সংক্ষিপ্ত ওজিফা (প্রথম পর্ব)

মুখবন্ধ

অস্থায়ী এই পৃথিবীতে মানুষের আগমন একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য। সময় উত্তীর্ণ হইলে তাহাকে এই জগৎ পরিত্যাগ করিতে হয়। যদিও মানবের চিরস্থায়ী আবাসস্থল পরপারে, তবুও মানব জীবনের এই জগৎ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, যেহেতু এই জগতে তাহার কৃতকর্মের উপর নির্ভর করে পরপারের সুখ-দুঃখ।

মানব জীবনের প্রধানতম উদ্দেশ্য তাহার আত্মপরিচয় লাভ করা। অর্থাৎ নিজের সত্তাকে অনুধাবন করা। বস্তুগঠিত পৃথিবীতে চলার জন্য এবং মানবের প্রকৃত সত্তার বাহক স্বরূপ তাহাকে নশ্বর দেহ প্রদান করা হইয়াছে, যাহার মধ্যে অবস্থান করিতেছে তাহার অবিনশ্বর আত্মা। এই আত্মিক সত্তাই মানবের আসল পরিচয়। মানুষ যদি মৃত্যুর পূর্বেই তাহার আত্মিক সত্তাকে অনুধাবন করিতে না পারে, তবে মৃত্যুর পরে তাহা সম্ভব হইবে না, যেহেতু মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গেই আমলের সম্ভাবনাও বন্ধ হইয়া যায়।

তাই রাসূলুল্লাহ (দঃ) বলিয়াছেন, নিজকে জানিতে চেষ্টা কর।” আত্মপরিচয় অনুধাবনের ফলশ্রুতিই খােদাপ্রাপ্তির পথে প্রথম ও শেষ কথা। যে স্রষ্টা মানুষের হৃদয়ে অবস্থান করেন এবং যিনি সর্বাপেক্ষা নিকটতম, সেই স্রষ্টা সম্পর্কে অভিজ্ঞতা অর্জন করিতে হইবে ও তাঁহার সত্তার সহিত স্বীয় আত্মার নিবিড় যােগসূত্র স্থাপন করিতে হইবে, অন্যথা মানুষের সর্বাপেক্ষা নিকটতম সত্তা স্রষ্টার প্রতি অবহেলা করা হইবে।

তাই অন্তর্দৃষ্টি প্রসারিত করিয়া স্রষ্টার দিকে তাকাইতে হইবে এবং মহান প্রতিপালক সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করিতে হইবে। সার্বিক বিশ্লেষণে দেখা যায় স্বীয় সত্তা, সৃষ্টি জগৎ ও স্রষ্টা সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করা এবং স্রষ্টার সহিত আত্মিক যােগসূত্র স্থাপনই মানব জীবনের প্রধানতম উদ্দেশ্য এবং এই উদ্দেশ্য সাধনের মাধ্যমেই কেবল মানব আত্মার মুক্তি সম্ভব।

ধাপঃ ২

এই উদ্দেশ্যসমূহ সফল করিতে যে পথে কঠোর রেয়াযত করিতে হয়, যে পথে পরিভ্রমণ করিতে হয়, ইসলামের পরিভাষায় তাহাই “তরিকত” যার অর্থ চলার পথ।

তাকলিদের উপর নির্ভরতার দ্বারা মানুষ ধর্মবিশ্বাসের উপর স্থায়ী থাকিতে পারিবে, এমন কথা বলা যায় না। তাই ধর্মবিশ্বাসকে অর্থাৎ আল্লাহতায়ালার উপর বিশ্বাসকে একটি স্থায়ী ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত করিতে হইলে সর্বাপেক্ষা প্রয়ােজন স্বীয় আধ্যাত্মিক অভিজ্ঞতার দ্বারা সত্যকে অনুধাবন করিয়া বিশ্বাসকে দৃঢ় করা।

