রাবেতার যােগ্য পীরের পরিচয়ঃ

    রাবেতার যােগ্য পীরের পরিচয়ঃ

    যে সাধক বেলায়েতে নবুয়ত ও কামালাতে নবুয়তের নেয়ামত প্রাপ্ত। তিনিই রাবেতার যােগ্য পীর। কারণ তাহার দেল এবং দেহে সর্বদাই জাতি নূরের ফয়েজ প্রবাহিত। তদীয় দেহের প্রত্যেক অণু-পরমাণুই খােদাতায়ালার নূরে নূরময় থাকে। তিনি তখন খােদাতায়ালা কর্তৃক পরিচালিত হন। এই মর্তবায় উন্নীত সাধক প্রসংগে হাদীসে কুদসীতে আল্লাহপাক বলেন, “আমার বান্দা আমার ফরজ সমূহ আদায় করা পূর্বক আমার নৈকট্য লাভে ধন্য হইয়া নফল ইবাদত সমূহ দ্বারাও অধিক নৈকট্য লাভ করিতে থাকে, এমন কি আমি তাহাকে নিজের বন্ধু বানাইয়া লই; যাহার ফলে আমি তাহার কর্ণ হইয়া যাই, যাহার দ্বারা সে শুনিতে পায়; তাহার চোখ হইয়া যাই, যাহার দ্বারা সে দেখিতে পায়; তাহার হাত হইয়া যাই, যাহার দ্বারা সে ধরিয়া থাকে ইত্যাদি।

    তাই হযরত মাওলানা রূমী (রঃ) ছাহেব তদীয় মছনবীতে বলেন,

    মােলক আওয়াযে খােদ আয শাহবুয়াদ,
    গার্চে আয হন্ডুমে আবদুল্লাহ বুয়াদ।”

    অর্থাৎ-ওলীয়ে কামেলসকল যাহা কিছু বলেন না কেন, তাহা সম্পূর্ণরূপে স্বয়ং বাদশাহগণের বাদশাহ মহান খােদাতায়ালার তরফ হইতে হইয়া থাকে; যদিও উহা বাহির হয় আল্লাহর বান্দার কণ্ঠনালী হইতে।” এই কারণেই বলা হয়, ওলীর মুখ স্বয়ং আল্লাহর মুখ। এমন ওলীয়ে কামেলের রাবেতার মাধ্যমে সাধারণ মুরীদ সকল বর্ণনাতীত ফায়েদা হাছিল করে। হযরত মাওলানা মকিমউদ্দিন (রঃ) সাহেব তদীয় গঞ্জে আছরার পুস্তকে রাবেতা প্রসংগে একটি চমৎকার উদাহরণ তুলিয়া ধরিয়াছেন। তিনি বলেন যে, “সূর্যের প্রখর তেজ সর্বত্র বিদ্যমান আছে, তথাপি তাহার তেজেতে কোন পদার্থ জ্বলে না। কিন্তু একখানি আতশী কাঁচকে সূর্যের দিকে ধরিয়া তাহার নীচে একখন্ড সাদা বা কাল কাগজ ধরিলে উহাতে তখনই আগুন লাগিয়া যায় । এইরূপ আল্লাহর জালাল সর্বত্র বিদ্যমান হওয়া সত্ত্বেও কাহারও দেলে সে তাছির ধরে না। কিন্তু পীরে কামেলের রাবেতা বা তাছাউর সম্মুখে রাখিয়া আল্লাহর দিকে। মােতাওয়াজ্জোহ হইলে অমনি আল্লাহর জালালের অগ্নি দেলে জ্বলিয়া উঠে। দেলে এক অপূর্ব তাছির হয়।”

    মূলতঃ ব্যাপারটিও তাই। রাবেতা চোষ কাগজ তুল্য। চোষ কাগজ যেমন কালিকে শুষিয়া লয়, তেমনি কামেল পীরের উপর জাতি নূরের যে ফয়েজ বিরামহীনভাবে পতিত হয়, মুরিদ রাবেতার মাধ্যমে সেই কাজের অংশ নিজের উপর টানিয়া লয়; যে ফয়েজে মুরীদের দেলের গােনাহের পাহাড়, গােনাহের তাছির, গােনাহের অন্ধকার, গােনাহের যুলমত সবই বিদুরিত হয়। মুরীদের দেল খেদামুখী হয়। নাফসে আম্মারা পাপ ও অন্যায় ত্যাগ করিয়া লাওমা হইয়া মােৎমাইন্নার স্তরে উপনীত হয়।

    হে জাকেরান ও আশেকান সকল! তােমরা যদি খােদাতায়ালাকে পাইতে চাও, ফানাফিশ-শেখ, ফানা-ফির রাসূল, ফানাফিল্লাহ ও বাকাবিল্লাহ এর জ্ঞান যদি অর্জন করিতে চাও, তাহা হইলে আদব, বুদ্ধি, মহব্বত ও সাহসের সাথে পীরের খেদমত কর।

