কারবালা প্রান্তরের করুন ঘটনা (দুধের শিশু আলী আজগর)।
পৃথিবীর সর্বকালের সর্বনিকৃষ্ট নরপিশাচ, কাফের এবং মোনাফেক এজিদ কর্তৃক মাওলা ইমাম হোসাইনের প্রাণপ্রিয় দুধের শিশু ইমাম আলী আজগরের হৃদয় বিদারক করুন ইতিহাস।
মহরমের ১০ তারিখে ইমাম হোসাইনের স্ত্রী সাহারবানু দুধের শিশু ইমাম আলী আজগরকে কোলে তুলে এনে কাঁদতে কাঁদতে বলতে লাগলেন, আজ সাত রাত নয় দিনের মধ্যে এক ফোঁটা পানিও স্পর্শ করলাম না। পিপাসায় আমার জীবন শেষ হোক, তাতে বিন্দুমাত্র দুঃখ করি না, কিন্তু স্তনের দুধ পর্যন্ত শুকাইয়া গেছে। আমার দুধের শিশু আলী আজগরের প্রাণ পাখি যাবার উপক্রম হলো। এই সময়ে একবিন্দু পানি কোন উপায়ে আলী আজগরের মুখে পান করাতে পারলে বোধ হয় বাঁচতে পারত।
মাওলা ইমাম হোসাইন বলল, পানি কোথায় পাবো ? নরপিশাচ এজিদের সৈন্যগণ ফোরাত নদীর কূল আবদ্ধ করে রেখেছে, পানি আনতে কারো সাধ্য নাই। সাহারবানু বললেন, আলী আজগরের জীবন রক্ষার্থে যদি আপনি নিজে গিয়ে সামান্য পানি তাকে পান করাতে পারেন, তাহলে আমার আলী আজগরের প্রাণ রক্ষা হবে। আমাদের জন্য আপনাকে যেতে বলছি না। মাওলা ইমাম হোসাইন বললেন, জীবনে কোনদিন শত্রুর নিকট কি কাফেরের নিকট কোন বিষয়ে প্রার্থনা করি নাই। নরপিশাচ কাফের এজিদের সৈন্যদের নিকট কোনকালে কিছু আশা করি না। পানি চাইলে কিছুতেই পাব না।
আর আমি এই শিশুর প্রাণ রক্ষার কারণেই যদি তাদের নিকট জল ভিক্ষা করি, তবে আমি চাইলেই তারা জল দিবে কেন? আমার মনঃকষ্ট, মনোবেদনা দিতেই তো নরপিশাচ কাফের এজিদের সৈন্যগন কারবালায় এসেছে, আমার জীবন বিনাশ করবার জন্যই তো তারা ফোরাতকূল আবদ্ধ করেছে। সাহারবানু বললেন, তা যাই বলুন, আমরা বেঁচে থাকতে কি দুধের শিশু আলী আজগর জল পিপাসায় প্রাণ হারাবে? তা আমি স্বচক্ষে দেখব! মাওলা ইমাম হোসাইন আর দ্বিমত করলেন না। অতি শীঘ্র উঠে গিয়ে ঘোড়া সজ্জিত করে এনে বললেন, দাও ! আমার কোলে দাও। আমার সাধ্যানুসারে চেষ্টা করে দেখি। এই বলে, মাওলা ইমাম হোসাইন ঘোড়ায় উঠলেন। সাহারবানু সন্তানটি হাতে নিয়ে ঘোড়ার পিঠে স্বামীর কোলে বসাইয়া দিলেন।
মাওলা ইমাম হোসাইন পুত্রকে কোলে নিয়ে ঘোড়ায় কশাঘাত করলেন। মুহূর্তের মধ্যে ফোরাত নদী তীরে উপস্থিত হয়ে সৈন্যগণকে বললেন, ভাই সকল ! তোমাদের মধ্যে যদি কেউ মুসলমান থাক, তবে এই দুধের শিশুর মুখের দিকে চেয়ে সামান্য পানি দাও। পিপাসায় তার কন্ঠতালু শুকাইয়া প্রাণ যাবার উপক্রম হয়েছে। এসময় সামান্য পানি পান করতে পারলে বোধ হয় বাঁচতে পারে। তোমাদের আল্লাহর দোহাই, তোমরা না আমার নানা হযরত রাসূল পাক (সঃ) এর উম্মত। মাওলা ইমাম হোসাইন কান্না জড়িত কন্ঠে বললেন, আমার দুধের শিশুর জীবন রক্ষার্থে তার মুখের দিকে চেয়ে সামান্য পানি দাও। এই দুধের শিশুর প্রাণ রক্ষা করলে আল্লাহ তোমাদের মঙ্গল করবেন।
