হোমপেজ ইলমে মারেফত মানব দেহস্থিত দশ লতিফার পরিচয় – ১ম পর্ব

মানব দেহস্থিত দশ লতিফার পরিচয় – ১ম পর্ব

2739
Advertisement:
IPL 2024: ফ্রিতেই IPL Live Cricket খেলা দেখুন Full HD তে

মানব দেহস্থিত দশ লতিফার পরিচয় – ১ম পর্ব

মানব দেহস্থিত দশ লতিফার পরিচয় এবং খোদাপ্রাপ্তি সাধনায় ইহাদের ভূমিকাঃ- (৩ পর্বের -১ম পর্ব) খোদাপ্রাপ্তি জ্ঞনের আলোকে শাহ্ সূফী হযরত খাজাবাবা ফরিদপুরী (কুঃছেঃআঃ) ছাহেবের নসিহত।

হাদীসে কুদসীতে আল্লাহপাক বলেন, অর্থাৎ “আমি গুপ্ত ধন ভাণ্ডার ছিলাম। অতঃপর আমি পরিচিত হইতে চাহিলাম। তাই বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডকে সৃষ্টি করিলাম।”

ইহা স্পষ্টত যে, আল্লাহ্‌পাক নিজেকে প্রকাশ করিবার জন্য সৃষ্টি কাজেই আমাদের কর্তব্য আল্লাহ পাকের করিলেন। কাজেই আমাদের কর্তব্য আল্লাহপাকের পরিচয় গ্রহণে সচেষ্ট হওয়া। এই পৃথিবী হইতে খোদাতায়ালাকে চিনিয়া না গেলে পরকালে অন্ধ হইয়া উঠিতে হইবে। পরকালে খোদাতায়ালাকে চিনিবার, জানিবার বা বুঝিবার কোন সুযোগ থাকিবে না। কিন্তু এই দুনিয়াতে কিভাবে খোদাতায়ালাকে চেনা যাইবে? আল্লাহ্‌পাক তাঁহাকে চিনিবার উপায় তিনি নিজেই বাৎলাইয়া দিয়াছেন।

সৃষ্টির পর্বে আল্লাহ্‌পাক একাই ছিলেন, আর কোন কিছুরই অস্তিত্ব ছিল না। অতঃপর সৃষ্টির উদ্দেশ্যে আল্লাহ্‌পাক ‘কুন’ বা হও বলিলেন। ফলে সকল মানব রূহ একত্রে সৃষ্টি হইয়া আলমে আরওয়াহতে অবস্থান গ্রহণ করিল। শুধু মানব রূহ-ই নহে, সৃষ্টি জগতের সকল কিছুই সূক্ষ্ম অবস্থায় আলমে আরওয়াহতে বিরাজমান রহিল। এখানে একটি বিষয় রহস্যাবৃত থাকিয়া যায়। আল্লাহ্‌পাক ‘কুন’ শব্দের আদেশ কাহার উপর প্রয়োগ করিলেন? আদেশ শব্দটার প্রয়োগের ক্ষেত্রে দ্বিতীয় আর একটি সত্ত্বা বা দ্বিতীয় পুরুষের আব্যশক হয়। ইহার উত্তরে বলা হয় যে, খোদাতায়ালার পবিত্র জাত চিরস্থায়ী। জাতের মত আল্লাহ্‌তায়ালার সেফাতও চিরস্থায়ী। আল্লাহ্‌তায়ালার হাকীকী সেফাতসমূহের মধ্যে সকল সৃষ্টির হকিকতের উৎপত্তি স্থান নিহিত। আল্লাহ্‌তায়ালা সৃষ্টিলগ্নে যে ‘কুন’ শব্দ প্রয়োগ করিয়াছিলেন, তাহা আল্লাহ্‌তায়ালার সেফাতস্থিত ঐ হকিকত সমূহের প্রতি। ফলে ঐ আদেশে সমুদয় সৃষ্টি সূক্ষ্মভাবে প্রকাশ পায়।