    পীরকে ভালবাস সকলের চেয়ে বেশী। পীরের প্রতি তােমার মহব্বত যদি জাতি পর্যায়ে না হয়, তুমি যদি তােমার প্রাণাপেক্ষা পীরকে বেশী ভালবাসিতে না পার, তাহা হইলে কেমনে তুমি খােদাতালাকে পাওয়ার আশা রাখ? আজ পর্যন্ত যত সাধক, যত ওলী পৃথিবীতে আসিয়াছেন, তাহারা আপন আপন পীরকে নিজ প্রাণাপেক্ষা বেশী মহব্বত করিয়াই খােদাতায়ালাকে বাধ্য করিয়াছেন। তাহাদের প্রত্যেকেরই মহব্বত ছিল জাতি পর্যায়ের, তাই তাহারা খােদাতায়ালাকে চিনিতে পারিয়াছিলেন। হযরত ওয়ায়েছ করনী (রাঃ) ছাহেব চর্মচক্ষে না দেখিয়াও রাসূলে পাক (সাঃ) কে এতই মহব্বত করিতেন যে, ওহুদের যুদ্ধে রাসূলের দন্ত মােবারক শহীদ হইয়াছে-এই সংবাদ পাইয়া একে একে নিজের বত্রিশটি দাঁতই তিনি ভাংগিয়া ফেলিয়াছিলেন। ইহাই মহব্বতের চূড়ান্ত পর্যায়।

    তােমরা ওলী আল্লাহর জীবনী পড়িয়া দেখ, তাহা হইলে, আপন আপন পীরের প্রতি তাহাদের গভীর মহব্বতের পরিচয় তােমরা পাইবে। হযরত মাওলানা রুমী (রঃ) ছাহেব তদীয় পীরকে কি গভীর ভাবেই না ভালবাসিতেন। তদীয় পীর পরীক্ষাচ্ছলে একবার তাহাকে নির্দেশ দিলেন, “বাবা, আমার দুই বােতল মদের প্রয়ােজন। তুমি সগ্রহ করিয়া আন।” মাওলানা রুমী (রঃ) ছাহেব নির্দেশ পাওয়ামাত্রই দ্রুত প্রস্থান করিয়া দোকান থেকে দুই বােতল মদ সংগ্রহ করিয়া পীরের সম্মুখে আনিয়া রাখিলেন। তৎপর তদীয় পীর তাহাকে খুব ছুরাত দুইজন যুবতীকে আনয়নের নির্দেশ দিলেন। হযরত মাওলানা রুমী (রঃ) নিজ ঔরসজাত দুই সাবালিকা কন্যাকে পীরের সামনে আনিয়া দিলেন। অতঃপর পীর ছাহেব মাওলানা রূমী (রঃ) ছাহেবকে খুব ছুরাত দুইজন যুবককে আনিতে নির্দেশ দিলেন। হযরত মাওলানা রূমী (রঃ) ছাহেব নিজের দুই যুবক ছেলেকে আনিয়া পীরের নিকটে হাজির করিলেন।

    ইহা দৃষ্টে হযরত শামছে তিবরেজী (রঃ) ছাহেব তদীয় যােগ্য মুরীদ হযরত মাওলানা রূমী (রঃ) ছাহেবকে আদর করিয়া বলিলেন, “বাবা, এসব কোন কিছুরই আমার দরকার নেই। পীরের প্রতি তােমার মহব্বত কতখানি তাহাই শুধু দেখিলাম।” উল্লিখিত এ ঘটনা থেকে চিন্তা করিয়া দেখ, হযরত মাওলানা রূমী (রঃ) ছাহেব তদীয় পীর ছাহেবকে কি পরিমান ভালবাসিতেন। আমার পীর কেবলাজান হযরত খাজাবাবা এনায়েতপুরী (কুঃ) ছাহেব তদীয় পীর হযরত ওয়াজেদ আলী (রঃ) ছাহেবের হাতের লাঠির কত যে আঘাত সহ্য করিয়াছেন তাহার অন্ত নাই। তথাপিও পীরের প্রতি বিন্দু পরিমান অভিযােগ তাহার ছিল না। পীরকে তিনি এতই ভালবাসিতেন যে, পীরের তরফ থেকে আগত ইষ্ট বা কষ্ট উভয়ই তাহার নিকট সমান মনে হইত। পীরের প্রতি তাহার এই মহব্বত ছিল জাতি পর্যায়ের।

    পীরের প্রতি প্রেম, ভক্তি বা মহব্বত জাতি পর্যায়ে উন্নীত করিতে না পারিলে, পীরের সন্তুষ্টি অর্জন সম্ভব নয়। আর পীরকে রাজী করাইতে না পারিলে খােদাতায়ালার রেযা বা সন্তুষ্টি কেমন করিয়া লাভ করিবে?

