আলিফ দিয়ে টোকা মারো, লাগবে গিয়ে মীমের গায়।
আলিফ দিয়ে টোকা মারো,
লাগবে গিয়ে মীমের গায়।
আয় নবীকে দেখবি যদি আয় রে আয়।।
আজব এক সুরাত দেখিয়া,
আলিফ গেল নিখোঁজ হইয়া।
লামটি তখন যায় ফাটিয়া,
তখন তাহার কী উপায়।।
আলিফ পড়িয়া ফান্দে,
জারেজার হইয়া কান্দে।
পড়িয়া নিরানন্দে,
ধরে গিয়ে মীমের পায়।।
আলিফ যায় রে অসুখ হইয়া,
মীম গেল তার ডাক্তার হইয়া।
শুম্ভ রসের ঔষধ দিয়া,
আলিফ কে বাঁচাইয়া লয়।।
লালন ফকির সবার তরে,
কয় কামেল পীর মূর্শিদ ধরে।
চলে যাও মীম শহরে,
দেখো খোদা কারে কয়।।
– এই পবিত্র কালামটি লালন ফকির এর আধ্যাত্মিক দর্শন এবং সুফি চিন্তাভাবনা থেকে এসেছে। এখানে আলিফ, মীম, লামটি—এগুলি একে অপরের সাথে সম্পর্কিত এবং প্রতীকী অর্থ বহন করে, যা আধ্যাত্মিক শিক্ষা এবং মানব জীবনের অন্তর্দৃষ্টিকে তুলে ধরে।
“আলিফ দিয়ে টোকা মারো, লাগবে গিয়ে মীমের গায়।”
এখানে আলিফ (একটি মৌলিক অক্ষর বা প্রতীক) দিয়ে টোকা মারতে বলা হচ্ছে, যা একটি আধ্যাত্মিক সংকেত হতে পারে। মীমের গায় (গুরু বা আধ্যাত্মিক পথপ্রদর্শক) লাগানোর মাধ্যমে আধ্যাত্মিক জ্ঞান বা সঠিক পথের প্রতি ইঙ্গিত দেয়া হচ্ছে। এখানে ‘আলিফ’ বা আধ্যাত্মিক সত্যের প্রথম পদক্ষেপ এবং ‘মীম’ বা মুর্শিদ (গুরু) দ্বারা পথপ্রদর্শন নির্দেশ করা হয়েছে।
এটি এক ধরনের অভিযান, যেখানে আলিফ থেকে মীমের গায় পৌঁছানো—মানে আত্মিক জ্ঞানের প্রথম ধাপ থেকে শুরু করে পরিপূর্ণ আধ্যাত্মিক শুদ্ধতার দিকে আগানো।
“আয় নবীকে দেখবি যদি আয় রে আয়।”
এটি একটি আহ্বান, যেখানে নবী (আধ্যাত্মিক মহাপুরুষ বা ঈশ্বরের প্রতিনিধি) কে দেখার জন্য আমন্ত্রণ জানানো হচ্ছে। এখানে নবী বা আধ্যাত্মিক পথপ্রদর্শক একজন মানুষের জীবনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন এবং তাকে ঈশ্বরের কাছাকাছি পৌঁছাতে সাহায্য করেন।
“আজব এক সুরাত দেখিয়া, আলিফ গেল নিখোঁজ হইয়া।”
এটি দেখায় যে, আলিফ (আত্মা বা ব্যক্তি) আজব সুরাত (বিভ্রান্তি বা মায়া) দেখার পরে পথ হারিয়ে ফেলে এবং সে নিখোঁজ হয়ে যায়। এটা আধ্যাত্মিক বিভ্রান্তির প্রতীক, যেখানে একজন ব্যক্তি ভুল পথে চলে যায় এবং আত্মিক সত্ত্বা হারিয়ে ফেলে।
“লামটি তখন যায় ফাটিয়া, তখন তাহার কী উপায়।”
এখানে লামটি (পথ বা আধ্যাত্মিক দিশা) ফাটিয়া যায়, অর্থাৎ যে পথ তাকে একসময় সঠিক মনে হয়েছিল, তা এখন বন্ধ বা বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। এমন সময়ের জন্য কোন উপায় খুঁজে পাওয়া কঠিন, যখন ব্যক্তি বিভ্রান্ত হয় এবং তার আধ্যাত্মিক পথ বন্ধ হয়ে যায়।
