সৃষ্টি জগতের সর্বকালের সর্বনিকৃষ্ট-কারবালা প্রান্তরের হৃদয় বিদারক কাহিনী।
সৃষ্টি জগতের সর্বকালের সর্বনিকৃষ্ট নরপিশাচ, কাফের ও মোনাফেক এজিদ সৈন্য বাহিনী কর্তৃক ইতিহাসের উজ্জ্বল নক্ষত্র, হযরত রাসূল পাক সঃ এর কলিজার টুকরা, মাওলা আলীর হৃদয়ের ধন এবং মা ফাতেমার আদরের দুলাল নয়নমনি, যুবকদের জান্নাতের সর্দার মহাবীর ইমাম হোসাইনের কারবালা প্রান্তরের হৃদয় বিদারক করুন কাহিনী।
আজ ১০ই মহরম। একে একে ইমাম হোসাইনের পরিবারের সকল পুরুষ সদস্য এবং সঙ্গীগণ কারবালা প্রান্তরে নিষ্ঠুর এজিদ বাহিনী কর্তৃক নির্মমভাবে শহীদ হন। শুধু মাত্র জয়নাল আবেদীন অসুস্হতার কারণে এখনো বেঁচে আছে। জয়নাল আবেদীন তার চোখের সামনে আপন ভাই আলী আজগর, আলী আকবর, চাচাতো ভাই কাসেম এবং শিবিরের সকল সঙ্গীদের নির্মমভাবে শহীদ হতে দেখলেন।
এমতাবস্থায় ইমাম হোসাইনের শিশু বালক সন্তান অসুস্থ জয়নাল আবেদীন ভ্রাতৃশোকে কাতর হয়ে কাঁদতে কাঁদতে শিবির হতে দৌড়ে বাহির হলেন। ইমাম হোসাইন পিছন পিছন দৌড়াইয়া গিয়ে তাকে ধরে আনলেন এবং অনেক স্বান্তনা দিয়ে বুঝাইতে লাগলেন। মুখে শত শত চুমু দিয়ে কোলে তুলে নিয়ে স্ত্রী সাহারবানুর নিকট এসে বললেন, জয়নাল আবেদীন যদি শক্রুহাতে প্রাণত্যাগ করে, তবে নবী বংশ জগৎ হতে একেবারে নির্মূল হয়ে যাবে এবং সৈয়দ বংশের নাম আর ইহজগতে থাকবে না। তোমরা জয়নাল আবেদীন কে সাবধানে রক্ষা কর এবং সর্বদাই চোখে চোখে রাখ। কোন ভাবেই তাকে শিবিরের বাহির হতে দিবে না।
ইমাম হোসাইন আর কারো জন্য দুঃখ করল না।
আল্লাহর উদ্দেশ্যে আকাশ পানে তাকাইয়া দুই হাত তুলে বলতে লাগলেন দয়াময়! তুমি অগতির গতি, তুমি সর্ব -শক্তিমান, তুমি বিপদের কান্ডারী, তুমি অনুগ্রাহক এবং তুমিই সর্ব রক্ষক। দয়াময় প্রভু! জগতে যে দিকেই তাকাই সেই দিকেই তোমার করুনা এবং দয়ার আদর্শ দেখতে পাই। কি কারণে – কি অপরাধে আমার এই দুর্দশা হলো, বুঝতে পারি না। পাষান্ড নরপিশাচ কাফের এজিদ আমার সর্বনাশ করে একেবারে নিঃশেষ করল, একেবারে বংশনাশ করিল। দয়াময় ! তুমি কি তার বিচার করিবে না।
এই কথাগুলো বলে, ইমাম হোসাইন অস্ত্র সজ্জিত হয়ে দুলদুল ঘোড়ার পিঠে চড়ে কারবালার প্রান্তরে এজিদের সৈন্য বাহিনীর সামনে চলে আসল। সকলের অন্তর কাপিয়া উঠল। সকলেই দেখতে পেল, স্বয়ং ইমাম হোসাইন যুদ্ধ ক্ষেত্রে এসেছে। মহাবীর ইমাম হোসাইন উচ্চস্বরে বলতে লাগলেন, ওরে নরপিশাচ কাফের পাপাত্না এজিদ! তুই কোথায়? তুই নিজে দামেস্কে থেকে নিরীহ সৈন্যগণকে কেন পাঠাইয়াছিস? আজ তোকে পেলে বংশ বধ বেদনা, ভাইয়ের ছেলে কাসেমের বিচ্ছেদ বেদনা এবং নিজ পুত্রগণের বিয়োগ-বেদনা, সমস্তই আজ তোর পাপ শোণিতে শীতল করতাম। তোর প্রতি লোম হতে রক্ত বের করে লোমে লোমে প্রতিশোধ নিতাম। জানলাম, কাফের মোনাফেক মাত্রই চতুর। ওরে নরপিশাচ নৃশংস মোনাফেক এজিদ! অর্থলোভ দেখাইয়া পরের সন্তানগণকে অকালে নিধন করবার নিমিত্তে পাঠাইয়াছিস।
