মনের ময়লা: আধ্যাত্মিক পথের অন্তরায়

মনের ময়লা: আধ্যাত্মিক পথের অন্তরায়

সাধক কুটি মনসুরের গভীর আধ্যাত্মিক উপলব্ধি-

“মনে ময়লা থাকে যদি,
সাধন সিদ্ধি হয় না তার।
হিংসা আর নিন্দা ছাড়,
মনটা কর পরিষ্কার।।”

এই দুটি পঙ্ক্তি মানব জীবনের এক শাশ্বত সত্যকে উন্মোচিত করে। এটি কেবল একটি গানের চরণ নয়, বরং আধ্যাত্মিক পথের এক সুস্পষ্ট দিকনির্দেশনা। মনের ভেতরের কলুষতা যে সাধনার পথে কত বড় বাধা এবং কীভাবে হিংসা ও নিন্দার মতো নেতিবাচক আবেগ মনকে অপরিষ্কার করে, সেই গভীর তত্ত্বই এই পঙ্ক্তিতে নিহিত। এই ভাবনার আলোকে একটি বিস্তৃত প্রবন্ধে আলোকপাত করা যাক, যেখানে কুরআন, হাদিস, বাউল কবি, ও সুফী সাধকদের বাণীর প্রাসঙ্গিকতাও তুলে ধরা হবে।

মানুষ জন্মগতভাবে পবিত্র স্বভাব নিয়ে পৃথিবীতে আসে। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে পারিপার্শ্বিক প্রভাব, জাগতিক আকর্ষণ এবং কুপ্রবৃত্তির তাড়নায় তার মন কলুষিত হতে থাকে। লোভ, মোহ, কাম, ক্রোধ, হিংসা, নিন্দা – এই সমস্ত নেতিবাচক আবেগ মনের মধ্যে বাসা বাঁধে এবং তাকে মলিন করে তোলে। এই মলিন মন নিয়ে যখন কেউ আধ্যাত্মিক সাধনায় ব্রতী হয়, তখন সেই সাধনা ফলপ্রসূ হতে পারে না। কারণ অপরিষ্কার পাত্রে যেমন বিশুদ্ধ জল ধারণ করা যায় না, তেমনি কলুষিত হৃদয়েও divine জ্ঞান ও প্রেমের জ্যোতি প্রবেশ করতে পারে না।

কুরআন মজিদেও আত্মশুদ্ধির উপর বারবার গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। আল্লাহ তায়ালা বলেন, “নিশ্চয়ই যে নিজেকে পরিশুদ্ধ করে, সে সফলকাম হয়।” (সূরা আশ-শামস, আয়াত ৯)। এই আয়াতে ‘তাযাক্কা’ শব্দের অর্থ হলো নিজেকে পরিশুদ্ধ করা, অভ্যন্তরীণ কলুষতা থেকে মুক্ত করা। স্পষ্টতই, আধ্যাত্মিক সাফল্যের পূর্বশর্ত হলো আত্মশুদ্ধি, যা মনের ময়লা দূর করার মাধ্যমেই অর্জিত হয়।

হাদিস শরীফেও কলুষিত হৃদয়ের ভয়াবহ পরিণতির কথা বলা হয়েছে। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন, “জেনে রাখ! শরীরের মধ্যে একটি মাংসপিণ্ড আছে; যখন তা সুস্থ থাকে, গোটা শরীর সুস্থ থাকে এবং যখন তা অসুস্থ হয়ে পড়ে, গোটা শরীর অসুস্থ হয়ে পড়ে। জেনে রাখ, সেটি হলো কলব (হৃদয়)।” (সহীহ বুখারী ও মুসলিম)। এই হাদিস থেকে বোঝা যায়, মানুষের আধ্যাত্মিক ও নৈতিক জীবনের মূল কেন্দ্র হলো তার হৃদয় বা মন। যদি মন কলুষিত থাকে, তাহলে তার প্রভাব সমগ্র জীবনে পড়ে এবং সাধনার পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে।