“আলিফ পড়িয়া ফান্দে, জারেজার হইয়া কান্দে।”
এটি আলিফ (আত্মা) যখন ফাঁদে পড়ে, অর্থাৎ মায়া বা বিভ্রান্তি তে আবদ্ধ হয়ে যায়, তখন সে জারেজার (বিপর্যস্ত, দুঃখিত) হয়ে কান্না করতে থাকে। এটি বুঝিয়ে দেয় যে, আত্মিকভাবে বিচ্ছিন্নতা বা বিভ্রান্তি মানুষের জন্য কষ্টকর হতে পারে।
“পড়িয়া নিরানন্দে, ধরে গিয়ে মীমের পায়।”
এটি দেখায় যে, আলিফ (আত্মা) যখন বিভ্রান্ত হয়ে পড়ে, তখন সে মীমের পায় ধরে, অর্থাৎ আধ্যাত্মিক শিক্ষক বা গুরুর কাছে সাহায্য চায়। এটি বুঝায় যে, যখন আত্মা বিপদে পড়ে, তখন গুরু বা মুর্শিদ তাকে সঠিক পথে পরিচালনা করেন।
“আলিফ যায় রে অসুখ হইয়া, মীম গেল তার ডাক্তার হইয়া।”
এখানে আলিফ (আত্মা) অসুস্থ হয়ে পড়ে এবং মীম (গুরু) তাকে তার ডাক্তার (চিকিৎসক) হিসেবে সেবা দেন। আধ্যাত্মিক দৃষ্টিকোণ থেকে, যখন আত্মা অসুস্থ হয়ে পড়ে (অর্থাৎ, বিভ্রান্ত বা পাপাচারে মগ্ন হয়), তখন গুরু তাকে আত্মিক শুদ্ধতা এবং সত্যের পথে ফিরিয়ে আনেন।
“শুম্ভ রসের ঔষধ দিয়া, আলিফ কে বাঁচাইয়া লয়।”
এখানে শুম্ভ রস হল একটি আধ্যাত্মিক চিকিৎসা যা আলিফ (আত্মা) কে সুস্থ করে। এটি একটি প্রতীক, যা ঈশ্বরের প্রেম বা আধ্যাত্মিক শান্তি প্রতিনিধিত্ব করে, যা মানুষের অন্তরে আসে এবং তাকে তার আত্মিক অসুস্থতা থেকে মুক্ত করে।
“লালন ফকির সবার তরে, কয় কামেল পীর মূর্শিদ ধরে।”
এখানে লালন ফকির বলছেন যে, কামেল পীর (পরিপূর্ণ আধ্যাত্মিক গুরু) বা মূর্শিদ সবার জন্য আছেন। তার উদ্দেশ্য হল, সকল মানুষের জন্য আধ্যাত্মিক পথপ্রদর্শক বা গুরু হাজির, যিনি সঠিক পথ দেখিয়ে ঈশ্বরের কাছে পৌঁছানোর ব্যবস্থা করেন।
“চলে যাও মীম শহরে, দেখো খোদা কারে কয়।”
এটি শেষের দিকে বলা হচ্ছে, মীম (গুরু)কে শহরে পাঠানো হচ্ছে, যেখানে খোদা (ঈশ্বর) কে দেখতে বা উপলব্ধি করতে তাকে নির্দেশ দেওয়া হচ্ছে। অর্থাৎ, মীম (গুরু) ঈশ্বরের প্রতি সঠিক দৃষ্টিভঙ্গি এবং আত্মিক উপলব্ধি প্রদান করেন।
শেষ কথা:
এই কালামটি একটি আধ্যাত্মিক শিক্ষার প্রচার করছে, যেখানে আলিফ (আত্মা) বিভ্রান্ত হয়ে পড়ে এবং তাকে মীম (গুরু) দ্বারা সঠিক পথ দেখানো হয়। এই আধ্যাত্মিক পথ অনুসরণ করে একজন ব্যক্তি তার অন্তর্দৃষ্টি খোলে এবং ঈশ্বরের সঙ্গে একাত্মতা অর্জন করতে পারে। লালন ফকিরের এই পবিত্র কালামের মাধ্যমে একটি শক্তিশালী বার্তা প্রদান করা হয়েছে যে, গুরু বা আধ্যাত্মিক পথপ্রদর্শক ছাড়া আধ্যাত্মিক জীবন সঠিকভাবে চালানো সম্ভব নয়, এবং শুধুমাত্র তাদের শিক্ষার মাধ্যমে মানুষ আধ্যাত্মিক মুক্তি অর্জন করতে পারে।
-ফরহাদ ইবনে রেহান