ওরে অর্থলোভী নরপিশাচরা! ধর্মভয় বিসর্জন দিয়ে আমার বিরুদ্ধে অস্ত্রধারন করেছিস। আয় দেখি, কে সাহস করে আমার অস্ত্রের সম্মুখে আসবি, আয়! আর বিলম্ব কেন? এজিদ পক্ষের সর্বশ্রেষ্ঠ যোদ্ধা আবদুর রহমান- ইমাম হোসাইনের সাথে যুদ্ধ করতে তার চির সাধ। ঘোড়ার পিঠে চড়ে আবদুর রহমান তলোয়ার চালনা করিতে করিতে ইমাম হোসাইনের সামনে এসে বলতে লাগল হোসেন! তুমি আজ শোকে তাপে মহাকাতর! বোধহয়, আজ ১০দিন তোমার পেটে খাবার নাই ; পিপাসায় কন্ঠ তালু শুকিয়ে গেছে। এই কয়েক দিন যে, কেন বেঁচে আছ বলতে পারি না। আর কষ্টভোগ করতে হবে না, শীঘ্রই তোমার মনের দুঃখ নিবারণ করতেছি।
বড় গৌরবের সাথে তলোয়ার চালনা করে বেড়াইতেছ; এই আবদুর রহমান তোমার সামনে দাঁড়াইল, যত শক্তি থাকে, আগে তুমিই আমাকে আঘাত কর। লোকে বলবে যে, পিপাসা কাতর, ক্ষুথার্ত এবং পরিবার – পরিজন হারিয়ে শোক-কাতর বীরের সাথে কে না যুদ্ধ করতে পারে? এ বদনাম আমি সহ্য করতে পারব না। তুমিই আগে আঘাতপ্রাপ্ত কর। তোমার বল বুঝিয়া দেখি; যদি আমার অস্ত্রের আঘাত সহ্য করবার উপযুক্ত হও, তাহলে আমি প্রতিঘাত করব।
ইমাম হোসাইন বললেন, এত কথার প্রয়োজন নাই। আমার বংশ মধ্যে কিংবা মুসলিম জাতির মধ্যে আগে অস্ত্র নিক্ষেপের রীতি থাকলে তুমি এত কথা বলবার সময় পাইতে না। নরপিশাচ, বেঈমান, কাফের, মোনাফেক এবং নামধারী মুসলমান শীঘ্রই যেকোন অস্ত্র আমার প্রতি নিক্ষেপ কর। সমর ক্ষেত্রে এসে বাকবিন্ডতার দরকার কি? অস্ত্রই বল পরীক্ষার প্রধান উপকরণ! কেন বিলম্ব করিতেছিস? যেকোন অস্ত্র হোক, একবার নিক্ষেপ করলেই তোর যুদ্ধ সাধ মিটাইতেছি। বিলম্বে তোর মঙ্গল বটে, কিন্তু আমার অসহ্য।
ইমাম হোসাইনের মাথা লক্ষ্য করে তরবারি উত্তোলন পূর্বক, হোসেন তোমার মাথার মূল্য লক্ষ্য দিরহাম। বাদশাহ নামদার মহামান্য এজিদ তোমার মাথার মূল্য ধার্য করেছে লক্ষ দিরহাম। তোমার মাথা কেটে নিতে পারলেই, তোমার মাথা বর্শায় বিদ্ধ করে নিয়ে দামেস্কে নগরে গিয়ে বিজয় মিছিল করব এবং তোমার মাথা সামনে রেখে দুই রাকাত শোকরানা নামাজ পড়ব আল্লাহর দরবারে। উক্ত কাজ করতে পারলে মহামান্য বাদশাহ এজিদের কাছ থেকে লক্ষ দিরহাম পুরস্কার পাব। এই বলে আবদুর রহমান তরবারি আঘাত করলেন। ইমাম হোসাইন আবদুর রহমানের তরবারির আঘাত বীরত্বের সাথে ফিরিয়ে দিল। রহমান লজ্জিত হয়ে পালানোর উপক্রম হলো।