স্রষ্টাকে সরাসরি অনুধাবন করিতে পারাই তাসাউফের মূল প্রতিপাদ্য বিষয়। সুফীতত্ত্ব মতে আল্লাহতায়ালাকে শুধু অন্ধভাবে বিশ্বাস করাই যথেষ্ট নহে, বরং স্বীয় সত্তাকে পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালার অস্তিত্বের সাথে চরম ও পরম অর্থে বিলীন করিয়া প্রত্যক্ষভাবে সম্পৃক্ত হইয়া যাওয়াই তাসাউফের লক্ষ্য। কেবলমাত্র আধ্যাত্মিক উন্নতির জন্যই নহে, প্রাথমিক ঈমানকে বিশ্বাসহীনতা হইতে মুক্ত রাখার জন্যও তাসাউফের শিক্ষা সমধিক গুরুত্বপূর্ণ।

যেহেতু কালব অর্থাৎ মানব হৃদয়ই সকল প্রকার আধ্যাত্মিক জ্ঞানের প্রাথমিক ক্ষেত্র, তাই সর্বাগ্রে প্রয়ােজন মানব বক্ষস্থিত কালব নামক রহস্যময় ক্ষুদ্র অংশটিকে আধ্যাত্মিকতার আলােকে প্রশস্ত করা।

রাসূলুল্লাহ (দঃ) বলিয়াছেন “যখন আল্লাহ কাহাকেও জ্ঞান দান করিতে ইচ্ছা করেন, তখন তিনি তাহার বক্ষকে ইসলামের জন্য প্রসারিত করেন, যখন তাহার বক্ষ প্রসারিত হয়, তখন তাহাতে আলাে প্রবেশ করে, আর যখন আলাে প্রবেশ করে, তখন উহা তাহাকে প্রসারিত করে।” তাসাউফ বা সূফীতত্ত্ব ইসলামের সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ দিক। কেননা তাসাউফই মানুষকে তাহার প্রকৃত অবস্থা সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান প্রদান করে।

ধাপঃ ৩

এই বিদ্যা দ্বারাই সে বুঝিতে পারে, কিভাবে এবং কেন মানুষকে আল্লাহর খলিফা মনােনীত করা হইয়াছে, আর কোন বিশেষ যােগ্যতার বলে মানুষ “আশরাফুল মাখলুকাত” হওয়ার গৌরব অর্জন করিয়াছে। তাসাউফের শিক্ষা ভিন্ন কোনভাবেই ঈমানের প্রকত ভিত্তি স্থাপন হয় না। এই জ্ঞানই মানুষকে স্বীয় বিশ্বাসের প্রকৃতি ও ইহার গভীরতা সম্পর্কে শিক্ষা দান করে।

আধ্যাত্মিকতার আলাে হইতে বঞ্চিত ব্যক্তি কখনাে করুণাময়ের দর্শন লাভ করিতে পারে না। পক্ষান্তরে যে হৃদয় আধ্যাত্মিকতার আলােকে সমুজ্জ্বল, তাহা সকল অজ্ঞানতাকে দূরীভূত করিয়া জ্ঞানের সর্বোচ্চ স্তরের সন্ধান পাইতে পারে।

তাই আধ্যাত্মবােধ হৃদয়ে জাগরিত করাই বিশ্বাসীর প্রধান সাধনা হওয়া প্রয়ােজন, অন্যথা হৃদয়ের প্রশস্ততার অভাবে সে চিরকালই অজ্ঞানতার অন্ধকারে আচ্ছন্ন থাকিবে। কালামুল্লাহ শরীফে প্রকাশঃ

و لا يفقهون بها ولهم أعين لا لم يبصرون بها ولهم أذان يسمعون بها

“হৃদয় থাকিতেও বুঝিবে না- চক্ষু থাকিতেও দেখিবে না, কর্ণ থাকিতেও শুনিবে না।” (সূরা আ’রাফঃ ১৭৯)।

সষ্টিকর্তার সাথে যােগসূত্র স্থাপনের জন্য যে সকল শর্তসমূহ রহিয়াছে, তাহার মধ্যে অন্যতম বিষয় হইতেছে খােদাপ্রাপ্তির পথে একটি মাধ্যম বা ওসিলার প্রয়ােজনীয়তা। তাই আল্লাহ বলেন,