কেউ কোন উত্তর দিলো না। সকলে একদৃষ্টিতে মাওলা ইমাম হোসাইনের দিকে চেয়ে রইল। পুনরায় মাওলা ইমাম হোসাইন বলতে লাগল, ভাই সকল ! চিরদিন তোমাদের সুদিন থাকবে না; কোন একদিন ইহার সন্ধ্যা হবেই হবে। আল্লাহর অনন্ত ক্ষমতার প্রতি একবার দৃষ্টিপাত কর; তাকে একটু ভয় করো। ভাইগণ ! পিপাসায় পানি দেওয়া মহাপূণ্য, তারপরে আবার আমার দুধের শিশু।
ভাই সকল ! আমার দুধের শিশুর জীবন আপনাদের অনুগ্রহের উপর নির্ভর করতেছে। আমি সামান্য সৈনিক পুরুষ নই। আমি হলাম যুবকদের বেহেশতের সর্দার, আমার পিতা মহামান্য শেরে খোদা মাওলা আলী, যিনি সকল মুমিনদের অভিভাবক। আমার মাতা হযরত মা ফাতেমাতুজ জোহরা খাতুনে জান্নাত, সকল মহিলাদের জান্নাতের সর্দারনী। আমার নানা নুরনবী হযরত মুহাম্মাদ (সঃ), যার পবিত্র কদমতলে সমগ্র মানব জাতি এবং সমগ্র সৃষ্টিকুলের মুক্তি। তিনি হলেন শাফায়াতের কান্ডারী, মানবজাতির মুক্তির কান্ডারী। আমার নানার শাফায়াত ছাড়া কেউ মুক্তি পাবে না এবং কেউ জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না।
আমি ঐ সকল পবিত্র পূণ্য আত্মার কসম দিতেছি, তোমরা এই দুধের শিশুটির প্রতি অনুগ্রহ কর। মনে কর, যদি আমি তোমাদের নিকটে কোন অপরাধে অপরাধী হয়ে থাকি কিন্তু আমার এই দুধের শিশুটি তো তোমাদের কোন ক্ষতি করে নাই। তোমাদের নিকট কোন অপরাধে অপরাধী হয় নাই। তার প্রতি দয়া করে তাহার জীবন রক্ষা কর। সৈন্যগণ মধ্য হতে একজন বলল, তোমার পরিচয় জানলাম, তুমি তাহলে হোসেন। তুমি হাজারবার অনুনয় বিনয় করে বললেও আমরা পানি দিব না। তোমার মাথা কেটে নিতে পারলেই, আমরা মহামান্য বাদশাহ এজিদের কাছ থেকে বিপুল পরিমাণ পুরস্কার পাব। মহামান্য বাদশাহ এজিদ আমাদের সেই দিক নির্দেশনা দিয়েছেন। আমরা তোমার মন ভুলানো কথা ভুলব না। তোমার পুত্র পানি পিপাসায় জীবন হারাইলে তাতে তোমার দুঃখ কি? তোমার জীবন তো এখনই যাবে, সন্তানের দুঃখে না কাদিয়া তোমার নিজের প্রাণের জন্য একবার কাঁদো। অসময়ে পিপাসায় কাতর হয়ে কারবালায় প্রাণ হারাবে, সেই দুঃখে একবার কাঁদো। শিশু সন্তানের জন্য আর কষ্ট পাইতে হবে না। এই তোমার সকল জ্বালাযন্ত্রণা একেবারে শেষ করে দিতেছি।
