হোমপেজ কারবালা ও ইমাম হোসাইন কারবালায় ইমাম হোসাইন (আ:) এর শেষ ভাষণ

কারবালায় ইমাম হোসাইন (আ:) এর শেষ ভাষণ

1157

কারবালায় ইমাম হোসাইন (আঃ) এর শেষ ভাষণ

কারবালার মাঠে একে একে যখন সবাই শাহাদাত বরণ করেছেন এবং হজরত ইমাম হােসেন আঃ যখন কেবল একা দাড়িয়ে ছিলেন তখন তার শেষ কয়টি কথার কিছু অংশ অনুবাদ করলাম:

কেন আমাকে হত্যা করতে চাও? আমি কি কোনাে পাপ অথবা অপরাধ করেছি? এজিদের সৈন্যবাহিনী বােবার মত দাড়িয়ে রইলাে। পুনরায় ইমাম হােসেন আঃ বললেন, ‘আমাকে হত্যা করলে আল্লাহর কাছে কী জবাব দেবে? কী জবাব দেবে বিচার দিবসে মহানবীর কাছে? এজিদের সৈন্যবাহিনী পাথরের মত দাঁড়িয়ে আছে।

আবার ইমাম হোসেন আঃ বলেন,
“হাল মিন নাসরিন ইয়ানসুরুনা?”

অর্থাৎ- “আমাদের সাহায্য করার মত কি তােমাদের মধ্যে একজনও নেই?”

তারপরের আহ্বানটি সাংঘাতিক মারাত্মক। ঐতিহাসিকদের মতে এটাই ইমাম হােসেন আঃ এর শেষ আহ্বান।

আলাম তাসমাও? আলাইসা ফিকুম মুসলিমু?

অর্থাৎ- “আমার কথা কি শুনতে পাও না? তােমাদের মাঝে কি মাত্র একজনও মুসলমান নেই?”

ইমাম হােসেনের এই শেষ ভাষণটি মাত্র একটি ছােট্ট বাক্য। অথচ এর ব্যাখ্যা যদি কাঁচ ভাঙার মত টুকরাে টুকরাে করে দেখাতে চাই তাহলে সেই বাক্যাটি হবে খুবই বেদনাদায়ক।

তাই বেশি কথা না বলে শেষ বাক্যটির সামান্য ব্যাখ্যা দিয়েই শেষ করতে চাই।

খাজা বাবা মইনুদ্দিন চিস্তি (রহ:) যেমন বলেছেন, ইমাম হােসেন আঃ আসল এবং নকলের ভাগটি পরিষ্কার করে দেখিয়ে গেলেন, সে রকমই অর্থ বহন করছে ইমাম হােসেন আঃ এর শেষ ভাষণটিতে।

কারণ, এজিদের সৈন্যবাহিনীতে একজন হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান অথবা অন্য কোনাে ধর্মের কেউ ছিল না। সবাই ছিল মুসলমান। অথচ কী সাংঘাতিক এবং জয়ন্তীর ভাষণ-তোমাদের মাঝে কি একটি মুসলমানও নেই?

এজিদের সৈন্যবাহিনীর সবাই মুসলমান, এটা অধম লেখকের কথা নয় বরং যে কোন বিজ্ঞ আলেমকে প্রশ্ন করে দেখুন। অথচ ইমাম হােসেন আঃ এ কী তাক লাগানাে কথা বলছেন, ‘তােমাদের মাঝে কি মাত্র একজনও মুসলমান নেই?

না, একটিও সত্যিকার আসল মুসলমান ছিল না বলেই ইমাম হােসেন আঃ এই আহ্বান জানিয়ে পৃথিবীকে চোখে আঙ্গুল দিয়ে বুঝিয়ে দিয়ে গেলেন। তিনি বুঝিয়ে দিয়ে গেলেন যে, যারা দাঁড়িয়ে আছে তারা সবাই নকল মুসলমান। বাজারের চালু আসল মালকে যেমন হুবহু নকল করে জনতাকে ধোকা দেয় সে রকম এরা নকল মুসলমান হয়ে সরল জনতাকে ধোকা দিয়ে যায় এবং এই ধোকার ফাঁদে অনেক বিজ্ঞজনও মনের অজান্তে পা-খানা বাড়িয়ে দেন।

বাজারে গিয়ে অনেক বিজ্ঞজনও নকল মাল কেনার ফাঁদে পড়ে যান, সে রকম অবস্থার শিকারও বলতে পারেন। আসল আর নকল চেনবার বিদ্যা রপ্ত করতে হয়, যদিও বিদ্যার প্রশ্নে তা সামান্য। যেমন বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের সবচাইতে বড় অধ্যাপককে জায়গাজমি কেনার দলিল লিখতে বললে অক্ষমতা প্রকাশ করবেন, অথচ সেই দলিল লিখছে নবম কিংবা তার নিচের শ্রেণীতে পাঠ করা দলিল-লেখক। তাই আসল আর নকলকে চিনতে হলে একটা বিশেষ জ্ঞানের প্রয়ােজন হয় অনেক ক্ষেত্রে। তবে সবার জন্য অবশ্যই নয়।

