হযরত খিজির আঃ ও মূসা (আঃ) এর শিক্ষনীয় ঘটনা
পবিত্র কুরআনে (সূরা ১৮ কাহাফঃ ৬০-৮২) ও হাদীস থেকে আরও একটি কাহিনী প্রনিধানযােগ্য। তাহা হইল, হযরত মুসা (আঃ) ও হযরত খিজির (আঃ) এর কাহিনী। পাক কুরআন ও হাদীস শরীফে এর বিবরন আছে। বােখারী শরীফে মােট ১২ জায়গায় এই কাহিনী বর্ণিত হইয়াছে।
হযরত মুসা (আঃ) অন্যতম উলুল আজম পয়গম্বর ছিলেন। এলমে জাহের ও বাতেন -উভয় জ্ঞানেই তিনি জ্ঞানী ছিলেন। তবে এলমে লাদুন্নীর পরিপূর্ণতা হয়তাে তাঁহার ছিল না।
আল্লাহতায়ালা একদা হযরত মূসা (আঃ) কে জ্ঞান অর্জনের জন্য হযরত খিজির (আঃ) এর নিকট পাঠাইলেন। হযরত খিজির (আঃ) এর নিকট পৌছাইয়া হযরত মুসা (আঃ) বলিলেন, “আমি কি আপনার সংগে থাকিতে পারি এই উদ্দেশ্যে যে, আপনি আপনার আলাহপ্রদত্ত বিশেষ জ্ঞান হইতে আমাকে কিছু শিক্ষা দিবেন?’ হযরত খিজির (আঃ) মুসা (আঃ) কে সংগে রাখিলেন একটি শর্তে।
তিনি বলিলেন, আপনি আমার সংগে থাকিবেন কিন্তু কোন বিষয়েই আমাকে কিছু জিজ্ঞাসা করিতে পারিবেন না অথবা আমার কোন কাজে সমালােচনা করিতে পারিবেন না, যতক্ষণ না আমি। নিজে উহা ব্যক্ত করি। এই শর্তের উপরে হযরত মুসা (আঃ) হযরত খিজির (আঃ) এর সংগে থাকিবার অনুমতি পাইলেন। একদা দুইজনে পথ চলিতেছেন। সম্মুখে নদী পড়িল। নদী পারাপারের জন্য তাহারা নৌকার সন্ধান করিতে লাগিলেন। কিছুক্ষণ বাদে একটা নতুন নৌকা লইয়া একজন মাঝিকে আসিতে দেখা গেল।
নৌকার মাঝি হযরত খিজির (আঃ) কে চিনিলেন। তিনি সাধকদ্বয়কে নৌকায় করিয়া নদী পার করিলেন কিন্তু হযরত খিজির (আঃ) নৌকা হইতে নামিবার পূর্বে নিখুঁত নৌকার একটি তখতা খুলিয়া ফেলিলেন। ইহা দৃষ্টে হযরত মুসা (আঃ) বলিয়া ফেলিলেন, “মাঝি বিনা পয়সায় আমাদিগকে পার করিল। আর আপনি তাহার নৌকার একটি তথতা খুলিয়া ফেলিলেন, কাজটি ভাল করেন নাই।” হযরত খিজির (আঃ) মুসা (আঃ) কে তাহার। শর্তের কথা স্মরণ করাইয়া দিলেন।
হযরত মুসা (আঃ) অনুতপ্ত হইলেন। তাহারা আবার পথ চলিতে লাগিলেন। পথিমধ্যে দেখিলেন, বেশ কয়েকটি ছেলে-পেলে খেলাধুলা করিতেছে। হযরত খিজির (আঃ)। তনধ্যের একটি ছেলেকে হত্যা করিলেন। ইহা দৃষ্টে হযরত মুসা (আঃ) এর আর সহ্য হইল না। প্রতিবাদের সূরে তিনি বলিলেন, “আপনি বড়ই অবাঞ্চিত কাজ করিলেন। একটি নির্দোষ ছেলেকে মারিয়া ফেলিলেন।
হষরত খিজির (আঃ) এবার একটু রাগতস্বরেই মুসাকে (আঃ) তাহার শর্তের কথা পুনরায় স্মরণ করাইয়া দিলেন। মুসা (আঃ) স্বীয় ভুলের জন্য দুঃখিত হইয়া বলিলেন, আর একবার যদি উক্তরূপ ভুল আমি করি, তাহা হইলে আমাকে আর আপনি সংগে রাখিবেন না; আমারও আর কোন ওজর-আপত্তি থাকিবে না।
এই বলিয়া তাহারা আবার পথ চলিতে শুরু করিলেন। পথ চলিতে চলিতে একটি গ্রামে আসিয়া উপনীত হইলেন। খুবই ক্ষুধার্ত ছিলেন তাহারা। গ্রামবাসীদিগকে খাবারের ব্যবস্থা করিতে অনুরােধ করিলেন কিন্তু গ্রামবাসীরা রাজী হইল না।