ইমাম হোসাইন বললেন, আগে সহ্য কর পরে পলায়ন করিস। এই কথা বলে এক আঘাতে রহমানের দেহ দ্বিখন্ডিত করে ফেললেন। এই ঘটনা দেখে এজিদের সৈন্যগণ মহাভয়ে কাঁপতে লাগল। কেউ আর ইমাম হোসাইনের সামনে আসতে সাহস করল না। সবাই বলতে লাগল, যদি ইমাম হোসেন আজ এ সময় পিপাসা মিটাতে বিন্দুমাত্র পানি পায়, তাহলে আমাদের একটি প্রাণীও তার হাত হতে প্রাণ বাঁচাতে পারবে না। যুদ্ধ যতই হোক, বিশেষ সতর্ক হয়ে দ্বিগুণ সৈন্য দ্বারা ফোরাত নদী ঘিরে রাখ। যে মহাবীর এক আঘাতে আবদুর রহমানকে নিপাত করল, তার সামনে কে সাহস করে দাঁড়াবে ? আমরা রহমানের গৌরবেই চিরকাল গৌরব করিয়া বেড়াই, তারই যখন এই দশা হলো, তখন আমরা তো হোসেনের ঘোড়ার আঘাতেই শেষ হয়ে যাব। পরস্পর এই কথা বলাবলি করে, সকলেই একমতে দ্বিগুণ সৈন্য দ্বারা বিশেষ সুদৃঢ়রুপে ফোরাত নদী বন্ধ করল।
ইমাম হোসাইন অনেক ক্ষণ পর্যন্ত যুদ্ধের ময়দানে কাউকে না পেয়ে শক্রুর শিবিরমুখে ঘোড়া পরিচালনা করলেন। মুহূর্তে অনেকেরই প্রাণ উড়ে গেল। কেউ ঘোড়ার পায়ের আঘাতে জাহান্নামে গমন করল, কেউ কেউ সাহসের উপর নির্ভর করে ইমাম হোসাইনের সামনে সশস্ত্র হয়ে দাঁড়াইল। কিন্তু হাতের অস্ত্র হাতেই রয়ে গেল, মাথাগুলি দেহ হতে বিচ্ছিন্ন হয়ে দুরে নিক্ষিপ্ত হতে লাগল। মহাবীর ইমাম হোসাইন কাফেরগণকে যেখানে পাইলেন, সেখানেই তাকে মেরে জাহান্নাম পরিপূর্ণ করতে লাগলেন। শিবিরের অবশিষ্ট সৈন্যগন প্রাণভয়ে যারা যেদিকে সুবিধা মত দ্রুতগতিতে সেই দিকে দৌড়াইয়া প্রাণ রক্ষা করল। যারা তার সামনে দৌড়াইয়া আসিল, তারা কেউ প্রাণ রক্ষা করতে পারল না। সকলেই ইমাম হোসাইনের অস্ত্রের আঘাতে দ্বিখন্ডিত হয়ে পাপময় দেহ পাপ রক্তে ভাসাইয়া জাহান্নামী হলো। অবশিষ্ট সৈন্যগণ কারবালার পাশের বিজন বনের মধ্যে পালাইয়া প্রাণ রক্ষা করল। ওমর, সীমার, আবদুল্লাহ জেয়াদ প্রভৃতি সকলেই ইমাম হোসাইনের ভয়ে বনের মধ্যে লুকাইল।
শক্রু পক্ষের শিবির সৈন্য একেবারে নিঃশেষ করে ইমাম হোসাইন ফোরাত নদীর দিকে ঘোড়া চালালেন। ফোরাত নদীর রক্ষীরা হঠাৎ পালালো না, কিন্তু অল্প ক্ষণের ভিতরে ইমাম হোসাইনের তরবারির আঘাত সহ্য করবার সাধ্য হলো না। কেউ পানিতে ঝাঁপ দিয়ে পড়ল, কেউ জঙ্গলে লুকালো, কেউ অন্য দিকে পালালো। কিন্তু বেশীরভাগ সৈন্যই ইমাম হোসাইনের অস্ত্রের আঘাতে দ্বিখন্ডিত হয়ে রক্ত স্রোতের সাথে ফোরাত নদীর স্রোতে ভেসে চলল। কোন স্থানে শক্রু সৈন্যের নাম মাত্র নেই। আজ ইমাম হোসাইনের অস্ত্রের আঘাতে কারবালা প্রান্তর একেবারে জনমানব শূন্য এবং নীরব প্রান্তর ইমাম হোসাইন পানি পিপাসায় এমনি কাতর হয়েছেন যে, আর কথা বলবার শক্তি নাই। এতক্ষণ সমূলে কাফেরদের বিনাশ করেছে, এখন শক্রু শেষ হলো এবং পিপাসাও অসহ্য হয়ে উঠিল। অতি শীঘ্রই ইমাম হোসাইন ফোরাত নদীর পানিতে নামলেন এবং পানি দেখে মনে হলো সমস্ত নদীর পানি পান করতে। দুই হাতে পানি তুলে মুখে দিবেন, এমন সময় সমুদয় পূর্বের কথা মনে পড়িল।