এখন মূল বিষয়টির দিকে আমরা ফিরে আসছি। সেই মূল বিষয়টি হল, হজরত ওয়ায়েস করনি কিন্তু মহানবীকে সঃ কোন প্রকার সাহায্য সহযােগিতা করা তো দূরে থাক জীবনে একবার জাহেরি চোখে দেখার ভাগ্যও হয়নি। তাই তাকে সাহাবার খেতাব হতে বাদ দেওয়া হয়, অথচ কোন কারণ নেই, কোন যুক্তি নেই, কোন প্রশ্ন আর সংশয়ের দোলা নেই, কেবলমাত্র মহানবীর প্রতি ভালবাসার দরুন তিনি একে একে সব কটি দাঁত পাথরের আঘাতে ভেংগে ফেললেন।

কেন ভাঙলেন? এই প্রশ্নের উত্তর খোজা বৃথা। কারণ যুক্তির ব্যাখ্যা দেওয়া যায়, কিন্তু ভালােবাসা আর বিশ্বাসের ব্যাখ্যা দেওয়া যায় না এবং এর ব্যাখ্যা নেই। হজরত ওয়ায়েস করনির মনপ্রাণ জুড়ে মহানবীর প্রতি কতটুকু ভালবাসা থাকলে দাঁত ভেঙ্গে রক্ত ঝরাতে পারেন।

হয়তাে যুক্তিতর্কের মানদণ্ডে এই ভালবাসার মূল্যায়ন কতটুকু তা বলতে পারবাে না তবে এটুকু অন্তত বলতে চাই যে, ভালবাসাকে ভালবাসা দিয়েই মাপতে হয়। অনেকে হয়তাে বলতে চাইবেন যে, এ রকম দাঁত ভেঙে ফেলার ভালবাসার কী মূল্য থাকতে পারে? এর উত্তর দিতে চাই না এ জন্যই যে, এ রকম প্রশ্ন তােলার কিছু মানুষ না থাকলে ভালবাসার রূপটি একঘেয়েমিতে পরিণত হয়। বিচিত্রতার ঝাকুনি থাকে না।

তাই মহানবী তাঁর নিজের জুব্বা মােবারক দিয়ে এই ভালবাসার মূল্যায়ন করেছেন। এখন আর একটি বিরাট প্রশ্ন তুলতে চাই যে, মহানবী যে ইমাম হােসেন আঃ কে কতটুকু ভালবাসতেন তার সামান্য নমুনা আগেই তুলে ধরেছি। তবু একটি কথা আবার মনে করিয়ে দিতে চাই যে, মহানবী বলেছেন যে, বেহেস্তের দুইজন সরদার হলেন হাসান এবং হােসায়েন এবং তিনি অন্য আর একটি হাদিসে বলেছেন যে, হােসায়েন কে যারা ভালবাসে তারা হােসায়েনের সঙ্গে থাকবে তথা বেহেস্তে থাকবে।

এখন একটি প্রশ্ন আসতে পারে তা হল, ইমাম হােসেনের আঃ কারবালার মাঠে সবচেয়ে বেদনাদায়ক শাহাদাত
বরণের শােকে ইমাম হােসেনের আঃ জন্য শোকের মাতম তুলে, বুক চাপড়িয়ে, ছােট ছােট চাকুর ছড়া দিয়ে পিঠে আঘাত করে হায় হােসেন, হায় হােসেন বলে রক্ত ঝরায়, তাহলে ইমাম হােসেন এই ভালবাসার জন্য কি কিছুই দেবেন না? কারণ নিরেট ভালবাসা এবং এই ভালবাসার ব্যাখ্যা ও যুক্তি উভয়ই সম্পূর্ণরূপে বেকার। ইমাম হােসেনের ভালবাসায় কেউ মাতম না করলেও বলার কিছু থাকে না। কারণ এটা ব্যক্তিগত ব্যাপার। তা ছাড়া ভালবাসা তৈরি করা যায় না। আর যারা ইমাম হােসেনের ভালবাসায় মাতম করে, রক্ত ঝরায় তাদেরকেও বলার কিছুই থাকে না।

কারণ, যুক্তি ও ব্যাখ্যার যেখানে কবর বা শেষ, ভালবাসা সেখান থেকেই আরম্ভ হয়। এটা হৃদয় দিয়ে বুঝতে হয় মাথা দিয়ে নয়। যুগে যুগে সব সময়ে এই মর্ত্যে একশ্রেণীর মানুষ বুঝে মাথা দিয়ে, আর একশ্রেণী বুঝে হদয় দিয়ে। কাউকেই তুচ্ছ করা যায় না। কারণ এই দ্বান্দিক পদ্ধতিতেই সব কিছুর রহস্য লুকিয়ে আছে।

কেউ বুঝে, কেউ বুঝে না। তাই কাউকেই দোষারােপ না করে এটা যার যার তকদিরের লিখন বললেই সুন্দর মানায়।

[সুএঃ মারেফতের বানী]
লেখক- কালান্দার বাবা জাহাঙ্গীর আল সুরেশ্বরী (রহঃ)