জেহাদে আসগর ও জেহাদে আকবর
জেহাদে আসগর ও জেহাদে আকবর -এই দুই মাঝে প্রভেদ নিয়ে আলোচনা:-
জেহাদে আসগর
মহানবীর সঙ্গে কাফেরদের যতগুলো যুদ্ধ হয়েছিল, সেই যুদ্ধগুলো নিছক নিজেদের রক্ষা করার জন্য। কাফেরেরা যখনই আক্রমণ করেছে তখনই প্রতিহত করতে মহানবী বাধ্য হয়েছেন। ইতিহাসের পাতায় এ সকল যুদ্ধকে আমরা কেবল আত্মরক্ষামূলক যুদ্ধ হিসাবেই দেখতে পাই।
তাই প্রতিটি যুদ্ধের পরই মহানবী সাহাবাদের এই বলে উপদেশ দিয়েছেন যে, ‘জেহাদে আসগর তথা ছোট জেহাদ। আরো একটি কথা হল, মহানবী এই অস্ত্রের যুদ্ধকে কখনোই একবারও ‘জেহাদে আকবর’ অথবা ‘জেহাদে কবির বলে ঘোষণা করে যাননি। বেশি উদাহরণ দিয়ে বই বড় না করে তিরমিজি শরীফের একটি হাদিস বর্ণনা করে বিষয়টি পরিষ্কার করে তুলে ধরছি।
মহানবী বলেন- “রাজানা মিনাল জিহাদি সাগিরা ইলাল জিহাদি কাবিরা!” অর্থাৎ: “আমরা ছোট জেহাদ হতে বড় (আকবর) জেহাদের দিকে ফিরে এসেছি।”
তাবুকের যুদ্ধ হতে ফিরে আসার পর মহানবী এই উপদেশ সাহাবাদের দিয়েছিলেন। কাফেরদের বিরুদ্ধে অস্ত্রযুদ্ধে জয়লাভ করাই যদি একমাত্র জেহাদ বলে আমরা ধরে নেই, তাহলে মহানবীর এরকম উপদেশ দেবার অর্থ কী হতে পারে? আর তিনি জেহাদকে ভাগই বা করে দেখালেন কেন? কেন তিনি তাবুকের যুদ্ধকে জেহাদে ছাগীর বললেন? তাহলে জেহাদে আকবর বলতে কী বুঝাতে চেয়েছেন?
নিজের রিপুগুলোর বিরুদ্ধে তথা ইন্দ্রিয়গুলোর বিরুদ্ধে তথা এক কথায় নফসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করাকেই জেহাদে আকবর বলেছেন। এখন কোরানের আগের এবং পেছনের আয়াতগুলোর হুবহু অনুবাদ বার বার মনোযোগ সহকারে পড়ে দেখুন তো, অস্ত্রযুদ্ধের কথাটি থাকা তো দূরে থাক।
বরং নামটি পর্যন্ত উল্লেখ করা হয়নি। তাহলে ‘ইয়াকতালু তথা আল্লাহর জন্য কতল হয়ে যান বলার মধ্যে জেহাদে আকবরের কথাটিই ঘোষণা করা হয়েছে। তবে যদি সত্যিকার অর্থে ধর্মযুদ্ধে কেউ কতল হন, তাহলে কোরানের এই ঘোষণাটি সেই কতল হয়ে যাওয়া মানুষটির জন্যও প্রযোজ্য হবে। উভয় অর্থ গ্রহণীয়, কিন্তু এখানে জেহাদে আকবরের কথাটি তথা নফসের বিরুদ্ধে জেহাদ করাটাই বড় করে তুলে ধরা হয়েছে।
জাহাদা ‘ শব্দ হতে জেহাদ। যার অর্থ করা হয়, কোন কর্মে সর্বশক্তি নিয়োজিত করা।
মহানবী বলেন,
আল মুজাহিদু মান জাহাদা নাফসাহু ফি তা আতিললা অর্থাৎ ‘একমাত্র মোজাহেদ সবসময় নফসের বিরুদ্ধে আল্লাহর এতায়াতের জন্য জেহাদে মশগুল থাকে।
এখন কোরানের পুরো আয়াতটি মিলিয়ে দেখুন তো আপনার মন ও বিবেক কী বলে? যদি মিল পান তাহলে এটা আপনার তকদির, আর যদি মিল না পান তাহলে সেটাও আপনার তকদির নফসের বিরুদ্ধে জেহাদের বিষয়টি নিয়ে আরো অনেক কথা তুলে ধরা যেত, কিন্তু যাদের লাভ হবার তাদের জন্য এই সামান্য ব্যাখ্যাটিই যথেষ্ট মনে করি, আর যাদের হবার নয় তাদের এক বস্তা উদাহরণ তুলে ধরলেও যেরকম তেমনই থেকে যাবে। কারণ তকদিরে না থাকলে আমি কী করতে পারি?
