বেলাদাত বা সা’দাত এ গওসে আ’যাম
নাম পাক:- হুযুর গওসে পাকের নাম পাক – ‘আব্দুল কাদির’ (আঃ), কুনিয়াত – ‘আবু মুহাম্মাদ’ এবং তাঁর লকব – ‘মুহীউদ্দীন’। আল্লাহ পাক তাঁকে ‘গওসে আ’যাম’ বলে সম্বোধন করতেন। [মাযহারে জামালে মুস্তাফা, পৃষ্ঠা -৩]
পবিত্র বংশ মর্যাদা:- হযরত মওলানা নূরুদ্দীন আব্দুর রহমান জামী (রহঃ) স্বীয় পুস্তক ‘নাফহাতুল উনস মিন হাযরাতিল কুদস এর মধ্যে লিখেছেন যে, সাইয়েদেনা শায়খ আব্দুল কাদির জীলানী (আঃ) বংশগত সাইয়েদ। মাতা-পিতা উভয়দিক থেকে বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত শাহযাদা। সম্মানিত পিতার দিক দিয়ে হাসানী আর মহীয়সী মাতার দিক দিয়ে সাইয়েদ হযরত আব্দুল্লাহ সওমেঈ যাহিদের মাধ্যমে হুসায়্নী বংশধর। (উক্ত কারণে হুযুর গওসে পাককে আল্ হাসানী আল্ হুসায়নী বলা হয়)। [মুল্লা আলী কারী, নুযহাতুল খাতির]
পিতার দিক থেকে বংশধারা:- ইমাম আফীফ উদ্দীন আব্দুল্লাহ ইবনে আসাদ আল্ ইয়াফেয়ী শাফেয়ী স্বীয় পুস্তক ‘রওযুর রয়াহিন ফী হিকায়াতিস সলেহীন’ এ, ইমাম শতনূফী স্বীয় পুস্তক ‘বাহজাতুল আসরার’ এ এবং হযরত মুল্লা আলী কারী স্বীয় পুস্তক ‘নুযহাতুল খাতিরিল ফাতির ফী মানাকিবিশ শায়খি আব্দিল কাদির’ এর মধ্যে সাইয়েদেনা হুযুর গওসে পাকের পবিত্র বংশধারা এভাবে বর্ণনা করেছেন যে, সাইয়েদ আবু মুহাম্মাদ মুহীউদ্দীন শায়খ আব্দুল কাদির ইবনে সাইয়েদ আবু সলিহ্ মুসা জঙ্গী দোস্ত ইবনে সাইয়েদ আবু আব্দুল্লাহ ইবনে সাইয়েদ ইয়াহ্ইয়া যাহিদ ইবনে সাইয়েদ মুহাম্মাদ ইবনে সাইয়েদ দাউদ ইবনে সাইয়েদ মুসা সানী ইবনে সাইয়েদ আব্দুল্লাহ ইবনে সাইয়েদ মুসা আল জাওন ইবনে সাইয়েদ আব্দিল্লাহিল মাহায ইবনে সাইয়েদ হাসান মুসান্না ইবনে সাইয়েদ ইমাম হাসান আল মুজতাবা ইবনে সাইয়েদ ইমাম আলী ইবনে আবী তালিব সলাতুল্লাহি ওয়া সালামুল্লাহি আলায়হিম আজমাঈন।
তাই হুযুর গওসে পাক স্বীয় কাসীদা পাকে ইরশাদ ফরিমেয়েছন যে –
أنا الحسنى والمخدع مقامى▪واقدامى على عنق الرجال
وعبد القادر المشهور اسمى ▪وجدى صاحب العين الكمال
অর্থ: আমি হাসানী (বংশজাত) ও মাখদা আমার স্থান। আর আমার কদম সমস্ত ব্যক্তির ঘাড়ের উপর। এবং আমার প্রসিদ্ধ নাম হল আব্দুল কাদির। আর আমার দাদাজান (রসুলে পাক সঃ) পরিপূর্ণতার ঝরণা। [ কাসীদা এ গওসিয়া ]