يأيها الذين آمنوا اتقوا الله و ابتوا اليه الوسيلة

“হে বিশ্বাসীগণ! তােমরা আল্লাহকে ভয় কর এবং তাহাকে পাওয়ার পথে ওসিলা অন্বেষণ কর।” (সূরা মায়েদাঃ ৩৫)

ধাপঃ ৪

স্বাভাবিকভাবেই বুঝা যায়, এই ওসিলা বা মাধ্যম এমন একজন বাক্তি যিনি পূর্বেই উক্ত জ্ঞান লাভ করিয়াছেন অর্থাৎ আলাহতায়ালার সাথে প্রত্যক্ষ আত্মিক যােগসূত্র স্থাপনে সমর্থ হইয়াছেন। তাই পবিত্র কুরআনে বলা হইয়াছে।

وممن خلقنا أمة يهدون بالحق

“যাহাদেরকে আমি সৃষ্টি করিয়াছি তাহাদের মধ্যে একদল লােক আছে যাহারা সত্যসহ পথ প্রদর্শন করে।” (সুরা আ’রাফঃ ১৮১)

এই ক্ষেত্রে সত্যসহ পথ প্রদর্শন করা কথাটি বিশেষ আধ্যাত্মিক তাৎপর্যবাহী। এই তাৎপর্য বুঝিতে হইলে সর্বাগ্রে জানা প্রয়ােজন, সত্যের প্রকৃত অর্থ ও রূপ কী? প্রকৃত অর্থে কেবলমাত্র আল্লাহতায়ালাই পরম সত্য।

তাই সত্যসহ পথ প্রদর্শনের অর্থ আল্লাহকে চিনিবার পথ নির্দেশ করা। এই আয়াতটিতে স্পষ্ট উল্লেখ করা হইয়াছে যে, বিশেষ একদল লােক আছেন যাঁহারা সত্য পথ প্রদর্শন করিয়া থাকেন। স্পষ্টতই বােঝা যায় আল্লাহ প্রাপ্তির পথ প্রদর্শনের ওসিলা বা মাধ্যম বিশেষ একদল লােক।

পবিত্র কুরআনে আমরা আরাে দেখিতে পাই যে, হযরত মুসা (আঃ) কে এক বিশেষ জ্ঞান শিক্ষা করিবার জন্য এমন এক ব্যক্তির নিকট যাওয়ার নির্দেশ দেওয়া হইয়াছিল, যিনি বিশেষ জ্ঞানের অধিকারী ছিলেন।

হাদীস শরীফে উল্লেখ আছে, “যখন তুমি কোন ব্যক্তিকে দেখ যিনি আধ্যাত্মিকজ্ঞান তাপস তাঁহার নিকট গমন কর কেননা তাহাকে বিশেষ জ্ঞান প্রদান করা হইয়াছে। তাই স্পষ্টই উপলব্ধি করা যায়, যিনি আধ্যাত্মজ্ঞান সমৃদ্ধ হইয়াছেন, একমাত্র তিনিই পারেন সেই জ্ঞান অন্যকে শিক্ষা দানের উপযুক্ত মাধ্যমরূপে কাজ করিতে।

এই কারণে আধ্যাত্মজ্ঞান শিক্ষা করার জন্য সেই জ্ঞান শিক্ষাদানে উপযুক্ত ব্যক্তির (তাসাউফের পরিভাষায় যাঁহাকে পীর বলা হয়) নিকট গমন করা তরিকতের প্রধানতম প্রয়োজনীয় শর্ত।

ধাপঃ ৫

পূর্বেই উল্লেখ করা হইয়াছে, আধ্যাত্মিক জ্ঞান শিক্ষা করার প্রাথমিক ক্ষেত্র কালব অর্থাৎ মানব হৃদয়। কালব এমন একটি আধ্যাত্মিক সত্তা যা মানুষের সকল প্রকার গুণাবলী নির্ধারণ ও নিয়ন্ত্রণ করিয়া থাকে।

