যয়নুল আবেদীন (আঃ) নিজ পরিবার নিয়ে মদীনায় প্রবেশ করলেন।
ইমাম যয়নুল আবেদীন (আঃ) নিজ পরিবার-পরিজন সহকারে মদীনায় প্রবেশ করলেন। তিনি আত্মীয় ও বন্ধুদের ঘর-বাড়ির দিকে তাকিয়ে দেখতে পেলেন যে, ঘরগুলো যেন নীরবে নিথরে (যারা ঘরে বসবাস করতো তাদের জন্য) বিলাপকারিনী মহিলাদের মত কাঁদছে, শোক করছে। এসব বাড়ীঘর ইমাম যয়নুল আবেদীনকে (আঃ) ঘরের অধিবাসীদের সম্পর্কে জিজ্ঞেস করছিল এবং নিহতের জন্য শোক প্রকাশ করছিল।
ইমাম হোসাইনের (আঃ) গৃহ ফরিয়াদ করে বিলাপ করছিল আর বলছিল, “হে লোকেরা যেহেতু আমি এভাবে শোক ও ফরিয়াদ করছি বলে আমাকে ক্ষমা কর। তোমরাও এ মহা বিপদের দিনে আমাকে সাহায্য কর। তারা আমার দিনরাতের সংগী, আধার রাত ও ভোর রাতের প্রদীপ, মর্যাদা ও গৌরবের প্রতীক, আমার শক্তি ও বিজয়ের উৎস এবং আমার চন্দ্র-সূর্য ছিলেন। তাদের মহত্ত্বের কারণে কত রাতে আমার ভীতি দূর হয়ে গেছে। তাদের অনুগ্রহ ও কৃপায় সম্মান বেড়েছে। তাদের প্রভাতী প্রার্থনা আমার কর্ণকুহরে এসে পৌঁছেছে। তাদের গুপ্তভেদের দ্বারা আমি সম্মানিত হয়েছি। তারা বিভিন্ন অনুষ্ঠান ও সভা উদযাপন করতেন, আর এ সব অনুষ্ঠান ও সভা আমার সৌন্দর্যকে আরো বাড়িয়ে দিত।
তাদের ফযীলত ও মহৎ গুণাবলী আমাকে মিষ্টি সৌরভে ভরপুর করে দিত। আমার শুষ্ক কাঠগুলো তাদের সদর্শনে সবুজ ও রসালো হয়ে পড়তো। তাদের আশীর্বাদপুষ্ট হয়ে আমার থেকে যাবতীয় অমঙ্গল দূর হয়ে যেত। আমার আশাকে তারা নব নব পল্লবে বিকশিত করেছিলেন। আর আমাকে নানাবিধ বিপদাপদ থেকে মুক্ত ও নিরাপদ রেখেছিলেন। প্রভাতকালে তাদেরকে পেয়ে অন্য সকল প্রাসাদ ও গ্রহের উপর আমার শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠিত হত। আর এ কারণে আমি গর্ববোধ করতাম, সুখী ছিলাম। তাদের সান্নিধ্যে অনেক নিরাশা আশার আলোয় পরিণত হয়েছিল। অনেক বিপদাপদ ও ভয় বা ভীতি ক্ষয়প্রাপ্ত অস্থির মত আমার অস্তিত্বের সীমারেখার মাঝে লুক্কায়িত ছিল তাদেরই বদৌলতে সেগুলো দূরীভূত হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু অবশেষে মৃত্যুর তীর তাদেরকে লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করলো। তারা অপরিচিত শত্রুদের দ্বারা পরিবেষ্টিত হয়ে তাদের হাতে নির্মমভাবে নিহত হলেন। মর্যাদা ও সম্মানবোধ যা তাদের জীবদ্দশায় বিদ্যমান ছিল তা আজ ধ্বংস হয়ে গেছে। তাদেরকে হারিয়ে আজ উন্নত চারিত্রিক গুণাবলী যেন নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে। মহান আল্লাহর বিধি-বিধানসমূহে তাদের জন্য বিলাপ করছে। হায়, ঐ পুণ্যাত্মার (হোসাইনের) রক্তপাত করা হয়েছে। হায়, পূর্ণত্বপ্রাপ্তদের সেনাদলের পতাকা আজ ভূলুন্ঠিত হয়ে গেছে।
আজ যদি আমার সাথে মানবজাতি ক্রন্দন না করে এবং অজ্ঞ লোকেরা যদি এ বিপদে শোক প্রকাশ করার সময় আমাকে ত্যাগ করে তাহলে পুরোনো টিলা-পাহাড় এবং ধ্বংসপ্রাপ্ত গৃহসমূহের দেওয়ালগুলোই আমার জন্য যথেষ্ট। কারণ ওগুলোও আমার মত ক্রন্দন করছে, বিলাপ করছে। আর আমার মত তারাও শোকাচ্ছন্ন এবং দুঃখভারাক্রান্ত। যদি তোমরা শুনতে পাও যে, নামায কিভাবে ঐ সব সত্যপন্থী শহীদের জন্য বিলাপ করেছে, দানশীলতা ও মহানুভবতা তাদের দর্শনপ্রার্থী এবং দর্শনের জন্য অপেক্ষমান; মসজিদের মেহরাব তাদের বিচ্ছেদ বেদনায় ক্রন্দনরত এবং অভাবীদের অভাব তাদের দান পাওয়ার জন্য উচ্চস্বরে ফরিয়াদ করছে; তাহলে অবশ্যই এসব ফরিয়াদ শুনে তোমরাও