মাতার দিক থেকে বংশধারা:- সম্মানিতা মাতার দিক থেকে তাঁর বংশ পরম্পরা সাইয়েদুশ শোহাদা ইমাম হুসায়্ন ইবনে আলী ইবনে আবু তালিব (আঃ) এঁর সাথে গিয়ে মিলিত হয়েছে। নির্ভরযোগ্য ও বিশ্বস্ত বর্ণনায় তাঁর মাতার দিকের বংশ পরম্পরা হল – সাইয়েদ আবু মুহাম্মাদ মুহীউদ্দীন শায়খ আব্দুল কাদির ইবনে উম্মুল খায়ের আমাতুল জাব্বার ফাতেমা বিনতে সাইয়েদ আব্দুল্লাহ সওমেঈ ইবনে সাইয়েদ আবু জামালুদ্দীন মুহাম্মদ ইবনে সাইয়েদ মাহমুদ ইবনে সাইয়েদ আবুল আতা ইবনে সাইয়েদ কামালুদ্দীন ঈসা ইবনে সাইয়েদ আবু আলাউদ্দীন মুহাম্মাদ জাওয়াদ ইবনে সাইয়েদ ইমাম আলী রেযা ইবনে ইমাম মুসা কাযিম ইবনে ইমাম জা’ফার সাদিক ইবনে ইমাম বাকির ইবনে ইমাম আলী যায়নুল আবেদীন ইবনে সাইয়েদুশ শোহাদা সাইয়েদেনা ইমাম হুসায়্ন ইবনে আমীরুল মু’মিনীন মওলা আলী ইবনে আবী তালিব আলায়হিমুস সলাতু ওয়াস সালাম। [মুল্লা আলী কারী, নুযহাতুল খাতির]
উপরোক্ত বংশীয় নিসবত দ্বারা বোঝা যায় যে, হযরত সাইয়েদ আব্দুল কাদির জীলানী (আঃ) ছিলেন ‘নাজীবুত তারফায়্ন’ অর্থাৎ মাতা-পিতা উভয়দিক থেকে পবিত্র ও সাইয়েদ বংশীয়। তাঁর সম্মানিত পিতা ও মাতা উভয়ের বংশীয় ধারা যথাক্রমে হযরত ইমাম হাসান ও হযরত ইমাম হুসায়্ন আলায়হিমাস সাথে গিয়ে মিলিত হয়েছে। তাঁর মহান বংশীয় ধারা শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সহীহ্ মুতাওয়াতির বর্ণনা সূত্রে প্রমাণিত। [মুল্লা আলী কারী, নুযহাতুল খাতির]
হযরত গওসুল আ’যাম পাক সম্পর্কে পূর্ববর্তী ওলীগনের ভবিষ্যতবাণী:- ইবনে হজর মক্কী তাঁর রচিত কেতাব ‘আল্ ফাতাওয়া আল্ হদীসিয়া’তে বর্ণনা করেছেন যে, “এমনকী পূর্বে অনেক সম্মানিত ওলী থেকে নির্ভরযোগ্য একাধিক সনদে বর্ণিত আছে যে, তাঁরা হযরত গওসুল আ’যাম পাকের বেলাদাত পাকের প্রায় ১০০ বছর পূর্বে ভবিষ্যতবাণী করেছিলেন যে, “অতি সত্বর অনারব বিশ্বে একজন মহান ওলী জন্মগ্রহণ করবেন। তিনি একথা বলবেন যে, আমার এ পদযুগল আল্লাহ্র প্রত্যেক ওলীর গর্দানের উপর। একথা শোনার পর ঐ যুগের সমস্ত ওলী তাঁর কদমের নীচে মাথা নত করবেন এবং তাঁর কদমের ছায়ায় আশ্রয় নেবেন।
[ ইবনে হজর মক্কী, আল্ ফাতাওয়া আল হাদীসিয়া, পৃষ্ঠা -৪১৪]
