জলমগ্ন বরযাত্রীর পুনঃর্জীবন লাভ।
একদিন হযরত বড়পীর সাহেব বেড়াতে বেড়াতে এক নদীর কিনারায় এসে পৌঁছলেন দেখা গেল গ্রামের মহিলারা পানির জন্য এবং প্রয়োজনীয় ধোয়ামোছার জন্য নদীর ঘাটে সমবেত হয়েছে।
তাদের কেউ কলসীতে পানি ভর্তি করছে, কেউ ভরা কলসী নিয়ে বাড়ি দিকে চলছে, কেহ বা নদীর শোভা দেখে মুগ্ধ হয়ে রয়েছে। এটারই মধ্যে একজন রমনী করুন ক্রন্দন ধ্বনি হযরত বড়পীর (র) সাহেবের কর্ণগোচর হল। তার কান্নার আওয়াজ এমনই হৃদয়স্পর্শী যে, পাষাণ হৃদযও় বিগলিত হয়।
মহিলার ক্রন্দনে হযরত আব্দুল কাদের জিলানী (র) এর অন্তর বিদীর্ণ হয়ে গেল। তাই সেই নদীর ঘাটে উপস্থিত হয়ে মহিলার ক্রন্দনের কারণ জানতে চাইলেন।
একব্যক্তি মহিলার কান্নার কারণ জানতো, সে হযরত বড় পীর সাহেবের কান্নার কারণ আদ্যোপান্ত সবিস্তারে বর্ণনা করল।
লোকটি বলল, হুজুর! এই হতভাগ্য মহিলার পুত্রশোকে হযরত ইয়াকুব (আ) অপেক্ষাও অধিক হৃদয়বিদারক! তা মনে পড়লে চক্ষু অশ্রুসজলে হয়ে উঠে, এই রমণীর একটিমাত্র ছেলে, পুত্রের বিবাহের বয়স হলে তাকে বিবাহ করাইয়া একটি সুন্দর বধূ ঘরে আনার জন্য ব্যাকুল হয়ে পড়ল।
কিছুদিন পর নদীর অপর পাড়ে একটি সুন্দর কন্যার সাথে বিবাহ হয়ে গেল, নির্দিষ্ট দিনে ঘরে বউ উঠিয়ে আনিবার জন্য বরযাত্রীদল বরকে নিয়ে পানসীযোগে বধূর পিত্রালয়ে গেল।
পরদিন খুব আমোদ-প্রমোদের সাথে মহাসমারোহ তারা বধু নিয়ে বাড়ি রওয়ানা হল এবং নদী পাড়ি দিল, মৃদুমন্দ বাতাসে মাঝিরা পাল তুলে মনের আনন্দে সারিগান আরম্ভ কর, তীরবেগে পানসীখানা গন্তব্যস্থলের দিকে ছুটে চলল।
মাঝ নদীতে আসার পর আকাশে এক টুকরা কালো মেঘ দেখা দিল, দেখতে দেখতে সমস্ত আকাশ মেঘে ঢেকে ফেলল, মাঝিরা প্রমাদ শুনলো, নৌকার যাত্রীগণ সকলেই ভয়ে আতঙ্কগ্রস্ত হল, মাঝিগণ নৌকার পাল নামাইয়া নিরাপদ আশ্রয়ের পথ খুঁজল; কিন্তু নদীতে নিরাপদ আশ্রয়ের স্থান কোথায়?
অগত্যা শক্তভাবে হাল ধরে রাখল, চোখের পলকেই শোঁ শোঁ শব্দে দমকা বাতাস এসে নৌকাটিকে কাত করে ফেলবার উপক্রম করল, নৌকার যাত্রী ও মাঝিরা আল্লাহ আল্লাহ রবে হৈ চৈ আরম্ভ করে দিল, পানসীখানা অতিকষ্টে কূলের প্রায় নিকটেই এসে পৌঁছেছিল।
এমনি সময় ভীষণ বেগে প্রচন্ড তুফান এসে তা যাত্রী ও মাঝি-মাল্লাসহ উল্টে ফেলল, মুহূর্তের মধ্যেই বরযাত্রী ও মাঝিগণসহ নৌকাখানা নদীতে তলিয়ে গেল, বরযাত্রীদের এই শোচনীয় বিপদে গ্রামের মধ্যে শোরগোল পড়ে গেল, যাত্রী বা মাঝিরা কেউই এই বিপদ থেকে রক্ষা পেল না, সকলেই সলিল সমাধি লাভ করল।
দিনের পর দিন চলে গেল, মাস গেল বৎসরও অতিক্রান্ত হল, নদীতে নিমজ্জিতদের আত্মীয়-স্বজন ধীরে ধীরে তাদের কথা ভুলে গেল; কিন্তু একমাত্র এই বৃদ্ধা তার একমাত্র পুত্র ও বধুর কথা আজও ভুলেনি, নদীর তীরে নদীর দিকে চেয়ে সে এভাবে কান্না জুড়ে দেয়।