শোকাচ্ছন্ন ও দুঃখভারাক্রান্ত হতে এবং জানতে পারতে যে এ মহাবিপদে তোমরা দায়িত্ব পালন করনি। বরং যদি তোমরা আমার একাকিত্ব ও ভেঙ্গে পড়ার অবস্থা প্রত্যক্ষ করতে এবং তাদের বিহনে আমার সভাগুলো যে খালি, এ অবস্থা যদি দেখতে পেতে তাহলে তোমাদের মানসপটে এমন এক চিত্র ফুটে উঠত যা সহিষ্ণু হৃদয়কে দুঃখ ও বেদনায় উদ্বেলিত করে ও বক্ষকে ভারী করে দেয়। যে সব গৃহ আমার সাথে হিংসা করত, আজ তারা আমাকে ভৎর্সনা করছে। আমার উপর যুগের বিপদাপদ জয়ী হয়েছে। হায়, অধীক আগ্রহের সাথে ঐ গৃহকে দেখতে ইচ্ছে করছে যেখানে তাদের দেহ শায়িত ।
হায়! আক্ষেপ, আমি যদি মানুষ হতাম এবং তলোয়ারের সামনে যদি ঢালের মত দাড়িয়ে তাদের চরণতলে নিজকে উৎসর্গ করতে পারতাম যাতে করে তারা জীবতি থাকতে পারেন। হায়, যদি আমি ঐসব শত্রুর বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নিতে পারতাম যারা তাদেরকে বর্শা দিয়ে আক্রমণ করেছে। হায়, আমি যদি তাদের কাছ থেকে শত্রুদের নিক্ষিপ্ত তীর ফিরিয়ে দিতে পারতাম। অথচ আমি এ মুহূর্তে কিছুই করতে পারলাম না। হায়, যদি আমি তাদের সুকোমল দেহের বাসস্থান হতে পারতাম এবং তাদের পবিত্র দেহকে যদি রক্ষা করতে পারতাম। আহ আমি ঐ সব মহান আত্মোৎসর্গকারী পুণ্যাত্মাদের অবস্থানস্থল হতে পারতাম তাহলে সর্বশক্তি ব্যয় করে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালিয়ে তাদের দেহগুলোকে রক্ষা করতাম এবং তাদের পুরোনো হক বা অধিকার আদায় করে আনতাম। পাথরগুলোকে তাদের উপর পড়তে দিতাম না। তাদের সামনে অনুগত দাসের মত সব সময় উপস্থিত থাকতাম তাদের চরণতলে সম্মান ও মর্যাদার গালিচা বিছিয়ে দিতাম। তাহলে তাদের সহচর্য লাভ করার সৌভাগ্য হত এবং অন্ধকারে তাদের আলো থেকে উপকৃত হতাম। আহ! এসব আশা পূরণ হওয়ার জন্য আমি কত আগ্রহী। আমার মাঝে যারা বসবাস করতেন তাদের বিরহ বিচ্ছেদে আমি জ্বলছি। আমার ফরিয়াদ অন্য সব ফরিয়াদকে ছাড়িয়ে গেছে ।
তারা ছাড়া আর কোন ওষুধে আমি আরোগ্য লাভ করব না। তাদেরকে হারিয়ে আমি শোকের পোশাক পরিধান করেছি। আমি আর ধৈর্য ধারণ করতে পারছি না। আমার ধৈর্যের বাধ ভেঙ্গে গেছে। আর আমি বলছি হে শান্তিদাতা, তোমার সাথে আমার দেখা হবে রোজ হাশরের মাঠে।
মালিকশূন্য ঘরগুলো যখন কাঁদছিল তা বর্ণনা করতে গিয়ে ইবনে কুতাইবা কত সুন্দর বলেছেনঃ মুহাম্মদের (সাঃ) বংশধরদের গৃহসমূহের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় দেখলাম ঐ ঘরগুলো যখন মহানবীর (সাঃ) বংশধরেরা এখানে থাকতেন এখন আর নেই। মহান আল্লাহ, এ গৃহ ও এ গৃহের মালিককে রহমত থেকে বঞ্চিত না করেন। আমার ধারণায় যদিও এ ঘরগুলো মালিকবিহীন হয়ে গেছে । তোমরা জেনে রেখো যে, কারবালায় শহীদদের নিহত হওয়ার কারণে মুসলমানদের ঘাড়ে অপমানের বোঝা অর্পিত হয়েছে। আর এখন তাদের উপর আপমানের চিহ্ন স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। মহানবীর (সাঃ) বংশধরেরা সব সময় উম্মতের আশ্রয়স্থল ছিলেন। আর এখন তাদের উপর অর্পিত বিপদাপদই সকল বিপদাপদ অপেক্ষা ভয়ানক। তোমরা কি দেখনি যে, ইমাম হোসাইনের শাহাদাতে আকাশের সূর্য স্লান হয়ে গিয়েছিল এবং পৃথিবী এ তীব্র বিপদে প্রকম্পিত হয়েছিল? তোমরা যে কেউ ইমাম হোসাইনের এ বিপদের কথা শুনবে যেমনিভাবে মহানবীর (সাঃ) বংশধরেরা শোকাভিভূত হয়েছিলেন ঠিক তেমনিভাবে তোমরাও শোকাভিভূত ।
নিবেদক- অধম নালায়েক, এ আর জি এম আর এ রাসেল।