১২ বছর খেদমতের পুরুষ্কার পীরের ছেঁড়া জুতা (শিক্ষনীয় ঘটনা)
পীরের তরফ হইতে কোন বস্ত্র বা অন্য কোন দ্রব্য বা পীরের ব্যবহৃত কোন জিনিস তাবারুক হিসাবে পাইলে ইহাকে মহামূল্য রত্ন মনে করিবে এবং তরিকতের উন্নতির স্বার্থে তাহা ব্যবহার করিবে।
একজন বার বৎসর পীরে কামেলের খেদমত করিলেন। বার (১২) বৎসর পর পীরে কামেল তাহাকে বলিলেন, “বাবা, তুমি বার বৎসর খেদমত করিলে, তোমাকে কি দিব।” তিনি একটা ছেঁড়া চটি জুতা মুরীদের হাতে দিয়া বলিলেন, “বাবা, তুমি এই ছেঁড়া চটি জুতাটা লইয়া যাও।” মুরিদ এই ছেঁড়া চটি জুতাতে খুশী হইল না। সে ইহার মর্তবা উপলব্ধি করিতে পারিল না। চটি জুতাসহ মুরীদ বাড়ীর দিকে রওয়ানা হইল। কিছুদূর যাওয়ার পর পথিমধ্যে তাহার এক পীর ভাইয়ের সাথে দেখা হইল। সেই পীর ভাই ছিলেন এক জমিদার। পীরের অত্যন্ত দেলী মুরীদ ছিলেন তিনি। দরবার শরীফের খাদেমকে দেখিয়া তিনি জিজ্ঞাসা করিলেন, “আপনি কোথা হইতে আসিলেন?” সেই খাদেম ছাহেব বলিলেন, “আমি দরবার শরীফ হইতে আসিলাম। কেবলাজান আমাকে বিদায় দিয়াছেন।” জমিদার ছাহেব বলিলেন, “কতদিন পর আসিলেন?” খাদেম ছাহেব উত্তর দিলেন, “বার বৎসর পর।”
তখন জমিদার ছাহেব জিজ্ঞাসা করিলেন, “বার বৎসর খেদমত করিলেন, হযরত পীর কেবলাজান আপনাকে কি দিলেন?” খাদেম ছাহেব বলিলেন, “আমার কপাল মন্দ, পোড়া কপাল আমার। কেবলাজান হুজুর কি দিবেন আমাকে; একটা ছেঁড়া চটি জুতা দিয়াছেন।” জমিদার ছাহেব বুঝিতে পারিলেন যে খাদেম ছাহেব এই জুতার উপর খুশী হইতে পারেন নাই। তখন জমিদার ছাহেব বলিলেন, “ভাই আমার বাড়ী নিকটেই, অল্প একটু দূরে। আপনি আমার বাড়ীতে যাবেন। আমি আপনাকে জিয়াফত করিলাম।” জমিদার তাহাকে বাড়ীতে লইয়া গেলেন এবং অতীব যত্নের সংগে তিনি নিজেই খাদেম হইয়া তাহাকে খাওয়াইলেন। অতিথিসেবার পরে অতীব মহব্বত এবং যত্নের সংগে বিনীতভাবে জিজ্ঞাসা করিলেন, “ভাই, এই ছেঁড়া চটি জুতা মোবারক দিয়া আপনি কি করিবেন? খাদেম ছাহেব বলিলেন, “এই ছেঁড়া চটি জুতা দিয়া আমি কি করিব। এর মূল্যইবা কত? পীর কেবলাজান দিয়েছেন, তাই ঘরে উঠাইয়া রাখিব।”
তখন জমিদার ছাহেব বিনীত ভাবে বলিলেন, “কোন কাজই যদি জুতা মোবারক দিয়া আপনি না করেন, তবে দয়া করিয়া উহা আমাকে দিয়া দেন।” খাদেম ছাহেব বলিলেন, “লইয়া যান।” জমিদার ছাহেব বলিলেন, “এই জুতা মোবারকের দাম কত দিলে আপনি খুশী হবেন?” খাদেম ছাহেব বলিলেন, “আপনি যা কিছু দেন, রাস্তাখরচ চলিবে।” তিনি একান্ত অনুরোধের সংগে বলিলেন, “ভাই! এই ছেঁড়া চটি জুতা মোবারক আপনার দীর্ঘ বার বছরের খেদমতের ফল। আমি ইহা অল্প দামে নিব না। যদি আপনি আমার কাছে কিছু চান তবে ভাল হয়।” খাদেম ছাহেব বলিলেন, “আপনার যাহা ইচ্ছা হয় তাহাই দেন। কিই-বা আমি চাইব। কতইবা ইহার দাম। যা ইচ্ছা করে দেন, তাতেই হবে। আমি জানি এই জুতা অন্য কেউ নিবে না, এর দামও নাই।”
