কন্টকময় অস্তিত্ববিহীন মায়া:
আল্লাহর অলী, মুনি, ঋষি, সন্ন্যাসীরা একটি বিশেষ বিষয়ের উপর চমৎকার ব্যাখ্যা করেছেন। আর সেই বিষয়টা হল, আমরা ঘুমের মাঝে অনেক রকম স্বপ্ন দেখি। স্বপ্নের বিষয়টি অনেক রকম। তবে সুখ, দুঃখ এবং ভয় এই তিনটি বিষয়েই স্বপ্নটি সীমাবদ্ধ থাকে। ঘুম হতে উঠে কেউ স্বপ্ন দেখার বিষয়টি মনে রাখতে পারে, আবার কেউ পারে না। আবার কেউ কিছুটা মনে রাখতে পারে। কয়েক বছরের পুরনো স্বপ্নের স্মৃতি মুছে যায়। এক কথায় মনে থাকে না। আর মনে থাকার কথাও নয়। ছোট বেলায় মায়ের স্তনের দুধ পান করার কথা কারোর মনে থাকার কথা নয়। যদিও বিষয়টি বাস্তব। কিন্তু ভুলে যাই। শত চেষ্টা করেও আর মনে করতে পারি না।
তাই আল্লাহ্র অলীরা বলে থাকেন যে, ঘুমে স্বপ্ন দেখে যেমন কিছুদিন পর সবকিছু ভুলে যাই, সেরকম একটা মানুষ আশিটি বছর বেঁচে থেকে বাস্তব জীবনের অনেক অভিজ্ঞতার বোঝা বহন করে চলছে। কিন্তু মৃত্যু-ঘটনা (কোরান মৃত্যুকে ধ্বংস না বলে ঘটনা বলেছে) আশিটি বছরের বিরাট অভিজ্ঞতার স্মৃতি আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দেয় এবং ফেরেস্তারূপী শিশুতে পরিণত করে। সূরা মোদাস্সেরের একত্রিশ নম্বর আয়াতটি এরকম ইঙ্গিতই দিচ্ছে বলে আমার কাছে মনে হয়। তা যা হোক, স্বপ্ন দেখার মত পৃথিবীতে আশি বছরের সমস্ত অভিজ্ঞতা মৃত্যু-ঘটনা এক নিমেষে ভুলিয়ে দেয়।
তাহলে আশি বছরের বিরাট অভিজ্ঞতার জীবনটি এক রাতে ঘুমে দেখা স্বপ্নের মত হারিয়ে যায়। এত বড় উলঙ্গ সত্যটি আমরা সবাই কমবেশী বুঝতে পারি। তবু অস্তিত্ববিহীন মায়া মনে বাসা বেঁধে জঘন্য স্বার্থপর, লোভী, হিংসুক, প্রতিযোগী, হিসাবী, খুনি, অপরাধী বানিয়ে ফেলে। অস্তিত্ববিহীন মায়া আপন পরিচয় জানার ইচ্ছাটির উপর শক্ত দেয়াল দাঁড় করিয়ে দেয়। অস্তিত্ববিহীন মায়া শিখিয়ে দেয় জন্ম দেওয়া সন্তানদের জন্য সবকিছু করে যেতে। সন্তানদের মাঝে বেঁচে থাকার অমরতার বাণী শোনায়। অথচ কোরান বার বার বলছে কাল কেয়ামতে কেউ কাউকে চিনবে না। কেউ কারোর পাপ-পুণ্যের বোঝা বহন করবে না। যার যার কর্মফল তারই হবে।
একজনের কর্মফল আর একজন ভোগ করবে না। এত কিছু বুঝেও আমরা দুনিয়াতে বাস করে বুঝতে পারি না অস্তিত্ববিহীন মায়ার নেশা কত ভয়ঙ্কর। অত্যাধুনিক মাদক নেশা হিরোইনের সঙ্গে এর কিছুটা তুলনা দেওয়া যায়। কারণ হিরোইন নামক মাদক নেশাটি বিবেকের মৃত্যু ঘটিয়ে জানোয়ারে পরিণত করে একটা মানুষকে। কুরআন বলছে, কখনো কখনো মায়ার নেশা পশুর চেয়েও খারাপ করে দেয় (আস্ফালুস্ সাফেলিন)। এই মায়াটির বাস্তবে কোন অস্তিত্ব নাই। যা কিছুরই অস্তিত্ব নেই তা আল্লাহ্ হতে সম্পূর্ণ আলাদা।
