মসনবী শরীফ পর্ব-১২
[বাংলা এই ভাবানুবাদ বরিশাল থেকে প্রায় ৫০ বছর আগে প্রকাশিত। এই দুর্লভ সংস্করণটি সরবরাহ করেছেন সুহৃদ (ব্যাংকার) নাঈমুল আহসান সাহেব। সম্পাদক – কাজী সাইফুদ্দীন হোসেন]
উজির নিজের ধোকাবাজীতে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার ঘটনা
হামচযু শাহ নাদান ও গাফেল বুদ উজির,
পানজা মী জাদ বা কাদীমে না গোজীর।
না গোজীর জুমলা গানে হাইউ কাদীর,
লা ইয়া জালু ওয়ালাম ইয়াজাল ফরদুন ও বছীর।
বা চুনাঁ কাদের খোদায়ে কাজ আদম,
ছদ চু আলম হাস্ত গরদানাদ বদম।
ছদ চু আলম দর নজর পয়দা কুনাদ,
চুঁ কে হাশমত রা বখোদ বীনা কুনাদ।
অর্থ: মাওলানা বলেন, উজির বাদশাহর ন্যায় জাহেল ও গাফেল ছিল। বে-নাইয়াজ পাক জাতের বিরোধিতা করিতেছিল। আর্থাৎ, আল্লাহতায়ালা ঐ সময় ঈসায়ী ধর্ম কবুল করিয়া উহা প্রচারের জন্য আদেশ দিয়াছিলেন। বাদশাহ্ এবং উজির ইহা ধ্বংস করিয়া দিবার চেষ্টায় ছিল। আল্লাহতায়ালা সকলের আশ্রয়স্থল, কেহই তাঁহার নিকট হইতে অ-মুখাপেক্ষী নয়। তিনি সর্বদা জীবিত, সর্বশক্তিমান, সব সময়েই আছেন এবং থাকিবেন। তিনি অদ্বিতীয়, সকলের বিষয় দর্শন করেন। তিনি এমন শক্তিশালী যে, এই পৃথিবীর মত হাজার হাজার পৃথিবী মুহূর্তের মধ্যে সৃষ্টি করিতে পারেন। তোমাকে মারেফাতের আলো দান করিতে পারেন, তখন তিনি তোমার চক্ষের সম্মুখে শত শত পৃথিবী সৃষ্টি করিয়া দেখাইতে পারেন। কমিনা উজির এমন খোদার বিরোধিতা করিতেছিল।
গার জাহান পেশাত আজীম ও পুর তনাস্ত,
পেশে কুদরাত জররায়ে মীদাঁকে নীস্ত।
ইঁ জাহান খোদ হাবছে জানেহায়ে শুমাস্ত,
হায়ে রুইয়াদ আঁছু কে ছাহরায়ে খোকাস্ত।
ইঁ জাহান মাহ্দুদ ও আঁ খোদ বেহ্দাস্ত,
নকশো ও ছরাতে পেশে আঁ মায়ানি ছদাস্ত।
ছদ হাজারানে নেজায়ে ফেরআউন রা,
দরশে কাস্ত আজ মুছা বা এব আছা।
ছদ হাজারানে তেব্বে জালিয়া নূছে বুদ,
পেশে ঈছা ও দমাশ, আফছুছে বুদ।
ছদ হাজারানে দফ্তরে আশ্য়ারে বুদ,
পেশে হরফে উম্মিয়াশ আঁ আরে বুদ।
অর্থ: এখানে মাওলানা ইহ-জগতকে খোদার কুদরতের সামনে নগণ্য বলিয়া দেখাইয়াছেন। তারপর (ইহ-জগতের) এই প্রকাশকে বাতেনী জগত হইতে আয়তনে খুব ছোট বলিয়া প্রমাণ করিয়াছেন। মাওলানা বলেন, যদিও এই বিশ্ব তোমার কাছে অতি বড় ও প্রকাণ্ড বলিয়া মনে হয়, কিন্তু জানিয়া রাখ, খোদার কুদরতের নিকট ইহা একটি অণু বরাবর বলিয়াও মনে হয় না। ইহ-জগত তোমার জন্য স্রেফ একটি কয়েদখানাস্বরূপ। তুমি খোদায়ী জগতের দিকে মনোনিবেশ করো, যাহা অতি প্রশস্ত। এই পৃথিবীর আকৃতি ও কারুকার্য্য হইতে ঐ পৃথিবীর নকশা ও কারুকার্য্য অতি উত্তম। ইহ-জগতের সাথে বন্ধুত্ব থাকিলে পরকাল হইতে ফিরিয়া থাকা হয়। ঐ পৃথিবী হইতে এই পৃথিবীর কার্যকলাপ অতি দুর্বল। তাই মাওলানা দৃষ্টান্ত দিয়া বর্ণনা করিতেছেন, ফেরাউনের যাদুকরদের শত সহস্র যাদুর লাঠি হজরত মূসা (আ:)-এর এক লাঠির সম্মুখে পরাজয় বরণ করিল। যেহেতু যাদুকরদের লাঠিসমূহে ঐ পৃথিবীর কোনো ক্রিয়া ছিল না, যাহা মূসা (আ:)-এর লাঠিতে ছিল। ইহা দ্বারাই শক্তি ও দুর্বলতার প্রমাণ হয়। লক্ষ লক্ষ জালিয়ানুছ তবীব বিদ্যমান ছিল, কিন্তু ঈসা (আ:) ও তাঁহার ফুঁকের সম্মুখে ইহা একটা খেলনার ন্যায় ছিল, ইহা তবীবদের জন্য অত্যন্ত দুঃখের বিষয় ছিল। তেব্বে ইউ নানীর মধ্যে ইহ-জগতের ক্রিয়া ছিল, আর ঈসা (আ:)-এর ফুঁকের মধ্যে ঐ পৃথিবীর ক্রিয়া ও বরকত ছিল। আমাদের হুজুর (দ:)-এর পবিত্র জামানায় জাহেলিয়ত যুগের আশ্য়ারের লক্ষ লক্ষ দফতরসমূহ স্তূপাকারে বিদ্যমান ছিল। কিস্তু আল্লাহ্র উম্মি নবীর প্রতি অবতীর্ণ আল্লাহ্র কালামের সামনে উহা মুখ হইতে নির্গত হওয়া লজ্জার কথা ছিল। কেননা ঐ সমস্ত বয়ানের মধ্যে ইহ-জগতের ফাছাহাত ও বালাগাত পরিপূর্ণ ছিল। আর আল্লাহর কালামের মধ্যে ঐ জগতের মাধুর্য্য পরিপূর্ণ ছিল।
বা চুনিঁ গালেবে খোদাওয়ান্দে কাছে,
চু নামীরাদ গার না বাশদ উ খাছে।
বাছ দেলে চুঁ কোহেরা আংগিখত উ,
মোরগে জীরাক বা দোপা আওবীখ্ত উ।
ফাহাম ও খাতের তেজ করদান নিস্তে রাহ,
জুজ শেকাস্তাহ মী নাগীরাদ ফজলে শাহ্।
অর্থ: মাওলানা বলেন, এই রকম জয়ী খোদার সম্মুখে কোনো ব্যক্তি নম্রতা সহকারে আনুগত্য স্বীকার করিবে না কেন; যদি সে কমিন না হয়। তাঁহার এমন শক্তি যে, অনেক ব্যক্তি যাহারা দৃঢ়ভাবে পাহাড়ের ন্যায় স্থায়ী ছিল, তাহাদিগকে সমূলে উৎপাটন করিয়া দিয়াছেন। যেমন, বালাম বাউর ঘটনা – তাহাকে সমূলে উৎপাটন করিয়া ধূলিসাৎ করিয়া দিয়াছেন। আর তোতা পাখী শিকার হবার সময়ে দুই পা উপরে দিয়া রশির সাথে ঝুলিয়া থাকে; শিকারীরা আসিয়া ধরিয়া নিয়া যায়। অতএব বুঝা গেল যে, বুদ্ধি ও খেয়ালতেজ করিলেই খোদাকে পাওয়ার পথ পাওয়া যায় না। নম্রভাবে বাধ্যতা স্বীকর করিলেই খোদাতায়ালা কবুল করিয়া লন।
আয় রছা গঞ্জেআগ্নানে গঞ্জে উ,
কা আঁ খেয়ালে আন্দেশেরা শোদরেশে গাউ।
গাউ কে বুদ তা তু রেশে উ শওবি,
খাকে চে বুদ তা হাশিশে উ শওবি।
জর ও নক্রাহ চীস্ত তা মফ্তুনে শওবি,
চীস্তে ছুরাতে তা চুনী মজনুন শওবী।
ইঁ ছারা ও বাগে তু জেন্দানে তুস্ত,
মুলকো ও মালে তু বালায়ে জানে তুস্ত।
অর্থ: মাওলানা এখানে দুনিয়ার মাল-মাত্তার নেশায় যাহারা মত্ত, তাহাদের নিন্দা করিয়া বলিতেছেন, অনেক লোক, যাহারা ধন সম্পদ গুদামজাত করে এবং সর্বদা গুদামজাত করার চেষ্টায় ব্যস্ত থাকে, তাহারা বোকা, ভবিষ্যতের চিন্তা করে না। দুনিয়া এমন কী বস্তু যাহার ঘাসের ন্যায় তুমি হইতেছ। অর্থাৎ, দুনিয়ার ধন-সম্পদ জমাকরণের চেষ্টায় তুমি সর্বদা ব্যস্ত থাক এবং আস্তে আস্তে ঘাসের ন্যায় তৃণ হইয়া যাইতেছ। ইহাতে তোমার লাভ কী? স্বর্ণ ও রৌপ্য এমন কোন্ বস্তু, যাহার জন্য পাগল হইয়া যাইতেছ। এই দুনিয়া এমন কী জিনিস, যাহার জন্য তুমি মজ্নুন হইয়া যাও। তোমার এই ঘর-বাড়ী, বাগ-বাগিচা, এ সবই তোমার কারা-ঘর। সাময়িকভাবে তুমি ইহার মহব্বতে আবদ্ধ আছ। তোমার রাজত্ব ও ধন-দৌলত সবই তোমার জানের শত্রু। ইহার জন্য তোমাকে নিশ্চয় শাস্তি ভোগ করিতে হইবে।
আঁ জমায়াত রা কে ইজ্ দে মছখে করদ,
আয়াতে তাছবীরে শাঁ রা নছখে করদ।
চুঁ জনে আজ কারে বদ শোদ রুয়ে জরদ,
মছখে করদ উরা খোদা ও জোহরা করদ।
আওরাতেরা জোহরা করদান মছখে বুদ,
আবো গেল গাস্তান না মছখাস্ত আয় আনুদ।
রূহে মী বুরাদাত ছুয়ে চরখে বরীঁ,
ছুয়ে আবও গেল শোদী দর আছফালীন।
পাছ তু খোদরা মছখে করদী জেইঁ ছফুল,
জা আঁ ওজুদে কে বুদ আঁ রেশকে অকুল।
পাছ বদ আঁ কেইঁ মছখে করদান চুঁ বুদ,
পেশে আঁ মছখে ইঁ বগায়েতে দুনে বুদ।
অর্থ: এখানে মাওলানা দুনিয়ার স্বাদ গ্রহণকারীর পরিণতি সম্বন্ধে বলিতেছেন, যাহাদিগকে আল্লাহতায়ালা আকৃতি পরিবর্তন করিয়া দিয়াছেন এবং পরিবর্তনের কারণ পবিত্র কুরআনে উল্লেখ করা হইয়াছে; তাহাদের মধ্যে একজন মেয়েলোকও আছে, যাহার বদকাম করিয়া চেহারা হলুদ বর্ণ হইয়া গিয়াছিল, তখন আল্লাহতায়ালা তাহার আকৃতি পরিবর্তন করিয়া দিয়া জোহরা সেতারা বানাইয়া দিয়াছিলেন। যখন মেয়েলোককে জোহ্রা সেতারা বানাইয়া দেওয়ার মছখ হইতে পারে, অর্থাৎ আকৃতি বদল হইতে পারে, তখন মানুষের শারীরিক প্রকৃতির স্বভাব রূহানী স্বভাবের উপর জয়লাভ করাকে আকৃতি বদল বা মছখ বলা যাইবে না কেন? মাওলানা নাফরমান বলিয়া সম্বোধন করিয়া বলিয়াছেন, হে নাফরমান! রূহানী আকাঙ্ক্ষা এবং আশা যদি পানি ও মাটির আশা এবং আকাঙ্ক্ষায় পরিণত হয়, তবে তাহাকে মছখ বা পরিবর্তন বলা যাইবে না কেন? তোমার রূহ্ তোমাকে নিয়া আসমানে আল্লাহর নিকট পৌঁছাইতে চাহিয়াছিল। কিন্তু তুমি তোমার খাহেশে নফ্সানীর বশবর্তী হইয়া সর্বনিম্ন স্তরে যাইয়া পৌঁছিয়াছ। অর্থাৎ, আল্লাহ হইতে অনেক দূরে যাইয়া উপস্থিত হইয়াছ। অতএব, তুমি এই নিম্নস্তরে যাইবার কারণেই নিজেকে পরিবর্তন করিয়া ফেলিয়াছ। প্রকৃতপক্ষে তোমার এই পরিবর্তন জোহ্রার পরিবর্তনের চাইতে অত্যন্ত অধমের কাজ। আদম-জাতের আহকামে রূহানী ও মারেফাতে ইলাহীর জন্য ফেরেস্তারা হিংসা পোষণ করিয়াছিল, সেই নিয়ামত ত্যাগ করিয়া তোমরা আজ অধঃপতনের নিম্নস্তরে যাইয়া বসিয়া রহিয়াছ।
