আপনার গৃহে চুরি করিতে আসিয়াছিলাম। আপনি আমাকে ক্ষমা করুন। আমি জীবনে আর চুরি করিব না।
হযরত গাউসুল আজম (রাঃ) ছাহেব বলিলেন, “আপনি অজু করিয়া আসেন।” তিনি অজু করিয়া আসিলে হযরত গাউসুল আজম (রাঃ) ছাহেব তাওয়াজ্জুহ এত্তেহাদী দ্বারা তাহার দেলকে জিন্দা করিয়া আল্লাহ্পাকের দিকে ঘুরাইয়া দিলেন। সেই দেল আল্লাহ্পাকের প্রেমে পাগল হইল।
তাই একজন আশেক কবি গাহিয়াছেনঃ-
“যাহার কৃপায় চোর সাধু হয়
তুমিতো মহাজ্ঞানী,
হস্তে দুরাচার, পাইল নিস্তার
ব’লেগো সত্য বাণী,
গাউসুল আজম,
পীরে মাজম মহীউদ্দিন জিলানী।”
ওলী-আল্লাহ সকলের রূহানী তাওয়াজ্জুহ তাহা হইলে কত শক্তিশালী যে, গাউসুল আজম জিলানী (রাঃ) ছাহেব তদ্বারা এক মুহূর্তে একজন মাটির মানুষকে আল্লাহ্পাকের সন্ধান লাভ করাইয়া দিলেন। ওলী-আল্লাহগণ একটা মুহূর্তে শুধু একজন ব্যক্তিকে নন, দুনিয়ার তামাম মানুষকে আল্লাহর দিকে ঘুরাইয়া দিবার ক্ষমতা রাখেন। এই রকম শক্তিশালী ওলী-আল্লাহ ছিলেন খাজাবাবা হযরত এনায়েতপুরী (কুঃ) ছাহেব, যিনির পাক তাওয়াজ্জুহতে এখনও লক্ষ লক্ষ মানুষের মুর্দা দেল আল্লাহর দিকে ঘুরিতেছে, আল্লাহ্পাকের জেকেরে মাতোয়ারা হইতেছে, এই দরবারে আসিয়া কষ্ট করিয়া আল্লাহ্পাকের জেকেরে মত্ত হইয়া আল্লাহতায়ালার তাজাল্লীতে দেল রওশন করিতেছে।
এই ভাবে ওলী-আল্লাহগণ তাওয়াজ্জুয়ে এত্তেহাদী দ্বারা কালব বা দেলকে ঘুরাইয়া রাসূলে করীম (সাঃ) এর পাক দেলের সহিত মুরীদের দেলের যোগ সূত্র স্থাপন করিয়া দেন, সেই যোগসূত্র বলে নবী করীম (সাঃ) এর হুজুরী হাসেল হয় এবং পীরে কামেলের যোগাযোগে নবী করীম (সাঃ) এর পাক দেলের সহিত মুরীদের দেল মিশিয়া যায় বা ফানা হয়। এই মাকামকে ফানা-ফির-রাসূলের মাকাম বলা হয়। এই মাকাম যখন হাসিল হয়, তখন ছালেক রাসূলে করীম (সাঃ) এর পাক দেলের সহিত সম্পূর্ণ মিশিয়া যায় এবং তাঁহার পূর্ণ মহব্বতের অধিকারী হন।
পীরে কামেল মুরীদের কালব বা দেলকে তদীয় পাক তাওয়াজ্জুহ দ্বারা ঘুরাইয়া রাসূলে করীম (সাঃ) এর পাক দেলের সহিত যোগসূত্র স্থাপন করিয়া দিবার পর আসিবে বিশ্ব আত্মার সান্নিধ্য। বিশ্ব আত্মার সান্নিধ্য মানে আল্লাহতায়ালার জাতপাকের সমুদ্রে নিমজ্জিত হওয়া। ইহা কঠিন রেয়াযতের মাধ্যমে আল্লাহতায়ালার রেজামন্দি হাসিলের ব্যাপার। কঠিন খেদমত ছাড়া এই দরজা কেহই লাভ করিতে পারে নাই, পারিবেও না।
তোমরা হয়তো শুনিয়া থাকিবে, হযরত শায়খ ফরিদ (রঃ) ছাহেব ৩৬ বৎসর অজ্ঞাত সাধনার দ্বারা বহু চেষ্টা করিয়াও আল্লাহতায়ালার রেজামন্দি হাসিল করিতে পারেন নাই। শেখ ফরিদ (রঃ) ছাহেব ১২ বছর না খাইয়া একটা কাঠের রুটি বানাইয়া নাফসকে ভাঁড়াইলেন, নিজের চক্ষু কাককে খাওয়াইলেন, পা উপরের দিকে বাঁধিয়া মাথা নীচের দিকে ঝুলাইয়া একটি কুয়ার ভিতরে ১২ বছর আল্লাহর জেকেরে রত রহিলেন, কত শ্মশানে-মশানে ঘুরিলেন, তবুও তাঁহার মাকছুদ পুরা হইল না, আল্লাহ্তায়ালার নিকট পৌঁছাইতে পারিলেন না।
তখন নিরাশ হইয়া তিনি হযরত শাহ্ কুতুবউদ্দিন (রঃ) ছাহেবের কাছে মুরীদ হন এবং ১৪ বছর কঠিন খেদমতের পরে তিনি আপন পীরের পাক তাওয়াজ্জুহ দ্বারা এই অপূর্ব নেয়ামতের অধিকারী হন। তখন তিনি পীরের তাওয়াজ্জুহ দ্বারা নাফসে আম্মারার সহিত জিহাদে জয়ী হন এবং নাফসে লাওমাকে অতিক্রম করিয়া মুৎমাইন্নার পর্যায়ে উপনীত হন এবং আল্লাহতায়ালার সন্তুষ্টি অর্জনে সক্ষম হন।
তথ্যসূত্রঃ [শাহসূফী বিশ্বওলি ফরিদপুরী (কুঃছেঃআঃ) ছাহেবের নসিহত-সকল খন্ড একত্রে, নসিহত নং ২৩, পৃষ্টা নং ২২৫-২২৬]