আল্লাহ্‌তায়ালা ‘কুন’ আদেশে সকল মানব রূহ একত্রে সৃষ্টি হইয়া আলমে আরওয়াহতে অবস্থান গ্রহণ করিল। তৎপর সেখান হইতে মানুষ বহু ধাপ অতিক্রম করিয়া এই আদামাতে আসিয়া স্থূল আকার ধারণ করিয়াছে। এই আদামাতে আসিয়া আমরা আপন প্রভুর কথা ভুলিয়া গিয়াছি। আলমে আরওয়াহতে আমরা আল্লাহ্‌তায়ালার প্রভুত্ব স্বীকার করিয়া আসিয়াছি। কিন্তু এই আদামাতে আসিয়া আমরা আমাদের প্রভুর কথা বিস্মৃত হইয়াছি। আমাদের উৎসের কথা ভুলিয়া নাফসে আম্মারার দাসত্ব করিতেছি। শয়তানের কুহকে পড়িয়া আমরা আমাদেরকে দেওয়া খোদাতায়ালার আমানতের খেয়ানত করিতেছি। এই অবস্থা চলিতে থাকিলে আমাদের পরিণাম হইবে ভয়াবহ। নাফসে আম্মারা এবং শয়তানের সংগে আমাদেরকে আল্লাহ্‌তায়ালার ক্রোধের শিকার হইয়া অনন্তকাল দোযখের আগুনে দগ্ধ হইতে হইবে। ইহ হইতে বাঁচিবার উপায়, দুনিয়া হইতেই খোদাতায়ালাকে চিনিয়া যাওয়া ।

IPL 2024: ফ্রিতেই IPL Live Cricket খেলা দেখুন Full HD তে

আল্লাহ্‌পাক আমাদের এই মানব দেহে দশটি কেন্দ্র নির্ধারণ করিয়াছেন, যে কেন্দ্রগুলিকে লতিফা বলা হয়। পীরে কামেলের নির্দেশিত পথে চেষ্টা ও সাধনা করিয়া উক্ত দশটি লতিফাকে পরিচ্ছন্ন করিয়া, সেখানে খোদাতায়ালার নূর ধারন করিয়া, সেই নূরে পথ দেখিয়া, ঊর্ধ্বলোকের পানে উরুজ ও ছায়ের করিয়া, খোদাতায়ালার পরিচয় গ্রহণ করা যায়। এই লতিফাগুলি হইলঃ- কালব, রূহ, ছের, খফি, আখফা, আব, আতস, খাক, বাদ ও নাফস।

সৃষ্টি জগতকে দুইভাগে ভাগ করা হইয়াছে। যথাঃ আলমে আমর ও আলমে খালক। কালব, রূহ, ছের, খফি, আখফা– এই পাঁচটি আলমে আমর বা সূক্ষ্ম জগতের লতিফা। আর আব, আতস, খাক ও বাদ অর্থাৎ আগুন, পানি, মাটি ও বাতাস আলমে খালক বা স্থূল জগতের লতিফা। আলমে আমর ও আলমে খালকের মধ্যস্থানে বিভেদকারী পর্দার মত আরশ অবস্থিত। সহজ কথায় আরশের উপর হইতে ঊর্ধ্ব দিকে আলমে আমর বা লা–মাকাম এবং আরশ হইতে নিচের দিকে সাততলা জমিনের নিচে তাহাতাস সারা পর্যন্ত আলমে খালক অবস্থিত। নিন্মে লতিফা সমূহের সংক্ষিপ্ত পরিচয় তুলিয়া ধরা হইল।

লতিফায়ে কালবঃ– এই লতিফা মানুষের বাম স্তনের অংগুলি নিচে অবস্থিত। পদ্মকোরক উলটাইয়া ধরিলে যেই রূপ দেখা যায়, লতিফা কালবের আকার অনেকটা সেইরূপ। বাংলায় যাহাকে হৃৎপিণ্ড এবং ইংরেজীতে যাহাকে হার্ট (Heart) বলে। এই লতিফায়ে কালব আল্লাহ্‌তায়ালার ভেদের এক মহা জ্ঞানভাণ্ডার, আল্লাহতায়ালার ভেদের এক মহা জ্ঞান সমুদ্র। এই কালবের মধ্যেই আল্লাহ্‌তায়ালার নিদর্শন সমূহ লাভ করা যায়।

আল্লাহ্‌পাক পবিত্র কোরআন মজীদে বলেন, অর্থাৎ “আমার নিদর্শন তোমাদের ভিতরেই আছে, তোমরা দেখ না কেন?” (সূরা জারিয়াতঃ ২১)