আছপে হিম্মাত ছুয়ে আখুর তাখতে,
আদমে মাছ্জুদেরা না শেনাখ্তে।
আখের আদম জাগাহ্ আয়ে না খল্ফে,
চান্দে পেন্দারী তু পুস্তিরা শরফে।
চান্দে গুই মান বেগীরাম আলমে,
ইঁ জাহাঁরা পুর কুনাম আজ খোদহামে।
অর্থ: মাওলানা বলেন, তুমি সাহসের ঘোড়াকে দুনিয়ার স্বাদ গ্রহণের জন্য ধাবিত করিয়াছ, দিবা-রাত্রি সর্বদা-ই তুমি দুনিয়ার স্বাদ লাভ করার জন্য ব্যস্ত আছ। হজরত আদম (আ:) যাঁহাকে ফেরেস্তারা সেজদাহ্ করিয়াছিল, তাঁহাকে চিনিতে পারিলে না! হে নাফরমান, তুমি ত সেই আদমেরই সন্তান, তুমি কেন তোমার শক্তি ও সম্মান দুনিয়া হাসিল করার জন্য নষ্ট করিতেছ? কতদিন পর্যন্ত তোমার অধঃপতনকে সম্মান ও উন্নতি বলিয়া মনে করিবে? আর কতদিন খেয়াল করিবে যে, সমস্ত দুনিয়াকে আমার আয়ত্ত্বে আনিব এবং শাসন করিব।
গার জাহান পুর বরফে গরদাদ ছার বছার,
তাবে খোর ব গোদাজাদাশ দর এক নজর।
ওয়াজরে উ ও বেজ্ রে চুঁউ ছদ হাজার,
নিস্তে গরদানাদ খোদা আজ এক শরার।
আইনে আঁ তাখাইউল রা হেকমাতে কুনাদ,
আইনে আঁ জহরে আব রা শরবত কুনাদ।
আঁগুমান আংগীজরা ছাজাদ ইয়াকীন,
মহর হা রুইয়ানাদ আজ আছবাবে কীন।
পরওয়ারাদ দর আতেশ ইবরাহীম রা,
আইমানে রূহ্ ছাজাদ বীমে রা।
দর খারাবী গন্জেহা পেন হাঁ কুনাদ,
খারেরা গুল জেছমে হারা জানে কুনাদ।
অর্থ: উপরে দুনিয়ার লোভ-লালসা ত্যাগ করার জন্য উপদেশ দেওয়া হইয়াছে। যাহারা দুনিয়ার মহব্বতে আবদ্ধ আছে, তাহারা এখন কীভাবে দুনিয়ার ভালোবাসা ত্যাগ করিতে পারে এবং ত্যাগ করিলে পিছনের পাপ কেমন করিয়া মোচন হইতে পারে, সেই সম্বন্ধে মাওলানা বলিতেছেন, তোমার পিছনের গুণাহের কথা ভাবিতেছ! উহা আল্লাহর মেহেরবানীর নিকট বরফের ন্যায় মনে কর। সমস্ত পৃথিবী যদি বরফে পরিপূর্ণ হইয়া যায়, তবু সূর্যের কিরণের সম্মুখে উহা কিছু নহে, মুহূর্তের মধ্যে উহা গলাইয়া দিতে পারে। এইরূপভাবে তোমার পাপ যতই হউক না কেন, খোদার মেহেরবানীর সম্মুখে সবই বিলীন হইয়া যাইবে। অর্থাৎ, খোদাতায়ালা মেহেরবানী করিয়া ক্ষমা করিয়া দিতে পারেন। তোমার পাপের বোঝা যতই ভারী হউক না কেন, অর্থাৎ হাজার বোঝার ন্যায় ভারী হইলেও আল্লাহ্তায়ালা ইশকের সামান্য স্ফুলিঙ্গ দ্বারা সব ধ্বংস করিয়া দিতে পারেন। প্রকৃতপক্ষে আল্লাহর ইশকে এই রকমই ক্রিয়া আছে। যে জীবন ভরিয়া আল্লাহ ছাড়া অন্যে লিপ্ত ছিল কিন্তু আল্লাহর অনুগ্রহে তাঁহার ইশকের প্রভাবে মুহূর্তের মধ্যে সব দূর হইয়া যায় এবং তোমার খারাপ ধারণার যে আশঙ্কা থাকে, উহার মধ্যে আল্লাহর কারুকার্য নিহিত আছে। ঐ সমস্ত খারাপ ধারণাকে প্রকৃতপক্ষে খাঁটি হেক্মত রূপে রূপান্তরিত করিয়া খারাপ ধারণাসমূহকে উপকারী জ্ঞানে পরিণত করে। যেমন, ঐ ব্যক্তি খারাপ কাজের সম্বন্ধে এত অভিজ্ঞতা লাভ করে যে, কেহ কোনো সময় আর খারাপ কাজের ধোকায় ফেলিতে পারে না। যেমন বলা হয় খারাপকে চিনিয়াছি, খারাপ কাজ করার জন্য নয়; বরং উহা হইতে রক্ষা পাইবার জন্য। যে ব্যক্তি ভাল-মন্দ পার্থক্য করিতে জানে না, সে মন্দের মধ্যে পতিত হয়।
আজ ছবাবে ছুজিয়াশে মান ছুদায়েম,
ওয়াজ্ খেয়ালাতাশ চু ছুফছ্ তাইয়েম।
দর্ ছবাবে ছাজিয়াশে ছার গর্দান্ শোদেম,
ওয়াজ্ ছবাবে ছুজিয়াশ্ হাম্ হয়রান্ শোদাম্।
অর্থ: মাওলানা বলেন, আল্লাহতায়ালার জ্বলনের কারণে আমি উপকৃত হইয়াছি এবং চিন্তিত আছি। এই জ্বলনের কারণ সম্বন্ধে চিন্তা করিতে যাইয়া আমি ছুফাছতাইয়া সম্প্রদায়ের ন্যায় হইয়া পড়িয়াছি। অর্থাৎ-ছুফাছ্তাইয়া দল যেমন এই পৃথিবীতে কোনো বস্তুর ক্রিয়া স্বীকার করে না, সেইরূপ আমি আল্লাহর জ্বলনের কোনো কারণ তালাশ করিয়া পাইতেছি না। শুধু আল্লাহর ইশকে জ্বলনই জ্বলনের কারণ দেখা যায়।
ধোকাবাজ উজির কওমে ঈছা (আঃ) এর লোকদিগকে পথভ্রষ্ট করার উত্তেজনা বৃদ্ধি করার ঘটনা
চুঁ উজিরে মাকেরে বদ্ ইতেকাদ্
দীনে ঈছারা বদল করদ আজ ফাছাদ।
মক্রে দীগার্ আঁ উজির আজ খোদ ব বাস্ত,
ওয়াজরা ব গোজাস্ত দর্ খেলাওয়াত নেশাস্ত।
দর্ মুরিদানে দর্ ফাগান্দ আজ শওকে ছুজ,
বুদ দর্ খেলাওয়াত চেহেল পান্জাহ রোজ।
খলকে দউয়ানা শোদান্দ আজ শওকে উ,
আজ ফেরাকে হাল ও কাল ও জওকে উ।
লাবায়ে ও জারী হামী কর্দান্দ উ,
আজরিয়া জাত গাস্তাহ্ দর খেলাওয়াতে দাও তু।
গোফতাহ ইশাঁ বে তু মারা নিস্তে নূর,
বে আছা কাশ চুঁ বুদ আহ্ওয়ালে কুর্।
আজছারে ইকরাম ও আজ বহরে খোদা,
বেশে আজ ইঁ মারা মদার আজখোদে জুদা।
মা চুঁ তেফ্ লানেম্ ও মারা দাইয়ায়ে তু,
বর্ ছারে মা গাস্তারানে আঁ ছায়াতু।
অর্থ: যখন ঐ ধোকাবাজ খারাপ মনোভাবাপন্ন উজির ঈসায়ী ধর্মকে পরিবর্তন করিয়া খারাপ করিয়া ফেলিল, তখন সে আর একটা নুতন ফন্দি আঁটিল এবং ওয়াজ-নসীহত করা ত্যাগ করিয়া একাকী এক স্থানে নির্জনতা অবলম্বন করিল; কাহাকেও দেখা সাক্ষাৎ করিতে দিত না এবং কাহারও সাথে কথা বলিত না। সমস্ত মুরিদানের মধ্যে তাহার জুদায়ীতে বেদনা ছড়াইয়া পড়িল। প্রায় চল্লিশ দিন অথবা পঞ্চাশ দিন পর্যন্ত একাকী নির্জনে কাটাইল। সমস্ত লোক তাহার আকাঙ্ক্ষায় তাহার কথাবার্তা ও সাক্ষাৎ হইতে দূরে থাকায় পাগল হইয়া গেল এবং সকলে কান্নাকাটি শুরু করিল। এদিকে উজির নির্জনতা অবলম্বন করিয়া চলিল। মুরিদেরা বলিতে লাগিল, “আমরা আপনার ফায়েযের আলো ছাড়া হেদায়েত পাইতে পারি না, আমাদের লাঠি যদি না থাকে, তবে আমরা অন্ধ – আমাদের অবস্থা কী হইবে? আপনার বোজর্গির দোহাই, আল্লাহর ওয়াস্তে আমাদিগকে এর বেশী পৃথক রাখিবেন না। আমাদের অবস্থা তো শিশু বাচ্চার ন্যায়, আর আপনি আমাদের পক্ষে ধাইমা’র মত। আপনি আপনার অনুগ্রহের ছায়া আমাদের মাথার উপর বিছাইয়া রাখিবেন।”
বিশেষ দ্রষ্টব্য: এখানে বুঝা যায় যে মুরিদ যত দিন পর্যন্ত কামেল না হয়, ততদিন পর্যন্ত পীরে কামেল হইতে দূরে যাইতে হয় না। পীরের নিকট থাকিয়া খেদমত করাই উত্তম।
গোফ্তে জানাম আজ মুহেব্বানে দূর নীস্ত,
লেকে বেরুঁ আমদান্ দস্তুরে নীস্ত।
অর্থ: উজির উত্তরে বলিয়া দিল, যদিও আমার দেহ তোমাদের নিকট হইতে দূরে রহিয়াছে, কিন্তু আমার প্রাণ বন্ধুদের হইতে দূরে নয়। অর্থাৎ, আমার প্রাণ তোমাদের সাথেই আছে, কিন্তু তোমাদের নিকট বাহির হইবার হুকুম নাই।
আঁ আমিরানে দর্ শাফায়াত আমদান্দ,
ওয়া আঁ মুরিদাঁ দর্ জারায়াত আমদান্দ।
কা ইঁ চে বদ্ বখ্তীস্ত মারা আয় করিম,
আজ দেল ও দীন মান্দাহ্ মাবী তু ইয়াতীম।
তু বাহানা মী কুনী ও মা জে দরদ্
মী জানেম আজ ছুজে দেল্ দমহায়ে ছরদ।
মা বে গোফতারে খোশত্ খো করদায়েম,
মা জে শীরে হেকমতে তু খোর্দায়েম।
আল্লাহ আল্লাহ ইঁ যাফা বা মাকুন,
লুৎফে কুন্ এমরোজেরা ফরদা মকুন।
মী দেহাদ দেলে মর তোরা কেইঁ বে দেলাঁ,
বে-তু গরদানাদ আখের আজ বে হাছেলাঁ।
জুমলা দর্ খুশকী চু মাহী মী তপান্দ,
আবে রা ব কোশা জে জওবর্ দার্বন্দ।
ইকে চুঁ তু দর্জমানায় নীস্তে কাছ,
আল্লাহ আল্লাহ খলকেরা ফরইয়াদে রছ।