ইমাম গাজ্জালীর মোকাশেফাতুল কুলুব নামক বিখ্যাত বইটির ২১৩ পৃষ্ঠায় কী বলা হয়েছে। বলা হয়েছে, একবার জেহাদ হতে একদল মুসলমান সবে মাত্র ফিরে আসায় মহানবী বললেন, ‘মারহানা এবং সেই সঙ্গে এটাও বলে দিলেন যে, ছোট জেহাদ হতে তোমরা বড় জেহাদের দিকে এসেছ। তখন মহানবীকে প্রশ্ন করা হল, ইয়া রাসুলাল্লাহ! জেহাদে আকবর বলতে কী বুঝায়? মহানবী বললেন, নিজের নফসের বিরুদ্ধে জেহাদ করাকেই বলা হয় জেহাদে আকবর তাই যারা আল্লাহর জন্য কতল হয়েছেন, যারা ফানাফিল্লাহ হয়েছেন,
যারা মরার আগেই মারা গেছেন, তাদেরকে সবচাইতে সাংঘাতিক উপাধি এবং সম্মানের মুকুট পরিয়ে দিয়েছেন এই বলে যে, তারাই হল ‘বাল আহইয়া’ ‘বরং তারা জীবিত’। এত বড় সম্মান পাওয়ার অর্থই হল কোরানে বর্ণিত সবচাইতে বড় সম্মানটি পাওয়া। কারণ আপেক্ষিক অর্থে নয়, কিছুদিনের জন্য নয়, বরং সার্বিক অর্থে, সব সময়ের জন্য তথ্য চিরন্তন জীবন লাভ করেছেন।
কোরানে বর্ণিত এই চিরন্তন জীবন যিনি লাভ করতে পেরেছেন তাকে দুনিয়ার মানুষের সামনে দেখানো হবে যদি ঘোষণা করা হয়, তা হলে সেই চিরন্তন মানুষটির রূপ দেখে দুনিয়ার মানুষেরা হয়তো হাসবে, টিটকারী করে হয়তো বলতে চাইবে যে, এই মানুষটিতো আমাদের মতই একজন মানুষ।
আরো হয়তো বলতে পারে, আমাদের মধ্যে এর চেয়েও শত রূপগুণে অনেক মানুষ আছে। হাঁ, তাদের জন্ডিস রোগের হলুদ চোখে তাই দেখবে। কারণ, তারা রূপ বলতে চামড়া আর মুখের আকৃতি দিয়ে বিচার করবে, আর শুণ বলতে মালপানি, নেতা, বড় বড় ডিগ্রীধারীদের দিয়ে বিচার করবে। এই রকম বিচার দেখে চিরন্তন জীবনের উপহার পেয়ে যারা পীরে কামেল তারা চুপ করেই থাকেন। কারণ তাদের বলার অনেক কিছু থাকলেও বলতে চান না, অথবা জানেন যে, যত সুন্দর করেই বুঝিয়ে বলি না কেন, তারা বুঝতে চাইবে না। কেন? এটা যে তাদের তকদিরের লিখন।
চামড়া আর আকৃতির রূপ দিয়ে কিন্তু এরাই আবার তাদের বিষয়ে তারাই বিচার করে না। এটা শুনে হয়তো অবাক হচ্ছেন, তাই না? তারা ভাল করেই জানে যে, কোকিলকণ্ঠী লতা মুঙ্গেশকর এবং সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের গানগুলো শুনতে কত মধুর, অথচ তত মধুর কি তাদের চেহারা-সুরত দেখতে? তারা এটা ভাল করেই জানে যে, কেবল গানের বেলায় নয়, যে কোন বিষয়ের বেলায় এরকম বিরাট গড়মিলটি বার বার দেখতে পাচ্ছে, অথচ চিরন্তন জীবনের উপহার পাওয়া পীরে কামেলদেরকে বিশ্বাস করতে পারছে না কেন? তকদিরের লিখন।
জেহাদে আকবর
তকদির বদলায় না, কিন্তু তখনই বদলাতে পারে যদি এই চিরন্তন জীবন পাওয়া পীর-ফকিরেরা দোয়া করেন তথা নেক নজর দান করেন, তথা ফয়েজ দান করেন, তথা যখন কেউ মুরিদ হয়ে তাঁর কথা মত কাজ করেন,
- ১. তথা তাঁকে ধ্যান করেন,