আত্মীয় বন্ধুর কথা মনে পড়িল, ইমাম হাসানের পুত্র কাসেমের কথা মনে পড়িল, আলী আকবরের কথা মনে পড়িল এবং দুধের শিশু আলী আজগরের কথা মনে পড়িল। একবিন্দু জলের জন্য তারা কত লালায়িত হয়েছেন, কত কাতরতা প্রকাশ করেছে, কত কষ্ট ভোগ করেছে, এই পানির জন্য আমার পরিজনরা পুত্রহারা, স্বামীহারা, ভাইহারা হয়ে মাথা ভেঙে মরছে, আর আমি এখন শক্রুর হাত হতে ফোরাত নদী উদ্ধার করে সর্বাগ্রেই নিজে সেই জলপান করব ! নিজের প্রাণ পরিতৃপ্ত করব – আমার প্রাণের মায়া কি এতই অধিক হলো?
এই জলের জন্য আলী আকবর আমার জিহ্বা পর্যন্ত চুষছে। এক পাত্র পানি পেলে আমার বংশের উজ্জ্বল মণি মহাবীর কাসেম আজ শক্রুর হাতে প্রাণ ত্যাগ করত না। এখনো যারা শিবিরের মধ্যে জীবিত আছে, তারা পানির পিপাসায় কাতর হয়ে মৃত্যুর সাথে লড়ছে। এ পানি আমি কখনোই পান করব না, ইহজীবনেই আর পান করব না। এই কথা বলে হাতের তালুতে রাখা পানি ফেলে নদীর তীরে উঠলেন। কি ভাবিলেন তিনিই জানেন। একবার আকাশের দিকে তাকিয়ে যুদ্ধের সকল অস্ত্র মাটিতে ফেলে দিলেন। আজ ভ্রাতৃশোক, পুত্রশোক এবং সকল শোক একত্রে এসে তাকে যেন যন্ত্রণা দিতে লাগল। কি মনে হলো, তাহাতেই বোধহয় যুদ্ধের সকল পোশাক খুলে ফেললেন এবং অস্ত্রশস্ত্র দূরে নিক্ষেপ করে ফোরাত নদীর দিকে এক দৃষ্টিতে চেয়ে রইলেন। ইমাম হোসাইনের দুলদুল ঘোড়া প্রভুর হাত,পা ও মাথা শূন্য দেখে দুই চোখ হতে অনবরত অশ্রু ফেলতে লাগল।
আবদুল্লাহ জেয়াদ, ওমর, সীমার এবং সৈনিকগণ যারা লুকাইয়াছিল তারা দূর থেকে সবকিছু দেখল। এই সুযোগে নরপিশাচ এজিদের সকল সৈন্য ইমাম হোসাইনকে ঘিরে ফেলল। ইমাম হোসাইন স্থিরভাবে দাড়িয়ে আছেন, কাউকে কিছু বলতেছেন না এবং মুখে কোন কথা নাই। এই সুযোগে ইবনে জেয়াদ ইমাম হোসাইনকে লক্ষ্য করে বিষাক্ত লৌহ তীর নিক্ষেপ করল।শত-শত বিষাক্ত তীর ইমাম হোসাইনের শরীরে বিদ্ধ করল।ইমাম হোসাইন চারিদিকে চেয়ে দেখলেন, জেয়াদ, অলীদ, ওমর, সীমার এবং সকল এজিদের সৈন্যগণ চারদিকে ঘিরে রেখেছে। সকলের হাতেই তীরধনুক এবং তরবারি। বিষাক্ত তীরবিদ্ধ ক্ষতস্হানের জ্বালা – যন্ত্রনা, পিপাসার জ্বালা, শোক তাপ, বিয়োগদুঃখ এবং নানা রকম জ্বালা – যন্ত্রনায় অস্থির হয়ে পড়লেন।
জেয়াদ, ওমর, অলীদ এবং সীমার ভাবল যে, ইমাম হোসেনের মৃত্যু হয়েছে। যেহেতু ইমাম হোসেন মাটিতে পড়ে শুয়ে রয়েছেন। কেউ কেউ নিশ্চিত মৃত্যু অনুমান করতেছে, মুখেও বলতেছে যে ইমাম হোসেন আর নেই ! চল হোসেনের মাথা কেটে আনি। দুই এক পা যেয়ে আর অগ্রসর হতে সাহস পায় না। ইমাম হোসেনের মৃত্যুর সংবাদ মহামান্য বাদশাহ এজিদের নিকট নিয়ে গেলে কোন লাভ নাই। এজিদ এই সংবাদ বিশ্বাস করে কখনোই পুরস্কার দিবে না। কারণ বাদশাহ এজিদ আমাদেরকে ইমাম হোসেনের মাথা কেটে নিতে বলেছে। যেকোন মূল্যে ইমাম হোসেনের মাথা চাই। সীমার ভেবে বলল জেয়াদ! তুমি তো খুব সাহসী, তুমিই মৃত ইমাম হোসেনের মাথা কেটে আন।