অর্থ: ঐ বারো নেতা উজিরের কাছে সুপারিশ করিতে লাগিল এবং জনগণ অর্থাৎ সাধারণ মুরিদগণ জারেজার হইয়া কাঁদিতে আরম্ভ করিল এবং বলিতে লাগিল, ইহা আমাদের জন্য অত্যন্ত বদ-নসীবের কথা; আপনার সোহবত ব্যতীত আমাদের মন শান্তি পাইতে পারেনা এবং আমাদের ধর্মে হেদায়েত হইতে পারে না। আপনার হেদায়েত ব্যতীত আমাদের ধর্ম একদম ধ্বংস হইয়া যাইবে। আপনি বাহানা করিতেছেন, আর আমাদের অন্তঃকরণ জ্বলিয়া ছাই হইয়া যাইতেছে। ঠান্ডা নিঃশ্বাস ছাড়িতেছি। কেননা, আমাদের আপনার উপদেশ শোনার অভ্যাস হইয়া গিয়াছে। আপনার জ্ঞানের মিঠা শরবত পান করিয়াছি। আল্লাহর ওয়াস্তে আমাদের সাথে কঠিন ব্যবহার করিবেন না। আমাদের অবস্থার উপর দয়া করিয়া মেহেরবানী করিবেন। অদ্য-ই দয়া করিবেন, কালকের জন্য নয়। আপনি কি পছন্দ করেন যে এই সমস্ত অজ্ঞ লোক আপনাকে ব্যতীত অসম্পূর্ণ থাকিবে? ইশকের উত্তেজনায় এইরূপ বেয়াদবী অন্যায় নয়। মুরিদেরা সকলেই এইরূপ ব্যস্ত ছিল, যেমন – মাছ স্থলে উঠিলে অসুবিধায় পড়ে। এখন আপনার ফায়েজের নহর জারী করিয়া দেন। আপনার সমকক্ষ এই দুনিয়ায় আর কেহ নাই। আল্লাহর ওয়াস্তে আমাদের জন্য খোদার নিকট আশ্রয় প্রার্থনা করুন।
মুরীদগণের পুনরায় উজিরকে নির্জনতা ভঙ্গ করার প্রার্থনা করা
জুম্লা গোফ্তান্দ আয়ে হাকীমে রোখ্না জু,
ইঁ ফেরেব্ ও ইঁ জাফা বা মা মগো।
মা আছিরানেম তাকে ইঁ ফেরেব্,
বে দেল্ ও জানেম তাকে ইঁ এতাব।
চুঁ পিজী রফ্ তী তু মারা আজ এব্তেদা,
মার হামাত্ কুন্ হাম চুনিঁ তা ইন্তেহা।
জোয়ফ্ ও এজ্জো ও ফকরে মা দানেছতা,
দরদে মারা হাম্ দাওয়া দানেছতা।
অর্থ: সকল মুরীদ উজিরের প্রতিউত্তরে আরজ করিল, হে হেকীম, এইরূপ ধোকাবাজী এবং অত্যাচার আমাদের প্রতি করিও না। এরূপ রূঢ় ব্যবহার ও কর্কশ বাক্য আমাদের প্রতি প্রয়োগ করিও না। আমাদের হইতে মুখ ফিরাইয়া নিও না। যাহাতে আমাদের অন্তর জ্বলিয়া পুড়িয়া ছাই হইয়া যায়। যখন আমাদিগকে প্রথম হইতে স্বীকার করিয়া লইয়াছ, তবে শেষ পর্যন্ত একইভাবে দয়া প্রদর্শন করিতে থাক। আমাদের অন্তরের দুর্বলতা, অপারগতা ও তোমার প্রতি আমাদের মুখাপেক্ষী হওয়া সম্বন্ধে তুমি সম্যক অবগত আছ। আমাদের অন্তরের ব্যথার প্রতিকার তোমার নৈকট্য লাভ, ইহাও তুমি জানো। অতএব, নির্জনতা ভঙ্গ করিয়া আমাদের দেখাশুনা কর।
চারে পারা কদরে তাকত্ বারে নেহ্,
বর্ জয়ীফানে কদ্রে কুওয়াত কারে নেহ।
দানায়ে হর্ মোরগে আন্দাজাহ্ ওয়ায়আস্ত,
তায়ামায়ে হর্ মোরগে আন্জীরে কায়ে আস্ত।
তেফ্লেরা গার্নানেদিহী বর জায়ে শির,
তেফলে মীছকীন রা আজাঁ নানে মোর্দাহগীর।
চুঁ কে দান্দানেহা বর্ আরাদ বাদে আজ আঁ,
হাম্ব খোদ গরদাদ দেলাশ জুইয়ায়ে নাঁ।
মোরগে পর্ না রেস্তাহ্ চুঁ পররাঁ শওয়াদ,
লোক্মায়ে হর্ গোর্বায়ে দররাঁ শওয়াদ।
চুঁ বর্ আরাদ পর্ বপর্রাদ উ বখোদ,
বে তাকাল্লুফ বে ছফীরে নেক্ ও বদ।
অর্থ: মাওলানা এখানে শায়েখে কামেলের জন্য শিক্ষা পদ্ধতি বাতলাইয়া দিতে যাইয়া বলিতেছেন, শিক্ষার্থীকে তাহার শক্তির বাহিরে কোনো শিক্ষা দেওয়া বা কোনো কাজ চাপাইয়া দেওয়া উচিত হইবে না। যেমন প্রথম দৃষ্টান্ত দিয়া বলিয়াছেন, চতুষ্পদ জানোয়ারের উপর তাহার শক্তি অনুযায়ী বোঝা চাপান চাই। এইরূপভাবে দুর্বলের উপর তাহার ক্ষমতা অনুযায়ী কাজ দেওয়া চাই। দ্বিতীয় উদাহরণে দেখাইয়াছেন, প্রত্যেক পাখীর খোরাকের দানা ইহার আন্দাজ অনুযায়ী আছে। প্রত্যেক পাখীর খোরাক আঞ্জির ফল হইতে পারে না। তৃতীয় দৃষ্টান্তে বলিয়াছেন, যদি দুধের শিশুকে দুধের পরিবর্তে রুটি খাইতে দিতে থাক, তবে ঐ বেচারা শিশুকে রুটির কারণে মৃত মনে করিতে পার। হাঁ, যখন তাহার দাঁত গজাইয়া উঠিবে, তখন সে নিজেই রুটি চাহিয়া লইবে। চতুর্থ দৃষ্টান্ত, যে পাখীর পাখা গজাইয়া উঠে নাই, ইহা যদি উড়িতে আরম্ভ করে, তবে নিশ্চয় করিয়া জানিয়া রাখ, সে বিড়ালের খাদ্যে পরিণত হইবে। যখন ইহার পাো বাহির হইয়া আসিবে, তখন সে নিজেই বিনা কষ্টে, কাহারও সাহায্য ব্যতিরেকে উড়িতে আরম্ভ করিবে। এইরূপভাবে যদি শিক্ষার্থীর প্রথম অবস্থায় কামেল মনে করিয়া ব্যবহার করা হয়, অথবা সে নিজে যদি নিজেকে দক্ষ মনে করে, তবে নিশ্বয়ই সে পথভ্রষ্ট হইয়া ধ্বংস হইয়া যাইবে। কেননা, প্রথম অবস্থায় তাহাকে কামেলের সোহবত লাভ করিতে হইবে। ইহাকে শিশুর দুধের সহিত তুলনা করা হইয়াছে।
দেউরা নতকে তু খামুশ মীকুনাদ,
গোশে মারা গোফ্তে তু হাশ্ মীকুনাদ।
গোশে মা হুশাস্ত চুঁ গোয়া তুই,
খুশকে মা বহরাস্ত চুঁ দরিয়া তুই।
বা তু মারা খাকে বেহতার্ আজ ফালাক,
আয়ে ছামাকে আজ তু মুনাওয়ার তা ছামাক্।
বে তু মারা বর ফাল্কে তারেকীস্ত,
বা তু আয় মাহ ইঁ ফালাক তারেকীস্ত।
বা তু বর খাকে আজ ফালাক বুরদেম দস্ত
বর ছামা মা বেতু চুঁ খাকেম পোস্ত।
ছুরাতে রফায়াতে বুদ আফলাকে রা,
মায়ানি রফায়াতে রওয়ানে পাকেরা।
ছুরাতে রফায়াত বরায়ে জেছমেহাস্ত,
জেছমেহা দর পেশে মায়ানি ইছমে হাস্ত।
আল্লাহআল্লাহ এক নজর বর মা ফেগান্
লা তাক্না তেন্না ফাকাদ তালাল হুজনা।
অর্থ: উজিরের মুরীদরা বলিতেছে, আমাদের মন আপনার কথা শুনিলে শান্ত থাকে। অর্থাৎ আপনার নসীহতের মর্ম ও রহস্য শুনিয়া আমাদের অন্তঃকরণের খারাপ ধারণাসমূহ বিদূরিত হইয়া যায় এবং আত্মাসমূহ শান্তরূপ ধারণ করে। কোনো প্রকার খারাবির দিকে ধাবিত হয় না। আমাদের অন্তরের কান সজাগ থাকে, যেমন আপনি আমাদিগকে একটা নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত চুপচাপ শান্ত থাকিতে বলিয়াছেন, এবং অন্তর সজাগ রাখিতে বলিয়াছেন। আমাদের প্রার্থনা ইহার বিরুদ্ধে নয়। কেননা, আত্মার দিক দিয়া চুপচাপ থাকার অর্থ ইহাই এবং ইহা আপনার কথাবার্তা ও নসীহতসমূহ শ্রবণেই হাসেল হইয়া থাকে। ইহাই আমরা চাই। অতএব, আমাদের প্রার্থনা প্রকৃতপক্ষে আপনার আদেশ পালনেরই নামান্তর। আর আপনি যে বলিয়াছেন, “তোমাদের অন্তরের কান সজাগ রাখ,” আমরাও ইহা চাই। এইজন্যই আপনার কথাবার্তা শুনার মুখাপেক্ষী। কেননা, আমাদের অন্তঃকরণ আপনার কথা ও উপদেশাবলী শুনিলেই হুঁশিয়ার থাকে। আর আমাদের শারীরিক চাহিদা রূহানি চাহিদায় পরিণত করিতে হইলে আপনার ন্যায় দরিয়ার ফায়েজের আবশ্যক। আমাদের আভ্যন্তরীণ ভ্রমণও আপনার সোহবতের দরুন হইয়া থাকে। কেননা, আপনি আমাদের সাথে থাকিলে, এই মাটির জমিন ও আসমান হইতে শতগুণে উত্তম বলিয়া মনে হয় এবং আপনি এমন ব্যক্তি, যদ্বারা এক প্রান্ত হইতে অন্য প্রান্ত পর্যন্ত আলোকিত হইয়া যায়। আর আপনি ব্যতীত যদি আমরা আসমানেও চলিয়া যাই, তবে আমদের নিকট আসমানও অন্ধকার বলিয়া মনে হয়। আপনি চাঁদের ন্যায়, আপনার সাথে আমরা আসমানে গেলেও আসমান অন্ধকার হইতে পারে না। অতএব, এই পৃথিবীতে আপনার সাথে থাকিয়া আপনার ওয়াজ নসীহত শুনিয়া আমাদের রূহানী আলো হাসেল হইবে। আর আপনি যদি আমাদের নিকট হইতে দূরে থাকেন এবং আমরা যদি আসমানেও পৌঁছে যাই, তথাপি আমরা রূহানী আলো হইতে বঞ্চিত থাকিব। কেননা, শুধু শারীরিক উচ্চস্থানে পৌঁছিলেই আত্মার উচ্চস্থানে পৌঁছা হয় না। এইজন্যই আমরা বলি, আপনার সাথে এই মাটির জমিনে থাকিয়া আসমান হইতেও অতিক্রম করিয়া যাইব এবং আপনাকে ছাড়া আসমানে থাকিয়াও অধঃস্থ জমিনের চাইতেও অধঃপতনে যাইতে হইবে। কেননা, এই আসমান শুধু প্রকাশ্যে উচুঁতে দেখা যায়। রূহের জন্য আত্মার দিক দিয়া উচ্চস্থান চাই এবং উহা আপনার সাথে থাকিলেই লাভ করা সম্ভব হইতে পারে। অতএব, আল্লাহর ওয়াস্তে আমাদের প্রতি দয়ার দৃষ্টি করুন, আমাদিগকে নিরাশ করিবেন না। কেননা,আমরা বহুত চিন্তিত হইয়া পড়িয়াছি; দুঃখে আমাদের অন্তর পরিপূর্ণ হইয়া গিয়াছে।
উত্তরে উজির বলিল, নির্জনতা ভঙ্গ করিব না
গোফতে হুজ্জাত হায়ে খোদ কোতাহ কুনেদ,
পন্দেরা দরজানো ও দর্দেলে বাহ কুনেদ।
গার্ আমিনাম্ মোত্তাহাম্ নাবুদ আমীন,
গার ব গুইয়েম্ আছমানরা মান্জমীন।
গার্ কামালাম্ বা কামাল ইনকারে চীস্ত,
দরীনাম্ ইঁ জহ্মত ও আজারে চীস্ত।
মান্ না খাহাম্ শোদ্ আজইঁ খেলওয়াত বেরুঁ,
জা আঁকে মাশ্ গুলাম বা আহ্ওয়ালে দরুঁ।