এই বলে সেই ব্যক্তি মাওলা ইমাম হোসাইনের বুক লক্ষ্য করে এক বাণ তীর নিক্ষেপ করল। দ্রুত গতিতে নিক্ষিপ্ত সেই বিষ মাখানো তীর মাওলা ইমাম হোসাইনের বুকে না লেগে, লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে কোলে দুধের শিশু ইমাম আলী আজগরের বুকে বিদ্ধ হয়ে কলিজা ছেড়ে বুকের পিছন দিয়ে বের হয়ে গেল। মাওলা ইমাম হোসাইনের কোল রক্তে ভাসতে লাগল। মাওলা ইমাম হোসাইন বলতে লাগলেন, ওরে পাষাণ হৃদয় ! ওরে নিষ্ঠুর কাফের এজিদের সৈন্য, তুই একি করলি ? তোর মনে কি কোন মায়া দয়া নাই। তুই কাকে মারলি জানিস, আমার আদরের দুলাল, হৃদয়ের ধন, কলিজার টুকরা আলী আজগরকে মারলি। ওরে পাপিষ্ঠ, কাফের, মোনাফেক, জাহান্নামী নরপিশাচ আমার দুধের শিশু আলী আজগরকে মেরে তোর কি লাভ হলো। নরপিশাচ কাফের এজিদের টাকার কাছে তোরা বিক্রি হয়ে গেলি।
হায় ! হায় ! আমি কোন মুখে তাকে নিয়ে যাব। আমার স্ত্রী সাহারবানুর নিকট গিয়ে আমি কি উত্তর দিব।মাওলা ইমাম হোসাইন মহা দুঃখে এই কথা বলে ঘোড়া নিয়ে শিবিরের দিকে রওনা হলেন। শিবিরের সামনে এসে মৃত সন্তান ইমাম আলী আজগরকে কোলে করে নিয়ে ঘোড়া থেকে লাফ দিয়ে নামলেন। স্ত্রী সাহারবানুর নিকট গিয়ে বললেন – ধর ! তোমার পুত্রকে কোলে তুলে নেও। আজ আমাদের কলিজার টুকরা, হৃদয়ের ধন সোনামনিকে জনমের মত পানি পান করাইয়া আনলাম।
সাহারবানু সন্তানের রক্ত মাখা বুকের প্রতি দৃষ্টিপাত করে জ্ঞান হারিয়ে মাটিতে পড়ে গেল। জ্ঞান ফিরে বলল, ওরে কোন নির্দয় নিষ্ঠুর পাপিষ্ঠ এমন কাজ করিল। কোন পাষাণ হৃদয় এমন কোমল শরীরে লৌহ তীর নিক্ষেপ করল। ওরে মোনাফেক কাফের নরপিশাচ এজিদ তোর কি ক্ষমতার এতই লোভ। তোর কি জাহান্নামের ভয় নেই। ওরে নরপিশাচ এজিদ মৃত্যুর পরে মহান আল্লাহর কাছে কি জবাব দিবি। আমার দয়াল রাসূল পাক (সঃ) এর শাফায়াত কি করে পাবি। তোর পূর্ব পুরুষরা মুসলমানদের সাথে ২৭ টি যুদ্ধে হেরে গিয়েছিল। তুই আজ কি সেই পরাজয়ের প্রতিশোধ নিতে আছিস। ওরে মোনাফেক এজিদ, তুই একি করিলি?
আল্লাহ! সবই তোমার খেলা। যেদিন মদিনা ত্যাগ করেছি, সেই দিনই দুঃখের বুঝা মাথায় নিয়ে ঘুরতেছি। শিবিরের সকল সদস্যরাই ইমাম আলী আজগরের জন্য কাঁদতে লাগল। আজ ইমাম আলী আজগরের শোকে আকাশ -বাতাস, তরুলতা,গাছপালা, বনের পশুপাখি সবাই কাঁদতেছে। কেউ কাউকে সান্ত্বনা দেওয়ার ভাষা খুঁজে পায় না। সবাই যে যার মত অশ্রু বিসর্জন দিতে লাগলেন। আজ সবার হৃদয় ভেঙে চুরমার হয়ে গেছে।
“রাসূল পাক সঃ এবং তার পরিবারের উপর নাই যার প্রেম, কে বলে মানুষ তারে পশু সেই জন “।
নিবেদকঃ অধম পাপী মোজাম্মেল পাগলা।
কারবালা সম্পর্কিত আরো পড়ুন:
→কারবালার প্রান্তরের সেই করুন ইতিহাস
→ইমাম হোসাইন (আঃ) ও লানিত ইয়াজিদের কারবালার করুন ইতিহাস
→সত্য ইসলাম কারবালার প্রান্তরেই বিলুপ্ত হয়েছে বলা হয় কেনো?
→আব্দুল ওহাব নজদী (ওহাবী)’র ইতিহাস ও পরিচয়