    তােমরা গভীর ভাবে চিন্তা করিয়া দেখ, পীরের প্রতি তােমাদের প্রেম বা মহব্বত সিফাতি, না জাতি পর্যায়ের। তােমরা প্রত্যেকেই কম-বেশী খেদমত করিতেছ। কেউবা ১০ বছর, কেউবা ২০ বছর, কেউবা ততােধিক সময় যাবৎ; তােমাদের দেলে পীরের প্রতি মহব্বত পরিলক্ষিত হয়, কিন্তু ইহা সিফাতি পর্যায়ের মহব্বত, জাতি পর্যায়ের নয়। কিন্তু প্রেম বা মহব্বত জাতি পর্যায়ের না হইলে কিভাবে তােমরা খােদাতায়ালাকে পাওয়ার আশা রাখ?

    কাজেই তােমরা যদি খােদাতায়ালাকে পাইতে চাও, চিরস্থায়ী শান্তির অধিকারী যদি হইতে চাও, তবে পীরের কদমে জান-মাল বিসর্জন দাও। পীরের যে কোন হুকুমে কাতেল থাক। দেখ, হযরত আবুবকর সিদ্দিক (রাঃ) যিনি এই তরিকার প্রথম পুরুষ, তিনি রাসলে পাক (সাঃ) কে কত যে ভালবাসিতেন, তাহার তুলনা নাই। একবার এক যুদ্ধের প্রাক্কালে রাসুলে করীম (সাঃ) সাহাবীগণকে সামর্থানুযায়ী অর্থ সম্পদ জেহাদের প্রয়ােজনে ব্যায়ের নির্দেশ প্রদান করিলে, হযরত সিদ্দিকে আকবর (রাঃ) তাহার নিকট যাহা কিছু ছিল সমুদয়ই রাসূলে পাক (সাঃ) এর কদমে আনিয়া হাজির করিলেন। দয়াল নবী (সাঃ) সিদ্দিকে আকবর (রাঃ) ছাহেবকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “আপনি আপনার সংসারের জন্য কি রাখিয়া আসিয়াছেন?” তিনি উত্তরে বলিলেন, “আল্লাহ ও আল্লাহর রাসূলকে।” ইহাই মহব্বতে জাতির নিদর্শন। এমনিভাবে পীরকে যদি তােমরা ভালবাসিতে পার, তাহা হইলে খােদাপ্রাপ্তিতত্ত্ব তােমরা লাভ করিতে পারিবে । জীবন তােমাদের সার্থক হইবে। অনাবিল শান্তির অধিকারী তােমরা হইতে পারিবে।

    দু’আ। ইতি!

    টীকা

    ১। জাত আহাদিয়াত- একক জাত।
    ২। শান- গুণাবলীর মূল। শানের আভিধানিক অর্থ-মহত্ব।
    ৩। ইতেবার- পবিত্র জাত অসংখ্য নূরের পর্দা দ্বারা বেষ্টিত। এ সমস্ত পর্দা গুলােকে ইতেবার বলা হয়।

    সূত্র: শাসূফী হযরত খাজাবাবা ফরিদপুরী (কু: ছে: আ:) ছাহেবের নসিহত ১২তম খন্ড “ফানা ও বাঁকা” হতে তুলে ধরা হয়েছে।

    পীর-মুর্শিদ প্রশঙ্গে আরো কিছু দলিল ভিত্তিক পোস্ট নিচে দেয়া হলো:

    * পীর-মুর্শিদ ধরতে হবে এই প্রশঙ্গে কোরআনের অসংখ্য দলিল।
    * মহিলাদের বায়াত হওয়ার দলিল
    * খোদা প্রাপ্তির জন্য মুর্শিদ শর্ত
    * কামেল পীর চেনার উপায়! দলিল ভিত্তিক পূর্ণাঙ্গ আলোচনা
    * কোরআনে কি পীর ধরার কথা উল্লেখ আছে? দলিল সহ তুলে ধরা হলো।
    * ফানার জন্য পীরের প্রয়ােজন : সংক্ষিপ্ত আলোচনা
    * পীর ওলিগণ শাফায়াত করিতে পারিবেন কিনা? তাহার দলিল।
    * রাবেতার যােগ্য পীরের পরিচয়ঃ
    * ফানা ও বাকা সিদ্ধ ওলীই প্রকৃত কামেল পীরঃ
    * কামেল পীর চেনার উপায়! দলিল ভিত্তিক পূর্ণাঙ্গ আলোচনা
    * হুজুরী কালব বা কালবের একাগ্রতা অর্জনে মুর্শিদে কামেলের ভুমিকা

    আরো পড়ুনঃ
    Sufibad24.com | WhatsApp চ্যানেল

    Sufibad24.com | Telegram Channel