বৃদ্ধার এই মর্মান্তিক শোকের কাহিনী শুনে বড়পীর (রহঃ) সাহেবের অন্তরে বেদনা তোলপাড় করে উঠল, তিনি এই ব্যথা কোন মতেই সহ্য করতে না পেরে লোকদেরকে বললেন, “তোমরা এই মহিলাকে সান্ত্বনা দাও, তার কোলের সন্তান কোলেই ফিরে আসবেন,” উপস্থিত জনতা তাকে সান্তনা দিতে লাগল, কিন্তু কোন অবস্থায় মহিলার বিলাপ ও শোকাশ্রুর বিরতি হলো না, তার কান্নার মাত্রা যেন আরো বহুগুণে বেড়ে গেল, এই সান্ত্বনার বাণী তার নিকট হাস্যাস্পদ বলে মনে হল।
তখন বড়পীর (রহ:)সাহেব নিজেই তাকে বললেন, “মা তুমি কেঁদো না। আমি ইনশাআল্লাহ তোমার পুত্র ও তার সঙ্গী-সাথীদেরকে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করছি।” এবার মহিলাই কিছুটা আশ্বস্ত হল।
বড়পীর সাহেব লোকজনের সংস্রব হতে নির্জন স্থানে চলে গেলেন, নির্জনে গিয়ে আল্লাহর দরবারে হাত মুনাজাত করলেন- “হে বিশ্বপালক করুণাময় অন্তর্যামী! তোমার ইচ্ছায় সবই এক পলকে সংঘটিত হয়ে থাকে, সবাই তোমার আয়ত্তাধীন, তুমি এই মহিলার মনের যাতনা সবই জান দেখ, অধমের মোনাজাত কবুল করে তার পুত্র ও পুত্রবধূকে দলবলসহ পূর্বাবস্থায় ফিররাইয়া দাও।”
দীর্ঘ সময় পর দৈববাণী আসল, হে প্রিয় বান্দা! বার বৎসর পূর্বে জলমগ্ন হয়ে মৃত্যুবরণ কারীদেরকে এই দীর্ঘকাল পর কিভাবে পূর্বাবস্থায় ফিরিয়ে দেয়া যেতে পারে?
মাহবুবে সোবহানী দৈববাণীর উত্তরে বললেন, “হে দয়াময় খোদা! প্রভু তুমি তোমার পবিত্র কালামে পাকে ঘোষণা করেছো, ‘হয়ে যাও বলার সাথে সাথে হয়ে যায়’। তোমার পক্ষে বার বৎসর পূর্বে মৃত্যুবরণ কারীদেরকে জিন্দা করা এমন কি কঠিন কাজ?
পুনরায় দৈববাণী হলো, “হে কুতুবে রব্বানী! যাদের শরীর, হাড়-মাংস বহুদিন পূর্বে জলজন্তু হাঙ্গর, কুমির খেয়ে ফেলেছে তাদেরকে কিভাবে জীবিত করা যায়?
উত্তরে বড়পীর সাহেব বললেন, “হে বিশ্বপালক! এটা তুমি কি শুনাচ্ছ? কিয়ামতের দিন তুমি কী প্রকারে সমুদয় সৃষ্ট জীবকে সৃষ্টি করে তোমার সম্মুখে উপস্থিত করবে? জ্বিন ও মানুষকে পুনর্জীবিত করে হিসাবের জন্য কিভাবে তোমার সম্মুখে হাজির করবে?”
মাহবুবে সোবহানীর এ কথার পর পুনঃ দৈববাণী হলো, “হে প্রিয় বান্দা আব্দুল কাদের জিলানী! চিন্তিত হয়ো না, চেয়ে দেখ, তোমার প্রভু সকল কিছুই করতে পারেন।”
চক্ষু খুলে বড়পীর (রহ.) সাহেব দেখলেন, নদীর ঘাটে একখানা পরিপাটি পানসী নৌকা, উহার ভিতরে বর, বধূ এবং হাস্য-কৌতুক রত, তাঁরা সকলেই ধীরে ধীরে কূলে অবতরণ করছে।
বার বছর পূর্বেই যেই অবস্থায় এবং যেই পোষাকে ছিল, ঠিক সেই অবস্থায়ই সকলে তীরে এসে দাঁড়াল, আল্লাহর অপার কুদরতের খেলা দেখে গ্রামবাসী নদীর তীরে এসে জড় হল, যারা পূর্ব হতে নদীর ঘাটে ছিল তার এই অলৌকিক কেরামত দেখে নিস্তব্ধভাবে দাঁড়িয়ে রইল।
পুত্র ও পুত্রবধূকে অলৌকিকভাবে পেয়ে মহিলা আনন্দে আত্মহারা হয়ে বড়পীর (রহঃ) সাহেবের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে বলল, হুজুর! আপনার দোয়ায় বার বৎসর পর আমার পু্ত্র ও পুত্রবধূকে পেয়েছি, আল্লাহ আপনার মঙ্গল করুন, বড়পীর (রহ.) সাহেব মহিলার উত্তরে তাকে দোয়া করে বিদায় হলেন।
সূএঃ ‘খোলাছাতুল কাদেরী’