অর্থ: উজির মুরীদগণকে উত্তর দিল, তোমরা যুক্তি-তর্ক ত্যাগ কর, তোমাদিগকে যে উপদেশ দেওয়া হয়, সেই অনুযায়ী আমল কর। আমার উপর হঠকারিতা করিও না। আমাকে যদি তোমরা হিতাকাঙ্ক্ষী ও আমানতদার মনে করিয়া থাক, তবে আমানতদারের উপর মিথ্যা দোষারোপ করা উচিত না। যদিও নাকি তোমরা আসমানকে জমিন বলিয়া প্রকাশ কর। অতএব, আমি যদি তোমাদের নিকট কামেল বলিয়া পরিগণিত হই, তবে কামেলের সহিত এন্কার ও প্রশ্ন-উত্তর কেন কর? আর যদি আমি কামেল না হই, তবে গায়েরে কামেলের সাথে সম্বন্ধ স্থাপন করিয়া এত দুঃখ-কষ্ট কেন ভোগ করিতেছ? আমি কখনও এই নির্জনতা ভঙ্গ করিব না। কেননা, আমি বাতেনী কাজে লিপ্ত আছি।
লজ্জাতে ইনয়ামে খোদরা ওয়া বগীর,
নক্লো ও বাদাহাউ জামে খোদরা ওয়া মগীর।
ওয়ার বগীরি কীস্তে জুস্ত ও জু কুনাদ,
নক্শ বা আন্কাশে চুঁ নীরু কুনাদ।
ম নেগার আন্দর মা মকুন দরমা নজর,
আন্দর ইকরামে ও ছাখায়ে খোদ নেগার।
মা নাবুদেম ও তাকাজা মানে নাবুদ,
লুৎফে তুনা গোফতাহ মা মী শনুদ।
অর্থ: মাওলানা এখানে আল্লাহর নিকট প্রার্থনা করিতেছেন, হে খোদা, তুমি ইচ্ছাপূর্বক আমাদিগকে নেয়ামত দান করিয়াছ; উহা হইতে বঞ্চিত করিও না। অর্থাৎ, আমাদিগকে যে ইশ্ক নেয়ামতস্বরূপ দান করিয়াছ, উহা তুলিয়া নিও না। আমাদিগকে সর্বদা তোমার মহব্বতের আশেক করিয়া রাখিও। আর ইশকের যে সমস্ত হাতিয়ার আমাদের মধ্যে আছে, উহা রহিত করিয়া দিও না। অর্থাৎ তোমার ইশক লাভ করার জন্য যে বিদ্যা, মারেফত এবং বাতেনী শক্তি দান করিয়াছ, উহা হইতে আমাদিগকে বঞ্চিত করিও না। বিদ্যা ও বাতেনী শক্তি প্রখর করিয়া দিও। যদি তুমি ঐসব শক্তি ফিরাইয়া নিয়া যাইতে চাও, তবে এমন কে আছে, যে তোমার কাছে তলব করিতে পারে? কেননা, আমরা মাত্র ছবির ন্যায়; ছবি অঙ্কনকারী তুমি। ছবি কোনো সময়ে অঙ্কনকারীর বিরোধিতা করিতে পারে না। আমরা ঐ নেয়ামতের দাবীদারও হইতে পারি না। কারণ, আমাদের অনেক ভুলত্রুটি ও পাপ আছে, যাহা দ্বারা আমরা ঐ নেয়ামতের উপযুক্ত হইতে পারি না। শুধু তোমার অনুগ্রহের উপর ভরসা করিয়া আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ করিতে পারি। হে খোদা, তুমি যদি আমাদের প্রতি দৃষ্টি না রাখ, তবে আমাদের অবস্থা অত্যন্ত খারাপ হইয়া পড়িরে। তাই তোমার বদান্যতার দরুন আমাদের প্রতি দানের দৃষ্টি রাখিও, যদিও আমরা উহার প্রকৃত দাবীদার হইতে পারি না। যেমন আমরা প্রথমে ছিলাম না, তুমি করিয়া বিদ্যমান করিয়াছ।
নকশে বাশদ পেশে নাক্কাশ ও কলম,
আজেজ ও বস্তাহ চু কোদাক দর শেকাম।
পেশে কুদরাতে খলকে জুমলাহ বারে গাহ,
আজেজ আঁ চুঁ পেশে ছুছন কারে গাহ।
গাহে নকশে দেউ এ গাহে আদম কুনাদ,
গাহে নকশে শাদী ও গাহে গম কুনাদ।
দস্তে নায়ে তা দাস্তে জম্বানাদ বদে,
নোতকে নায়ে তা দমে জানাদ আজ জরও নফা।
অর্থ: মাওলানা বলেন, ছবি অঙ্কনকারী ও তাহার কলমের সম্মুখে ছবি যেমন দুর্বল অর্থাৎ ছবির নিজস্ব কোনো মতামত প্রকাশের ক্ষমতা থাকে না এবং মাতৃগর্ভে বাচ্চার যেমন নিজের গঠন ও আকৃতির সম্বন্ধে কোনো ক্ষমতা প্রকাশ করার শক্তি থাকে না, সেই রকম মানুষেরও আল্লাহর ইচ্ছার বিরুদ্ধে শক্তি চালনার কোনো ক্ষমতা নাই। যেমন, সুঁচ ছেঁড়া কাপড়কে ভেলভেটরূপে তৈয়ার করিয়া দেয়। সেই রকম আল্লাহতায়ালা কখনও শয়তানের সুরত তৈয়ার করেন, আবার কখনও আদমের সুরত তৈয়ার করেন; আর কখনো কখনো সুন্দর দৃশ্য সৃষ্টি করেন। কখনও দুঃখের ছবি অঙ্কন করেন, ইহাতে মানুষের কোনো হাত নাই, বলার কোনো ভাষাও নাই। খোদার যাহা ইচ্ছা তাহা-ই করিতে পারেন। মানুষ তাঁহার বিরোধিতা করিতে সাহস পায় না এবং বিরোধিতা করার শক্তিও রাখে না।
তুজে কুর-আন্ বাজ জু তাফছিরে বয়াত,
গোফতে ইজদে মারা মাইতা ইজ রামাইতা।
গার বেররানেম্ তীরে আঁকে জেমাস্ত,
মা কামান ও তীর আন্দাজাশ খোদাস্ত।
অর্থ: মাওলানা বলেন, আমার উপরোল্লিখিত বয়াত-সমূহের ব্যাখ্যার সাহায্য পবিত্র কুরআন দ্বারা পাওয়া যায়। যেমন, আল্লাহ তা’য়ালা পবিত্র কুরআনে উল্লেখ করিয়াছেন, যখন আমাদের নবী করিম (দ:) কাফেরদের প্রতি পাথর-কুচি নিক্ষেপ করিয়াছিলেন, তখন আল্লাহ্তায়ালা ইর্শাদ করিলেন: হে নবী, যখন আপনি পাথরের কঙ্করগুলি কাফেরদের প্রতি নিক্ষেপ করিলেন, তখন উহা আপনি নিক্ষেপ করেন নাই, নিক্ষেপের মালিক স্বয়ং আল্লাহ্তায়ালা-ই। আপনি শুধু নিক্ষেপকারী, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে নিক্ষেপের কর্তা আল্লাহতায়ালা। ইহা দ্বারা বুঝা যায় যে, আমরা যদি তীর চালনা করি, তবে উহা আমাদের তরফ হইতে নয়। আমরা শুধু তীরের কামানের ন্যায়, তীর নিক্ষেপকারী আল্লাহ্তায়ালা। আমরা হাতিয়ারস্বরূপ এবং কাজ প্রকাশ হবার স্থান-মাত্র। প্রকৃতপক্ষে কাজ করার মালিক আল্লাহতায়ালা। ইহাই উপরোক্ত বয়াতসমূহের ভাবার্থ।
ইঁ না যবর ইঁ মায়ানী জাব্বারী আস্ত,
জেকরে জাব্বারী বরায়ে জারীস্ত।
জারী এ মা শোদ দলিলে এজতে রার,
খাজলাতে মা শোদ দলিলে ইখতিয়ার।
গার নাবুদী ইখতেয়ারে ইঁ শরম চীস্ত,
ওয়াইঁ দেরেগ ও খাজলাত ও আজারাম চীস্ত।
যজরে উস্তাদাঁ বশাগেরদাঁ চেরাস্ত,
খাতেরে আজ তদবীর হা গরদান চেরাস্ত।
অর্থ: মাওলানা বলেন, আমি যাহা উপরে বর্ণনা করিলাম, ইহা একেবারে যবর অর্থাৎ বাধ্যতামূলক নহে। আমার বর্ণনার উদ্দেশ্য হইল যে, আমাদের শক্তির উপর আল্লাহ্র শক্তি প্রভাব বিস্তার করিতে পারে। তিনি আমাদের শক্তির উপর শক্তিশালী। এই কথা মনে করিয়া তাঁহার শক্তির নিকট আমরা সর্বদা বশ্যতা স্বীকার করিয়া থাকিব। আমাদের শক্তির বিরুদ্ধে আল্লাহর শক্তি জয়ী, এইজন্য আমাদের সব সময়ে তাহার নিকট নত থাকিতে হয়। আর আমাদের ইচ্ছাধীন শক্তি দ্বারা অনেক সময়ে কাজ করিয়া লজ্জিত হই বলিয়া আমাদের ইচ্ছাধীন শক্তি আছে, স্বীকার করিতে হয়। নতুবা লজ্জিত হই কেন? যদি আমাদের ইচ্ছাধীন শক্তি না থাকিত, তবে উস্তাদ সাহেব কেন ছাত্রদিগকে শিক্ষা করার জন্য তাকীদ করিবেন এবং শাস্তির ব্যবস্থা করিবেন? প্রত্যেক কাজ সম্পন্ন করার জন্য কেনই বা এত চেষ্টা তদবীর করা হয়? ইহা দ্বারা বুঝা যায় যে, বান্দার কিছু শক্তি তাহার ইচ্ছাধীন করিয়া দেওয়া হইয়াছে।
ওয়ার তু গুই গাফেলাস্ত আজ যবরে উ,
মাহে হক পেন্হাঁ শোদ আন্দর আবরে উ।
হাস্তে ইঁরা খোশে জওয়াব আর বেশনূবি,
বোগ জারী আজ কুফরো ও বরদীনে বগরোবী।
হাছরাত ও জারী কে দর বিমারীস্ত,
ওয়াক্তে বীমারী হামা বেদারীস্ত।
আঁ জামানে কে মী শওবী বীমারে তু,
মী কুনী আজ জুরমে ইস্তেগফারেতু।
মী নূমাইয়াদ বর্ জেস্তী গুণাহ,
মী কুনী নিয়াতে কে বাজ আইয়াম বরাহ।
আহাদ ও পায়মান মী কুনী কে বাদে আজইঁ,
জুযকে তায়াত না বুদাম কারে গুজীঁ।
পাছ ইয়াকীনে গাস্ত আঁকে বীমারি তোরা,
মী বা বখশাদ হুশো ও বেদারী তোরা।
অর্থ: মাওলানা বলেন, যদি কেহ সন্দেহ পোষণ করে যে বান্দা নিজের শক্তি দিয়া খারাপ কাজ করিয়া লজ্জিত হয় না, বরং বাধ্যগত শক্তির দরুন অন্যায় করিয়া ফেলিয়াছে, অজ্ঞতা বশতঃ ইহা জানে না বলিয়া লজ্জিত হয়, যেমন চন্দ্র, ইহার কিরণ থাকা সত্ত্বেও অনেক সময়ে মেঘের কারণে ঢাকিয়া থাকে, সেইরূপ বাধ্যতামূলক শক্তি সর্বদা প্রভাব বিস্তার করে, কিন্তু অজ্ঞতার মেঘে ঢাকিয়া রাখে, বাধ্যতামূলক শক্তি অনুভব করিতে পারে না, নিজের শক্তি মনে করিয়া লজ্জিত হয়। ইহার জওয়াবে মওলানা বলিতেছেন, রোগী যখন রোগগ্রস্ত হইয়া নিজের পাপ কার্যের জন্য অনুতপ্ত হইয়া কান্নাকাটি করে, তখন সে সম্পূর্ণ সজাগ ও ওয়াকেফহাল হইয়া পাপ হইতে তওবা ও ইস্তেগ্ফার করিতে থাকে এবং দৃঢ় সংকল্প প্রকাশ করিতে থাকে যে, আর কখনও পাপ ও অন্যায় কাজ করিব না; সর্বদা সৎপথে থাকিব। ইহা দ্বারা নিশ্চয় করিয়া বুঝা গেল যে, রোগই তাহাকে সজাগ ও হুঁশিয়ার করিয়া দিয়াছে। খারাপকে খারাপ বলিয়াই মনে করে। যদি অজ্ঞতার কারণে লজ্জিত হওয়া প্রমাণ হইত, তবে রোগের অবস্থায়ই ঐ অজ্ঞতা দূর হইত, তথাপি সে কেন গুণাহের জন্য লজ্জিত হইতেছিল, এবং তওবা করিতেছিল। অতএব, অজ্ঞতা দূর হওয়া সত্বেও লজ্জিত হওয়া ও তওবা করা প্রমাণ করে যে, প্রকৃতপক্ষে মানুষের জন্য ইচ্ছাধীন শক্তি আছে, যাহা দ্বারা সে অন্যায় ও পাপ করিতে পারে।
