নফসকে চিনলে আল্লাহকে চেনা যায়-এই কথার ভেদতত্ব।
আসুন কোরআন ও হাদিসের আলোকে জেনেনিই।
নফস শব্দের অর্থ হলো ইচ্ছাশক্তি। প্রতিটি মানুষের ভিতরেই আত্নার দুটি বিপরীতধর্মী বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান। যথা – জীব আত্না ও পরম আত্না। জীব আত্নাকে নফস এবং পরম আত্নাকে রুহ নামে অভিহিত করা হয়। নফস মূলে পবিত্র। এই নফস যখন ষড়রিপু যুক্ত হয়, তখন তা অপবিত্র হয়ে পড়ে। আর যখন ষড়রিপু মুক্ত হয়, তখন তা পুনরায় পবিত্র হয়। ষড়রিপু যুক্ত ইচ্ছা মানুষকে পাপের দিকে ধাবিত করে। পক্ষান্তরে ষড়রিপু মুক্ত ও আল্লাহ প্রাপ্তির ইচ্ছা মানুষকে আল্লাহ পর্যন্ত পৌঁছিয়ে দেয়। আর আল্লাহ পর্যন্ত না পৌঁছা পর্যন্ত মানুষকে কঠোর সাধনা করতে হয়। কেননা, আল্লাহর সত্তাই তো মানুষের মধ্যে বিরাজমান।
পবিত্র কুরআন শরীফে আল্লাহ বলেন,
“আমি (আল্লাহ) আমার রুহ থেকে আদমের ভিতরে রুহ ফুঁকে দিলাম।” (সূরা আল হিজর, আয়াত নং ২৯)।
“(আমি আল্লাহ) তোমাদের দিলে (ক্বালবের সপ্তম স্তর নাফসীর মাকামে) অবস্থান করি, তোমরা কি দেখ না?” (সূরা আয যারিয়াত, আয়াত নং ২১)।
হযরত মাওলা আলী (আঃ) বলেন,
“যে নিজের নফসকে চিনতে পেরেছে সে তার প্রভুকে চিনতে পেরেছে।” (সিররুল আসরার, পৃষ্ঠা নং ১৮)।
অর্থাৎ যে নিজের পরিচয় লাভ করেছে, সে আল্লাহর পরিচয় লাভ করতে সক্ষম হয়েছে। মোটকথা – নফস ও রুহ দুটি ভিন্ন সত্তা। নফস আলমে খালক (সৃষ্টি জগৎ) এর বস্তু – ইহা পিতার শুক্রকীট থেকে সৃষ্টি হয় ; আর রুহ আলমে আমর (সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম জগৎ) এর বস্তু, ইহা আল্লাহ হতে আগত। সাধক সাধনার মাধ্যমে যখন ক্বালবের সপ্তম স্তরে নাফসীর মাকামে উপনীত হন, তখনি তিনি আল্লাহর দীদার লাভ করে থাকেন।
রাসূল পাক সঃ বলেন,
“মুমিন ব্যক্তির দীল হলো আল্লাহর আরশ।”
“ক্বালব একটি মাংসের টুকরা। ঐ ক্বালবের ভিতর পেট আছে। এমনকি উহার ভিতর ৭টি পেট আছে। অর্থাৎ ঐ ক্বালবের এক পেটের ভিতর অপর আর একটি পেট, তার ভিতরে আর একটি পেট, এইভাবে পরপর ৭টি পেট আছে। কিন্তু সকল পেটের ভিতরের পেটকে ক্বালবে মোদাব্বের ও হাকিকতে ইনছানি বলা হয়। মাথার তালুর সহিত উহার যোগ রয়েছে ঐ স্হানেই খোদার আরশ রয়েছে। অর্থাৎ সব ছেফাতের ও সব জিনিসের মূল কর্তা ঐ স্হানে মজুদ রয়েছে। (নুরুল আসরার ১ম খন্ড, পৃষ্ঠা নং ১০১)।