কারণ “লা মওজুদা ইললাললা” “আল্লাহ্ ছাড়া কোন অস্তিত্ব নেই” বলা হয়ে থাকে। তাই এই মায়াটিকে বলা হয় ইলা- কর্তা, নেতা, প্রভু, অধিকারী। এই মায়া নামক ইলার পূজা করতে কুরআন বারণ করেছে। এবং মায়া নামক ইলার পূজা করাটাই শেরেক বলা হয়েছে। কুরআনের সূরা জাসিয়ার তেইশ নম্বর আয়াতে বলছে, “আফারাইতা মানিত্তাখাজা ইলাহাহু হাওয়াহু” তথা “তুমি কি দেখো না যে ব্যক্তি গ্রহণ করেছে তার প্রবৃত্তিকে (ইচ্ছা) উপাস্যরূপে।” সূতায় তৈরী জালে বড় বড় বনের পশুকে কাবু করে যেমন ধরা হয়, তেমনি অস্তিত্ববিহীন মায়ার জাল দিয়ে মানুষগুলোকে বিবেকহীন করে তোলে। আর বিবেকহীন মানুষ পশু এবং অনেক সময় পশুর চেয়েও খারাপ হয়।
অথচ দুনিয়ার আশিটি বছর বেঁচে থাকার অভিজ্ঞতাটি মৃত্যুর পর হয় একটা লম্বা স্বপ্ন। অথচ এই স্বপ্নে কত আস্ফালন, কত লাফালাফি, কত প্রতিযোগিতা, কত পেত্নীর নাচানাচি, কত জ্ঞানী, দার্শনিক, বিজ্ঞানী, সবজান্তা, মান-অপমান, সম্মান ফুটো হবার মত কত আজব আজব শখ আবিষ্কার করি আর নিজেকে হামসে হাম মনে করে গর্ব করি। আল্লাহ্ যে মহাজ্ঞানী এই সামান্য একটি অস্তিত্ববিহীন মায়া তৈরী করাতেই হাড়ে হাড়ে বুঝতে পারি। এই দুনিয়ার জীবনটা সত্যিই কি একটা লম্বা স্বপ্ন যা মৃত্যু ঘটনার পর বিস্মৃতির অতল অন্ধকারে হারিয়ে যাবে? প্রশ্ন, সংশয় আর অনুমানের স্থান সূফীবাদে নেই।
সূফীবাদ একটি অতি গোপনীয় রহস্যময় জ্ঞান, যা শরিয়তে প্রকাশ করা অনেক সময় ঠিক বলে অনেকেই মনে করেন না। মাত্র তিনবার বইটিতে বর্ণিত মোরাকাবার নিয়ম পদ্ধতিটি সঠিকভাবে অনুধাবন করে সাধনায় বসুন, খোদার কসম বু-আলী শাহ্ কলন্দরের মোরাকাবার বাণীটি কখনোই ব্যর্থতায় পর্যবসিত হবে না। দেখবেন, আপন সানুবরি কালবে আপনার রূপটি ফুলের মতো গোপনে ফুটে আছে। আর কারোর প্রশ্ন ও প্রমাণের দরকার হবে না। তখন নিজের সাক্ষী নিজেই হবেন। আপনার পকেটে যদি হাজার টাকা থাকে আর সবাই যদি বলে যে, আপনার পকেটে এক টাকাও নেই, তাহলে আপনি মনে মনে হাসবেন। কারণ টাকা পকেটে আছে কি-না তাতো আপনারই জানা আছে। সে রকম আপন গোপন ঘরে ফুল ফুটলো কি-না তার সাক্ষীতো আপনি নিজেই। এই রহস্যময় জ্ঞানকেই বলা হয় এলমে লাদুনি । সাধনা করলে অবশ্যই কিছু না কিছু পাবেনই। আর যদি তকদিরে না থাকে তা হলে আপনি কোন না কোন অজুহাতে সাধনায় বসার সুযোগই পাবেন না।