জমিদার ছাহেব বলিলেন, “জুতা মোবারক যদি ইচ্ছা করিয়া আমাকে দেন-ই তবে আপনি নিজ হাতে উঠাইয়া দেন। আমি নিজ হাতে উঠাইয়া নিব না। কারণ ইহা আপনার বার বছরের পরিশ্রমের ফসল। আপনি দয়া করিয়া আমার হাতে উঠাইয়া দিন।” খাদেম জুতা মোবারক লইয়া জমিদারের হাতে উঠাইয়া দিলেন। জমিদার অতি মহব্বতের সংগে, অতীব আদবের সাথে জুতা মোবারক হাতে লইয়া বহুবার চুম্বন খাওয়ার পর বাড়ীর ভেতর তাহার শয়ন কক্ষে লইয়া গেলেন এবং বিবিকে বলিলেন, “একটা চাদর বিছাইয়া দাও। আমি জুতা মোবারক চাদরের উপর রাখিব। পীর কেবলাজানের জুতা মোবারক। ইহা যেখানে সেখানে রাখা যাবে না।”
চাদর বিছানো হইল। সেই জুতা মোবারক আতর গোলাপ দিয়া চাদরের উপর রাখিয়া দিলেন এবং বিবিকে বলিলেন, “বিবি, সিন্দুক খুলিয়া কিছু টাকা দাও।” বিবি বলিলেন, “কত টাকা দিব?” জমিদার বলিলেন, “হাজারী সত্তরটা তোড়া বাহির কর। কারণ এই জুতা মোবারকের দাম দেওয়ার ক্ষমতা কাহারোও নাই। তামাম পৃথিবী বিক্রয় করিলেও এই জুতার দাম হইবে না।” বিবি সত্তরটা তোড়া বাহির করিয়া তাহার স্বামী জমিদারের হাতে দিলেন। জমিদার সেই টাকা লইয়া খাদেম ছাহেবের কাছে গেলেন এবং বিনীতভাবে বলিলেন, “ভাই, এই জুতা মোবারকের দাম দেওয়ার ক্ষমতা তো কাহারো নাই। আমি মিছকিন হালাতে যা দিতেছি দয়া করিয়া গ্রহণ করেন। এই বলিয়া ৭০ হাজার টাকা খাদেম ছাহেবের হাতে দিলেন।” খাদেম ছাহেব বলিলেন, “এত টাকা কেন আপনি আমাকে দিলেন, এর দাম কি এত হবে?” জমিদার বিনীতভাবে বলিলেন, “আপনি দয়া করিয়া কবুল করেন। তবে এত টাকা লইয়াতো আপনি একা যাইতে পারিবেন না। তাই আমি চারজন সশস্ত্র বরকনদাজ (গার্ড) আপনার সংগে দিতেছি। কারণ পথিমধ্যে দস্যুরা আপনাকে মারিয়া ফেলিতে পারে।” খাদেম ভাবিতে লাগিলেন, কিন্তু রহস্য কিছুই বুঝিতে পারিলেন না। জমিদার ছাহেব কেনইবা এত টাকা তাহাকে দিলেন। কোন বিপদে ফেলিবার অভিসন্ধি আছে কি না কিছুই ভাবিয়া পাইলেন না।
জমিদার ছাহেব চারজন বরকনদাজকে বলিলেন, “যাও আমার পীর ভাইয়ের সংগে। সত্তর হাজার টাকা দিয়া দিলাম। ষাট হাজার টাকা দিয়া জমিদারী ক্রয় করিয়া দিও এবং দশ হাজার টাকা দিয়া বাড়ী করিয়া দিও। তাহাকে লইয়া যাও আদবের সাথে। কোন বেয়াদবী যেন না হয়। প্রয়োজন হইলে আরোও ২/১ হাজার টাকা নিও।”
খাদেম ছাহেব চারজন বরকনদাজসহ টাকা লইয়া চলিয়া গেলেন। বাড়ী যাওয়ার পর ষাট হাজার টাকা দিয়া জমিদারী ক্রয় করিলেন এবং ১০ (দশ) হাজার টাকা দিয়া বাড়ী করিলেন। খাদেম দুনিয়াদারীতে পূর্ণ সুখী হইলেন। অন্য দিকে জমিদার ছাহেব সেই ছেঁড়া চটি জুতা মোবারককে একটা বালিশের ভিতর করিয়া রাত্রিতে শয়নকালে ঐ বালিশ শিয়রে লইয়া শুইয়া থাকিতেন। আর হর’ রাত্রিতে তিনি স্বপ্নে দেখিতেন তাহার পীর কেবলাজানকে। তিনি দেখিতেন, তাহার