হাদীসে বর্ণিত আছে, “যখন এই কালব পবিত্র থাকে তখন মানুষের সমস্ত অস্তিত্বই পবিত্র থাকে এবং যখন এই কালব অন্যায়ের দিকে ধাবিত হয়, তখন তাহার সমস্ত অস্তিত্বই অন্যায়ের দিকে ধাবিত হইয়া থাকে। কালব একটি স্বচ্ছ আয়নার মত, যাহার মধ্যে সৃষ্টিকতার নিদর্শনসমূহ দেখা যায় এবং তাঁহার নুরের প্রতিফলন হইয়া থাকে।

কিন্তু বিভিন্ন প্রকার অন্যায় ও পাপের দরুন এই কালব ম্লান ও অস্বচ্ছ হইয়া যায়। অস্বচ্ছ কালব আল্লাহতায়ালার নিদর্শনসমূহ এবং তাঁহার নূরকে প্রতিফলিত করার যােগ্যতা হারাইয়া ফেলে। এই অবস্থায় আধ্যাত্মজ্ঞান সমৃদ্ধ সাধকের বিশেষ ইচ্ছার দ্বারা জ্ঞানের আলােক-স্ফুলিঙ্গ সাধকের কাল হইতে জ্ঞানপিপাসু শিষ্যের অস্বচ্ছ কালবে সঞ্চারিত হয় এবং এক অভূতপূর্ব অবস্থার সৃষ্টি করে এবং কালবকে সৃষ্টিকর্তার নিদর্শনসমূহ অনুধাবনের উপযুক্ত করিয়া তােলে।

খােদাপ্রাপ্তির পথে প্রতিটি স্তরে একজন সাধকের মাধ্যম প্রয়ােজন, যিনি এই পথের পথিকদের বিভিন্ন প্রকার জটিল স্তরসমূহ অতিক্রম করিতে সহায়তা করিয়া থাকেন। যদিও হযরত রাসূলুল্লাহ (দঃ)-এর সময় থেকেই তাসাউফের ধারা চলিয়া আসিতেছে, তবুও হযরত আব্দুল কাদের জিলানীর (রঃ) পূর্ব পর্যন্ত তাসাউফের তেমন কোন উল্লেখযােগ্য বা সুসংঘবদ্ধ প্রচার হয় নাই।

তিনিই সর্ব প্রথম সূফী তরিকাকে সুসংঘবদ্ধভাবে সংগঠিত করেন। তাঁহার নামানুসারে উক্ত তরিকা কাদেরিয়া’ নামে পরিচিতি লাভ করে। এর পরবর্তী সূফী তরিকার প্রবর্তক হযরত খাজা মঈনউদ্দীন চিশতী (রঃ)। তাঁহার প্রবর্তিত তরিকা ‘চিশতীয়া’ নামে অভিহিত।

ধাপঃ ৬

এর পরবর্তী তরিকা নকশবন্দীয়া’ হযরত বাহাউদ্দীন নকশবন্দ (রঃ) কর্তৃক প্রবর্তিত হইয়াছে। সপ্তদশ শতাব্দীতে সুফীতত্তের ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন ও বিকাশ ঘটিয়াছে। এই শতাব্দীতে হযরত শায়খ আহমদ ছিরহিন্দী (রাঃ) কর্তৃক পূর্ববর্তী তরিকাগুলির বিশেষতঃ নকশবন্দীয়া তরিকার সংস্কার সাধনের দ্বারা “নকশবন্দীয়া মুজাদ্দেদীয়া” তরিকায় তাসাউফের একটি পরিপূর্ণ আলেখ্য প্রণীত হইয়াছে, যাহা অদ্যাবধি সূফীবাদের তাত্ত্বিক ও ব্যবহারিক দিকের উপর বিশেষ প্রভাব বিস্তার করিয়া আছে।

উল্লেখ করা যাইতে পারে, হযরত শায়খ আহমদ ছিরহিন্দী (রাঃ) সর্বপ্রথম ওহদাতুল ওজুদ মতবাদের খন্ডন করিয়াছেন এবং সুফীতত্ত্বকে উহার নানাবিধ জটিলতা হইতে পরিপূর্ণরূপে মুক্ত করিয়াছেন। প্রচলিত ইসলামী মতাদর্শের সহিত তিনি সূফীতাত্ত্বিক চিন্তার পরিপূর্ণ সমন্বয় বিধান করেন। তিনি মুজাদ্দিদ আলফেছানী (রাঃ) বা দ্বিতীয় সহস্রাব্দের সংস্কারক নামে পরিচিতি লাভ করিয়াছেন।