জেয়াদ বলল,ইমাম হোসেনের মাথা কাটা আমার হাত দ্বারা হবে না এবং সাহসও হবে না। আমি ইহা পারব না। যদি দুর্বলতার কারণে ইমাম হোসেন ধরাশায়ী হয়ে থাকে কিংবা অন্য কোন মতলবে মরার ন্যায় মাটিতে পড়ে থাকে, আমাকে হাতে পেলে বল তো আমার কী দশা ঘটবে ? যার ভয়ে জঙ্গলে পালাইয়া প্রাণ রক্ষা করেছি, ইচ্ছা করে তার হাতে পড়ব ? আমি তো কখনোই যাব না ? মাথা কাটিয়া আনা তো দূরের কথা, নিকটেও যাইতে পারব না। অলীদকে সম্বোধন করে সীমার বলল, ভাই অলীদ ! তোমার ইচ্ছা কি ? তুমি ইমাম হোসেনের মাথা কেটে আন। অলীদ উত্তর দিল, আমি ইমাম হোসেনের মাথা কেটে আনতে পারব না। আমার এত সাহস নেই। জেয়াদ যে কথা বলেছে, আমারও সেই একই কথা।
গৌরবের সাথে সীমার বলে উঠল, দেখলাম তোমাদের বীরত্ব ! দেখলাম তোমাদের সাহস ! বুঝলাম তোমাদের ক্ষমতা। এই দেখ, আমি ইমাম হোসেনের মাথা কেটে আনি। এই কথা বলে সীমার ছোরা হাতে নিয়ে এক লাফে ইমাম হোসেনের বুকের উপর গিয়ে বসল। সীমার বুকের উপর চড়ে গলা কাটতে উদ্যত হলো। ইমাম হোসাইন এখনো জীবিত আছে। উঠবার শক্তি নাই। চোখ মেলে বুকের উপর ছোরা হাতে সীমারকে দেখে বলতে লাগল, তুমি আল্লাহর সৃষ্ট জীব – তুমি আমার বুকের উপর বসলে। তুমি নূরনবী মুহাম্মদ (সঃ) এর উম্মত হয়ে ইমাম হোসাইনের বুকের উপর পা রেখে বসলে। তোমার কি পরকাল বলে কিছুই মনে নেই? এমন গুরুতর পাপের জন্য তুমি কি একটুও ভয় পাও না। তুমি জান আমি কে ? আমার নানা হযরত মুহাম্মদ সঃ হলেন, মানবজাতির মুক্তির ও শাফায়েতের কান্ডারি। যার শাফায়াত ছাড়া কোন মানুষ জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না।
সেই নানা আমাদের দুই ভাইকে নিজের পিঠের উপর নিয়ে খেলা করত। আবার বলত, আমি ইমাম হোসাইন থেকে এবং ইমাম হোসাইন আমার হতে। কেউ ইমাম হোসাইনকে কষ্ট দিলে, সে যেন আমাকে কষ্ট দিল এবং যে ইমাম হোসাইনকে ভালবাসবে, সে যেন আমাকে ভালবাসল। আমার এই শরীরে নানাজান চুমু খেয়েছে। আমার পিতা হলেন,আলী বেলায়েতের সম্রাট এবং সকল মুমিনদের অভিভাবক। আমার নানা ছিলেন জ্ঞানের শহর এবং আমার পিতা ছিলেন জ্ঞানের দরজা। আমার মাতা হলেন, পৃথিবীর সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ রমনী। যিনি মহিলাদের জান্নাতের সর্দারনী। আর আমি হলাম সকল যুবকদের জান্নাতের সর্দার। তোমার কি একবারও বুক কাপবে না, আমাকে হত্যা করতে ? আমি তো তোমাদের কোন ক্ষতি করি নাই। তবে কেন আমার প্রতি তোমাদের এত অত্যাচার ?