কোরানের সূরা রাদের ষোল নম্বর আয়াতে বলছে, “কুল্ হাল ইয়াস্সাবিল আমা ওয়াল বাসিরু আম হাল তাতাওয়ীজ জুলুমাতু ওয়ান নুরু।” “বল অন্ধ এবং চক্ষুষ্মান কি সমান? অথবা অন্ধকার এবং আলো কি সমান?” তাই এই এলমে লাদুনির রহস্যময় জ্ঞানের ফুলটি ফুটেছে যার মাঝে তাকে দুনিয়ার বৈষয়িক লোভ মোহ আর ধোঁকা দিতে পারে না। বৈষয়িক সম্পদের সাগরে তখন সাধক নৌকার মত চলে। পেটে পানি পড়লেই নৌকা ডুবে যাবে এটা সাধকের অজানা থাকে না। (সূত্রঃ সুফিবাদ আত্মপরিচয়ের একমাত্র পথ প্রথম খন্ড : কালান্দার মাওলানা জাহাঙ্গীর)।
শক্তির পূজারীরা সূফীকে শ্রদ্ধা করে এবং ভক্তিও করে। কিন্তু সেই ভক্তি ও শ্রদ্ধা জাগতিক বিষয় লাভের জন্য, আত্মপরিচয়ের ধ্যান সাধনার জন্য নয়। যদিও সে জানে যে, এক রাতের স্বপ্ন দেখার মত দুনিয়াতে আশিটি বছর বেঁচে থাকা একটি লম্বা স্বপ্ন বৈ আর কিছুই নয়। যদিও সে জানে মৃত্যুর পর আপন পরিবার পুত্রজন আর কেউ সহায় থাকবে না। যদিও সে জানে দুনিয়ার জীবনটা একটা মায়া। এই মায়ার শক্তি যে কত ভয়ঙ্কর কত মারাত্মক এবং পারমাণবিক শক্তিও যে মায়ার শক্তির কাছে অতি তুচ্ছ এটা সে ভাল করেই জানে। তবু এই মায়ার বাঁধনে পড়ে কত অন্যায় কত অত্যাচার কত হীন স্বার্থ চরিতার্থ করতে জেনে শুনে এগিয়ে যায়। এ যেন তকদিরের চিকন সুতায় বাঁধা জীবনটা দেখে শুনে বুঝে জহর গান করার মত। শতবার বুঝতে চাইলেও মায়ার বাঁধন বুঝতে দেয় না।
চোখ থাকতেও অন্ধ। সূরা বনী ইস্রাইলের বাহাত্তর নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে, “ওয়া’ মান ফানা ফি হাজিহি আমা ফাহুয়া ফিল আখেরাতে আমা ওয়া আদাদলু সাবিনান।” “এবং যে ব্যক্তি ছিল এর মধ্যে অন্ধ সুতরাং সে আখেরাতের মধ্যেও অন্ধ এবং অধিক পথহারা।” (হুবহু অনুবাদ করা হল)। (সূত্র: সুফিবাদ আত্মপরিচয়ের একমাত্র পথ খন্ড: কালান্দার মাওলানা জাহাঙ্গীর)।
তুমি সবচেয়ে বড় কবি। দুনিয়া-জোড়া তোমার নাম ফুটবে। দেশের জ্ঞানী-গুণীরা তোমার কবিতা পড়ে ধন্য ধন্য করবে। কত সম্মান আর সম্মানের ফুলমালা। কত বুদ্ধিজীবি তোমার কবিতা পড়ে প্রবন্ধ লিখে বলে