শায়খ আবু বকর ইবনে হিওয়ার (রহঃ) এঁর ভবিষ্যতবাণী:- শায়খ আযযায ইবনে মুসতাওয়াদা বাত্বা-ইহী (রহঃ) বলেন আমাদেরকে সংবাদ দিয়েছেন আমাদের শায়খ আবু বকর ইবনে হিওয়ার (রহঃ)। তিনি একদিন স্বীয় মজলিসে তাঁর সাথীদিগকে আওলিয়া এ কেরামের জীবনী কথা আলোচনা করছিলেন। তিনি এক পর্যায়ে বললেন, “অতি সত্বর ইরাকে একজন অনারবীয় ব্যক্তির জন্ম হবে, যিনি মানুষের নিকট অতি উঁচু মর্যাদাবান হবেন। তাঁর পবিত্র নাম হবে ‘আব্দুল কাদির’ (আঃ)। তিনি বাগদাদে বসবাস করবেন। তিনি বলবেন, ‘আমার এ কদম প্রত্যেক ওলী আল্লাহর গর্দানের উপর।’ তাঁর যুগের ওলীগন তাঁর কথা মানবেন। তিনি স্বীয় যুগের একক ব্যক্তি হিসাবে আবির্ভূত হবেন।” [ইমাম শতনূফী, বাহজাতুল আসরার, পৃষ্ঠা -৬-৭]
শায়খ আলী ইবনে ওয়াহাব (রহঃ) এঁর ভবিষ্যতবাণী:- শায়খ কায়েস ইবনে ইউনুস বলেন, একদিন আমাদের মুর্শিদ শায়খ আলী ইবনে ওয়াহাব (রহঃ) এঁর দরবারে ফকীরদের একটি দলের আগমন ঘটলো, শায়খ তাঁদেরকে জিজ্ঞেস করলেন, “আপনারা কোত্থেকে এসেছেন?” তাঁরা বললেন, “আজম (আরবের বাইরে) থেকে।” তিনি (শায়খ) জিজ্ঞেস করলেন, “আজমের কোন জায়গা থেকে?” তাঁরা বললেন জীলান থেকে ।” তখন তিনি (শায়খ) সকলের উদ্দেশ্যে বললেন, “নিশ্চয় আল্লাহ তা’আলা দুনিয়াকে এমন এক ব্যক্তি দ্বারা উজ্জ্বল করে দিয়েছেন, যিনি অতি সত্বর তোমাদের মধ্য থেকে আত্মপ্রকাশ করবেন। তিনি আল্লাহর খুবই নৈকট্যধন্য হবেন। তাঁর পবিত্র নাম ‘আব্দুল কাদির’। তাঁর প্রকাশ ইরাকে হবে। বাগদাদে তিনি ঘোষণা করবেন, “আমার এ পদযুগল আল্লাহ্র প্রত্যেক ওলীর গর্দানের উপর’। ঐ যুগের ওলীগন তাঁর এ বুযুর্গী ও মর্যাদার কথা স্বীকার করে নিবেন।” [ইমাম শতনূফী, বাহজাতুল আসরার]
জন্মস্থান:- সাইয়েদেনা হুযুর গওসে আ’যাম পাকের জন্মস্থান ‘গীলান’। আরবীতে ‘গাফ’ (گ ) কে ‘জীম’ ( ج) দ্বারা পরিবর্তন করে ‘জীলান’ উচ্চারণ করা হয়। এই কারণে তাঁকে ‘জীলানী’ বলা হয়। জীলানীর সংক্ষিপ্ত রূপ হচ্ছে ‘জীলী’ যার কারণে তাঁকে ‘জীলী’ও বলা হয়। হুযুর গওস পাক ৪৭০ হিজরীর ১লা রমযানুল মোবারক জন্মগ্রহণ করেন এবং ৫৬১ হিজরীর ১১ই রবিউস সানী ৯১ বছর বয়সে বেসাল পাক লাভ করেন। তিনি সম্মানিত নবীগনের মতো নিষ্কলুষ পবিত্র জীবন নিয়ে এসেছেন।