সীমার বলল, আমি কাউকে ভয় করি না, একমাত্র আল্লাহ ছাড়া। ইমাম হোসেন তুমি দেখ না, আমরা দশদিন ধরে সঠিক সময়ে জামাতে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়েছি। এক ওয়াক্ত নামাজ কাযা করি নাই। আমরা সবসময় পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করি। এটা মহামান্য বাদশাহ এজিদের হুকুম। তোমার মুখে দাড়ি আছে, গায়ে জুব্বা আছে এবং মাথায় পাগড়ী আছে। ঠিক অনুরূপভাবে আমাদের সকল এজিদ সৈন্য বাহিনীদের দাড়ি,জু্ব্বা, পাগড়ি আছে। ইমাম হোসেন তুমিও আল্লাহকে ডাক, আমরাও আল্লাহকে ডাকি। তোমার নানা মুহাম্মদ, তোমার পিতা আলী, তোমার মা ফাতেমা এবং তুমি যেমন আল্লাহর বান্দা। ঠিক তেমন আমরা মহামান্য এজিদের সৈন্য বাহিনীরা আল্লাহর বান্দা। তোমাদের সাথে আমাদের কোন প্রার্থক্য নাই। ( নাউজুবিল্লাহ )। নূরনবী মুহম্মদ কে ? আমি তাকে চিনি না। তোমার বুকের উপর বসিয়াছি বলে পাপের ভয় দেখাইতেছ। সে ভয় আমার নাই। কারণ আমি এখন এই ছোরা দ্বারা তোমার মাথা কেটে নিব। এটা মহামান্য বাদশাহ এজিদের হুকুম। তিনি হলেন সমগ্র আরব জাহানের খলিফা। হযরত মাবিয়া এবং আল্লাহ যাকে মনোনয়ন করে গেছে। (নাউজুবিল্লাহ )।
তাই খলিফা এজিদের হুকুম পালন করা ফরজ। তোমার মাথা কেটে লক্ষ দিরহাম পুরস্কার পাব। তাতে তোমার বুকের উপর বসিতে আবার পাপ কিসের?
(মোয়াবিয়া মৃত্যুর আগে লোক সম্মুখে, আল্লাহর কাছে মুনাজাত করে, হে আল্লাহ! আমার সন্তান এজিদ যদি তোমার দৃষ্টিতে বর্তমান সময়ে সবচেয়ে যোগ্য, ভালো এবং ঈমানদার মনে কর, তাহলে তুমি তাকে মুসলিম খেলাফতের খলিফা বানিয়ে দাও। আর যদি তাকে অযোগ্য এবং খারাপ মনে কর, তাহলে এখনই তাকে মৃত্যু দাও। আমার সামনে এখন কঠিন বিপদ, আমি কি ইমাম হোসেনকে খলিফা নিযুক্ত করব নাকি এজিদকে নিযুক্ত করব ? আমি যদি এজিদকে খলিফা নিযুক্ত করি তাহলে সবাই বলবে, আমার নিজ ছেলে বলে তাকে আমি খলিফা নিযুক্ত করেছি। যদি এজিদ এখনই মারা যায়, তাহলে আমি ইমাম হোসেনকে খলিফা নিযুক্ত করব। আর যদি এজিদ এখনই মারা না যায়, তাহলে ভেবে নিব; এজিদই বর্তমান সময়ে তোমার কাছে সবচেয়ে যোগ্য ও ঈমানদার ব্যক্তি। তাহলে আমি এজিদকে তোমার আদেশ অনুসারে এখনই খলিফা নিযুক্ত করে যাব। এই কথা কিছুক্ষণ বলে মোয়াবিয়া সবাইকে বললো, দেখেন আপনারা সবাই এজিদ মারা যায় নাই। তার মানে আল্লাহ এজিদকে খলিফা নিযুক্ত করেছে। এখন থেকে এজিদই মুসলিম জাহানের খলিফা। আপনারা সবাই এজিদের আদেশ – নির্দেশ মেনে চলবেন। কারণ সে ইমাম হোসেনের চেয়ে বেশী মর্যদাবান এবং ঈমানদার। এজিদ সরাসরি আল্লাহ কর্তৃক মনোনীত, যা আপনারা চাক্ষুষ সাক্ষী। সুতরাং এজিদের হুকুম পালন করা ফরজ। এভাবেই চতুর মোনাফেক মোয়াবিয়া সকল লোকজনকে ধোঁকা দিয়ে, এজিদকে মুসলিম জাহানের খলিফা নিযুক্ত করে যান। এটা ছিল মাবিয়ার সম্পূর্ণ কূটকৌশল এবং চালাকি। এই জন্যই সীমার ইমাম হোসাইনের সাথে এভাবে কথা বলল )।
