জন্মান্তরবাদ (পর্ব-০৬)
বৌদ্ধ ধর্ম হচ্ছে সাধনের উপর নির্ভর করে বাসনা থেকে মুক্তির একটা ধর্ম। ইচ্ছেপোষণ করলাম সকল ধর্মের ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে পুনুরুত্থান, জন্মান্তরবাদ এবং নির্বাণ সম্পর্কে লিখব যদিও রাহাত ভাই শুরু করেছেন তাই আমি অন্যদিকটাই তুলে ধরব আশা রাখছি। প্রথমেই বৌদ্ধ ধর্মে নির্বাণ সম্পর্কে লিখব।
মহামতি বুদ্ধ বুদ্ধত্ব লাভ করার পরই বললেন- “হে গৃহকারক আমি তোমাকে জন্ম জন্মান্তর ধরে খুঁজছি কিন্তু তোমার সন্ধান পাইনি।আজ তোমার সন্ধান পেয়েছি। আমি তোমাকে ধ্বংস করেছি। আর তুমি দেহরুপ গৃহকে ধারণ করে আমাকে কষ্ট দিতে পারবেনা।”
বুদ্ধ সেদিন তৃষ্ণার নির্বাণ ঘটিয়েছিলেন। তাই তিনি আর জন্মগ্রহণ করবেন না বলেছিলেন। কর্ম বিমুক্তি হলে তৃষ্ণা বিমুক্তি হয় এবং জন্মনিরোধ হয়। জন্মনিরোধ হলে একত্রিশ লোকভূমির কোন ভূমিতে জন্মগ্রহণ করেনা।জন্ম-মৃত্যু স্বাধীন হয়। দেহ অন্তর জ্বালা শেষ হয়। এটাই হচ্ছে বৌদ্ধ ধর্মের মূল কথা। তাই বলা হয়-নিব্বানং পরম সুখ।
একত্রিশ লোকভূমি কি:
এক জন্মচক্রাবলে একত্রিশ লোকভূমি থাকে। লোক বলতে জগৎ বা স্থান (realm)। একত্রিশ লোকভূমিতে চার অপায়, একটি মনুষ্যলোক, ছয়টি স্বর্গলোক, ও বিশটি ব্রহ্মলোক।
চার অপায় হচ্ছে: তীর্যক, অসুর, প্রেত ও নরক।
১. তীর্যকলোক:
তীর্যক লোক বলতে মানুষব্যাতীত অন্যপ্রাণী বর্তমান আছে। বাকী তিন অপায়েই মানুষ আছে। এ তীর্যক লোকের আয়ু অনন্ত, অন্যান্য লোকের আয়ু নির্দিষ্ট। এখানে এক প্রাণী আরেক প্রাণীকে বধ করে বিধায় তীর্যক বৃদ্ধিপায়। গৌতম বুদ্ধের একটি উদাহরণ দিয়ে শেষ করছি- একটি কচ্ছপ সমুদ্রের নীচ থেকে একশ বছর পর পর সমুদ্রের নীচ থেকে উপরে উঠে একটি যোয়াল দেখতে পেলে যোয়ালের ছিদ্র দিয়ে মাথা ঢোকাতে চেষ্টা করে ঐ যোয়ালের ছিদ্র দিয়ে মাথা ঢোকাতে পারলেই সে কচ্ছপ কুল থেকে মুক্তি পেয়ে অন্য কুলে যেতে পারবে তবে আশা ক্ষীণ। যারা সবসময় রাগ দেখায় ওরা সাপ কুল থেকে জন্মগ্রহণকারী। সকল মানুষ সর্বদা অলসভাবে ঘুমিয়ে কাটায় তারা সরিসৃপ জাতি প্রাণী থেকে মুক্তি পেয়ে মনুষ্যলোকে জন্মগ্রহণ করেছে। এ রকম অসংখ্য উদাহরণ দেয়া যাবে। আর কোন আত্মা যখন মানুষ রুপে আসে যে কুল থেকে আসে সে কুলের স্বভাব কিছুটা হলেও দেখা যায়।
কয়েকটি তীর্যক প্রাণী:– বানর, বাঘ, ভাল্লুক, সিংহ, হায়না, মাছ, কুমীর ইত্যাদি। তবে তীর্যক লোক এতটুকুই জানা যথেষ্ট।
২. অসুরলোক:
যারা পৃথিবীতে সব সময় মারামারি-কাটাকাটি, সন্ত্রাস এবং শক্তি প্রয়োগ করে বেড়ায় তারা অসুর লোক উৎপন্ন করে বা জন্মনেয় সেথা। এখানে একে অপরের আঘাত দ্বারা অসহ্য যন্ত্রণা ভোগ করে। হাত-পা, মাথা কাটা যাওয়ার পর আবার জোড়া লাগে সেখানে। নির্দিষ্ট সময় না হওয়া পর্যন্ত মরেনা। নির্দিষ্ট সময় হলে পরে অসুরলোক চ্যুত হয়ে নানা যোনী বা লোকে উৎপন্ন হয়। এরাই দুনিয়ায় সন্ত্রাসী ও ঝগড়াটে লোক।
৩. প্রেতলোক:
প্রেতরা সর্বদা ক্ষুধার জ্বালায় জ্বলতে থাকে। পোশাক পরিচ্ছদ নোংরা থাকে নর্দমায় এরা পরে থাকে। ইহ জীবনে যারা খাই খাই স্বভাবের, কৃপন, খাবারের প্রতি লোভ, হিংসা, ধর্মীয় এবং শিক্ষাখাতের টাকা আত্মসাৎ করে, দানীয় বস্তু ভোগ করে এরাই প্রেত লোকে উৎপন্ন হয়। যারা মৃত্যুর সময় চর্মসার, কঙ্কাল, ও ক্ষুধার্ত প্রাণীর দৃশ্য বা তালোয়ার দেখে তারা ২২টি প্রেতলোকে কর্ম অনুযায়ী উৎপন্ন হয়।
৪. নরক:
নরক দু:খ যন্ত্রণাদায়ক ও কষ্টকর। আটটি মহানরক আছে। লেখার কলবর বড় হওয়াতে সংক্ষেপে লেখা। প্রত্যেক মহানরকের চারটা কোণ ও দরজা রয়েছে। লোহা দ্বারা নির্মিত। দাউ দাউ করে জ্বলছে। নরকে কোন কোন নারকীদের দেহ ৩ মাইল ৩২০ গজের কম বেশীও আছে। যারা ব্যাভিচারী, প্রতারক ও কর্কশভাষী, ঘুষ খোর, শিকারী, জীবিত প্রাণী দগ্ধ করে, নেশা করে, অপরকে কষ্ট দেয়, ওজনে কম দেয়, চুরি করে, মিথ্যাবাদী, পুর্ণজন্মে বিশ্বাস করেনা, অন্যের জমি ভোগ করে তারাই নরকবাসী।
৫. ব্রহ্মলোক:
ব্রহ্মলোক ২০ টি। স্বর্গলোকের উপর ব্রহ্মলোক অবস্থিত। যারা ধ্যানী তারা এ লোকে উৎপন্ন হন। এখানে অধ্যানী উৎপন্ন হয়না। কারন ব্রহ্মলোক কাম লোক নয়। কামলোক হচ্ছে স্বর্গ হতে নীচের ভূমিগুলো। ধ্যানের কতগুলো ধাপ আছে বিতর্ক, বিচার, প্রীতি, সুখ ও একাগ্রতা। ধ্যানীরা এই চারটি ধাপ এবং বিদর্শণ ধ্যানের মাধ্যমে যারা অনুগামী ফল লাভ করেন তারা ব্রহ্মলোকে জন্মগ্রহণ করেন। কেউ ৫ বার কেউ ৭ বার।
৬. স্বর্গলোক:
স্বর্গলোক মোট ৬টি। কোনটার আয়ুস্কাল ১২১ কোটি ৬০ লক্ষ বছর, কোনটা ২৩০ কোটি ৬০ লক্ষ বছর আবার কোনটা ৫৭ কোটি ৬০ লক্ষ বছর। এ লোকে কর্ম অনুযায়ী আয়ুস্কাল প্রাপ্ত হয়। বোধি সত্ত্বা গন, তাদের পিতামাতা, মহাপূণ্যবানব্যাক্তি এ স্বর্গে উৎপন্ন হন। দেবতারাই এখানে অবস্থান করেন তবে তারা এখান থেকে সর্বলোকে স্বেচ্ছায় ভ্রমণ এবং জন্মগ্রহণ করেন।
৭. মনুষ্যলোক:
এটা বলার কিছুই নেই এখানে সবাই বর্তমান। যারা পূণ্যবান সত্ত্বা তারা এ ভূমিতে জন্মগ্রহণ করেন। সুদীর্ঘ সময় ধরে চারি অপায়ে পাপ ভোগের পরও এ ভূমিতে জন্মগ্রহণ করে। স্বর্গলোক আর ব্রহ্মলোকের আয়ু শেষ হলেও সত্ত্বগণ এ লোকে জন্মগ্রহণ করে।
নির্বাণ লাভের উপায়ঃ-
দু:খ নিবৃত্তি তথা জন্ম নিরোধে বৌদ্ধ ধর্মে প্রধান কাজ হচ্ছে প্রতিটি মানুষের শীলময় জীবন গঠন করা। শীল অর্থ চরিত্র। এটাই বৌদ্ধ ধর্মের মূল স্তম্ভ।
কয়েক প্রকারের শীলের মধ্যে প্রধান হচ্ছে:
(১) পঞ্চশীল, (২) অষ্টাশীল, (৩) দশশীল, (৪) ২২৭ শীল, (৫) ৫১০ শীল।
এর মধ্যে পঞ্চশীল আর অষ্টাশীল হল গৃহবাসীদের জন্য।
পঞ্চশীল:
- (১) প্রানী হত্যা থেকে বিরত থাকা।
- (২) চুরি করা থেকে বিরত থাকা।
- (৩) ব্যাভিচার থেকে বিরত থাকা।
- (৪) মিথ্যা কথা বলা থেকে বিরত থাকা।
- (৫) নেশা থেকে বিরত থাকা।
অষ্টাশীল:
- (১) প্রানী হত্যা থেকে বিরত থাকা।
- (২)পরদ্রব্য হরণ থেকে বিরত থাকা।
- (৩)ব্রহ্মাচার্য পালন করা।
- (৪) মিথ্যা কথা বলা থেকে বিরত থাকা।
- (৫)নেশা থেকে বিরত থাকা।
- (৬)বিকাল ভোজন (দিনের ১২টা থেকে ভোর ৪ টা পর্যন্ত) হতে বিরত থাকা।
- (৭) নাচ-গান বাদ্য দর্শণ ও শ্রবন সুগন্ধি বিলেপন হতে বিরত থাকা।
- (৮) উচ্চ শয়ন ও মহাশয়ন হতে বিরত থাকা।
আশাকরি বৌদ্ধ ধর্মের নির্বাণ সম্পর্কে কিছুটা ধারণা দিতে পেরেছি।
» জন্মান্তরবাদ (সবগুলো পর্ব পড়ুন)
লেখকঃ শ্রদ্ধেয় গুরুভাই (Md Anwar Hossain)