পূর্ববর্তী তরিকাগুলির সংস্কার সাধনের মাধ্যমে তিনি আল্লাহ প্রাপ্তির পথের সর্বাপেক্ষা সহজ পন্থা বা তরিকার প্রবর্তন করিয়াছেন। হযরত মুজাদ্দিদ আলফেছানী (রাঃ) এর প্রবর্তিত তরিকা আজও সূফীতত্ত্বের বিকাশে এক বিশেষ ভূমিকা পালন করিয়া আসিতেছে।

নকশবন্দিয়া মুজাদ্দেদীয়া তরিকায় আধ্যাত্মিক ক্রমােন্নতির জন্য চারিটি প্রাথমিক শর্ত বিধান করা হইয়াছে। আদব, বুদ্ধি, মহব্বত ও সাহস-এই চারিটি গুণ আধ্যাত্মিকতা শিক্ষা করার যােগ্যতা অর্জনের জন্য একান্তভাবে অপরিহার্য অর্থাৎ যাহার মধ্যে এই চারিটি গুণাবলীর সমন্বয় ঘটিয়াছে, সেই আধ্যাত্মিকতা শিক্ষা করার যােগ্য বলিয়া বিবেচিত হইতে পারে।

নকশবন্দীয়া-মুজাদ্দেদীয়া তরিকায় এর পরবর্তী পর্যায়ে ছয়টি লতিফা বা আধ্যাত্মিক সাধনের ক্ষেত্র উল্লেখ্য। লতিফাগুলি যথাক্রমে কালব, রূহ, সেরখফি, আখফা ও নাফস। আধ্যাত্মিকতার ক্ষেত্রে এই লতিফাসমূহ মানুষের দেহের মধ্যেই সুপ্ত অবস্থায় বিরাজমান।

ধাপঃ ৭

বিভিন্ন প্রকার জিকির ও মুরাকাবা (ধ্যান) -এর মাধ্যমে সাধক এই সকল লতিফাসমহের অস্তিত্ব সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান অর্জন করিতে সক্ষম হয়। মানুষের আধ্যাত্মিক সত্তার প্রথম লতিফা কালব। কালব স্বচ্ছ অস্তিত্ব, যাহার মধ্যে সাধক আল্লাহতায়ালার বিভিন্ন প্রকার নিদর্শন অবলােকন করিয়া থাকেন।

সর্বশেষ লতিফা নাফস মানুষের আপন সত্তা। সাধক যখন নাফসের অস্তিত্ব উপলব্ধি করিতে সমর্থ হন, তখন তিনি আল্লাহর অস্তিত্বই উপলব্ধি করিতে পারেন। হযরত রাসূলুল্লাহ (দঃ) বলিয়াছেন, যে ব্যক্তি নাফসকে চিনিয়াছে, সে আল্লাহকে চিনিয়াছে।

আধ্যাত্মিক ক্রমােন্নতির ক্ষেত্রে নাফসের পরবর্তী আরও চারিটি লতিফা আছে। আধ্যাত্মিকতার সর্বোচ্চ স্তরে পৌছাইতে সাধকের এই চারিটি লতিফা অতিক্রম করিতে হয়। এই চারিটি লতিফা যথাক্রমে আব, আতশ, খাক ও বাদ অর্থাৎ পানি, আগুন, মাটি ও বাতাস -যে গুলাের দ্বারা মানুষের এই বাহ্যিক দেহ সৃষ্টি করা হইয়াছে।

এই লতিফাসমূহের যথার্থ অনুশীলনের দ্বারা সাধক আল্লাহতে বিলীন হইয়া থাকেন অর্থাৎ ফানাফিল্লাহর স্তরে উত্তীর্ণ হন। ফানাফিল্লাহ অর্থ আল্লাহতে বিলুপ্তি। ফানাহ একটি বিশেষ আধ্যাত্মিক অবস্থা, যে অবস্থায় সূফীসাধক আধ্যাত্মিক উন্নতির এক চরম পর্যায়ে আরােহণ করিয়া পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালার অস্তিতের সহিত নিজের সর্বস্ব বিলীন করিয়া দেন।