পাছ বেদাঁ ইঁ আছলেরা আয় আছলে জু,
হরকেরা দরদাস্ত উ বোরদাস্তেবু।
হরকে উ বেদার তর পুর দরদে তর,
হরকেউ আগাহ তর রুখে জরদেতর।
অর্থ: এখানে মাওলানা আত্মার শান্তি ও সৌন্দর্যের কথা বর্ণনা করিতে যাইয়া বলিতেছেন, যাহার জন্য মহব্বতের ব্যথা থাকিবে, তাহার মিলন সে নিশ্চয়ই পাইবে। অতএব, তোমরা এই স্বতঃসিদ্ধ নিয়ম জানিয়া রাখ যে, যাহার জন্য যার ব্যথা আছে, সে নিশ্চয়ই তাহার সাক্ষাৎ পাইবে। যে ব্যক্তি ভালোবাসায় অধিক সজাগ থাকিবে, সে পূর্ণ মহব্বত লাভ করিতে পারিবে। যেমন, হাদীসে বর্ণনা করা হইয়াছে- “আল মারউ মা’আ মান আহব্বা” অর্থাৎ, মানুষ যাহাকে ভালবাসিবে, তাহার সহিত থাকিবে।
গার জে যবরাশ আগাহী জারিয়াত কো,
বীনাশ জেনজীরে যব্বারিয়াত কো।
বস্তাহ দর জেনজীরে চুঁ শাদী কুনাদ,
কায়ে আছীরে হারছে আজাদী কুনাদ।
ওয়ার তু মী বিনিকে পায়াত বস্তান্দ,
বর তু ছার হাংগানে শাহব নেস্তান্দ।
পাছ তু ছার হাংগি মকুন বা আজেজাঁ,
জা আঁকে নাবুদ তাবায়া ও খুয়ে আজেজাঁ।
চুঁ তু যবরে উনমী বিনি মগো,
ওয়ার হামী বিনি নেশানে দীদে কো।
অর্থ: মাওলানা যবরিয়া সম্প্রদায়কে যবর সম্বন্ধে জওয়াব দিতেছেন, যদি তোমরা খোদার ইচ্ছায় নিজেকে আবদ্ধ মনে কর, তবে তোমরা খোদার নিকট বিনয় সহকারে নম্রভাবে কান্নাকাটি কর না কেন এবং খোদার ইচ্ছা শক্তির সহিত যদি তোমরা আবদ্ধ হও, তবে তাঁহার সহিত মারেফাতের সম্বন্ধ স্থাপন করার আলামত কেন পাওয়া যায় না। কেননা, প্রত্যেক কাজেরই একটা ক্রিয়া আছে। যাহারা খোদার ইচ্ছায় আবদ্ধ, তাহারা কোনো কাজে বা কথায় নিজেদের শক্তি বা জোর চালাইবে না; বরং নিজেকে সর্বদা দুর্বল ও বাধ্যগত মনে করিবে। কিন্তু তোমাদের চাল-চলন ইহার বিপরীত দেখা যায়। খোদার আদেশ ও নিষেধের বেলায় নিজের শক্তিকে অকর্মণ্য বলিয়া মনে কর না। মানুষের উপর জোর-জুলুম কর, মনে হয় তোমরা তোমাদের বিশ্বাস অনুযায়ী কাজ কর না। তবে মুখে দাবী কর কেন? যে ব্যক্তি শিকল দ্বারা আবদ্ধ থাকে, সে কখনও আনন্দ প্রকাশ করিতে পারে না। কিন্তু তোমরা তো বেশ আনন্দ প্রকাশ কর। আর যে ব্যক্তি কয়েদখানায় আবদ্ধ থাকে, সে কখনও স্বাধীনতা প্রকাশ করিতে পারে না। তোমাদের যদি প্রকৃতপক্ষে ধারণা থাকে যে, তোমরা আল্লাহ্র কাজ ও কদর দ্বারা আবদ্ধ, তবে তোমরা দুর্বলের উপর অত্যাচার করিও না। কেননা, বেচারা দুর্বলদের চরিত্র ঐরূপ হয় না। অতএব, দুই অবস্থার অবলম্বন কর। যদি যবরিয়ার বিশ্বাসী না হও, তবে মুখে দাবী করিও না। আর যদি প্রকৃত যবরিয়ার বিশ্বাসী হও, তবে অসহায় দুর্বলের অবস্থা দেখাও না কেন?
দরহর আঁ কারে কে মীলাতাস্ত বদাঁ
কুদরাতে খোদরা হামী বিনী আয়াঁ।
দরহর আঁ কারে কে মীলাত নীস্তো ও খাস্ত,
খেশরা যবরী কুনী কে ইঁ আজ খোদাস্ত।
অর্থ: মাওলানা বলেন, যবরিয়া লোকেরা নিজেদের খাহেশ নফ্সানীজনক কাজগুলিকে খোদার শক্তির প্রভাবে হইয়াছে বলিয়া খোদার উপর দোষারোপ করিয়া থাকে। প্রকৃতপক্ষে নিজেদের কু-রিপুর তাড়নায় অপকর্ম করিয়া থাকে। আর খোদার উপর দোষারোপ করিয়া বসিয়া থাকে। আর যে কাজে নিজেদের মনোবাসনা পূর্ণ হয় না, সে কাজগুলি সম্পন্ন করে না, নিজেকে যবরিয়া বলিয়া ক্ষান্ত থাকে। খোদায় করায় না বলিয়া উহা হইতে বিরত থাকে। যদি প্রকৃত যবরিয়া বিশ্বাসী হও, তবে নিজেদের মনঃপুত কাজ নিজেদের শক্তি খাটাইয়া কর কেন? আর খোদার আদেশ ও নিষেধ যাহা তোমাদের মনঃপুত নয়, উহা খোদার ইচ্ছার উপর ফেলিয়া রাখ। ইহা দ্বারা বুঝা যায় তোমরা যবরিয়া বিশ্বাসী নও। শুধু বাহানা করিয়া চল। মনের খেয়াল-খুশী মত কাজ কর। অতএব, বাহানা করা ত্যাগ কর। প্রকৃত খোদার কুদরতে বিশ্বাসী হইয়া কাজ কর, আখেরাতে মুক্তি পাইবে।
আম্বিয়া দরকারে দুনিয়া যবরিয়ান্দ,
কাফেরানে দরকারে উক্বা যবরিয়ান্দ।
আম্বিয়ারা কারে উকবা ইখতিয়ার,
কাফেরানরা কারে দুনিয়া ইখতিয়ার।
জা আঁকে হর মোরগে বছুয়ে জেনছে খেশ,
মীর রওয়াদ উদর পাছ ও জান্ পেশে পেশ।
কাফেরানে চুঁ জেনছে ছিজ্জীন আমদান্দ,
জেছনে দুনিয়ারা খোশে আইনে আমদান্দ।
আম্বিয়া চুঁ জেনছে ইল্লিন বুদান্দ,
ছুয়ে ইল্লিন ব জানো ও দেল শোদান্দ।
ইঁ ছুখান পায়া নাদারাদ লেকে মা,
বাজে গুইয়াম আঁ তামামী কেচ্ছারা।
অর্থ: উপরের বর্ণনায় বুঝা গেল যে, মানুষ নিজের উদ্দেশ্য সাধন করিতে কখনও যবরীয়া হইয়া যায়, আবার কখনও ইচ্ছাধীন শক্তির পূজক হইয়া যায়। ইহা দ্বারা বুঝা গেল যে, উভয় মতই পোষণ করিয়া থাকে এবং উভয় মতের মানুষ দুনিয়ায় বিদ্যমান আছে। তাই মাওলানা কোন্ স্থানে যবরিয়া হইতে হইবে, আর কোন্ স্থানে ইচ্ছাধীন শক্তির মত পোষণ করিতে হইবে, এই পরামর্শ দিতে যাইয়া তিনি বলিতেছেন, আম্বিয়া আলাইহেচ্ছালামগণ দুনিয়ার কাজে যবরিয়া ছিলেন। আর কাফেররা আখেরাতের কাজে যবরিয়া ছিল। আম্বিয়াগণ আখেরাতের কাজ পছন্দ করিয়াছিলেন এবং সেই কাজ সম্পন্ন করার জন্য খুব চেষ্টা করিতেন। কাফেররা দুনিয়া পছন্দ করিয়া নিয়াছে, এইজন্য তাহারা দুনিয়ার কাজ সম্পন্ন করার জন্য সর্বদা ব্যস্ত থাকে। কারণ, প্রত্যেক পাখী নিজের দলের অনুসরণ করে। কাফের যেহেতু দোজখবাসী, এইজন্য দুনিয়া পছন্দ করিয়া লইয়াছে। দুনিয়া অন্বেষণ করাই শান্তি মনে করে, যাহার পরিণাম দোজখবাসী হওয়া। আম্বিয়া আলাইহেচ্ছালামগণ বেহেস্তবাসী, এইজন্য বেহেস্ত পাবার জন্য জান-প্রাণ দিয়া চেষ্টা করেন। পরকালের দিকে সর্বদা খেয়াল রাখেন; যাহাতে সহজে বেহেস্তে প্রবেশ করিতে পারেন। মাওলানা বলেন, এই কেচ্ছার শেষ নাই। অতএব, আমি এই কেচ্ছা এখন শেষ করিলাম।
উজিরের মুরীদগণকে নিরাশ করিয়া নির্জনতা ত্যাগ করিয়া চলিয়া যাওয়া
আঁ উজির আজ আন্দারুনে আওয়াজ দাদ,
কা আয় মুরীদান্ আজমান ইঁ মারালুম বাদ।
কে মরা ঈছা চুনীঁ পয়গাম করদ,
কাজ হামাহ্ খেশানে ও ইয়ারানে বাশে ফরদ।
রুয়ে দর দউয়ারে কুন্ তনহা নেশীঁ,
ওয়াজ ওজুদে খেশে হাম খেলওয়াত গুজীঁ।
বাদে আজইঁ দস্তুরে গোফতারে নীস্ত,
বাদে আজইঁ বা গোফতে গুয়েম কারে নীস্ত।
তা বজীরে চরখে নারী চুঁ হাতাব,
মান নাছুজাম দর আনাউ দর এতাব।
পহ্লুয়ে ঈছা নেশিনাম বাদে আজইঁ
বর ফরাজে আছেমানে চারে ইঁ।
অর্থ: উজির হুজরার মধ্য হইতে মুরীদগণকে সম্বোধন করিয়া বলিল, হে আমার প্রিয় মুরীদগণ! তোরা জানিয়া রাখ, আমাকে হজরত ঈসা (আ:) খবর দিয়াছেন যে, তুমি তোমার আপনজন ও আত্মীয় এগানা হইতে দূর হইয়া একাকী নির্জনতা অবলম্বন কর; কাহারও দিকে ফিরিও না। একা বসিয়া ধ্যান কর এবং নিজের অস্তিত্ব ভুলিয়া যাও। এখন আমার কাহারও সহিত কথা বলার সুযোগ নাই। তোমাদিগকে এখন আমি বিদায় করিয়া দিতেছি এবং আমি মরিয়া যাইতেছি। চতুর্থ আসমানে আমার অস্তিত্ব নিয়া হজরত ঈসা (আ:)-এর নিকট যাইতেছি। তাহা হইলে এই অগ্নিময় দুনিয়ার মধ্যে দুঃখ-কষ্ট ও ইহার সম্বন্ধ বজায় রাখার যন্ত্রণা হইতে রেহাই পাইব। হজরত ঈসা (আ:)-এর সাথে শান্তিতে বাস করিব।
বারো নেতার প্রত্যেককে উজির নিজের প্রতিনিধি নিযুক্ত করা
ওয়া আগাহানী হর আমিরেরা ব খান্দ,
এক ব এক তনহা ব হরি এক হরফে রান্দ।
গোফতে হরি একরা বদীনে ইছুবী,
নায়েবে হক ও খালিফায়ে মান তুই।
