আনুষ্ঠানিক সেজদা না করিয়াও প্রকৃত সেজদা হইতে পারে।
আদমকে সেজদা করা প্রসঙ্গে কেহ হয়তো প্রশ্ন করিবেন, এই ব্যাখ্যাই যদি সত্য হয় তাহা হইলে রসুলাল্লাহ (আ.)-কে এবং তাঁহার প্রতিনিধিস্থানীয় লোককে সেজদা করিবার ব্যবস্থা রসুলাল্লাহ (আ.) কেন তাঁহার শরীয়তে অনুষ্ঠান হিসাবে রাখিলেন না?
উত্তর: ধর্ম ব্যবস্থার দুইটি অংশ আছে। একটি উহার মূলনীতি আর একটি সেই মূলনীতিকে প্রতিষ্ঠা করিবার জন্য উহার আনুষ্ঠানিক নিয়ম। আনুষ্ঠানিকভাবে মস্তক অবনত করিলেই সেজদা হয় না। আত্নসমর্পণ করিয়া নিজের অস্তিত্বকে কোনো কিছুতে ভুলিয়া যাওয়াই তাঁহার প্রতি সেজদা বুঝায়। ফানা ফিসশেখ এবং ফানাফির রসুলই শেখের প্রতি এবং রসুলের প্রতি প্রকৃত সেজদা। আনুষ্ঠানিক সেজদা না করিয়াও প্রকৃত সেজদা হইতে পারে।
আনুষ্ঠানিকভাবে রসুলাল্লাহ (আ.) সেজদা গ্রহণ করিলে এইরূপ সেজদার সামাজিক অপপ্রয়োগ হইত। মোল্লা-মৌলভী হইতে আরম্ভ করিয়া রাজা-বাদশা অনেকেই আনুষ্ঠানিক সেজদা গ্রহণ করিত এবং তাহা সমাজে বাধ্যতামূলক হইয়া কদাকারণরূপ ধারণ করিত। ফলত যেই মুর্তিপূজা রসুলাল্লাহ (আ.) উচ্ছেদ করিতে চাহেন সেই মূর্তিপূজার প্রতিষ্ঠাই নবরূপে করা হইত। ইহাতে মূর্তিপূজারী অবিশ্বাসীরা রসুলাল্লাহ (আ.) প্রবর্তিত ইসলামকে ভুল বুঝিত।
রসুলাল্লাহ (আ.) -এর পরবর্তীকালে এইরূপ অনেক ঘটনা ঘটিয়াছে যেইখানে এক মহাপুরুষ অন্য একজন মহাপুরুষকে আনুষ্ঠানিক প্রকাশ্য সেজদা করিয়াছে। ইহাতে তাঁহাদের কোনো অপরাধ হয় নাই বরং ঐরূপ না করিলেই প্রকৃতপক্ষে অপরাধ হইত। সামাজিক রীতি হিসাবে ইসলামে ইহা গৃহীত না হইলেও যদি কেহ ঐরূপ করে তবে তাহা মোটেই অন্যায় হইবে না। যাঁহারা কামেল পীরকে এইরূপ সেজদা করেন তাঁহারা সমাজের সাধারণ লোকদিগকে একপ্রকার বুঝ দিবার জন্য উহাকে ‘ তাজিমী সেজদা ‘ (সেজদায়ে তাহিয়া) বলিয়া প্রকাশ করিয়া থাকেন, কিন্তুু কোরান মতে উহা তাজিমী সেজদা নহে বরং উহা দাসত্বের সেজদা। অবশ্য উচ্চাঙ্গের সত্যকে কিছুটা আবরণের মধ্যে রাখা জ্ঞানীলোকের লক্ষণ।