সাধকদ্বয় ঐ গ্রাম অতিক্রম করিবার সময় দেখিতে পাইলেন, একটি দেওয়াল ধসিয়া পড়িবার উপক্রম হইয়াছে। হযরত খিজির (আঃ) ঐ দেওয়ালটি হাতে ধরিয়া সােজা করিবার ন্যায় ইশারা করিলেন-আল্লাহর কুদরতে সংগে সংগে দেওয়ালটি সোজা হইয়া গেল। ইহা দেখিয়া হযরত মুসা (আঃ) তাহার শর্তের কথা ভুলিয়া আবার বলিয়া ফেলিলেন, গ্রামবাসীরা আমাদের মেহমানদারী করিল; সুতরাং আপনি ইচ্ছা করিলে এই কার্যের জন্য তাহাদের নিকট হইতে পারিশ্রমিক আদায় করিতে পারিতেন।
তখন হযরত খিজির (আঃ) পরিস্কার বলিয়া বসিলেন-এইবার আপনার ও আমার সংগ ভংগ হইল। এই পর্যন্ত যাহা কিছু ঘটিয়াছে এবং যাহা দেখিয়া আপনি ধৈর্যহারা হইয়া শর্ত ভংগ করিয়াছেন-তাহার প্রত্যেকটি রহস্য বর্ণনা করিতেছি।
শুনুনঃ নৌকাটির একটি তখতা ভাংগিয়া ফেলার কারণ -ঐ দেশের বাদশাহ বড়ই স্বৈরাচারী। নতুন ও ভাল কোন জিনিস দেখিলেই সে ছিনাইয়া লয়। যে নৌকায় আমরা পার হইলাম তাহা ছিল যেমন নিখুঁত, তেমনি সুন্দর। অথচ মাঝি ছিল খুবই অভাবগ্রস্থ। তখতা ভাংগিয়া আমি নৌকাটিকে রক্ষা করিবার ব্যবস্থা করিয়াছি।
তারপর ছেলে হত্যার রহস্য হইল-ছেলেটি অনিবার্যভাবে কাফের হইতে চলিতেছিল, অথচ তাহার পিতামাতা ঈমানদার। আমার আশংকা হইল যে, এই ছেলের মমতার বন্ধন হয়তাে মাতা পিতাকেও কুফরীর মধ্যে জড়িত করিয়া ফেলিবে। তাই মারিয়া ফেলিলাম। অবশ্য আমি প্রার্থনা করিলাম, আল্লাহতায়ালা যেন এই ছেলের পরিবর্তে তাহাদিগকে স্নেহের যােগ্য কোন সুসন্তান দান করেন।
আর দেওয়ালের ঘটনার রহস্য এই যে, দেওয়ালটির মালিক দুইটি এতিম ছেলে। তাহাদের পিতা অতি নেককার ছিলেন। তিনি ঐ শিশু দুইটির জন্য কিছু ধন-দৌলত ঐ দেওয়ালের নীচে পুতিয়া রাখিয়া গিয়াছেন। আল্লাহতায়ালার ইচ্ছা হইল-এই সম্পদের হেফাজত করা, যেন এই এতিমদ্বয় বড় হইয়া তাহাদের ঐ প্রােথিত ধন বাহির করিতে পারে। ইহা সবকিছুই আমি আল্লাহতায়ালার ইংগিতে করিয়াছি; নিজের ইচ্ছামত করি নাই। ইহাই হইল উক্ত ঘটনা সমূহের রহস্য। যাহার জন্য আপনি ধৈর্য ধারণ করিতে পারেন নাই।
হযরত মুসা (আঃ) যদি শর্তানুযায়ী হযরত খিজির (আঃ) এর কাজে সমালােচনা না করিয়! ধৈর্যসহ চুপ থাকিতে পারিতেন; তাহা হইলে হযরত খিজির (আঃ) এর আল্লাহপদত্ত প্রদানেও তিনি আশা হইতে পারিতেন। হয়তো আত্মাহপাক পরবর্তীতে তাহাকে [মুসা (আঃ)] উক্ত জ্ঞান দান করিয়াছিলেন। আল্লাহ পাকই সব ভাল জানেন।
হযরত মুসা (আঃ) যদি হযরত খিজির (আঃ) এর কর্মের ভাল-মন্দ চিন্তা না করিতেন, তাহা হইলে যে উদ্দেশ্যে আল্লাহপাক তাহাকে খিজির (আঃ) এর নিকট প্রেরণ করিয়াছিলেন তাহা হযরত মুসা (আঃ) এর সিদ্ধ হইত। কুরআন ও হাদীসে বর্ণিত “মুসা-খিজির কাহিনী” পীরের প্রতি মুরীদের আদব রক্ষার বা আদব প্রদর্শনের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।