ওয়া আঁ আমিরানে দিগার ইত্তেবায়ে তু,
করদে ঈছা জুমলারা অসিয়ায়ে তু।
হর আমীরে কো কাশাদ গরদান বগীর,
ইয়া ব কোশ ইয়া খোদ হামী দারাশ আছীর।
লেকে তা মান জেন্দাহ্ আম্ ইঁরা মগো,
তা নমীরাম ইঁ রিয়াছাত রা মজো।
তা নমীরাম মান তু ইঁ পয়দা মকুন,
দাবীয়ে শাহী ও ইস্তিলা মকুন।
ইঁ নাক ইঁ তু মারো ও আহকামে মছীহ,
এক ব এক বর খানে তু বরা মত ফছীহ।
অর্থ: এই সময় উজির বারো নেতাকে পৃথকভাবে ডাকিয়া নির্জনে বসিয়া কথাবার্তা বলিলেন। প্রত্যেককে বলিয়া দিলেন, ঈসায়ী ধর্মে আল্লাহর প্রতিনিধি এবং আমার খলিফা তুমি একাই মাত্র, অন্যান্য সবে তোমার অধীনস্থ থাকিবে। হজরত ঈসা (আ:) তাহাদিগকে তোমার অধীন করিয়া দিয়াছেন। অতএব, তাহাদের মধ্যে যদি কেহ তোমার নাফরমানি করে তবে তাহাকে হয়ত বন্দী করিবে নতুবা হত্যা করাইয়া দিবে, অথবা শিকল দিয়া হাত পা বাধিঁয়া আবদ্ধ করিয়া রাখিবে। কিন্তু, যতদিন পর্যন্ত আমি জীবিত থাকিব, ততদিন পর্যন্ত এই রাজত্বের কেহ আশা করিও না, আর অন্য কোনো নেতাও আমাকে এ বিষয়ে বিরক্ত করিবে না, এই ঈসায়ী ধর্মের হুকুম-আহকাম ইহাতে বিদ্যমান আছে। ইহা ঈসায়ী ধর্ম অনুসারী ব্যতীত অন্য কাহাকেও দেখাইও না।
হর আমীরে রা চুনিঁ গোফত উ জুজা,
নীস্তে নায়েব জুজেতু দরদীনে খোদা।
হরি একরা করদে উ এক এক আজীজ,
হরচে উরা গোফতে ইঁরা গোফতে নীজ।
হর ইকেরা উ একে তু মার দাদ,
হর ইয়েকে জেদ্দে দীগার বুদ আল মুরাদ।
মতনে আঁ তু মার হাবুদ মোখতালেফ,
হামচু শেকলে হরফে হা বা তা আলিফ।
হুকমে ইঁ তু মার জেদ্দে হুকমে আঁ,
পেশে আজইঁ করদেম ইঁ জেদ্দেরা বয়াঁ।
জেদ্দে হামদিগার জে পায়ানে তা বে ছার,
শরেহ দাদেস্তেম ইঁ রা আয় পেছার।
অর্থ: প্রত্যেক আমীরকে উজির পৃথক পৃথকভাবে ডাকিয়া বলিয়া দিল, আল্লাহর ধর্মে তুমি ব্যতীত অন্য কেহ আমার প্রতিনিধি নয় এবং প্রত্যেককে খেলাফতনামা দিয়া সম্মানিত করিল। প্রত্যেককে একটি আহ্কামে দীনের নোছ্খা দিয়া দিল। প্রত্যেক নোছ্খা অন্যটির বিপরীতে ছিল এবং নোছ্খার সারমর্ম পরস্পরবিরোধী ছিল। যে রকমভাবে হরুফে হেজা পরস্পর বিভিন্ন হয়। প্রত্যেক কপির হুকুম-আহ্কাম অন্য কপির হুকুম-আহ্কামের বিরুদ্ধে ছিল।
নির্জনে উজিরের আত্মহত্যা
বাদে আজ আঁ চল রোজ দীগার দর বা বাস্ত,
খেশেরা কোশত আজ ওজুদে খোদ বরাস্ত।
চুঁ কে খলকে আজ মোরগে উ আগাহ্ শোদ,
বরছারে গোরাশ কিয়ামত গাহ্ শোদ।
খলকে চান্দা জমায়া শোদ বর্ গোরউ,
জামা দরাঁ দর্ দেশ ওয়ারউ।
কানে আদদ্ রাহাম খোদাওয়ান্দে শুমারদ,
আজ আরবে ওয়াজ তুরকে ওয়াজ রুমী ও করদ।
খাকে উ করদান্দ বর ছারে হায়ে খেশ,
দরদে উ দীদান্দ দর মানে হায়ে খেশ।
আঁ খালায়েক বরছারে গোরশ্ মাহে
করদাহ্ কুনরা আজদো চশ্মে খোদ রাহে।
জুমলা আজ দরদে ফেরাকাশ দর্ ফেগান,
হাম শাহানে ও হাম মেহানে ওহাম কাহান।
অর্থ: ইহার পর উজির চল্লিশ দিন পর্যন্ত হুজরার দরজা বন্ধ রাখিল এবং আত্মহত্যা করিল। জড় দেহ হইতে মুক্তি পাইল। যখন চতুর্দিকে লোকে তাহার মৃত্যুর খবর পাইল, তাহার কবরের উপর কিয়ামতের মাছের ন্যায় লোক জমা হইতে লাগিল এবং লোকে চুল ছিঁড়িয়া কাপড় ফাঁড়িয়া রোণাজারি করিতে আরম্ভ করিল। আরব-আজম হইতে এত লোক জমা হইয়াছিল, যাহার সংখ্যা আল্লাহ্ ব্যতীত কেহ সীমাবদ্ধ করিতে পারে না। তাহার কবরের ধুলাবালি উঠাইয়া সকলে মাথায় মাখিত এবং তাহার জন্য ব্যথা প্রকাশ করা অমোঘ ঔষধ বলিয়া মনে করিত। এই রকমভাবে তাহারা একমাস পর্যন্ত উজিরের কবরের কাছে বসিয়া কান্নাকাটিতে লিপ্ত ছিল; এবং চক্ষু দিয়া রক্ত প্রবাহিত করাইয়াছিল। ছোট-বড় সকলেই উজিরের শোকে শোকাতুর হইয়া পড়িয়াছিল।
ঈসা (আ:)-এর উম্মতদের বারো নেতার মধ্যে কে প্রতিনিধি জানিতে চাওয়া
বাদে মা হায়ে খলকে গোফতান্দ আয় মাহাঁ,
আজ্ আমীরানে কীস্ত বর জায়েশ নেশাঁ।
তা বজায়ে উ শেনাছামেশ ইমাম,
তাকে কারে মা আজ উ গরদাদ তামাম্।
দস্তে দরদে আমানে দো উ জানেম,
ছার হামা বর ইখতিয়ারে উ নাহেম।
চুঁকে শোদ খুরশীদ ও হামারা করদে দাগ,
চারাহ্ নাবুদ বর মকামাশ আজ চেরাগ।
চুঁকে শোদ আজ পেশে দীদাহ্ ওয়াছলে ইয়ার,
নায়েবে বাইয়াদ আজ উ মানে ইয়াদগার।
চুঁ কে গোল্ ব গোজাস্ত ও গোল্শান্ শোদ খারাব,
বুয়ে গোলরা আজকে জুইয়াম আজ গোলাব।
অর্থ: একমাস পরে মুরীদগণ পরামর্শ করিল যে, আমাদের বারো নেতার মধ্যে উজিরের প্রতিনিধি কাহাকেও নিযুক্ত করা চাই। যাহাকে আমরা উজিরের খলিফা মনে করিয়া ইমাম ও পথ প্রদর্শক মনে করিব, তাহার দ্বারা আমাদের ধর্মের কাজ পরিপূর্ণতা লাভ করিবে; আমরা তাহার দ্বারা ধর্ম সম্বন্ধীয় বিধান লাভ করিব। আমরা সকলে তাহার রায় একবাক্যে মানিয়া লইব। কেননা. যখন আমাদের আফ্তাব চলিয়া গিয়াছে এবং আমাদিগকে জ্বালাইয়া দিয়া গিয়াছে, এখন তাহার পরিবর্তে একটি বাতি হওয়া একান্ত আবশ্যক। আমাদের চক্ষের সম্মুখে দিয়া যখন মাহ্বুব উঠিয়া গিয়াছে, তখন তাহার স্মরণ-চিহ্ন আমাদের জন্য থাকা আবশ্যক। যেমন ফুলের মৌসুম চলিয়া গিয়াছে, বাগান ফুলশূন্য বিরান পড়িয়া রহিয়াছে। এখন ফুলের সুগন্ধি শুধু গোলাপ ফুল হইতে লইতে পারি। এই সব দৃষ্টান্তের উদ্দেশ্য, যখন আসল পাওয়া যাইবে না তখন তাহার খলিফা দিয়াই কাজ চালাইতে হইবে।
চুঁ খোদা আন্দর নাইয়ায়েদ দর্ আইয়ান,
নায়েবে হকান্দ ইঁ পয়গম্বরাঁন।
নায়ে গলতে গোফ্তাম কে নায়েবে বা মানুব,
গার দু পেন্দারী কবীহ্ আইয়াদ না খুব।
নায়ে দু বাশদ তা তুই ছুরাত পোরোস্ত,
পেশে উ এক গাস্ত কাজ ছুরাতে বরাস্ত।
অর্থ: মাওলানা বলেন, যখন আসল পাওয়া যায় না, তখন খলিফার আবশ্যক। যেমন আল্লাহ্কে চর্মচক্ষু দিয়া দেখার শক্তি নাই, পয়গম্বরগণকেই তখন আল্লাহর খলিফা বলিয়া মনে করিতে হইবে। তাহাদের নিকট হইতে ফায়েজ হাসেল করিতে হইবে। নায়েব আর আসল দুই বস্তু হওয়া আশ্যক। তাই আল্লাহ্তায়ালা এবং আম্বিয়ায়ে কেরাম পৃথক পৃথক বুঝা যায়। এই সন্দেহ দূর করার জন্য মাওলানা বলিতেছেন, আমি ভুল বলিয়াছি। এমন নায়েব যে, আসল আর নায়েব ভিন্ন কোনো বস্তু নহে, এরূপ ধারণা করিলে পাপ হইবে। এই কথায় আবার সন্দেহ হয় যে, নবী এবং আল্লাহ বুঝি একই বস্তু, কোনো দিক দিয়া পার্থক্য নাই। তাই মাওলানা পুনঃ রদ করিয়া বলিতেছেন, এখানে নায়েব এবং আসল পৃথকভাবে দুই বস্তু হওয়া একেবারে ভুল নহে, যদি বাহ্যিক দিক দিয়া দেখা যায়, তবে দুই বলিয়াই মনে হয় এবং পরস্পর পৃথক। আর যদি হাকীকতের দিক দিয়া নজর করা হয়, তবে উভয়েরই এক অস্তিত্ব বলিয়া মনে হইবে।
চুঁ বছুরাত্ বেংগরী চশমাত দো আস্ত,
তু ব নূরাশ দর্ নেগার কানে এক্ তু আস্ত।
লা জেরা মচুঁ বর একে উফ্তাদ নজর,
আঁ একে বীনি দো না আইয়াদ দর্ বছর।
নূরে হর দো চশ্মে না তাওয়াঁ ফরকে করদ,
চুঁকে দর নূরাশ নজরে আন্দাখতে মর্দ।
উ চেরাগ আর হাজের্ আইয়াদ দর্ মকান,
হরি একে বাশদ্ বছুরাতে জেদ্দে আঁ।
ফরকে না তাওয়াঁ করদ নূরে হরি একে,
চুঁ ব নূরাশ রুয়ে আরী বে শকে।
উত্লুবুল মায়ানী মিনাল ফরকানে কুল।
লা নু ফাররেকু বাইনা আহাদেম্ মের রুছুল
গার তু ছাদ ছীবো ও ছদাই ব শুমারী,
ছাদ নুমাইয়াদ এক বুদ্ চুঁ ব ফেশারী
দর মায়ানী কেছমতে ও আদাদে নীস্ত,
দর মায়ানী তাজ্ জীয়া ও আফরাদে নীস্ত।