খোদাতায়ালার নিদর্শন সমূহ দেখিবার কেন্দ্রই এই কালব। একটি বটের বীজের মধ্যে যেমন বিরাট একটি বটগাছ লুকাইয়া রহিয়াছে, তেমনি মানব বক্ষস্থিত কালব নামক ক্ষুদ্র এই মাংসপিণ্ড, যাহার মধ্যে আল্লাহ্‌তায়ালার ভেদের এক বিরাট দফতর লুকাইয়া আছে। লতিফায়ে কালব মহাকালবের ক্ষুদ্রতম অংশ। সূফী সাধকগন ফরমাইয়াছেন যে, কালবের ক্ষেত্র ব্যাপক এবং বিস্তৃত। দুই চারিশত আসমান যদি এই কালবের ভিতরে রাখা হয়, তবে তাহা কালবের এক পার্শ্বে পড়িয়া থাকিবে। কালব আরশের উপরের জগতের লতিফা হওয়ায় তাহা স্বচ্ছ এবং পবিত্র। কিন্তু আলমে খালকে আসিয়া নাফসে আম্মারার সংস্পর্শে কালব তাহার পবিত্রতা এবং স্বচ্ছতা হারাইয়া ফেলে।

মানুষ যতই পাপ কার্যে লিপ্ত হয়, তাহার কালব ততই অসচ্ছ হয়, মলিন হয়। পীরে কামেলের তাওয়াজ্জুহ এত্তেহাদীর বলে মুরীদের কালব তাহার স্বচ্ছতা এবং পবিত্রতা ফিরিয়া পায়। এমতাবস্থায় মহাকালবের সহিত কালব পুনরায় যোগসূত্র স্থাপন করিতে সমর্থ হয়। মহাকালব হইতে আল্লাহ্‌তায়ালার জাতের জেল্লী, তাঁহার গুণসমূহ বা সেফাতের প্রতিচ্ছবি এবং তাঁহার ক্রিয়াসমূহের প্রতিচ্ছবি তখন মুরীদের কালবে প্রতিফলিত হয়। ফলে ছালেক এই কালবের মাধ্যমে সৃষ্টিতত্ত্বজ্ঞান এবং স্রষ্টাতত্ত্বজ্ঞান অর্থাৎ এলমে হুসুলী এবং এলমে হুজুরীর জ্ঞান লাভ করিতে পারে। পরিচ্ছন্ন এই কালবে আরশ, কুরছি, লওহ, কলম, সবই দৃষ্ট হয়।

মাওলানা রূমী (রঃ) বলিয়াছেন ,
“আরশ, কুরছি, দার দেলে উস্ত লওহ কলম
হারকে দেলরা ইয়াফত্যা আরা নিস্ত গোম।”

অর্থাৎ- “আরশ, কুরছি, লওহ, কলম, বেহেশত, দোযখ, সাত তলা আসমান হইতে সাত তলা জমিনের নীচে তাহাতাস সারা পর্যন্ত সবই তোমার কালবে পরিলক্ষিত হইবে, যদি তোমার কালব মহাকালবের সহিত যোগ সূত্র স্থাপন করিবার ক্ষমতা প্রাপ্ত হয়।”

মহাকালব হইতে তখন ছালেকের কালব অসীম জ্ঞান রাজ্যের জ্ঞান অহরণ করিয়া মহাজ্ঞানী হয়। এই প্রসঙ্গে একটি ঘটনা তোমাদের জানাইতে চাই। হযরত আবুবকর কাতানী (রঃ) ছাহেব কাবা শরীফের নিকটবর্তী এলাকায় তরিকা প্রচার করিতেন। তিনি মক্কাবাসীদের নিকট “চেরাগে হেরেম’’ অর্থাৎ হেরেম শরীফের প্রদীপ বলিয়া আখ্যায়িত ছিলেন। একদিন তিনি কাবা শরীফের ভিতরে এক পার্শ্বে একাকী বসিয়া ওজিফারত আছেন। দূরে মাকামে ইব্রাহিমের নিকট কয়েকজন তাবেঈ রাসূলে করীম (সাঃ) এর বানীসমূহ লইয়া আলোচনা করিতেছেন। এমন সময় একজন বৃদ্ধলোক সোজাসুজি হযরত কাতানী (রঃ) ছাহেবের নিকট আসিয়া বলিলেন, “মাকামে ইব্রাহিমের নিকট হাদীস বিশারদগণ হাদীস লইয়া গবেষণা করিতেছে, আর আপনি এখানে একাকী বসিয়া আছেন কেন? সেখানে হাদীস গবেষণায় অংশ গ্রহণ করিতে তো পারতেন।”