সীমার আমি এখনই মরিব। বিষাক্ত তীরের আঘাতে আমি অস্থির হয়ে আছি। বুকের উপর হতে নেমে আমাকে নিঃশ্বাস ফেলতে দাও। একটু বিলম্ব কর ! একটু বিলম্বের জন্য কেন আমাকে কষ্ট দিবে ? আমার প্রাণ বের হয়ে গেলে মাথা কেটে নিও। দেহ যত খন্ড করতে ইচ্ছা হয়, করিয়ো। একবার নিঃশ্বাস ফেলতে দাও ! আজ নিশ্চয়ই আমার মৃত্যু। ক্ষণকাল অপেক্ষা কর। সীমার অতি কর্কশস্বরে বলল, আমি তোমার বুকের উপর চেপে বসেছি, মাথা না কেটে উঠব না। যদি অন্য কোন কথা থাকে, বল। বুকের উপর হতে একটুও সরে বসব না। এই বলে সীমার আরো শক্তভাবে চেপে বসে ইমাম হোসাইনের গলায় ছোরা চালাইতে লাগল ইমাম হোসাইন বলতে লাগলেন, সীমার ! আমার প্রাণ-পাখি এখনই বের হবে, একটু বিলম্ব কর। এই কষ্টের উপর আর কষ্ট দিয়ে আমাকে মেরো না। কে শুনে কার কথা ! সীমার ধারালো ছোরা ইমাম হোসাইনের গলায় সজোরে চালাইতে লাগল। কিন্তু চুল পরিমাণ কাটতে সক্ষম হলো না। হাত দ্বারা বারবার ছোরার ধার পরীক্ষা করে দেখল। পুনরায় অধিক জোরে ছোরা চালাইতে লাগল। কিছুতেই কিছু হল না, বিন্দু পরিমাণ চামড়া কাটলো না।
ইমাম হোসাইন বলল সীমার ! কেন বারবার এ সময় আমাকে কষ্ট দিতেছ। শীঘ্রই মাথা কেটে ফেল ! আর সহ্য হয় না। অনর্থক আমাকে কষ্ট দিয়ে তোমার কি লাভ হইতেছে ? শীঘ্রই আমার মাথা কেটে ফেল।
সীমার বলল, আমি তো কাটিতে বসেছি। সাধ্যানুসারে চেষ্টা করতেছি। ছোরায় না কাটিলে আমি আর কি করব। এমন সুতীক্ষ্ম ধারালো ছোরা তোমার গলায় বসতেছে না, আমার দোষ কী – আমি কি করব?
ইমাম হোসাইন বলল সীমার ! আমার একটি কথা আজ মনে পড়েছে। যার কারণে তোমার ছোরা আমার গলা কাটতেছে না, তোমারও পরিশ্রম বৃথা হচ্ছে। আর আমিও যারপরনাই কষ্টভোগ করতেছি।
সীমার ! আমার নানা জগৎ বিখ্যাত হযরত মুহাম্মদ সঃ প্রায় সময় আদর করে আমার গলায় চুমু দিত। সেই পবিত্র ঠোঁটের চুমুর কারণেই তোমার তীক্ষ্ণ ধার ছোরা বারবার ব্যর্থ হচ্ছে। আমার মাথা কাটতে তোমাকে নিষেধ করছি না; আমি বিনয় করে বলছি, আমার গলার পিছনে ছোরা বসাও। দেখবে, অবশ্যই আমার মাথা দ্বিখন্ডিত করতে পারবে। তা না হলে সারাজীবন ছোরা চালাইলেও, আমার মাথা কাটতে সফল হবে না।
সীমার বলল – না,তা কখনো হবে না। আমি অবশ্যই এই প্রকারে তোমার মাথা কাটব।
ইমাম হোসাইন বলল – সীমার ! আমাকে এ প্রকার কষ্ট দিয়ে তোমার কি লাভ ? এইভাবে কিছুতেই সম্ভব নয়। আমি মিনতি করে বলতেছি, আমার গলার সামনে দিকে আর ছোরা চালাইও না। তোমার চেষ্টা বিফল হবে, আমিও কষ্ট পাব অথচ মাথা কাটতে পারবে না। দেখ, নিঃশ্বাস ফেলতে আমার বড় কষ্ট হচ্ছে। এ জীবনে আমি কখনো মিথ্যা কথা বলি নাই। তুমি আমার গলার পিছনের দিকে ছোরা চালাও, এখনই ফল দেখতে পারবে। আমাকে এই প্রকারে কষ্ট দিলে এজিদের অঙ্গীকারকৃত লক্ষ দিরহাম অপেক্ষা তোমার আর কি অধিক লাভ হবে?