অর্থ: মাওলানা উপরোক্ত উদাহরণসমূহ প্রমাণ করার সাহায্যার্থে আরও দৃষ্টান্ত দিয়া পরিষ্কার করিয়া দিতেছেন, যদি বাহ্যিক আকৃতি দেখা যায়, তবে চক্ষু দুইটাই দেখা যায়। আর যদি নজর করার হিসাবে দেখা যায়, তবে একটাই মনে হয়। কেননা, উভয় চক্ষুর মধ্যে আলো হিসাবে একই আলো দিয়া দেখা যায়। এই হিসাবে দুই চক্ষুর আলো একই আলো, ইহাতে কোনো পার্থক্য নাই। যদি কোনো বস্তুর প্রতি দৃষ্টি করে, তবে একই সময়ে একই আলো দ্বারা একই বস্তু দেখা। অতএব, যদিও প্রকাশ্যে দুইটি চক্ষু দেখা যায়, কিন্তু হাকীকতের দিক দিয়া একই রকম বলিয়া মনে হয়। এইরূপভাবে যদি একস্থানে দশটি বাতি জ্বালাইয়া দেওয়া হয়, তবে বাহ্যিক দৃষ্টিতে প্রত্যেকটি বাতি পৃথক পৃথক দেখা যাইবে। কিন্তু প্রদান হিসাবে একই রকম আলো দান করিবে উহাতে কোনো রকম পার্থক্য করা যায় না। মাওলানা বলেন, এই রকম দৃষ্টান্ত পবিত্র কুরআনে তালাশ কর এবং এই আয়াত পাঠ কর – “লা-নুফাররেকু বাইনা আহাদেম্মের-রুসূলিহি”, অর্থাৎ, আমি আল্লাহর রাসূলদের মধ্যে কোনো পার্থক্য করিতেছি না। অর্থাৎ, তাঁহাদের রিসালাত সম্বন্ধে কোনোরূপ পার্থক্য করি না। রিসালাত প্রাপ্তি হিসাবে সবই এক রকম। কাহারও মধ্যে কোনো প্রকার কম ও বেশী নাই। এইরূপভাবে একশত ছেপ ও একশত আবি লইয়া গণনা আরম্ভ কর। একশতই মোট গণনায় পাইবে। আবার যখন নিংড়াইয়া লইবে, তখন সবই এক হইয়া যাইবে। পার্থক্য উঠিয়া যাইবে। উপরোক্ত প্রমাণাদি দ্বারা ইহাই বুঝা গেল যে, আকৃতির দিক দিয়া যদিও ভিন্নরূপ দেখা যায়, কিন্তু উদ্দেশ্যের দিক দিয়া সকলই এক পর্যায়ে পড়ে। এইভাবেই দেখা যায় যে, সৃষ্টির অস্থায়ী বস্তুসমূহ যদিও বিভিন্ন আকারে প্রকাশ পাইয়াছে, প্রকৃত অবস্থায় সৃষ্টিকর্তা ওয়াজেবুল ওজুদ আল্লাহ্তায়ালা এক। তাঁহার কোন শরীক নাই। তিনি অদ্বিতীয়।
ইত্তে হাদে ইয়ারে বা ইয়ারানে খোশ্ আস্ত
পায়ে মায়ানী গীর ছুরাতে ছারকাশ্ আস্ত
ছুরাতে ছারকাশ গুদা জাঁকুন বরঞ্জ,
তা বা বীনি জীরে উ ওয়াহাদাত চুঁ গঞ্জ।
ওয়ার তু না গোদাজী এনায়েত হায়ে উ,
খোদ্ গোদা জাদ্ আয় দেলাম মাওলায়ে উ।
উ নোমাইয়াদ হাম বদেলহা খেশেরা,
উ বদুজাদ খেরকায়ে দরবেশ রা।
অর্থ: মাওলানা বলেন, যখন প্রকৃত উদ্দেশ্য এক হক-তায়ালাকে হাসেল করা, জাহেরী মাওজুদাত (প্রকাশ্য উপস্থিতি) ইহার পর্দাস্বরূপ। তাই তালেব (অন্বেষণকারী)-কে মতলুবের (তালাশকৃতের) সহিত সম্বন্ধ রাখাই অতি উত্তম। মতলুব এক আল্লাহতায়ালা, তিনি প্রত্যেক মাওজুদাতের অভ্যন্তরে নিহিত। অতএব, মায়ানির দিকে সর্বদা লক্ষ্য রাখা চাই, কেননা সুরাতে জাহেরী আল্লাহর একত্বের বিরোধিতা করিতে চায়, ইহারা বিভিন্ন রকমে বহু সংখ্যায় প্রকাশ পায়। ইহা প্রকাশ্যে একত্বের বিরোধিতা করে। হাকীকতের দিক দিয়া এক। যখন মাওজুদাতের প্রকাশ্য সুরাত একত্বের বিরোধিতা করে, তখন প্রকাশ্য সুরাত বাদ দিয়া রিয়াজাত (সাধনা) কর। রিয়াজত দ্বারা মা’বুদের সাথে এমন সম্বন্ধ স্থাপন কর, যাহাতে জাহেরী সুরাত দেখার অভ্যাস তোমার দৃষ্টি হইতে চলিয়া যায়। ইহাকেই ‘ফানা ফিল্লাহ’ (খোদার মাঝে লয়প্রাপ্তি) বলে। তাহা হইলে তোমার মধ্যে মা’বুদের একত্ব অনুভব করার শক্তি সঞ্চয় হইবে এবং ইহা তোমার মধ্যে একত্বের ভাণ্ডারে পরিণত হইবে। যদি বাহ্যিক দৃষ্টি ত্যাগ করিয়া রিয়াজাত করিয়া খোদার একত্বের আলো দৃষ্টিগোচর না হয়, তবে চিন্তিত ও দুঃখিত হইও না; কারণ খোদার মেহেরবানী তোমার উপর আছে। তিনি নিজে ইচ্ছা করিয়া তোমার পর্দা সরাইয়া দিবেন। তুমি রিয়াজাতের মাধ্যমে চেষ্টা করিতে থাক। খোদাতায়ালাকে চর্ম চক্ষু দিয়া দেখা যায় না। আশেকের অন্তরে আল্লাহ্র তাজাল্লি প্রকাশ পায়। অর্থাৎ, খোদা ব্যতীত অন্য কাহারও প্রতি দৃষ্টি থাকে না। দরবেশদের অন্তর, যাহা খোদার প্রেমে বিগলিত থাকে, তাহাদের খোদার সাথে মিলন হয়।
মোম্বাছাত বুদেম ও এক্জওহর হামা,
বে ছার ও বেপা বুদেম আঁ ছার হামা।
এক গহর বুদেম হামচুঁ আফ্তাব,
বে গেরাহ বুদেম ও ছাফী হামচু আব্।
চুঁ বছুরাত আমদ্ আঁ নূরে ছেররাহ,
শোদ্ আদাদ্ চুঁ ছায়া হায়ে কাংগারাহ্।
কাংগারাহ্ বিরান্ কুনেদ আজ মেন্ জানিক,
তা রওয়াদ্ ফরকে আজ মিয়ানে ইঁ ফরিক।
অর্থাৎ, মাওলানা বলেন, আমরা আলমে আরওয়াহ্র (রূহের জগতের) মধ্যে একই পদার্থ ছিলাম; সেখানে কোনো ভাগাভাগি ছিল না, আর কোনো সংখ্যাও ছিল না। সেখানে আমাদের দেহের কোনো অস্তিত্ব-ই ছিলনা। সূর্যের ন্যায় একই আলো জ্বলিতেছিল। পানির মত স্বচ্ছ পদার্থ ছিলাম। যখন খাটিঁ নূর ইহ-জগতে দেহরূপ ধারণ করিয়া আসিল, তখন বিভিন্নরূপ ধারণ করিয়া সংখ্যায় পরিণত হইল। প্রত্যেক দেহের সাথে রূহের সম্বন্ধ স্থাপিত হইল। যেমন পাথরের কণায় সূর্যের কিরণ পতিত হইলে প্রত্যেক কণায় পৃথক পৃথক আলো দেখায়, সেইরূপ আমাদের দেহে রূহের আলো আসিয়া পৃথকভাবে সংখ্যায় পরিণত করিয়াছে। অন্যথায় রূহ্ সূর্যের ন্যায় একই আলো দান করে। দেহের বিভিন্নতার কারণে পৃথক পৃথক রূপ ধারণ করিয়াছে। যাহা দ্বারা এখন গণনায় পরিণত হইয়াছে। অতএব, আমাদের উচিত ‘মানজাবিক’ পাথরের ন্যায় রিয়াজাত ও মোরাকেবা দ্বারা দেহের আবরণ দূর করিয়া রূহের আলো অবলোকন করিয়া উহার পার্থক্যের ধারণা লোপ করা। যেমন পাথর-কণাগুলি পিষিয়া এক করিয়া ফেলিলে তখন সূর্যের আলোতে উহা একই আলোরূপে মা’লুম হইবে। এইরূপে দেহের আবরণ হইতে মুক্ত হইলে সমস্ত রূহ একই আলো বলিয়া অনুমিত হইবে।
সারমর্ম: আল্লাহ্তায়ালা যেমন এক, রূহ্ও সেইরূপ এক। আল্লাহ যেমন সুরাতবিহীন, রূহ্ও তেমনি সুরাতহীন। আল্লাহ্র নূর যেমন প্রকাশ পাওয়া হিসাবে বহুত প্রকার দেখা যায়, রূহ্-ও বাহ্যিক প্রকাশ পাওয়ার দিক দিয়া অনেক রূপ ধারণ করিয়াছে। বাহ্যিক হাজার হাজার পর্দা উঠাইয়া দিতে পারিলে আল্লাহর নূরের ‘মোশাহেদাহ’ করা যায়। এরূপ রূহের বাহ্যিক আবরণ দূর করিতে পারিলে রূহের খাঁটিঁ আলো এক বলিয়া দেখা যায়। এই কারণেই রূহকে আল্লাহ্র হুকুম বলা হইয়াছে।
নবী (দঃ) ফরমাইয়াছেন –
“কাল্লেমেন নাছা আলা কদ্রে অকুলিহিম।”
অর্থাৎ, মানুষের জ্ঞান অনুযায়ী তাহার সাথে কথা বলো; কেননা যাহা সে জানে না, অস্বীকার করিয়া বসিবে। তাহাদের মুখ আছে, কথা বলার শক্তি রাখে। নবী করিম (দ:) আরও বলিয়াছেন, মানুষের মরতবা অনুযায়ী তাহাকে স্থান দাও, এইরূপ আমি নির্দেশিত হইয়াছি।
ইহার বর্ণনা
শরেহ্ ইঁ রা গোফ্তামে মান আজ মরে,
লেকে তরছাম তা না লগজাদ খাতেরে।
নক তাহা চুঁ তেগে পুলা দস্তে তেজ,
গার নাদারী তু ছপর ওয়াপেছ গুরীজ।
পেশে ইঁ আলমাছ বে আছপার মায়া,
কাজ বুরিদান তেগেরা নাবুদ ছায়া।
জি ইঁ ছবাবে মান তেগে করদাম দর গেলাফ।
তাকে কাস্ খানে না খানাদ বরখেলাফ
আমদেম আন্দর তামামী দাছে তাঁ
উ ওফা দারী জমায়া রাছে তাঁ।
অর্থ: মাওলানা বলেন, আমি এই মারেফাত সম্বন্ধে বিস্তারিত ব্যাখ্যা করিতাম, কিন্তু ভয় করি যে, কাহারও অন্তঃকরণ বিগ্ড়াইয়া না যায়। অত্যন্ত সূক্ষ্ম রহস্য। ফালাদ লোহার তরবারীর ন্যায় অত্যন্ত ধারাল। যদি তোমার নিকট ঢাল না থাকে, তবে পিছনে হটিয়া যাওয়াই উত্তম। এত সূক্ষ্মও তীক্ষ্ণ বিষয় ঢাল ব্যতীত আলোচনা করিতে অগ্রসর হওয়া উচিত না। কেননা, তরবারী কাটিতে কখনও লজ্জা বোধ করে না। এই রকমভাবে এই তীক্ষ্ম বিষয় যখন ভ্রান্ত ধারণার অন্তঃকরণে পতিত হইবে, তখন তাহার ঈমান নষ্ট হইয়া যাইবে। এইজন্য আমি আমার তরবারী কোষাবদ্ধ করিয়া রাখিলাম। তাহা হইলে কোনো তেড়া বুঝের লোক বিপদে পড়িবে না। অতএব, আমি সেই কেচ্ছা পূর্ণ করার জন্য মনোনিবেশ করিলাম যাহাতে বর্ণিত হইয়াছে ঐ উজিরের মুরীদরা খাঁটি অন্তঃকরণে উজিরের মুরীদ ছিল এবং কীভাবে তাহারা তাহার অসিয়ত পূর্ণ করিয়াছিল।
প্রতিনিধিত্ব নিয়া শেষ পর্যন্ত লড়াই উপস্থিত হইল এবং সকলের উপর উম্মুক্ত তরবারী চালনা করা হইল
কাজ পাছে ইঁ পেশওয়া বর খাস্তান্দ
বর মাকামাশ, নায়েবে মী খাস্তান্দ।
এক আমিরে জাঁ আমীরানে পেশে রফ্ত
পেশে আঁ কওমে ওফা আন্দেশ রফত্।
গোফ্তে ইঁ নাক নায়েবে আঁ মর্দে মান,
নায়েবে ঈচ্ছা মানাম্ আন্দর জমান্।
ই নাক ইঁ তু মারে বুরহানে মানাস্ত,
কে ইঁ নেয়াবাত বাদে আজওয়ানে মানাস্ত।