পীর কেবলাজান আসিয়া তাহাকে তাওয়াজ্জুহ দ্বারা তরিকতের নিয়ম কানুন শিখান। মাত্র কয়েক দিনের ভিতর তাহার পীর কেবলাজান তাহাকে তাওয়াজ্জুহ দ্বারা তরিকতের নিয়ম-পদ্ধতি শিখাইয়া মাঞ্জিলে মাদে পৌঁছাইয়া দিলেন, যেমন বড় পীর হযরত আব্দুল কাদের জিলানী (রঃ) ছাহেব একটা চোরকে তাওয়াজ্জুয়ে এত্তেহাদীর দ্বারা অল্পক্ষণের ভিতরে ওলীর দরজায় পৌঁছাইয়া দিয়াছিলেন।
এরপর জমিদারের বাড়ীতে লোকজন আসা শুরু করিল। জমিদার মুরীদ করিতে লাগিলেন। মুরীদের সংখ্যা দিন দিন বৃদ্ধি পাইতে লাগিল। অল্প দিনের মধ্যেই দরবার বড় হইল যেন সেই পূর্বের পীরের দরবার। কিছুদিন পর খাদেম ভাবিল, “একটা ছেঁড়া চটি জুতার বদলে এতগুলো টাকা যে আমাকে দিয়া দিল, সেই আহাম্মকের অবস্থা কি আমি গিয়া দেখিব।” তাই তিনি গেলেন এবং যাহা দেখিতে পাইলেন তাহাতে আশ্চর্য হইলেন। যেন তাহার পীরের দরবার। দৈনিক হাজার হাজার মানুষ আসিতেছে। হাজার হাজার টাকা নজরানা দিতেছে। মুরীদ হইতেছে। জেকের আজকার করিতেছে। সেই বিশাল কর্মকান্ড যাহা তাহার পীরের দরবারে ছিল। তিনি সত্তর হাজার টাকা দিয়াছিলেন। আর প্রতিদিন লক্ষ লক্ষ টাকা স্রোতের মত আসিতেছে। দেখিয়া খাদেম ছাহেব অবাক হইলেন।
খাদেম ছাহেব জিজ্ঞাসা করিলেন, “ভাই, এই অপূর্ব বাজার আপনি কেমনে মিলাইলেন? যাহা হযরত কেবলাজানের দরবারে দেখিয়াছিলাম তাহা সবই আপনার দরবারে দেখিতেছি। কি ভাবে আপনি ইহা তৈরী করিলেন?” জমিদার বলিলেন, “ভাই, ইহা তো আপনিই দিয়াছেন। আপনি যে ছেঁড়া চটি জুতা দিয়াছিলেন, সেই জুতা মোবারক বালিশের ভিতর ভরিয়া শিয়রে দিয়া শুইয়া থাকিতাম। তখন হযরত পীর কেবলাজান হর রাত্রিতে স্বপ্নযোগে আসিয়া তাওয়াজ্জুহ দ্বারা তরিকতের নিয়ম পদ্ধতি শিখাইতেন। এই ভাবে তাওয়াজ্জুহ দ্বারা আমাকে মাঞ্জিলে মাছুদে পৌঁছাইয়া দিয়াছেন। তারপর থেকেই আল্লাহপাকের এই বিশাল দান।”
উল্লিখিত কাহিনীতে দেখা যায়, একজন মুরীদ ১২ বছর খেদমত অন্তে পীরের নিকট থেকে একটি ছেঁড়া চটি জুতা পাইলেন। মুরীদ সেই ছেঁড়া জুতার মূল্য বুঝিতে না পারিয়া কিছু টাকার বিনিময়ে তাহারই এক জমিদার পীর ভাইয়ের নিকট বিক্রয় করিয়া দিলেন-যাহা ছিল বেয়াদবীর সামিল। জমিদার ছাহেব পীরের সেই জুতাকে অমূল্য সম্পদ মনে করিয়া নিশীথে বালিশে ভরিয়া শিয়রে দিয়া শুইয়া থাকিতেন। পীরের প্রতি জমিদারের এই চরম আদব দেখিয়া আল্লাহপাক তাহাকে মারেফাতের জ্ঞানে ভরপুর করিয়া দিলেন। অন্যদিকে ১২ বছর খেদমতের বিনিময়ে প্রাপ্ত এই ছিন্ন জুতার মূল্য না বুঝিতে পারিয়া খাদেম খোদা প্রাপ্তিতত্ত্বজ্ঞান প্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত হইলেন।
সূত্রঃ খোদাপ্রাপ্তিজ্ঞানের আলোকে- শাহসূফী হযরত খাজাবাবা ফরিদপুরী (কুঃ ছেঃ আঃ) ছাহেবের “নসিহত” ১ম খন্ড (বিষয়ঃ “আদাবুল মুরীদ” এর অংশ বিশেষ)।