- ২. তাঁর চোখ, মুখ, হাত, পা, সবকিছু মনে মনে ধ্যান করেন,
- ৩. আমার মধ্যেই তিনি,
- ৪. আমি দেখছি না, তিনি দেখছেন,
- ৫. আমি শুনছি না, তিনি শুনছেন,
- ৬. আমি খাই না, তিনি খাচ্ছেন,
- ৭. আমি চলি না, তিনি চলছেন,
- ৮. আমি ঘুমাই না, তিনি ঘুমাচ্ছেন,
- ৯. আমি হাসছি না, তিনি হাসছেন,
- ১০. আমি কাদছি না, তিনি কাঁদছেন,
- ১১. আমি প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিচ্ছি না, তিনি দিচ্ছেন,
- ১২আমি দুঃখ পাচ্ছি না, তিনি দুঃখ পাচ্ছেন,
- ১৩. আমাকে মারছে না, তাঁকে মারছে,
- ১৪.আমাকে ঠাট্টা করা হচ্ছে না, তাঁকে ঠাট্টা করা হচ্ছে
এভাবে প্রতিটি কাজে-কর্মে চলা-ফেরায়, আচার-ব্যবহারে যখন তাঁর ধ্যান করতে করতে আপনি আর আপনার মধ্যে থাকবেন না, সম্পূর্ণ তিনি হয়ে যাবেন, তখনই আপনি সম্পূর্ণরূপে থাকবেন, তথা তার মত চিরন্তন জীবন পেয়ে আপনিও পীরে কামেল হয়ে যাবেন এবং এই পীরে কামেল হওয়াটা আপনার তকদিরের সবচাইতে বড় পাওয়া। এই ধ্যানের নামই বৈরাগ্য সাধন। বৈরাগ্য সাধনের শেষ পর্বটিই হল মুক্তি চক্রাকারে আগমনের পরিত্রাণ হল এর নাম।
এই ধ্যান কর্মের মাঝে নিয়োজিত থেকেও করা যায়, সংসার জীবন পালন করেও করা যায়, আবার সংসার জীবন পালন না করেও করা যায়। ঘর ছেড়ে দিতে পারলেই বৈরাগ্য হয় না, আমার এই ‘আমি আমি’ ভাবটি ত্যাগ করতে পারলেই হয় বৈরাগ্য সংসারধর্ম ত্যাগ করতেই হবে এরকম কথা ইসলামে বলা হয়নি ত্যাগ করা না করা যার যার নিজস্ব বিষয়। এখানে বাধ্যবাধকতা নেই।
বাধ্য যারা করতে বলেন এটা তাদের নিজেদের বানানো আইন। ইহা কখনোই ইসলামের আইন নয়। কারণ ইসলামে বলপ্রয়োগ নেই। বাহির এবং ভেতর উভয় দিকের একটিতেও বলপ্রয়োগ একদম মানা করে দেওয়া হয়েছে। চিরন্তন জীবন পারার সৌভাগ্য যাদের হয়েছে তাদেরকে আবার অলী, আবদাল, কুতুব, দরবেশ, পীর, ফকির, মুনি, ঋষি, মোমিন ইত্যাদি নামে ডাকা হয়। এরা সবাই মিলে এক, আবার একই হয় বহু। অনেকটা একের মাঝে দশ, আবার দশের মাঝে এক এক ক্যাসেটের কথা ও গান দিয়ে অনেক ক্যাসেট বানানো যায়। বহু হলে কী হবে, মূলে একই কথা ও গান।
এই মারেফতের গোপন আলাপটি যিনি পরিষ্কার বুঝতে পেরেছেন যে, কোরানে কেন আল্লাহ একবার আমি বলছেন আবার আমরা বলেছেন। সবখানেই যদি আমরা শব্দটি ব্যবহার করা হতো তা হলে না হয় মনে করতাম যে এটা কোরানের একটি বাচনিক স্টাইল, কিন্তু একবার আমি আবার আমরা এ কেমন কথা? তাও আবার কয়টি বিশেষ বিশেষ বিষয় বলার সময় তিনি আমরা রূপে (আল্লাহ্) বলেন, আবার বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে আমি (আল্লাহ্) বলেছেন।।
সুত্রঃ সুফিবাদ আত্মপরিচয়ের একমাত্র পথ (চতুর্থ খন্ড)
লেখক- কালান্দার জাহাঙ্গীর আল সুরেশ্বরী (রহঃ)