ফেলবে: তুমি কবিও, প্রফেটও। সেই বিখ্যাত কবিও বৃদ্ধ বয়সে নাতিকে কোলে নিয়ে শিশুর মতো বলে ফেলেন: আমি এই বুড়ো পোশাকটা ফেলে দিতে চাই না—অর্থাৎ এই জীর্ণ দেহে হতে বিদায় নিতে চাই না, অর্থাৎ মরতে চাই না। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ যতবারই যত রকম ব্যাখ্যা দিয়ে বলুন না কেন যে, তোমার এই দেহটি জীবাত্মার সবচেয়ে নিকটতম পোশাক। পরিধানের পোশাকটি দুর্বল হয়ে গেলে যেমন তুমি নিজেই ফেলে দাও, মৃত্যুটাও সে রকম দুর্বল দেহ-পোশাকটি ফেলে দেওয়া। এত মূল্যবান উপদেশগুলো একটি বৃদ্ধের কাছে বেকার হয়ে যায়। একটি পয়সার মূল্যও থাকে না তখন। ভাবে: এত কালের এই দেহ পোশাকটি ফেলে কোথায় কোন অজানা রহস্যলোকে যেতে হবে? ভয় পায়। বড় বড় জাঁদরেল মানুষও ভয় পায় এই ভেবে যে, এতকাল যাকে বাস্তব বাস্তব বলে বুদ্ধিজীবিদের সঙ্গে চা-পান করতে গিয়ে টেবিল চাপড়াতাম, সেই বাস্তব জীর্ণ দেহটা ফেলে কোনো অজানা রহস্যলোকের বাসিন্দা হতে ভয় লাগে।
তা হলে কি আশিটা বছরের দেহধারণ করার বাস্তব জীবনটা এক ফুৎকারে নিভে গিয়ে অজানা রহস্যলোকে যেতে হবে? এতকাল মানুষের ভীড়ে, মানুষের দেওয়া কত সম্মানের কাছে রহস্যলোকের জীবনটাকে ভ্রু-কুঁচকে ডাস্টবিনে ফেলে দিয়েছি, কত বড় টিটকারির ভেংচি কেটেছি। আর এখন? নাতিকে জড়িয়ে ধরে বলে: দাদু ভাই, তোমাদের মায়া ছেড়ে চলে যেতে চাই না অন্য আর এক রহস্যলোকে। কী বেদনাদায়ক বোবা বিলাপ! কী আজব বোবা কান্নার লম্বা নিঃশ্বাস ফেলা! (সূত্র: ইতিহাস নয় সুফিবাদই রহস্য: কালান্দার মাওলানা জাহাঙ্গীর)
ক্ষণস্থায়ীঃ
লোভ লালসা ভালবাসা, চিরস্থায়ী হয় না-
চাওয়া পাওয়ার আবেগ কখনও মিটেনা
যত গড়ায় স্বপ্নের ঘরে,
আর ও পাইতে-চায় অধিক করে-
শেষ নাই এই সংসারে,
সবুর হইয়া থাকতে পারে না।
ভাবি শুধু গাড়ী বাড়ি,
আরও চাই কত সুন্দর নারী-
অট্টালিকা যত গড়ি,
ছেড়ে যাইতে কেউ চায়না।
কন্টকময়ঃ
কন্টকে রাইখাছ ঘিরে,
মিলন হবে কেমন করে,
আঁধারে আলো রাইখাছ ধরে,
যাব সেথায় কেমন করে।
বাধল নফসে আমায় ছাড়ে না,
স্ব-রূপের আলো-তাই দেখিনা-
মহামায়ায় আমায় ছাড়ে না,
পারিয়াছি বিষম ফেরে।
গোলক ধাঁধার খেলা ঘরে,
বিনা সুতায় বাঁধলো আমারে-
স্বাধীনতা নাই রাজ্য জুড়ে,
পর-অধীন যাই কেমন করে।
কাম রাজ্যের কারাগারে,
ছয় চোরায় নিল ধরে-
মন চোরার কথায় পড়ে,
বিবেক জ্ঞান হারাইলামরে।
জেলের ঘরে শান্তি নাই,
মুক্তি আমি কেমনে পাই-
তরাইয়া নেও মুশকিল কোঁসাই,
স্মরণ করি বাবে বারে।
(সূত্র: সংযমের সংবিধান: সাধক শাহজাহান শাহ)
নিবেদক: আর এফ রাসেল আহমেদ