সীমার আর কোন উপায় না দেখে, ইমাম হোসাইনের কথামত গলার পিছন দিকে ছোরা চালিয়ে মাথা দ্বিখন্ডিত করে ফেলল। সীমার ইমাম হোসাইনের বুকের উপর থেকে উঠে মাথা নিয়ে হাসতে হাসতে সবাইকে বলল, চলো এবার দামেস্ক নগর মহামান্য এজিদের কাছে। দামেস্ক নগরে গিয়ে আসরের নামাজ সবাই জামাতের সহিত পড়ব। বাদশাহ এজিদ ইমাম হোসেনের মাথার জন্য অপেক্ষা করছে। আমরা মহামান্য এজিদের পূর্ব প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী ইমাম হোসেনের মাথা সামনে রেখে, আল্লাহর নিকট দুই রাকাত শোকরানা নামাজ আদায় করব। আজ যে আমাদের বড়ই খুশির দিন। এই খুশিতে ইমাম হোসেনের মাথা বর্শায় বিদ্ধ করে সারা দামেস্ক নগরে বিজয় মিছিল করব। সীমার এই কথাগুলো বলে, ইমাম হোসাইনের মহাপবিত্র মাথা মোবারক বর্শায় বিদ্ধ করে, সবাই আল্লাহ আকবার এবং এজিদের নামে ধ্বনি দিতে দিতে দামেস্ক নগরের দিকে রওনা হলো। ( সাথে রাসূল পাক সঃ এর পরিবারের সকল মহিলা সদস্যদের বন্দী করে নিয়ে যায় )।
এদিকে ইমাম হোসাইনের মাথা বিহীন পবিত্র দেহ মোবারক পড়ে আছে। যেন বলতে লাগলেন, আজ জগৎ দেখুক, আমি কি অবস্হায় চললাম! নুরনবী মুহাম্মদ সঃ এর নাতি, জগত জননী মা ফাতেমার নয়নের মণি কলিজার টুকরা, মদিনার রাজা মহাবীর আলীর পুত্র হয়ে শূন্য হাতে নরপিশাচ কাফের এজিদের চক্রান্তে নিষ্ঠুর সীমারের অস্ত্রঘাতে কিভাবে আমি ইহ সংসার হতে বিদায় হলাম। নানা গো তোমার নামধারী উম্মতরা আমার কি অবস্থা করছে! তোমার ইমাম হোসাইন যে আজ বড় নিষ্ঠুর নির্মমতার শিকার। তুমি তো সবই দেখতেছ, ওরা আমায় কত কষ্ট নির্যাতন করে হত্যা করেছে। আজ আমি আমার নানার উম্মতের মুক্তির জন্য কারবালা প্রান্তরে শহীদ হলাম। জগৎ আজ প্রাণভরে দেখুক। ইমাম হোসাইনি প্রেমিকরা কখনো কারবালার বিয়োগ ব্যথা ভুলতে পারবে না। আমার প্রেমিকরা যখনই কারবালার কথা মনে পড়বে, তখনই তারা অঝোর নয়নে কাঁদবে। তারা কখনো এজিদের দোসরদের সাথে আপোষ করবে না।
আর এজিদ প্রেমিকরা কারবালার ইতিহাস ঢেকে রাখার চেষ্টা করবে। যাতে কারবালার করুন ইতিহাস প্রকাশ না পায়। আজ আকাশ -বাতাস, গাছ -পালা, সাগর -পর্বত এবং মাটি ভেদ করিয়া চারদিক হতে শোকের মাতম চলছে আর বলছে, “হায় হোসেন”, “হায় হোসেন”, “হায় হোসেন “, “হায় হোসেন “, “হায় হোসেন”।
“ইমাম হোসাইনের প্রতি নাই যার প্রেম, কে বলে মানুষ তারে পশু সেই জন”।
নিবেদক : অধম পাপী মোজাম্মেল পাগলা।