এক কথায় – ক্বালব বলতে মানুষের হৃদপিন্ডকে বুঝায়। আল্লাহ প্রাপ্ত সাধক অলী-আল্লাহগণ পবিত্র কুরআন ও হাদিসের জাহেরী অর্থের পাশাপাশি তাঁদের সাধনালব্ধ জ্ঞান থেকে বাতেনী ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে বলেন, ক্বালব সূক্ষ্ম সৃষ্টি জগতের রহস্যের এক মহাসমুদ্র বিশেষ। সূক্ষ্ম জগৎ স্তরে স্তরে এ ক্বালবের ভিতরে অবস্থান করে। মানুষের জীবআত্না তার ক্বালবের বহিরাঙ্গের সাথে সম্পর্ক যুক্ত। আর পরম আত্মা এর ভিতরের স্তর সমূহের সাথে সম্পৃক্ত।
অন্যান্য বস্তুর মত ক্বালবেরও জাহের ও বাতেন আছে। ক্বালবের স্তর সমূহকে ৭টি ভাগে ভাগ করা হয়। প্রথম স্তরের চেয়ে দ্বিতীয় স্তরটির পরিধি সূক্ষ্মতা ও মর্যাদা অনেক বড়। এভাবে পরবর্তী স্তরসমূহ ক্রমানয়ে পূর্ববর্তীটির চেয়ে বড়। এভাবে বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় – জীব আত্মার সাথে সম্পৃক্ত ক্বালবের প্রথম স্তরের পরম আত্মার সাথে সম্পৃক্ত ক্বালবের অন্যান্য স্তরের পরিধি অনেক ব্যাপক। এজন্য অনেক সময় বলা হয়ে থাকে যে, ক্বালবের ২টি মুখ রয়েছে। একটি নফসের দিকে, অপরটি রুহের দিকে। রুহের দিকের মুখটি নফসের দিকের মুখ অপেক্ষা বড়। মোট কথা ক্বালব, নফস ও রুহের মিলন কেন্দ্র স্বরুপ।
জীবআত্না যতক্ষণ কু-রিপুর তাড়নাযুক্ত থাকে, ততক্ষণ সে থাকে রুহের প্রতি অমনযোগী। অর্থাৎ – জীবআত্নার মনযোগ ক্বালবের ভিতরের দিকে না হয়ে তা থাকে বহির্মুখী। এ অবস্থায় জীবআত্না স্বেচ্ছাচারী হয়। তখন রুহের কোন নির্দেশ তাঁর উপরে প্রভাব বিস্তার করতে পারে না। সাধনার দ্বারা এরুপ স্বেচ্ছাচারী জীবআত্না যখন রুহের প্রতি মনযোগী হয়, তখন তার খেয়াল থাকে ক্বালবের ভিতরের দিকে। ফলে ক্বালবের প্রথম স্তরে অবস্হিত কু-রিপু সমূহ এই জীবআত্নার উপর প্রভাব বিস্তার করতে পারে না, তখন সে শয়তানের কুমন্ত্রণা মুক্ত হয়।
জীবআত্নার এরুপ অবস্থার প্রতি ঈঙ্গিত করে হযরত রাসূল পাক (সাঃ) বলেন, “তোমাদের ভিতরে যেমন শয়তান আছে, আমার ভিতরেও তেমনি শয়তান রয়েছে। কিন্তু আমার শয়তান মুসলমান হয়েছে, তোমাদের শয়তান এখনও মুসলমান হয়নি।”
অর্থাৎ রাসূল পাক (সাঃ) এর নফসের উপর তাঁর রুহের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ ছিল, রুহের ইচ্ছানুযায়ী তিনি নফসকে পরিচালিত করেছেন। যদি কোন মানুষ সাধনার দ্বারা নিজের নফসের বিপদগামী অবস্থা অনুধাবন করতঃ উহা সংশোধন করে তাকে রুহের নিয়ন্ত্রণে আনতে পারে; তখন রুহের সহায়তায় এরুপ নফস মহান প্রভুর সন্ধান লাভ করে থাকে। অর্থাৎ মানুষ জীবআত্নাকে পরিশুদ্ধ করে পরমআত্নার সহায়তায় নিজের ভিতরে আল্লাহর রহস্য উদঘাটন সক্ষম হয়।
সূত্র: আল্লাহ কোন পথে।
নিবেদক: অধম পাপী মোজাম্মেল পাগলা।