আদমকে সেজদা করিবার আদেশটি ‘তাজিমী সেজদা’ নহে, উহা দাসত্বের সেজদা। আল্লাহকে শুধু তাজিম করিলে হয় না, দাসত্বও করিতে হয়। সেজদা কখনো দুই হইতে পারে না, সেজদা একটাই। রসুলাল্লাহ (আ.) খোদা নহেন, খোদা হইতে জুদাও নহেন। খোদাকে পাইতে চাহিলে আনুগত্য ও আত্নসমর্পণ (অর্থাৎ প্রকৃত সেজদা) রসুলাল্লাহ (আ.)-এর নিকটই করিতে হইবে, নতুবা সেই সেজদা আল্লাহর নিকট পৌঁছে না। মস্তক অবনত করা? সেটা তো জাহেরী সেজদা মাত্র। উহা প্রতিষ্ঠা করিবার প্রয়োজনীয়তার মধ্যে তিনি গুরুত্ব স্থাপন করেন নাই, সেইজন্য আনুষ্ঠানিকভাবে উহা পালন করা বাদ দিয়াছেন। কিন্তুু যদি কেহ ঐরূপ করেন তাহা হইলে মূলনীতির সঙ্গে কোনোরূপ অসমাঞ্জস্যের সৃষ্টি মোটেই করে না। এইজন্য ইহা শরীয়তসিদ্ধ।
কিন্তুু যেইহেতু ইহা রসুলাল্লাহ (আ.) তাঁহার আনুষ্ঠানিক শরীয়তে প্রচলন করেন নাই সেইহেতু ইহা অনুষ্ঠান হিসাবে সাধারণভাবে রাখা চলিবে না। অবশ্য রসুলাল্লাহ (আ.) সত্যিকার প্রতিনিধিস্থানীয় কোনো মহাপুরুষ যদি তাঁহার অনুগত লোকদের মধ্যে চালু করেন তবে তাহা নিশ্চয় নির্দোষ। শুধু নির্দোষ নহে বরং কল্যাণপ্রসূ। এইরূপ একজন মহাপুরুষ রসুলাল্লাহ (আ.)-এর অনুমতি ব্যতীত কিছুই করেন না, কারণ তিনি রসুলের সঙ্গে সংযুক্ত এবং তাঁহার প্রতক্ষ্য নির্দেশের মধ্যে বাস করেন।
আল্লাহর সঙ্গে সহজে মিলন কামনা রাখিলে বাহিরের আনুষ্ঠানিক সেজদা না করিলেও আনুগত্য ও আত্নসমর্পণ অবশ্যই তাঁহার নিকট (কামেল মোর্শেদের নিকট) করিতে হইবে। সেজদার বাহ্যিক আনুষ্ঠানিক অংশটুকু প্রবর্তন করা নির্দোষ হইলেও উহা প্রয়োজনের অতিরিক্ত, কিন্তুু বেদাত নহে। শেরেক হওয়ার তো কোনো প্রশ্নই আসে না।
আর একটি কথা: ধর্ম পালন বিষয়ে না বুঝিয়াই একটি বিষয়ে আমরা অতিমাত্রায় সাবধান থাকিতে অভ্যস্ত হইয়া গিয়াছি। আমাদের অনুষ্ঠান বিষয়ে পাছে হিন্দু বা খ্রিস্টান কাহারও সঙ্গে যেন উহার কোনোরূপ মিল না থাকে তাহা হইলে মহাঅপরাধ হইবে। এইরূপ একটি ধারণা আমাদের মধ্যে এবং বিশেষ করিয়া অহাবীদের মধ্যে আছে – ইহা একেবারেই ভ্রান্ত ধারণা।
আমাদের ধর্মীয় অনুষ্ঠান পালন করিতে যাইয়া কাহারও সঙ্গে কতোটুকু মিলিল কি না মিলিল তাহা লক্ষ করিবার কী প্রয়োজন আছে? বেশিরভাগ মিল থাকাই তো ছিল স্বাভাবিক ও সঙ্গত, কারণ মূলত সকল সত্য ধর্মই যে আল্লাহ হইতে আগত। যাহা আল্লাহ হইতে আগত নহে তাহা ধর্মই নহে। অবশ্য আল্লাহ হইতে আগত ধর্ম ব্যবস্থাগুলিও মানুষের হস্তক্ষেপের ফলে ভুল পথে যাইয়া বিকৃত হইয়া গিয়াছে – তাহাতে সন্দেহ নাই, কিন্তুু তাই বলিয়া আনুষ্ঠানিক কোনো অংশ মিলিয়া গেলেই সর্বনাশ – এইরূপ চিন্তা নিতান্তই অর্বাচীনতা।
– সূফী সদর উদ্দিন আহমদ চিশতি।