হযরত কাতানী (রঃ) ছাহেব মাথা উত্তোলন পূর্বক বলিলেন, “যাহারা হাদীস লইয়া গবেষণা করিতেছেন, তাহারা কোথা হইতে তাহা পাইয়াছেন।” উত্তরে আগন্তক বৃদ্ধ বলিলেন, “তাহারা প্রধান প্রধান সাহাবীদের নিকট হইতে হাদীস শিখিয়াছেন এবং সাহাবা সকল রাসূলে করীম (সাঃ) এর নিকট হইতে প্রাপ্ত হইয়াছেন।” ইহা শুনিয়া হযরত কাতানী (রঃ) বলিলেন, “আপনি তো দীর্ঘ সূত্রের কথা বলিলেন, কিন্তু আমি এখানে বসিয়া বিনা সূত্রে সরাসরি তাহা শ্রবণ করিতেছি।” “কি ভাবে আপনি শ্রবণ করিতেছেন?” বৃদ্ধ প্রশ্ন করিলেন। তিনি বলিলেন, “আমার কালব খোদাতায়ালার নিকট হইতে সমস্তই আমার নিকট বর্ণনা করিয়া থাকে।” আগন্তক বৃদ্ধ পুনরায় প্রশ্ন করিলেন, “আপনার এই কথার সমর্থনে কোন প্রমাণ আছে কি?” হযরত কাতানী (রঃ) মুচকি হাসিয়া বলিলেন, ইহার পক্ষে এতটুকু প্রমাণই যথেষ্ট যে, যে আগন্তক বৃদ্ধ আমাকে উপদেশ প্রদান করিতেছেন, তিনি হযরত খিজির (আঃ)। হযরত খিজির (আঃ) ইহা শ্রবণে নিজের পরিচয় প্রদান করিয়া উপরোক্ত কথার সাথে একমত পোষণ করিলেন।

কালবে যে নূর দৃষ্ট হয়, তাহা সরিষা ফুলের ন্যায় হলুদ বর্ণের। কালবের মূল আরশের উপরে এবং ইহার মূলের মূল তাজাল্লীয়াতে আফায়েলে সন্নিবেশিত আছে। ছালেক বা মুরীদ যখন এই মাকামে উন্নীত হয়, তখন সে বুঝিতে পারে যে, এই বিশ্ব ব্রমান্ডে যাহা কিছু সংঘটিত হইতেছে তাহা এক খোদাতায়ালার ইচ্ছা এবং ক্রিয়াগুণ সমূহের দ্বারা সংঘটিত হইতেছে। পৃথিবী, চন্দ্র, সূর্য, গ্রহ-নক্ষত্রের নিজ নিজ কক্ষ পথে ভ্রমণ, এক এক ঋতুতে পৃথিবীর এক এক রূপধারণ, সমস্ত আল্লাহ্‌তায়ালার ক্রিয়াগুণ সমূহের প্রতিবিম্ব। লতিফায়ে কালব প্রথমে হযরত আদম (আঃ) এর উপর বিকাশ পাইয়াছিল। তাই এই লতিফাকে হযরত আদম (আঃ) এর জেরে কদমের লতিফা বলা হয়। লতিফায়ে কালবের বেলায়েত অর্জনকারীকে ‘আদমী মাশরাব অলী’ – অর্থাৎ হযরত আদম (আঃ) – এর ঘাটের ঘাটি বলা হয়।

বাকি ৯টি লতিফা যথাঃ- রুহ, ছের, খফি, আখফা, আব, আতস, খাক, বাদ ও নাফস সম্পর্কে লেখা পরবর্তী পোষ্টে।

গ্রন্থসূত্র- শাহ্ সূফী হযরত খাজাবাবা ফরিদপুরী (কুঃছেঃআঃ) ছাহেবের “নসিহত- সকল খন্ড একত্রে।”
নসিহত নং- ২০, পৃষ্ঠা নং- ৪০৯, ৪১০ ও ৪১১।

» মানব দেহস্থিত দশ লতিফার পরিচয়- সবগুলো পর্ব।