কবরকে মাজার বানানো যেভাবে শুরু হলো

কবরকে মাজার বানানো যেভাবে শুরু হলো

পৃথিবীতে মৃত মানুষের কবরকে রওজা অথবা স্মৃতিচিহ্ন হিসাবে মাজার বানানো কবে থেকে শুরু হলো তা নিয়ে আলোচনা:- পৃথিবীতে মৃত মানুষের কবরকে রওজা, মাজার বা স্মৃতিচিহ্ন হিসেবে নির্মাণের ইতিহাস বহু পুরাতন এবং এটি বিভিন্ন ধর্ম, সংস্কৃতি ও সভ্যতার অংশ হিসেবে গড়ে উঠেছে। বিভিন্ন সময় ও সভ্যতায় এটি ভিন্নভাবে প্রচলিত হয়েছে।

প্রাচীন সভ্যতায় কবর ও স্মৃতিচিহ্ন নির্মাণের ইতিহাস

১. মিশরীয় সভ্যতা (প্রায় ২৬৫০ খ্রিস্টপূর্ব)
প্রাচীন মিশরীয়রা ফেরাউনের মৃতদেহ সংরক্ষণ (মমি) করে পিরামিড তৈরি করত। এটি ছিল তাদের বিশ্বাস অনুযায়ী মৃত রাজাদের সম্মান জানানোর উপায়।

সবচেয়ে বিখ্যাত পিরামিড হলো গিজার পিরামিড, যা প্রায় ৪,৫০০ বছর আগে নির্মিত হয়।

২. গ্রিক ও রোমান সভ্যতা (প্রায় ৫০০ খ্রিস্টপূর্ব – ৫০০ খ্রিস্টাব্দ)
গ্রিক ও রোমানরা বিশিষ্ট ব্যক্তিদের কবরের উপর বড় স্মৃতিস্তম্ভ ও মন্দির নির্মাণ করত।

বিখ্যাত উদাহরণ হলো মৌসোলাসের সমাধি (Mausoleum at Halicarnassus), যা বিশ্বের সপ্তাশ্চর্যগুলোর একটি।

৩. ভারতীয় সভ্যতা ও বৌদ্ধ স্থাপত্য (প্রায় ৩য় শতাব্দী খ্রিস্টপূর্ব):
সম্রাট অশোকের আমলে (৩য় শতাব্দী খ্রিস্টপূর্ব) বৌদ্ধদের স্তূপ নির্মাণ শুরু হয়, যেখানে গৌতম বুদ্ধ বা বিশিষ্ট বৌদ্ধ ভিক্ষুদের দেহাবশেষ রাখা হতো।

বিখ্যাত উদাহরণ: সাঁচির স্তূপ (Sanchi Stupa)।

ইসলামে রওজা ও মাজার নির্মাণের প্রচলন

১. ইসলামের প্রাথমিক যুগ (৭ম – ৮ম শতাব্দী):
ইসলাম ধর্মের শুরুতে সাধারণ কবরই প্রচলিত ছিল, এবং মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) সাধারণ কবরকে সমর্থন করতেন। তাঁর নিজের কবর মসজিদে নববীর পাশে অবস্থিত, যা পরবর্তীতে রওজা শরিফ নামে পরিচিত হয়।

২. সুফিবাদ ও মাজার সংস্কৃতি (১০ম – ১৩শ শতাব্দী):
সুফি সাধকরা ইসলামের ভালোবাসা, আধ্যাত্মিকতা ও মানবসেবার বার্তা প্রচার করতেন। তাদের মৃত্যুর পর অনুসারীরা তাদের কবরকে মাজার হিসেবে সম্মান জানাতে শুরু করে। বিখ্যাত সুফিদের মধ্যে খাজা মঈনুদ্দিন চিশতি (Ajmer, ভারত), শাহ জালাল (বাংলাদেশ), দাতা গঞ্জ বাকশ (লাহোর, পাকিস্তান) প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য।

এই সময় থেকেই সুফি দরবেশদের কবরকে সম্মান জানিয়ে মাজার নির্মাণের সংস্কৃতি জনপ্রিয় হয়।

৩. মুঘল ও উসমানীয় সাম্রাজ্য (১৫শ – ১৮শ শতাব্দী):
মুঘল সম্রাটরা বিশাল কবর-সমাধি নির্মাণ করত, যেমন তাজমহল (শাহজাহান ও মুমতাজের সমাধি), হুমায়ুনের সমাধি (দিল্লি)। উসমানীয় শাসকরা

পবিত্র ব্যক্তিদের কবর সংরক্ষণ করত, যেমন রুমি ও অন্যান্য সুফিদের মাজার।

আধুনিক যুগে মাজার ও রওজা সংস্কৃতি

আজও বিশ্বজুড়ে সুফিদের মাজার, বিভিন্ন ধর্মীয় নেতার রওজা ও ঐতিহাসিক সমাধি সংরক্ষিত হয়।
কিছু মুসলিম গোষ্ঠী (বিশেষ করে সালাফি ও ওয়াহাবি মতবাদ অনুসারীরা) মাজার সংস্কৃতিকে ইসলামের মূল নীতির পরিপন্থী মনে করলেও সুফি মতবাদ অনুসারীরা এটিকে সম্মান ও ভালোবাসার প্রতীক হিসেবে দেখে।

শেষ কথা:-
কবরকে স্মৃতিচিহ্ন, রওজা বা মাজার হিসেবে গড়ে তোলার প্রথা বহু প্রাচীনকাল থেকে চলে আসছে। এটি বিভিন্ন ধর্ম ও সংস্কৃতির মধ্যে ভিন্ন ভিন্ন রূপে প্রকাশ পেয়েছে। ইসলামে প্রাথমিকভাবে সাধারণ কবর প্রচলিত থাকলেও সুফি ও মুঘলদের মাধ্যমে মাজার ও রওজা নির্মাণের সংস্কৃতি জনপ্রিয় হয়ে ওঠে, যা আজও বহমান।

– ফরহাদ ইবনে রেহান
২৯/০১/২০২৫

আরো পড়ুনঃ
Sufibad24.com | WhatsApp চ্যানেল

Sufibad24.com | Telegram Channel