আঁ আমীর দীগার আমদ্ আজ কামীন,
দাবীয়ে উদর খেলাফত বুদ হামীন।
আজ বগলে উ নীজ তু মারে নামুদ,
তা বর আমদ হর দোরা খশমো ও জহুদ।
আঁ আমীরানে দীগার এক এক কাতার
বর কাশীদাহ তেগে হায়ে আবদার।
হরি এক রা তেগে ও তু মারে বদস্ত,
দর হাম উফ্ তাদান্দ চু পীলানে মস্ত।
হর আমীরে দাস্তে খায়েল বে কারা,
তেগ হারা বর কাশী দান্দ আজ মিয়াঁ।
ছদ হাজারানে মরদে তরছা কুশতাহ শোদ
তাজে ছার হায়ে বুরিদাহ পোশতাহ শোদ।
খুন রওয়াঁ শোদ হামচু ছায়েল আজ চুপ ও রাস্ত
কোহ কোহ আন্দর হাওয়া আজইঁ গেরদে খাস্ত।
তখ্মা হায়ে ফেত্না হা কো কোশতাহ্ বুদ
আফতে ছার হায়ে ই শাঁ গাশতাহ্ বুদ।
অর্থ: ঘটনা এইরূপ ঘটিল যে, উক্ত উজিরের পরে ঐ নেতারা প্রতিনিধি হইবার জন্য প্রার্থী হইল। এক নেতা নাসারাদের সম্মুখে অগ্রসর হইয়া বলিল, আমি ঈসা (আ:)-এর অসীলায় উজিরের খলিফা নিযুক্ত হইয়াছি। এই কপি আমার প্রতিনিধিত্বের প্রমাণ দেয়। এই কপি অনুযায়ী প্রতিনিধিত্বের দাবীদার আমি। দ্বিতীয় একজন এতক্ষণ চুপ ছিল, বাহির হইয়া বলিল, ’এই খেলাফতের দাবীদার আমি’ এবং সে একখানা তুমার বাহির করিয়া দেখাইল। উভয়েই রাগান্বিত হইয়া একে অন্যের দাবী অস্বীকার করিতে লাগিল। এই রকমভাবে যত নেতা ছিল, প্রত্যেকের পিছনে বহু লস্কর ও সৈন্য-সামন্ত ছিল। খাপ হইতে তরবারী বাহির করিয়া যুদ্ধের জন্য ঝাঁপাইয়া পড়িল। অবশেষে লক্ষ লক্ষ নাসারা নিহত হইল, গর্দান কাটা লাশ পড়িয়া রহিল। রক্তের নদী বহিয়া গেল। চতুর্দিকের বায়ু ধূলিপূর্ণ হইয়া গেল। ঐ ধোকাবাজ উজির শেষ পর্যন্ত নাসারাদের মুণ্ডের আপদ হইয়াছিল।
জুজেহা কাস্ত ও আঁ কো মগজে দাস্ত
বাদে কুস্তানে রূহে পাকে নগজে দাস্ত
কোস্তান ও মুরদান কে বর নক্শে তনাস্ত
চুঁ আনার ও জুজেরা বশে কাস্তা নাস্ত।
চে শীরিনাস্ত উ শোদ ইয়ারে দাংগ,
ও আঁকে বুছিদাস্ত নাবুদ গায়রে বাংগ।
আঁ চে বা মায়ানী আস্ত খোশে পয়দা শওয়াদ,
ও আঁ চে বে মায়ানী আস্ত উ রেছওয়া শওয়াদ।
অর্থ: নাসারাদের মধ্যে কতক লোক উজিরের ধোকার জাল হইতে বাঁচিয়া গিয়াছিল। প্রায়ই সাধারণ বালা-মসীবতের দরুন নেক লোক নিহত হয়। এখানে তাহাদের অবস্থা বর্ণনা করা হইয়াছে। হত্যার দরুন সবগুলি দেহ ধ্বংস হইয়া গিয়াছিল। কিন্তু যাহাদের মধ্যে মেধাশক্তি ছিল, অর্থাৎ, ঈমানের আলোতে অন্তর পরিপূর্ণ ছিল, তাহাদিগকে হত্যায় কোনো ক্ষতি সাধন করিতে পারে নাই। কেননা, তাহাদের অন্তর পবিত্র ছিল। তাহারা দুনিয়ার যন্ত্রণা হইতে মুক্তি পাইয়া গেলেন। আল্লাহ্র মেহেরবানীতে তাহাদের দরজা আরও উন্নত হইল। মাওলানা তাহাদের মৃত্যুর পরের অবস্থা বর্ণনা করিতে যাইয়া বলিতেছেন, তাহাদিগকে হত্যা করা হইয়া থাকুক অথবা এমনি মরিয়া যাইয়া থাকুক, তাহাদের দৃষ্টান্ত হইল আনার বা আখরোটের ন্যায়। ইহাদের মধ্যে যেটি মিষ্টি, সেটিকে ভাঙ্গিয়া দিলে মূল্য অনেক বাড়িয়া যায়। কেননা, তাহার সৌন্দর্য বাহিরে প্রকাশ পায়। আর যেটি খারাপ হয়, সেটির জন্য শুধু কথা কাটাকাটি হয়। এই রকম যখন দেহের উপর মৃত্যু আসিয়া পড়ে, যাহার মধ্যে ঈমানের কামালাত তথা পূর্ণতা থাকে, তাহার প্রশংসা বাড়িয়া যায়। আর যাহার ঈমানের পূর্ণতা থাকে না, সে শাস্তি ও লজ্জা ব্যতীত কিছুই পায় না।
রোও ব মায়ানী কোশ আয় ছুরাত পোরোস্ত,
জা আঁ কে মায়ানী বরতনে ছুরাত পোরোস্ত।
হাম নেশিনে আহলে মায়ানী বাশ্ তা,
হাম আতা ইয়াবি ও হাম বাশী ফাতা।
জানে বে মায়ানী দরী তন বে খেলাফ,
হাস্ত হাম চুঁ তেগে চওবীন দর গেলাফ।
তা গেলাফে আন্দর বুদ বা কী মাতাস্ত,
চুঁ বেরু শোদ ছুখতানরা আলা তাস্ত।
তেগে চওবীনরা মবর্দর কারেজর,
নেগার আউয়াল তানা গরদাদ কারেজার।
গার বুয়াদ চওবীন বরু দীগার তলব,
ওয়াব বুদ আলমাছ পেশে আঁ বা তরব।
তেগে দর জেরাদে খানা আউলিয়াস্ত,
দীদানে ই শাঁ শুমারা কীমিয়া তাস্ত।
অর্থ: যখন প্রমাণ হইয়া গেল যে রূহানী গুণের উপর মর্যাদা নির্ভর করে, শারীরিক গুণের কোনো মূল্য নাই, তাই মাওলানা বলেন, যাও, আত্মার পূর্ণতা হাসেল করার জন্য চেষ্টা কর। চরিত্র, বিশ্বাস ও আল্লাহ্র মহব্বত এবং সততা শিক্ষা কর, শরীরের কার্যকলাপ ইহার মধ্যেই শামেল থাকে। আত্মার পূর্ণতা ব্যতীত যদি শরীরের সৌন্দর্য বাড়ে, তাতে কোনো মূল্য হয় না। কেননা, আত্মার পূর্ণতা শারীরিক হিসাবে পাখনা স্বরূপ। পাখীর যদি পাখা না হয়, তবে সে বেকার সাব্যস্ত হয়। পাখীর যেমন পাখা উড়িবার যন্ত্র, এইরূপ রূহানী শক্তিও দেহের জন্য যন্ত্র-স্বরূপ, আত্মার উন্নতি ও বাতেনী সায়েরের জন্য। আত্মার পবিত্রতার জন্যই মানুষ আল্লাহ্র নেয়ামত বেহেস্ত পাইয়া থাকে। তাই মাওলানা আত্মা পবিত্র করার পদ্ধতি বাতলাইয়া দিতেছেন। তিনি বলেন, আহ্লে বাতেনের (অাধ্যাত্মিক সিদ্ধপুরুষের) সোহ্বত এখ্তিয়ার কর, তবে তুমি আল্লাহ্র দান প্রাপ্ত হইবে এবং সৎসাহসী পুরুষ হইবে। যে প্রাণী আত্মার পূর্ণতা লাভ করিতে পারে নাই, রূহানী গুণাগুণ অর্জন করিতে পারে নাই, সে প্রাণ যেন গেলাফের মধ্যে কাঠের তরবারী লুক্কায়িত। যতক্ষণ পর্যন্ত গেলাফের মধ্যে লুক্কায়িত থাকে, ততক্ষণ পর্যন্ত মূল্যবান তরবারী বলিয়া মনে হয়; যখন বাহির করা হয়, তখন জ্বালানি কাঠ ব্যতীত আর কোনো কাজে আসে না। এই রকমই রূহ যতক্ষণ পর্যন্ত দেহের মধ্যে থাকে, ততক্ষণ দুনিয়াদারদের নিকট কিছু কদর মনে হয়। যখন দেহ হইতে বাহির হইয়া যায়, তখন জাহান্নামের কাঠ ব্যতীত আর কিছুই হয় না। কাঠের তরবারী এত অকাজের যে, উহা নিয়া লড়াইয়ের ময়দানে যাইও না। প্রথম হইতেই উহা দেখিয়া লও। তবে কাজের সময় নষ্ট হইয়া যাইবে না। প্রথমে দেখার সময়েই যদি কাঠের তরবারী বলিয়া অনুমিত হয়, তবে অন্য আর একখানা তালাশ কর। যদি আলমাসের হয়, তবে খুশীর আর সীমা থাকিবে না। মাওলানা বলিতেছেন, তোমার রূহে কামালত না নিয়া হাশরের মাঠে যাইও না। পৃথিবীতে বসিয়া ঠিক করিয়া লও। তাহা হইলে ওখানে লজ্জা পাইবে না। আল্লাহ্র অলিদের কারখানায় ভাল তরবারী পাওয়া যায়। যদ্বারা নফসের সহিত যুদ্ধ করা যায়। অলি-আল্লাহর সাক্ষাৎ মানুষের কাছে স্পর্শ-মণির ন্যায় কাজ করে। খারাপ চরিত্র উত্তম চরিত্রে পরিবর্তিত করিয়া দেয়।
জুমলা দানাইয়ানে হামী গোফ্তাহ হামীঁ,
হাস্তে দানা রহমাতুল লিল আলামীন।
গার আনার মী খরী খান্দাঁ ব খার,
তা দেহাদ খান্দাহ জেদানা উ খবর।
আয় মোবারক খান্দাশ কো আজ দেহান,
মী নুমাইয়াদ দেল চুঁ দুর আজ দুরজে জান।
না মোবারক খান্দাহ আঁ লালা বুদ,
কাজ দেহানে উ ছওয়াদে দেলা নামুদ।
অর্থ: এখানে মাওলানা খাঁটি অলি-আল্লাহর নমুনা বাতলাইয়া দিতেছেন। তিনি বলেন, সমস্ত জ্ঞানী ব্যক্তিরা বলিয়াছেন যে, যদি আনার খরিদ করিতে হয়, তবে খোলা আনার খরিদ কর। তাহা হইলে ইহার ফাটল দানার অবস্থা দেখাইয়া দেয়। জ্ঞানী ব্যক্তিরা মানুষের জন্য দয়াস্বরূপ। মওলানা অতঃপর খোলা আনার সম্বন্ধে বলিতেছেন যে, ইহার ফাটল এমন সুন্দরভাবে হয় যে বাহির হইতে নিজের অন্তঃকরণ, যাহা মুক্তার ন্যায়, উহা দেখা য়ায়। যেমন সিন্দুকের অন্তর্গত প্রাণ দেখা যায়। অর্থাৎ, দেহের মধ্যস্থিত রূহ্ দেখা যায়। এই রকমই হইল খোদার রহমত। আরেফীন লোকে বলিয়াছেন যে, যদি কাহাকেও পীর বানাইতে চাও, তবে তাহাকে জানিয়া লও, তাঁহার সোহবতে বসিয়া কলবে স্বাদ, আলো ও মহব্বতে এলাহী অনুভব করা যায় কি না! তাঁহাদিগকে দেখিবামাত্র আল্লাহ্র স্মরণ আসে। আর যাহারা মিথ্যা দাবীদার, তাহাদের সোহবতে কলব অন্ধকার হইয়া যায়।
মসনবী শরীফ
মূল: মাওলানা জালালউদ্দিন রুমি (রহ:)
অনুবাদক: এ, বি, এম, আবদুল মান্নান
মুমতাজুল মোহদ্দেসীন, কলিকাতা আলিয়া মাদ্রাসা।
সূত্রঃ https://mishukifti.wordpress.com/