ফানার পর্যায়ে সাধকের ব্যক্তিগত সত্তা বলিয়া কিছুই থাকে না। যেহেতু তাঁহার সমস্ত অজুদ (অস্তিত)ই তখন আল্লাহতে বিলীন, এই অবস্থায় সাধকের ইচ্ছা আল্লাহতায়ালারই ইচ্ছা এবং তাহার সমগ্র অবস্থা আল্লাহতায়ালার ইচ্ছারই প্রতিফলন মাত্র।

তাই হযরত রাসূলুল্লাহ (দঃ) বলিয়াছেন, “আল্লাহ বলেন, আমার বান্দা নফল এবাদতের দ্বারা আমার নৈকট্য লাভের জন্য অগ্রসর হয়, যতক্ষণ না আমি তাহাকে ভালবাসি। যখন আমি। তাহাকে ভালবাসি, আমি তাহার কর্ণ হই, যা দ্বারা সে শ্রবণ করে এবং তাহার চক্ষু হই, যা দ্বারা সে দর্শন করে এবং তাহার জিহ্বা হই, যা দ্বারা সে কথা বলে।”

ফানার তিনটি পর্যায় রহিয়াছে। প্রথমে আধ্যাত্মজ্ঞান শিক্ষার্থী সূফী সাধক বা পীরের সহিত, দ্বিতীয় পর্যায়ে রাসূলুল্লাহ (দঃ) এর সহিত এবং তৃতীয় পর্যায়ে আল্লাহতায়ালার সহিত ফানা হইয়া থাকেন। তৃতীয় পর্যায়টি ফানার সর্বশেষ মাকাম।

সৃষ্টিকর্তার অস্তিত্বের সহিত সাধকের অস্তিত্বের বিলুপ্তির দুইটি পরস্পর সম্পর্কযুক্ত দিক আছে। ফানার মাকামে আল্লাহর সাথে কোন ধরণের দ্বিত্ব
অবস্থাই সাধক অনুধাবন করেন না। ফানার পরবতী অবস্থাটি তাসাউফের পরিভাষায় বাকা বলা হয়। এই অবস্থাতে সূফীসাধক আল্লাহতে স্থায়িত্ব লাভ করিয়া থাকেন। এই অবস্থাটি আধ্যাত্মিক পর্যায়সমূহের সর্বোচ্চ মাকাম। বাকা’র পর্যায়ে সাধক সকল প্রকার আধ্যাত্মিক জিজ্ঞাসার সঠিক জবাব পাইয়া থাকেন এবং সকল প্রকার আধ্যাত্মিক অনিশ্চয়তা হইতে পরিপূর্ণভাবে নিরাপদ থাকেন।

– মাহফুযুল হক

 

বিশ্ব জাকের মঞ্জিলের “সংক্ষিপ্ত ওজিফা” (পৃষ্ঠা: ৩,৪,৫,৬,৭,৮,৯,১০) হতে

» সংক্ষিপ্ত ওজিফা (দ্বিতীয় পর্ব)

আরো পড়ুন:

→ সংক্ষিপ্ত ওজিফা সবগুলো পর্ব

→ আদাবুল মুরিদের সবগুলা নসিহত একসাথে

→ বিশ্ব জাকের মঞ্জিলের পরিচালনা-পদ্ধতির সব গুলো অধ্যায়

→ বিশ্ব জাকের মঞ্জিলের প্রতি আদব প্রদর্শন

→ মাজার জেয়ারতের তাৎপর্য ও নিয়মাবলীঃ

→ ফাতেহা শরীফ, খতম শরীফ এবং রহমত পালনের নিয়মাবলীঃ

→ অছিলা ধরিবার নিয়মঃ

আরো পড়ুনঃ
Sufibad24.com | WhatsApp চ্যানেল

Sufibad24.com | Telegram Channel