বাংলার বাউল কবিরাও তাদের গানে ও দর্শনে মনের পবিত্রতার উপর অপরিসীম গুরুত্ব দিয়েছেন। লালন সাঁইজি গেয়েছেন, “মন তোর কেন এত মলিন”। তিনি মনের ভেতরের কালিমা দূর করে আত্মতত্ত্ব জানার কথা বলেছেন। বাউলরা মনে করেন, দেহ একটি খাঁচার মতো এবং মন হলো সেই খাঁচার পাখি। যদি খাঁচা পরিষ্কার না থাকে, তাহলে পাখি যেমন অস্বস্তি বোধ করে, তেমনি অপবিত্র মনেও আত্মারূপী পরমাত্মার উপলব্ধি সম্ভব নয়। বাউলদের গানে প্রায়শই ‘মনের মানুষ’, ‘হৃদয়াকাশে চাঁদ’ ইত্যাদি রূপকের মাধ্যমে মনের গুরুত্ব এবং তার পরিশুদ্ধির প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরা হয়।

সুফী সাধকদের বাণীও একই সুর প্রতিধ্বনিত করে। হযরত বায়েজিদ বোস্তামী (রহঃ) বলেছেন, “যদি তুমি আল্লাহর নৈকট্য লাভ করতে চাও, তবে মানুষের মন থেকে বিদ্বেষ দূর করো।” সুফীরা মনে করেন, মানুষের হৃদয় আল্লাহর আরশ। সেই আরশ যদি হিংসা, বিদ্বেষ, অহংকার ইত্যাদি আবর্জনায় পূর্ণ থাকে, তাহলে সেখানে আল্লাহর জ্যোতি কিভাবে প্রতিফলিত হবে? তারা আত্মশুদ্ধির বিভিন্ন পদ্ধতির উপর জোর দেন, যার মূল লক্ষ্য হলো মনকে নির্মল ও স্বচ্ছ করা।

সাধক কুটি মনসুরের দ্বিতীয় পঙ্ক্তি – “হিংসা আর নিন্দা ছাড়, মনটা কর পরিষ্কার।।” – মনের ময়লা দূর করার দুটি প্রধান উপায় বাতলে দেয়। হিংসা হলো অপরের সুখ ও উন্নতিতে কাতর হওয়া এবং তার অমঙ্গল কামনা করা। নিন্দা হলো অন্যের দোষ চর্চা করা এবং তাকে হেয় প্রতিপন্ন করা। এই দুটি নেতিবাচক আবেগ মানুষের মনকে বিষাক্ত করে তোলে। হিংসা হৃদয়ে অস্থিরতা সৃষ্টি করে এবং নিন্দার মাধ্যমে অন্যের প্রতি বিদ্বেষ জন্ম নেয়। এই কলুষিত মন কখনোই শান্ত ও স্থির হতে পারে না, যা আধ্যাত্মিক সাধনার জন্য অপরিহার্য।

হিংসা ও নিন্দা পরিহার করার মাধ্যমেই মনকে পরিষ্কার করা সম্ভব। এর জন্য প্রয়োজন আত্ম-পর্যালোচনা এবং নিজের ভেতরের কুপ্রবৃত্তিগুলোকে চিহ্নিত করা। অন্যের প্রতি সহানুভূতি ও ভালোবাসা জাগিয়ে তোলার মাধ্যমে হিংসার বিষ দূর করা যায়। তেমনিভাবে, অন্যের দোষ চর্চা না করে নিজের দোষগুলো সংশোধনের দিকে মনোযোগ দিলে নিন্দার প্রবণতা কমে আসে। ক্ষমা ও সহনশীলতার চর্চা মনকে উদার করে এবং অপরের প্রতি ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি করে।

সাধক কুটি মনসুরের এই ছোট্ট গানটি আধ্যাত্মিক জীবনের এক গভীর সত্যকে ধারণ করে। মন যদি ময়লাযুক্ত থাকে, তাহলে কোনো প্রকার সাধন-ভজনই ফলপ্রসূ হবে না। তাই আধ্যাত্মিক পথে অগ্রসর হতে হলে সর্বপ্রথম প্রয়োজন মনকে পরিষ্কার করা। হিংসা ও নিন্দার মতো মারাত্মক কলুষতা ত্যাগ করে প্রেম, ক্ষমা ও সহানুভূতির মাধ্যমে হৃদয়কে নির্মল করাই হলো প্রকৃত সাধনার প্রথম ধাপ এবং সাফল্যের মূল চাবিকাঠি। কুরআন, হাদিস, বাউল দর্শন ও সুফীবাদের মূল সুরও একই – আত্মশুদ্ধির মাধ্যমেই পরম লক্ষ্যে পৌঁছানো সম্ভব।

-ইলমে মারেফত (facebook page)

আরো পড়ুনঃ
Sufibad24.com | WhatsApp চ্যানেল

Sufibad24.com | Telegram Channel