তাঁর মহীয়সী মাতা আমাতুল জাব্বার বলেন, “যখন আমার ছেলে হযরত ‘আব্দুল কাদির ‘ জীলানী (আঃ) ভূমিষ্ঠ হন তখন তিনি দিনের বেলায় দুধ পান করতেন না।” আকাশ মেঘাচ্ছন্ন থাকার কারণে ঈদের চাঁদ দেখা না গেলে তাঁর আম্মা পুরো নিশ্চয়তার সাথে বলতেন যে, “আজ রমযানের শেষ তারিখ, কারণ আমার ছেলে আজ দুধ পান করেন নি।” সেদিন থেকে সারা গীলান শহরে প্রসিদ্ধি লাভ করলো যে, আশরাফের ঘরে যে সন্তান ভূমিষ্ঠ হয়েছেন তিনি রমযানের দিনের বেলায় দুধ পান করেন না। [মুল্লা আলী কারী, নুযহাতুল খাতির]
মওলা পাক তাঁর ‘দেওয়ানে হযরতে জামাল’ এর মধ্যে লিখেছেন –
آپکا ماہ ولادت ہے مبارک ہو نہ کیوں
شہر پاک رمضان حضرت غوث الثقلین
ابتو پیدا ہوئے اسمیں نہو کیوں عید کا چاند
جملہ ماہ رمضان حضرت غوث الثقلین
বেলাদাত পাকের সময় কারামাত পাক :-
১। হুযুর গওসে পাকের আব্বাজান হযরত আবু সলিহ্ মুসা জঙ্গী দোস্ত (আঃ) এঁর একদিন হুযুর নবী আকরাম (সঃ) এঁর যিয়ারত পাক হলো, তো তিনি (সঃ) বললেন, “হে আমার পুত্র আবু সলিহ্! তোমাকে আল্লাহ তা’আলা এমন এক ফরযন্দ আতা করেছেন যিনি আমার পুত্র ও আমার মাহবুব এবং খোদা তা’আলারও মাহবুব। আর তাঁর মর্যাদা আওলিয়া এ কেরামের মাঝে ঐরকম যেমন সমস্ত আম্বিয়া এ কেরামের মাঝে আমার মর্যাদা।
২। সমস্ত নবী ও রসূলগন হুযুর গওসে পাকের আব্বাজানকে স্বপ্নে খবর দিলেন যে, “পূর্ববর্তী ও পরবর্তী সমস্ত আওলিয়া এ কেরাম আপনার ফরযন্দের অনুগত হবেন এবং তাঁর কদম মোবারক তাঁরা নিজের নিজের গর্দানের উপর রাখবেন এবং তাঁর অনুসরণ তাঁদের মর্যাদার উন্নতির কারণ হবে।
৩। হুযুর গওসে পাকের বেলাদাত পাকের রাত্রিতে সবই ছেলে সন্তান জন্মগ্রহন করেছিল যার সংখ্যা ছিল এগারো শত (১১০০) এবং তাঁরা প্রত্যেকেই (গওসে পাকের ফায়েযে) আওলিয়া এ কামেল হয়েছিলেন।
৪। হুযুর গওস পাক পুরো রমযান মাস সেহেরী থেকে ইফতার পর্যন্ত তাঁর মায়ের দুধ পান করেন নি।
৫। হুযুর গওসে পাকের বেলাদাত পাকের সময় তাঁর আম্মাজানের উমর মোবারক (বয়স) ছিল ষাট (৬০) বৎসর। এই বয়সে জন্মলাভ করাটাও তাঁর একটা কেরামত পাক।
বেলাদাত পাকের সময় হুযুর গওস পাকের চেহারা মোবারক এতটাই নূরানী ছিল যে, কোনো ব্যক্তি মনোযোগ দিয়ে তাঁর দিকে তাকিয়ে থাকতে পারতো না, যেন আল্লাহ পাক তাঁকে রসুলে পাক (সঃ) এঁর জামালিয়াতের বহিঃপ্রকাশ করে প্রেরণ করেছেন।
[মাযহারে জামালে মুস্তাফা, পৃষ্ঠা-৩-৪]
✍️ আলহাজ্জ মওলানা মুহাম্মাদ ওয়ালীউল্লাহ্ কাদেরী